শাহরুখ পিকলুর খুদে গল্প

প্রকাশিত : জুলাই ০৩, ২০১৯

পোড়া মোবিল

আবদুল কাদের সকালে বেরিয়েই লক্ষ্য করল, শহরটায় এক অন্ধকারের কালিমা লেপে আছে। কই তেমন ঘন মেঘ তো নেই, ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়েছিল সকালে। কিন্তু তার জন্য তো এত অন্ধকারের প্রয়োজন পড়ে না। হঠাৎ তার প্রিয় কবি আবুল হাসানের একটা কবিতার ক’টা পঙক্তি মনে এলো:

যেখানেই যাই আমি সেখানেই রাত।
স্টেডিয়ামে খোলা আকাশের নিচে রেস্তোরাঁয়
অসীমা যেখানে তার অত নীল চোখের ভিতর...

আরে, এত ফার্মগেটে সকাল ন’টা। রাত কেন হবে? অসীমা নামের কাউকে সে কখনো চেনেনি, জানেনি, ভেবেছে শুধু। নীল চোখ? তাও বা কোথায়! সে দাঁড়িয়ে আছে বাসের জন্য যেটা তাকে তার নৈমিত্তিক জীবনকে ধরে রাখবে, চাকরি করে সে বনানীর এক আপিসে। শরীর তার সোনামুড়িয়ে না দিলেও ভরপেট ভাত আর কেচকি মাছে পেটটা ভরিয়ে দেয়, সঙ্গে বউ জামিলার, একমাত্র সন্তান পাঁচ বছরের আশার। আশা করতে পয়সা লাগে না।

ব্যাপার কী আজ! সেই তো পান-বিড়ি-চায়ের কদম মিয়া ব্যবসা করে যাচ্ছে, তার মাসের শুরু শেষ বলে কিছু নেই, দিনেরটা দিনেই। আজ কাদেরের প্রায় মাস শেষে বেতন পাওয়ার দিন। আজ ফিরতি পথে সে মেয়েটার জন্য একটা রঙ পেন্সিলের সেট আর দুটো খাতা কিনবে, বউয়ের জন্য কিছু একটা, নিজের ছিঁড়েফাটা পাঞ্জাবিটাতে একটা ‘অদৃশ্য’ রিপু করবে। কিন্তু অফিস তো যেতে হবে আগে!

আবদুল কাদের বরিশালের ব্রজমোহন কলেজ থেকে বিএ-এমএ পাশ করেছে ইতিহাসে, অংকে-ইংরেজিতে বরাবরই কাঁচা। সিভিল সার্ভিস ছিল সোনার হরিণ, রয়েও গেল তা। ঢাকায় এসে এক আপিসে ক্লার্কের চাকরিতেই জীবনের উচ্চাশা শেষ। তাতেও ভাত তো জুটলো, বউও। একটা বাচ্চাও এসে গেল কোত্থেকে যেন। পর্যটক, বৈমানিক ইত্যাদি অফিসের বালাম খাতায় এসে থিতু হলো। বেঁচে থাকতে পারাই জীবনের সব মনে হলো, জীবন যে একটাই। বিশ্বাসের অভ্যাস কখনো মাথায় চাপেনি, কিছু বই আর কবিতা তাতে বাধ সাধলো। চোখ বন্ধ করলে তখনো জীবন তার টেকনিকালার।

সে দশ বছর আগের কথা, এখন জীবন তার ছকে বাঁধা। কলম্বাস বা ভেসপুচি হওয়া তো আগেই শেষ, একবার কক্সবাজারও যাওয়া হয়নি। হ্যাঁ, আমরা কাদেরের সঙ্গে ছিলাম ফার্মগেটের ভিড়ে। বহুকষ্টে পাঁচজনে মিলে একটা সিএনজি ভাড়া করে বনানীর দিকে রওয়ানা হতে দেখলাম তাকে। ভাড়ার টাকায় জামার রিপু আর জামিলার জন্য কোনো কিছু ঝরে পড়েছে ততক্ষণে তবুও রক্ত বেচেও মেয়ের জন্য কিছু সে কিনবে, আমরা সেটা কেন যেন অনুধাবন করলাম। আমাদের সবার ছেলেমেয়ের নামই আসলে আশা। নিরাশা থেকে যায় অন্তরালে।

মহাখালীর কাছে এসেই আক্রমণ। এক গাদা গালাগালিসহ সিএনজিকে উল্টে দেয়া হলো। কাদেরের সঙ্গের বাকি চারজন যারপরনাই ছুটে পালালো। কিন্তু কাদের তখন কবিতা নিয়ে ভাবছিল। মুখ তার পোড়া মোবিলে কারা যেন কালো করে দিলো। তার হাতব্যাগটাও খোয়া গেল, সেখানে কিছু কবিতা আর টাকা ছিল।

টাকার তো কোনো বিকার নেই, কিন্তু কবিতাগুলো সে আর কখনোই ফেরত পাবে না। কবিতা লেখে মানুষ বিশেষ মুহূর্তে, বিশেষ চিন্তায়, তা ফিরে আসে না।

আবদুল কাদের পোড়া মোবিলে, কালো মোবিলে কৃষ্ণকায় হয়ে হেসে দিল। এই না কারণ তবে সকাল থেকে এই কৃষ্ণকায় আকাশ। কৃষ্ণকায় যে তার জীবনটাই।  

সে হাসতে হাসতে হেঁটে চলল। সামনে মহাখলীর রেললাইন। সেখানে ক্ষণে-ক্ষণেই বিধ্বংসী ট্রেন আসে। হা হা হা... ওদিকেই হেঁটে চললো সে।

খিদে

কেন জানি শুধু খেতে ইচ্ছে করে। এটা খাই, সেটা খাই, তবে সব কিছু না। খাসির নেহারি খেতে ইচ্ছা করে না, গরুর তেহারিও না। খাসির চাপ বা মুরগির টিক্কা, নাহ। নান না, পরোটা না, ময়দাছানা পাতলা রুটিও না। খেতে মন চায় শুধু শাদা ভাত। সঙ্গে তার লালশাক, পুঁইশাক, পালংশাক, কলমিশাক সঙ্গে এক গাদা চিংড়ি দিয়ে। বড্ড খিদে আমার, বুভুক্ষের মতন। ইলিশ ভাজা দিয়ে আমডাল, প্লেট উপচে পড়া সেই ছোটবেলার বিলের পাবদা মাছ। ডিমভরা কই, শিং বা মাগুর, চাষের না, প্রকৃতি থেকে পাওয়া।

প্লেট উঁচিয়ে ভাত দিয়ে শাকের তরকারি, পরের অংশে টক দই দিয়ে শিং কি মাগুরের ঝোল। রোগ না থাকুক কিন্তু সুস্থ মানুষেই বা সেই সে পুরোনো দিনের মাগুরের ঝোল আর পায় কই?

আমার বড্ড খিদে পায়। সারাক্ষণ খিদে পায়। হৃদযন্ত্রের উথালপাথাল, শ্বাস নিতে পারা যেন এক পরম বিজয়। তবুও খালি খিদে পায়। মরার আগে মড়ার খিদে। চাই খাশির তেহারি, কাচ্চি বিরিয়ানি, শাদা ভাতের সঙ্গে মুরগির ঝোল বা গরুর কালাভুনা।

আমি শুধু খেতে চাই। খেয়ে খেয়ে মৃত্যুকে দূরে ঠেলে দিতে চাই বা কাছে ডেকে আনি, তবুও খেতে চাই। এই বাংলার মানুষ সারাজীবন শুধু দুটো খেতেই চেয়েছিল, চাকচিক্য নয়, বিদ্যুতের ঝলকানি নয়, কোনো ভগবানের গুণকীর্তন নয়। সেই কপালপোড়া বাঙালির মতো আমিও শুধু খেতে চাই, পেট ফেটে যাওয়া পর্যন্ত শুধু খেতে চাই।