শিমুল বাশারের গদ্য ‘প্রিয়-অপ্রিয়র গভীরতা’

প্রকাশিত : জুলাই ২০, ২০২০

খুব দ্রুত কাউকে ভালোলেগে যাওয়া আমাদের একটা বিরাট জাতিগত সমস্যা। কারণ প্রায় ৯০ ভাগ মানুষই নানা সাইকোলজিক্যাল বায়াসনেসে ভুগে অযোক্তিক সিদ্ধান্ত নিয়ে ফ্যালে। শুধু আপনি আমি নন, জবা, কুসুম, রুনা, মুনা, মিলি, রোকন, দোলনও ট্রুডোকে পছন্দ করেন। ট্রুডোকে তাদের শুধু ভালোই লাগে না, এই ভালোলাগা নিয়ে তারা গর্বিতও। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাদের ভালোলাগার সেই বিষয়টা তারা জানানও দিচ্ছেন নানাভাবে। এভাবেই দেখাদেখি আরেকজনের ভেতরেও একটা মিমেটিক ডিজায়ার তৈরি হয়, হয়ে থাকে। সাথে সাথে সেই ডিজায়ারের অপূর্ণতাজনিত চেইন রিয়েকশন ঘটে যায় গোটা ফেসবুকজুড়ে।

এখন কেন ট্রুডোকে তাদের এতটা ভালো লাগলো? উত্তর সন্ধান করতে গেলে যে সার খুঁজে পাবেন তা অনেকটা এক্সিবিশনে অ্যাবস্ট্রাক্ট পেইনটিং দেখে কেমন লাগলো, এ প্রশ্নের উত্তরে পাওয়া `ভালোলাগলো`র মতো কিংবা আপনি কেন নিউজ প্রেজেন্টার হতে চান? সেই প্রশ্নের সাধারণ উত্তরের মতো। প্রতিদিন গড়ে অন্তত দুজন নারী আমার কাছে প্রেজেন্টার হবার আগ্রহের কথা জানান। তাদেরকে ‘কেন প্রেজেন্টার হতে চান?’ এ প্রশ্ন করে একজনের কাছ থেকেও স্মার্ট এন্সার পাওয়া যায় না। বেশিরভাগই উত্তর দেন `ভালো লাগে`। কেন ভালোলাগে? সেটারও পরিষ্কার এন্সার তাদের কাছে থাকে না। কেউ যখন বলে কবিতা ভালো লাগে তখন যদি প্রশ্ন করি প্রিয় কবি কে? আমতা আমতা করেন... কদাচিৎ দুয়েকজন প্রিয় কবির নিশ্চিত নামটি বলতে পারলেও সেই প্রিয় কবির পাঁচটা কবিতার নাম তারা বলতে পারেন না। বোঝেন তাদের প্রিয়-অপ্রিয়র গভীরতা!

আমিতো খুব রুড মানুষ। এরপরও যারা নক দিতে থাকেন তাদেরকে পরিষ্কার জানায়ে দেই, যদি নিজেরে খুব সুন্দরী মনে করেন বলে প্রেজেন্টার হতে চান, তাহলে আপনাকে বলবো বাটপারের পাল্লায় পড়তে যে রাস্তায় হাঁটতে হয় আপনি ঠিক সেই রাস্তাতেই হাঁটছেন। আসি আসল কথায়। জাস্টিন ট্রুডো ক্ষমতাবান, হ্যান্ডসাম, কাজকর্মেও অভিনবত্ব আছে তার। সোশ্যাল মিডিয়াকে নানাভাবে ম্যানিপুলেইশন করতেও ওস্তাদ। প্রয়াত জেনারেল এরশাদ এক ইন্টারভিউতে তার নিজের নারী কেলেঙ্কারী বিষয়ে বলেছিলেন, নারীরা তাকে স্বেচ্ছায় ভালোবাসতো কারণ তিনি ছিলেন দেশের প্রেসিডেন্ট, সেনা প্রধান এবং ইয়াং।

নারী পুরুষের ক্ষমতা বৈষম্যের এ সমাজে সহজাতভাবেই সবাই ক্ষমতাবানের প্রতি কিছুটা দুর্বল হয়। জাস্টিন ট্রুডোর ক্ষেত্রে অধিকাংশ কেসই এমন। এর বাইরে যারা আছেন তারা হয়তো অজ্ঞাতসারেই ভেতরে ভেতরে কিছুটা রেসিজমে আক্রান্ত। কানাডার লিবারেল পার্টি ও তাদের রাজনীতি বোঝেন এদেশে এমন মানুষই কম। নিজের দেশেরই রাজনীতির খবর রাখেন না আর কানাডা! এদেশের সেই ক্রাশ খাওয়া নারীদের বেশিরভাগই জাস্টিন ট্রুডোর চলমান `উই কেলেঙ্কারী`র খবর বিশেষ রাখবেন আশা করি না! হিউম্যান সাইকোলজি অনুসারে তর্ক-বিতর্কের সময় সবার মধ্যেই একটা প্রবণতা থাকে, যে করেই হোক নিজের অবস্থানকে সঠিক প্রমাণ করার জন্য উপযুক্ত যুক্তি দেয়া এবং সে যুক্তির পক্ষে তথ্য-প্রমাণ উপস্থাপন করা। আর এটা করতে গিয়ে তারা কেউই শতভাগ নিরপেক্ষ থাকতে পারে না; অতি সামান্য মাত্রায় হলেও অসততার বা প্রতারণার আশ্রয় নেয় তারা।

যেহেতু তারা ক্রাশ খেয়ে গেছেন সুতরাং ট্রুডোরও যে হাজারটা ত্রুটি থাকতে পারে তা তাদের চোখ এড়িয়ে যাবে। এটাকে সাইকোলজির ভাষায় বলে কনফার্মেশন বায়াস। নিজের বিশ্বাসকে নিজের কাছেই ‘ভালো’ এবং ‘সঠিক’ বলে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা তারা করতেই থাকবেন। আর এটা করতে গিয়ে নিজের বিচার-বুদ্ধির সাথেই তারা ছলনা করতে থাকবেন। এই যে একটা ত্রুটিপূর্ণ প্রবণতা, এটা মানুষের সুষ্ঠু চিন্তাধারার ক্ষেত্রে খুব বড় একটা অন্তরায় এবং দীর্ঘমেয়াদে কোনো মানুষের নিরপেক্ষ মত প্রদানের বা সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতাকে বাধাগ্রস্থ করে। সংক্ষেপে, আপনি যা দেখতে চান বা আপনার মন যা দেখলে আরাম পাবে, আপনি তা-ই দেখতে পাবেন। যা দেখলে আপনার মন অস্বস্তিতে ভুগবে, সেটা আপনি এড়িয়ে যেতে চাইবেন বা দেখেও না দেখান ভান করবেন। একারণেই জাস্টিন ট্রুডোর উই কেলেঙ্কারি নিয়ে এদেশে তেমন আলোচনা নেই। ট্রুডো যে কোভিডের সময় শিক্ষার্থীদের জন্য তার রাষ্ট্রের বরাদ্দকৃত টাকা বিতরণের জন্য ডিসাইসিভ ফ্যাক্টর হয়েছিলেন এবং যে সংস্থা ওই কাজটি পেয়েছিলেন সেই সংস্থাটির সাথে ট্রুডোর মা, ভাই নানা উপায়ে সম্পর্কিত আছেন। এমনকি তারা ওই সংস্থা থেকে আড়াইলাখ ডলার নিয়েছেন বলে কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেষ্ট থাকায় ট্রুডোকে এখন এথিকস কমিশনের সামনে দাঁড়াতে হচ্ছে।

এজন্যই বলি, হুট করে কাউকে ভালোবেসে ফেলবেন না। যতই ক্ষমতাবান বা দেখতে সুন্দর হোক না কেন। প্রথমেই ধরে নেন লোকটাকে যেহেতু ভালো লাগছে সেহেতু নিশ্চয়ই কোথাও ঝামেলা আছে। ভাবুন, সময় নিন। তার সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে এটলিস্ট চেষ্টাটা করুন। নিজের নিরপেক্ষ বিচার বুদ্ধি কাজে লাগান তারপর সিদ্ধান্ত জানায়েন। মনে রাখবেন, আপনার সিদ্ধান্ত আপনার বন্ধুর মাঝে মিমেটিক ডিজায়ার তৈরি করে। এসব বিবেচনায় এলিট ফোর্সের হাতে ধরা খাওয়া মি. সাহেদকে যারা এফবিতে সার্টিফাই করেছিলেন তাদেরকে অপরাধী এবং কু-বুদ্ধিজীবী বলা যেতে পারে।

লেখক: গণমাধ্যমকর্মী