শিমুল বাশারের গল্প ‘সার্ত্রের প্রেমিকারা’

প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ০৮, ২০২০

মাঝরাত।
অফিস থেকে বের হয়েছি। বাসার দূরত্ব খুব একটা বেশি না।
ড্রাইভারদের তাই খামোখা আর বিরক্ত করি না।
তাছাড়া কানে এয়ার ফোন লাগিয়ে গান শুনতে শুনতে রাতের নির্জনে পথ হাঁটতে আমার ভালোই লাগে। নিজেকে কিছুটা নিবিড় করে পাওয়া যায়।
ভয়, উৎকণ্ঠা, সামাজিক নিরাপত্তাহীনতার সঙ্কট নিয়ে জার্মান হেগেল থেকে কার্ল জেসপার্স এবং হাইডেগার ঘুরে রূপতত্ত্বের হুলার্স এরপর ফ্রেঞ্চ এক্সিটেনশিয়ালিস্ট জাঁ পল সার্ত্রের দরবার আলো করতে ভালো লাগে আমার।

অন্ধকারে অবসাদ ঘিরে এলে কখনো কখনো গতি আনতে রিকশা নিয়ে নেই। যদিও বাসায় ফেরার তাড়া নেই, তবু সেদিন অফিস থেকে বের হয়ে দেখলাম, কাছেই অন্ধকারে একটা রিকশা থেমে আছে।
দূর থেকেই ডাক দিলাম।
জবাব না পেয়ে কিছুটা কাছে এগিয়ে গেলাম। রিকশাঅলা রিকশার পাটাতনে বসে আছে। বললাম, যাবেন?

সে রিকশা থেকে নেমে সম্মতিসূচক হাসি দিয়ে হ্যান্ডেল ধরলো। আমি চমকে গেলাম।
এত সেই লোকটা! যাকে আমি প্রায়ই অফিসের সামনে দেখতাম। খুব সিরিয়াস ভঙ্গিতে বারবার রাস্তা ক্রস করতো।
যানবাহন নেই, তবু তার চোখমুখে সতর্কতার স্পষ্ট ছাপ দেখা যেত।
কখনো কখনো খুব রেগে কল্পিত কোনও প্রতিপক্ষের সাথে বাকবিতণ্ডায় জড়িয়ে যেত। কখনও আবার মিটমিট করে হাসত।
রাস্তায় ফেলে দেয়া বিড়ি-সিগারেটের শেষাংশ কুড়িয়ে নিয়ে আয়েসে টান দিত। সমস্যা হলো, সে তো রাজি হয়ে গেছে আমাকে নিতে। আমি এখন না করি কী করে?

নিজেই ডেকেছি, না বলাটা এখন কেমন না? আমি সাহস করে ওঠে পড়লাম রিকশায়। হাত ছেড়ে দেয়া শেষ প্রেমিকাটার কথা মনে পড়ল।
আমাকে প্রায়ই সে বলতো, পাগলদের ওস্তাদ। সুতরাং আমার তো পাগলে ভয় পেলে চলে না। তাছাড়া কোনো ট্রু পাগল এ জীবনে আমার সাথে খারাপ আচরণ করেনি। যদিও অল্প অল্প ভয় কাজ করছে, তবু আমি খুব শান্ত কণ্ঠে চালককে জিজ্ঞেস করলাম, কেমন আছ?

ঘাড় নেড়ে সে জবাব দিল, ভালো আসি।
এরপর আমি কথা চালিয়ে গেলাম। জিজ্ঞেস করলাম, বছরে খারাপ থাকো কতদিন?
সে বলে, গরমের সময়।

এরপর কানে হেডফোন লাগিয়ে গান শুনতে শুনতে সুস্থ আর অসুস্থ পাগলদের পার্থক্য নিয়ে ভাবছিলাম।
এ জীবনে আমি যত মানুষের সত্যি ভালোবাসা পেয়েছি, তারা হয় পাগল কিংবা ভালোবাসতে বাসতে পাগল। এ কেমন নিয়তি আমার শুধু পাগলরাই জোটে আমার কপালে!

হঠাৎ রিকশা থামিয়ে দেয়ায় গানের সুর আর চিন্তার জাল ছিঁড়ে বেরিয়ে এলাম। দেখলাম, বাসার গেইটে!
আমি অবাক! জিগেশ করলাম, তুমি আমার বাসা চেনো?
সে আবার একটা হাসি দিল।

মানিব্যাগ বের করতে করতে আ বললাম, ভাড়া বিশ টাকা, কিন্তু তুমি আমার বাসা চিনতে পারায় তোমার জন্য ত্রিশ টাকা।
একথা বলে ওর দিকে তাকালাম।
সে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে।
মানিব্যাগ থেকে টাকা বের করতেই একশো টাকা ওঠে এলো।
সে ওই নোটটার দিকে তাকিয়ে আছে দেখে আমি ওর হাতে টাকাটা দিয়ে দিলাম।
সে বলল, এটা কি বখশিস? আমি বললাম, হুম কারণ তুমি আজ আমার বাসাটা চিনেছো।

আর আমি প্রতিদিনই বাসাটা চিনে ফিরে আসি।