শিক্ষক পদের আবেদন বাবদ আয় ৯০ কোটি টাকা

পর্ব ১৯

প্রকাশিত : মে ১২, ২০২১

কথাসাহিত্যিক মারুফ ইসলাম ‘দহনদিনের লিপি’ শিরোনামে আত্মজীবনীর মতো করে গদ্য লিখছেন ছাড়পত্রে। আজ প্রকাশিত হলো ১৯ পর্ব

৫ মে ২০২১ বুধবার
সফল মানুষদের টু ডু লিস্ট থাকে। প্রতিদিন সকালে উঠে তারা এই তালিকা করেন। সারাদিন কোন কাজগুলো করবেন, কোনটার পর কোনটা করবেন, কোনটা আগে করবেন কোনটা পরে করবেন— এসব সুন্দর করে সাজিয়ে নেন। ইংরেজিতে যাকে বলে প্রায়োরিটি সেট করা।

আমার কোনো টু ডু লিস্ট নেই। সময় আমার ঘাড়ের উপর বসে থেকে দুই কান মলা দিতে দিতে বলে, এখন এই কাজ কর, এখন ওই কাজ কর। এরপর এটা কর, তারপর ওটা কর। আমি এভাবেই কানমলা খেতে খেতে সারাদিন কাজ করে যাই।

আজও সেভাবেই কাটল। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত বাসা-হাসপাতাল-অফিস এই চক্রে কাটল। বিকেলের দিকে ফরহাদের ফোন এলো। তার কিশোরীসূলভ আবদার, আজ বাইরে ইফতার করতে হবে। আমি প্রথম দিকে আমার আপারগতা বোঝানোর চেষ্টা করলাম। সে বুঝতে নারাজ। উল্টো আমাকেই বোঝাতে লাগল, কেন আজকেই বাইরে ইফতার করা জরুরি এবং অতিআবশ্যক। এই অবেলায় তার সঙ্গে পাল্টা যুক্তি-তর্কে যেতে ইচ্ছে করল না। তাছাড়া সে ভীষণ অভিমানী। বালিকাদের মতো অভিমান তার। আজ যদি তার সঙ্গে ইফতার না করি, সে অভিমানে কোন কুকাণ্ড করে বসে কে জানে!

সঞ্জুকে ফোন দিলাম, ফরহাদ কিছু বলেছে তোকে?
হুমম।
কী করবি?
কী আর করার। না আসলে তো গাল ফুলে থাকবে। আসতেছি।
বুঝলাম, সেও ফরহাদের অভিমানজনিত ভয়ে ভীত হয়ে বাইরে ইফতার করতে রাজি হয়েছে।

সুলতানস ডাইনে ইফতার করা হলো আজ। থাক সে গল্প। খানাপিনার গল্প করতে ভালো লাগে না আমার। খাওয়া দাওয়াকে আমার কাছে মনে হয় পৃথিবীর সবচেয়ে ওর্থলেস কাজ।

ওর্থলেস কাজ সেরে বাসায় ফিরছি। রাত খুব বেশি হয়নি। নটা সাড়ে নটা বাজে। তবু এক ধরনের নির্জনতা চেপে বসেছে শহরের গায়ে। আকাশ মেঘলা, ঘন অন্ধকার হয়ে আছে, তারকারাজির দেখা নেই। বাতাসে বৃষ্টির ঘ্রাণ। দূরে কোথাও একঝলক বৃষ্টি হয়ে গেছে মনে হয়। সেখান থেকেই সম্ভবত মৃদু হিমমেশানো বাতাস ধেয়ে আসছে।

এরমধ্যে দেখি লাউতলা নামক জায়গার উল্টোদিকে ঘন জঙ্গলের মতো এক ঢিবির সামনে উবু হয়ে বসে থেকে এক যুবক হাঁপাচ্ছে। দূর থেকে দৃশ্যটা স্পষ্ট বোঝা গেল না। এখানে রাস্তার পাশে কোনো সড়কবাতি নেই। অথবা ছিল, চুরি হয়ে গেছে। এখন জায়গাটা ছায়াছায়া অন্ধকার।

কাছে যাব কি যাব না ভাবছিলাম। সময় আমাকে এই মুহূর্তে কান মলে কোনো নির্দেশ দিচ্ছে না। আমি কানমলা খাওয়ার অপেক্ষায় হতবিহ্বল হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। হঠাৎ দেখি দুজন লোক এগিয়ে যাচ্ছে। সাহস পেয়ে আমিও তাদের সঙ্গ নিলাম।

কাছে গিয়ে যা শুনলাম, তাতে মনটা বিষণ্নতায় ছেয়ে গেল। ছেলেটা যুবকই বটে। ছাব্বিশ সাতাশ বছর বয়স হবে। নাকের নিচে কেটে রক্ত বের হচ্ছে। গালে খামচির দাগ। চোখের নিচে আলুর মতো গোটা উঠে গেছে। শার্টের বোতামগুলো পেট পর্যন্ত ছিড়ে গেছে। পায়ে জুতো স্যান্ডেল কিছু নেই। ধুলোবালিমাখা খালি পা। বুড়ে আঙুলের কোণা উঠে সেখানেও রক্ত ঝরছে। বোঝা যাচ্ছে, ছেলেটা বেদম প্রহারের শিকার হয়েছে।

পলাশ নামের এই যুবক মাস্টার্স পাশ করেছে। মেসে থেকে চাকরির পড়াশোনা করছিল। টিউশনি করে নিজের খরচ চালাচ্ছিল। কিন্তু গত এক বছর ধরে টিউশনিগুলো নেই। সঞ্চয় যা ছিল তা মেস ভাড়া দিতে দিতে আর চাকরির অবেদন করতে করতে ফুরিয়ে গেছে।

আজ সে গিয়েছিল মোহাম্মদপুর তিন রাস্তার মোড়ের ওখানে মোবাইল ছিনতাই করতে। ওখানে সিএনজি, রিকশা, অটোরিকশা, লেগুনার জন্য অনেক লোকের ভিড় হয়। একটা কোনো লেগুনা আসামাত্র লোকজন হুড়োহুড়ি করে তাতে উঠতে চায়। আর সেই সুযোগে কারো একজনের পকেট থেকে মোবাইল কিংবা মানিব্যাগ তুলে নিতে হয়।

পলাশও সেই কাজ করতে গিয়েছিল। কিন্তু অনভিজ্ঞ হলে যা হয়। ধরা পড়ে যায়। তারপর উৎসুক জনতার বেদম প্রহার। কোনোমতো পালিয়ে দৌড় দিয়ে এই লাউতলার অন্ধকারে এসে লুকিয়েছে সে।

এটুকু শোনার পর আমার আর কিছু শুনতে ইচ্ছে করল না। আমার সঙ্গী দুজন ব্যক্তি তখনও বিভিন্ন জেরা করেই যাচ্ছিলেন। এই বেকার যুবকের প্রহারক্লিষ্ট মুখ আমার দেখতে ইচ্ছে করল না। আমি মাথা নিচু করে বাসার পথ ধরলাম। আমার মনে পড়ল, সকালের একটা খবর— ৫৪ হাজার শিক্ষক পদে আবেদন পড়েছে ৯০ লাখ। আবেদন ফি বাবদ এনটিআরসিএর আয় ৯০ কোটি টাকা।