শামীমা জামানের স্মৃতিগদ্য ‘আব্বাকে নিয়া রচনা’

প্রকাশিত : জুন ২২, ২০২০

আব্বাকে নিয়া রচনা লিখতে হইলে প্রথমেই তার নাম বলা দরকার। উনার নাম কে. এম. মনিরুজ্জামান হইলেও শৈশবে জানতাম তার নাম হাজী মুহম্মদ মহসীন। ওই নামেই অনেকে তাকে ডাকত। কারণ, চাহিবা মাত্রই উনি মানুষকে টাকা-পয়সা দিয়ে সাহায্য করার জন্য তিন পায়ে খাড়ায়ে থাকতেন। আব্বা একটু বেশি ভালো। মানুষ মাথায় কাঁঠাল ভেঙে খায়, এই রকমের ভালো। তার চেহারা কিঞ্চিত তেঁতুল হুজুরের মতো বইলা কেউ কেউ ১৩ সালের সেই শাহবাগ মঞ্চের উত্তাল সময়ে ফোন করে বলতে থাকে, এই তোমার আব্বারে পত্রিকায় দেখলাম, মেয়েদের নিয়া কীসব বলছে!

ও মোর আল্লাহ! এইটা একটা কথা বললেন! উনি রাজস্ব কর্মকর্তা ছিলেন। রিটায়ার্ডমেন্টের পর পাঁচবেলা নামাজ আর ছয়বেলা বাজার, দৈনিক পত্রিকার হেডলাইন থেকে শেষ পাতায় সম্পাদকের নাম ঠিকানা অব্দি মুখস্ত করা ছাড়া উনি আর কোনও কাজ করেন না। মাঝে মাঝে দুশ্চিন্তা করেন, সংসারে কে কে জাহান্নামের রাস্তার দিকে আগায়া গেছে। স্ত্রী এই বুড়ি বয়সে তড়িঘড়ি করে নামাজ আদায় করে সিরিয়াল দেখার জন্য! আব্বাকে আমরা সারাজীবনে কোনোদিন রাগতে দেখি নাই। তবে ইদানীং কেউ যখন তার সামনে শেখ হাসিনার সরকারের সমালোচনা করে তিনি বেশ উত্তেজিত হয়ে যান। বলেন, তোমরা কি যুদ্ধ দেখছ? এইজন্য এইসব কথা বলো।

৭১ এ আব্বা মুক্তিযুদ্ধ করেন নাই। নতুন চাকরিতে ব্যস্ত ছিলেন। কিন্তু শত ব্যস্ততার মাঝেও নিজের খরচে মুক্তিযোদ্ধাদের তিনটি ক্যাম্পে তিনি নিয়মিত খাবারের যোগান দিতেন। যুদ্ধশেষে কোনো এক সময়ে বঙ্গবন্ধু এসেছিলেন আব্বার কর্মস্থলে। পিঠ চাপড়ে দিয়ে আব্বাকে বলেছিলেন, `কিরে তুই এখানে কেন! আমার কাছে ঢাকা যাস।’ আব্বা কোনোদিন যায় নাই। কেন যায় নাই জিজ্ঞেস  করলে আব্বা বলেন, কোনো কিছু পাওয়ার জন্য কিছু করবা না। মানুষের উপকার হয় এই জন্য করবা।

শৈশবে আব্বার সাথে আমার স্মৃতিগুলি হাতড়ালে বহু রোমাঞ্চকর ঘটনাবলির সন্ধান পাওয়া যায়। আমি চাকরি-বাকরি না করিয়া বেকার লেখক হইতে চাইতাম বলেই আল্লাহপাক আমার আব্বাকে দিয়া এমন বদলির চাকরি করাইয়াছেন। শৈশবের শুরুতে যখন মানুষ ইশকুল যায়, সে সময় আমরা থাকতাম নড়াইলে। আব্বাকে নড়াইলের সব মানুষ এক নামেই চিনতো। সেই নাম অবশ্য তার পিতা মাতার দেয়া নাম নয়। আব্বার নাম ছিল সিও সাহেব। তো সিও সাহেব (আগে এসি ল্যান্ডকে সিও রেভিনিউ বলা হতো) ছিলেন অত্যন্ত ডিসিপ্লিনড একজন মানুষ। তবে এরকম মানুষের ক্ষেত্রে যা হয়, তারা তার সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে নিজের বাড়ির ভিতর ডিসিপ্লিন কায়েম করেন।

আব্বা সেই রকম পাবলিক নন। উনি উনার ডিসিপ্লিন নিজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখিতেন। মাঝে মধ্যে মৃদু স্বরে আমাদের বলিতেন সেইসব নিয়ম কানুন মাইনা চলতে। যেমন রাত ১০টার মধ্যে আব্বার বিছানায় যাওয়া চাই। দুপুরের খাওয়া ঠিক দুপুর ২টাই করিয়া ফেলা চাই। খাবার শুরু করিবা তিতা দিয়ে, শেষ করিবা টক দিয়ে। গোসলে যাইবার পূর্বে এক গ্লাস পানি পান করিতে হয়। রোদ থেকা আইসাই পানি খাইবা না। উচ্ছে প্রতিদিন। শাক প্রতিদিন। আব্বার দাবি, তিনি জীবনে এত তিতা খাইছেন এজন্য তার কোনোদিন পক্স হয় নাই। আব্বার পড়ার নেশা অতি মারাত্মক। তার প্রিয় বিষয়ের একটি ছিল কবিরাজি। নানান ভেষজগুণ বিষয়ক বইপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করিয়া উনি সেইসব নিজের খাদ্যতালিকায় যুক্ত করিতেন।

সেসব নিয়ে মায়ের টীকা টিপ্পনীরও অভাব ছিল না। কিন্তু আব্বার পুরো জীবন দেখে এই শেষ বয়সে কয়েকটা জিনিস আবিষ্কার করে আমি রীতিমতো চমকিত হই। উনি সারাজীবন এমনকি একটি প্যারাসিটামলও খাননি। জীবনে কখনো হাসপাতালমুখো হননি বড় কোনো রোগের কারণে। প্রায় নীরোগ একটি জীবন কাটিয়ে দেয়ার মতো বড় প্রাপ্তি বুঝি আর হয় না। উনার ডিসিপ্লিনড লাইফ স্টাইলের উছিলায়ই এমন হইয়াছে ভাবতে ভালো লাগে। যেসব আদেশ নিষেধ উনি আমাদের করিয়া উল্টো আমাদের আহ্লাদপূর্ণ ঝাড়ি খাইতেন, এই মধ্য বয়সে সেইসব বিধিনিষেধকেই আকড়ে ধরার সাধ জাগে। এরই মধ্যে পুত্রধন তার নানাকে আদর্শ মানিয়া চলা আরম্ভ করিয়াছে। আব্বার সাথে শেষ দেখা বছর দেড়েক আগে। এই যে সামনে সিটিজেন শিপের জটিলতা, ট্রাম্পের হুংকারি বিধিনিষেধ এসব পেরিয়ে আবার কবে আব্বাকে দেখতে পাব, জানি না। শুধু চাওয়া, দেখা যেন হয়।

লেখক: কবি, কথাসাহিত্যিক ও কলামিস্ট