শিমুল বাশারের গল্প ‘চলে যাবার সময় হয়েছে’

প্রকাশিত : এপ্রিল ০৭, ২০২১

পাশের ফ্ল্যাটের কার্নিশের ছায়ায় বসে থাকা একলা পায়রাটাকে আর দেখা যায় না। জানালার গ্লাস সরিয়ে খুঁজি এদিক সেদিক। কোথাও চলে গেছে হয়তো। পায়রাটার কথা ভেবে আজ এই মধ্যরাতে খুব কান্না পাচ্ছে আমার। বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে ওই পায়রাটাকে আমি রোজ দেখতাম। কার্নিশে চুপটি মেরে বিছানায় আমার নড়াচড়ার দিকে কেমন সিসি ক্যামেরার মতো নজর রাখতো। মাঝেমাঝে ওই পায়রাটার দৃষ্টি বুকের ভেতর কেমন আতঙ্ক তৈরি করতো! মনে হতো, আমার একাকিত্বের বিচিত্রসব কর্মকাণ্ডের নোট টুকে রাখছে কেউ।

বিছানায় শুয়ে শুয়ে পায়রাটার নীলচে ধুসর চোখের দিকে আমিও তাকিয়ে থাকতাম। জীবনের সাধ না মেটার টুকরো টুকরো গ্লানি, বঞ্চনা আর ক্লান্তির গল্পগুলো সব বলতাম। বন্ধূ, আমারও বুঝি চলে যাবার সময় হয়েছে, পৃথিবীতে কত বৃষ্টি দেখলাম, তুমিও দেখেছিলা। কত বেদনার ভরা দুপুর বিষণ্ণ হয়ে মিলিয়ে যেতে দেখলাম, কত নতুন পাতা, কত ঝিলমিল রোদ্দুর, কত ফুল আমাদের বারান্দার বাগানে বাগানে ঝরে গেল, আহা!

কয়েকদিন ধরে ডান হাতের আঙুলের মাথায় টনটনে ব্যথা বোধ হচ্ছে। কেউ যেন পাটা পুতায় মশলা ছেঁচার মতো ছেঁচে দিয়েছে। যৌবনের এক ব্যথাতুর স্বপ্নের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে আমার। যে স্বপ্নটায় আমি চেতনালুপ্ত হবার অনুভূতি কেমন হয়, তা টের পেয়েছিলাম। কী ভয়ঙ্কর স্বপ্ন!

টেবিলে আমার জন্য পরিবেশিত পানিভাঙা পচা ডিম পোছ, প্লাস্টিকের পানির জগ রাখা। দোকানদারকে জিজ্ঞেস করলাম, পচা ডিম দিলেন কেন? দোকানদার উত্তর দিলো, আমি কি ডিমের ভেতরে ঢুইকা দেখছিলাম?

এ উত্তরেই আমি মেজাজ হারালাম। মুহূর্তেই প্লাস্টিকের জগটা পানিসহ তুলে মেরে দিলাম দোকানদারের গায়ে। আমি সাধারণত এমন শর্ট টেম্পারড আচরণ কম করি। ওই অতিতুচ্ছ ঘটনায় রাগে আমার গা কাঁপতে শুরু করলো। আমি হাঁটা ধরলাম। চারপাশ কেমন যেন অচেনা লাগছে! স্বপ্নের ভেতরই বুঝতে পারছিলাম, আমার চেতনা লুপ্ত হচ্ছে, স্মৃতি হারিয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। কী যে ভীষণ কষ্ট লাগতে থাকলো! বুঝতে পারছিলাম, মানসিক ভারসাম্য হারাচ্ছি আমি। দ্রুত হোস্টেলে যেতে হবে কিন্তু পুকুরের পুব পাশে হোস্টেল ভবনটাকে আর দেখা যাচ্ছে না।  বরং সেখানে অচেনা নতুন একটা ঘর, টিনের চালা চকচক করছে রোদে।

আমি হাঁটতে থাকলাম পোড়া ইট বিছানো পথে। দু’পাশে অজস্র ভাটফুল ফুটে আছে, লতা ঘাসগুলো সাপের মতো পেঁচিয়ে আছে একটা আরেকটার সাথে। লতা গুল্মের মাথায় মাথায় শ্বেতশুভ্র ফুল, শ্যেন চোখের মতো আমার দিকে তাকানো। কথা বলতে ভুলে গেছি, বাক্য গঠন সম্ভব হচ্ছে না। একসময় খেয়াল করলাম, গলা দিয়ে অর্থবোধক শব্দও করতে পারছি না। দিশেহারা লাগতে থাকলো। অবশেষে নিজের এই নিয়তি মেনে নিয়ে অগত্যা পা যেদিকে যায় সেদিকেই এগিয়ে যেতে থাকলাম। হাঁটতে হাঁটতে একটা অচেনা গ্রামে পৌঁছুলাম আমি। সেখানে শিশুরা মাঠে মাঠে কলরব করে খেলছে। আমি দাঁড়িয়ে তাদের খেলা দেখছি।

হঠাৎ একটা বাচ্চা আমাকে দেখে খেলা রেখে কাছে এগিয়ে এলো। খুব আপন ঢংয়ে হাতের আঙুল ধরে টানতে থাকলো। টানতে টানতে একটা কাঠের পাটাতন করা ঘরের কাছে নিয়ে গেল আমাকে। ঘরটাতে কাঠের সিঁড়ি। বাচ্চাটা একটা একটা ধাপ পেরিয়ে ঘরে ঢুকে গেল ঠিকই কিন্তু সিঁড়ির ধাপগুলো কিছুতেই আমি অতিক্রম করতে আর পারছি না... ভুলে গেছি। এরপর অনেক কষ্টে সিঁড়ির হাতল বেয়ে গাছে চড়ার মতো ক্রলিং করে ঘরে ভেতরে যেতে সমর্থ হলাম। দেখলাম, ঘরটার কোনো মেঝে নেই। মেঝেতে ছড়ানো রাশি রাশি বর্গাকৃতির গভীর গহ্বর হা করে আছে। বর্গের বাহুগুলো সুতার মতো শুধু দেখতে পাচ্ছি। সেই বাহু বরাবর সন্তর্পণে পা ফেলে ঘরের এককোনে রাখা ওয়ার্ড্রোব ধরে দাঁড়ালাম।

ওয়ার্ড্রোবের ওপর একটা ম্যাগাজিন রাখা। সাদা কালো প্রচ্ছদ। সেই প্রচ্ছদে একটা শশ্রুমন্ডিত নগ্ন লোকের ফটোগ্রাফ। বুক পর্যন্ত একটা চাদর টেনে লাজুক চোখে তাকিয়ে আছে। প্রচ্ছদ ফটোর লোকটাকে চেনা চেনা লাগছিলো আমার। একসময় চিনতেও পারলাম। লোকটা জার্মান দার্শনিক ও অর্থনীতিবিদ কার্ল মার্ক্স। হঠাৎ মনে হলো, কে যেন আমার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। আমি ঘুরে তাকালাম। মাঝবয়সী এক রমণী আমার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে মৃদু মৃদু হাসছে। খুব চেনা মনে হলো তাকে, কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারছি না। কে এই রমণী? তবে মন বলছে সে আমার খুব চেনা কেউ। কিন্তু কে সে? তা আর জিজ্ঞেস করতে পারছি না। কারণ আমি কথা বলতে ভুলে গেছি। বুক ফেটে যাচ্ছে আমার।

হঠাৎ মনে হলো, আমি হয়তো লিখতে পারবো। এরপর ওয়ার্ড্রোবের ওপর থেকে একটা কলম নিয়ে ওই ম্যাগাজিনের গায়ে লিখলাম, আপনি আমার কে হন?
ওই রমণী মুচকি হেসে আমার হাত থেকে কলমটা নিয়ে উত্তরে লিখলো, বউ।

বন্ধু, কয়েকদিন ধরেই ২০ বছর আগের দেখা ওই স্বপ্নটা আমাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। আমার অনেক স্বপ্নই বাস্তব হয়নি। কোথায় যেন একটা গাঢ় অপূর্ণতা রয়েই গেল। বারবার খুব তীব্রভাবেই মনে হচ্ছে, আমি হয়তো এ জীবনে আর বেশিদিন থাকবো না, চলে যাবার সময় হয়েছে। সবার কাছ থেকে ক্ষমা চেয়ে নিতে পবিত্র এই রাত্রির কাছে আজ নতজানু হয়েছি আমি। আমার মাকে খুব মনে পড়ছে আজ, বাবাকেও। চড়াইগুলো খুব ডাকছে, ধীরে ভোরের আলো ফুটছে পৃথিবীতে। কার্নিশের পায়রাটা নেই।

লেখক: কথাসাহিত্যিক ও গণমাধ্যমকর্মী