লেখিকার মুখচ্ছবি

লেখিকার মুখচ্ছবি

শামীমা জামানের ভ্রমণগদ্য ‘গাছেদের শহরে’

প্রকাশিত : ডিসেম্বর ৩১, ২০১৯

মিষ্টি বিষণ্ণ একটা শহর। সে আমার কেউ হয় না। কিছুদিন সেখানে ছিলাম। তবু শহর যেটা পারে, আপন করে নিতে, সামান্য মানুষ হয়ে সাধ্যি কি সে উদাত্ত আহ্বান ফেরাবার। উত্তর আমেরিকার সোনার রাজ্য ক্যালিফোর্নিয়া। তারই রাজধানী এই আধুনিক ঐতিহাসিক শহর স্যাক্রামেন্টো। আমেরিকার ক্যাপিটল সিটিগুলো যেমন হয়, একটু গ্লামার কম, ডিসেন্ট, দরকারি সব অফিস আদালত, সরকারি প্রতিষ্ঠানে ঠাসা জরুরি শহর। স্যাক্রামেন্টোর চেহারাও তাই।

এখান থেকে খুব সহজেই যাওয়া যায় আশপাশের বিনোদন কেন্দ্রিক শহরগুলোতে। হাইওয়ে ফিফটি ধরে ঘণ্টা দু‘য়েকের ড্রাইভিংয়ে পৌঁছানো যাবে সানফ্রান্সিসকো। তারো আগে দেখা মিলবে ছোট্ট শহর ডেভিস, ডক্সিন ও ভ্যালেহোর। অন্যদিকে রোজভিলের পথ হয়ে রিনো দিয়ে প্রবেশ করা যাবে পাশের রাজ্য নেভাডায়।

১৮৪৯ সালে গোল্ড রাশের মধ্য দিয়ে এ অঞ্চলের জনপদ গড়ে ওঠে। অস্ট্রেলিয়া, চীন, ইউরোপ ও ল্যাটিন আমেরিকার ভাগ্য ফেরাতে চাওয়া মানুষগুলো দলে দলে ছুটতে থাকে আমেরিকান রিভারের তীরে, এই শহরে। বণিকরা ভিড় করতে থাকে। গড়ে ওঠে স্বর্ণকেন্দ্রিক নানা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। ওল্ড স্যাক্রামেন্টো আজো সেই নিদর্শনগুলো ধরে রেখেছে তার পুরাতন চেহারায়। আজকাল মানুষ সেদিকে স্রেফ বেড়ানোর উদ্দেশ্যেই যায়। নদীর উপরে আজো ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে ডেল্টা কিং। তারই পাশে জাদরেল ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে সোনালি টাওয়ার ব্রিজ। এ শহরের প্রতীক।

এই নদীতে এখন আর বণিকদের যাতায়াত নেই। কালেভদ্রে দু’একখানা ইয়ট ভেসে গেলে ড্র ব্রিজ তার স্বভাব অনুযায়ী ইয়টগুলোর যাত্রাপথকে সুগম করে দিতে নিজেকে বিভক্ত করে আবার মিশে যায়। ওল্ড স্যাক্রামেন্টো থেকে ডাউন টাউনের দিকে যেতেই সুউচ্চ বিল্ডিংগুলোর স্থাপত্য শৈলী নজর কাড়ে। ডাউন টাউনে অন্যান্য প্রতিষ্ঠান ছাড়াও রয়েছে ক্যালিফোর্নিয়া স্টেট ক্যাপিটল বিল্ডিং, শ্বেত শুভ্র রাজকীয় চেহারা নিয়ে। ভিতরের কক্ষগুলো যথারীতি সম্ভ্রান্ত। বছর দুয়েক আগেও এর করিডরে তৎকালীন গভর্নর হলিউড কিংবদন্তি আর্নল্ড শোয়ারজেনেগার এর পদচারণায় আকর্ষিত ছিল কৌতূহলি জনমন।

স্টেট ক্যাপিটল বিল্ডিংয়ের প্রাঙ্গণে বিচিত্র সব গাছের দেখা মেলে। প্রায় সব প্রজাতির গাছ এখানে রাখা হয়েছে। এমনকি কলাগাছ কিম্বা বাঁশঝাড় পর্যন্ত। এই পার্কের একদিকে রয়েছে ভিয়েতনাম যুদ্ধে নিহত আমেরিকান বীরদের স্মরণে নির্মিত ভাস্কর্য। আরো অনেক ভাস্কর্যের দেখা মেলে ডাউন টাউনেই। অতি পরিছন্ন শহরের বাঁকে বাঁকে কফিপ্রেমীদের জন্য কফি শপের অভাব নেই। স্টার বাক্সের কফির স্বাদ নিতে হলেও বেশি দূর যেতে হবে না, মোটামুটি সব এলাকাতেই ছড়িয়ে আছে এর শাখা।

সানফ্রান্সিসকোর ফ্যাশনেবল হাওয়া এ শহরেও ঝড় তোলে। তাইতো গাছপালা ঘেরা নিঝুম কোনও রাস্তাতেও ট্যাটু হাউস মিলে যাবে। চারদিকে এত্ত এত্ত গাড়ি। ছুটছে। মানুষের দেখা নেই। পাবলিক ট্রান্সপোর্ট নেই বললেই চলে। দু’একটা বাস যে ন্যাটোমাস থেকে ডাউনটাউনের দিকে যায়, দেখি সবই প্রায় খালি। ন্যাটোমাস। খুব চমৎকার নেইবারহুড। অথচ দু‘হাজার সালের আগেও এখানে ধু ধু প্রান্তর। আজ কী নেই এখানে! একটা বাড়ির সামনে ঠিক কি প্রজাতির, ক‘টি গাছ থাকবে, তাও স্থপতির নকশার বাইরে নয়। যেন সৃষ্টিকর্তার নিপুণ হাতে গড়া স্বর্গোদ্যান!

বিগ টমেটো স্যাক্রামেন্টোর অন্যান্য ডাকনামের মধ্যে একটি হলো, সিটি অব ট্রিজ। কেন নয়? আমেরিকার এই কুলেস্ট সিটির শরীরজুড়ে যে কেবলই রং-বেরঙের গাছ। সারি সারি। গোছানো, পরিপাটি। তবে কিঞ্চিত অগোছালো ডিসকভারি পার্কের বুনো সৌন্দর্যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা রোদে পিঠ ঠেকিয়ে নিখোঁজ হওয়া যায়। এখানে ঠিক এই জঙ্গলের চেহারা অনেকটা ‘কোথাও কেউ নেই’ টাইপ। খানিকটা ভুতুড়ে। রোজ সকালে হাঁটতে বেরোলে আমি আসলে ঘোরের মধ্যে থাকতাম। রাস্তায় আমি আর গাছেরা ছাড়া যে তখন কেউ নেই। কেবল কদাচিৎ দু’একজন তাদের নিঃসঙ্গ জীবনের একমাত্র সাথীকে দড়ি বেঁধে পটি করাতে ব্যস্ত। শহরের যারা আমাকে পরম মমতায় আপন করে নিয়েছিল, সেই গাছেদের পাঠশালায় আবার পাঠ নিতে যাব কোনোদিন।

লেখক: কবি ও কথাসাহিত্যিক