শিমুল সালাহ্উদ্দিনের ১০ কবিতা

প্রকাশিত : মে ১৭, ২০২০

করোনামারির চাঁদ

ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে মরণের ফাঁদ
তবুও এখানে ওঠে এমন মায়ার চাঁদ!
এই চন্দ্রমায় ছাদের কার্ণিশে
একা বালিকাটি আরো, একলা দাঁড়িয়েছে

এই চাঁদের তলায় হাহাকার বুকে
ছেলেটি নিচ্ছে কোন আলো টুকে
ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে মরণের ফাঁদ
তবুও এখানে ওঠে এমন মায়ার চাঁদ!

আলোগুলি ম্রিয়মান আজ ঘরে ঘরে
ছুঁতে না পারাগুলো বিস্বাদ স্বরে
জমা হয় জমে যায় বুকের ভেতর
মগজে ঘোর জমে আরো ঘনঘোর

ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে মরণের ফাঁদ
তবুও এখানে ওঠে এমন মায়ার চাঁদ!

তাকিয়ে থাকাগুলি চন্দ্রিমা পানে
উঠে আসে আমাদের রাত্রির গানে
গান সেতো একই গান কবে এই নভে
রাত শেষ হবে আর আলো কথা কবে
ছড়াবে ছিটাবে আলো ভেঙে সব ফাঁদ
ছেলেটির বুকে নামে একজোড়া চাঁদ!

মেয়েটির চোখমুখ সেই চাঁদ হয়
পৃথিবীর সব ছেলে পায় বরাভয়
ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে মরণের ফাঁদ
তবুও এখানে ওঠে এমন মায়ার চাঁদ

জীবনপুর মেইল


জীবনপুর মেইল নামের একটা বিষণ্ন ট্রেনে আমাদের দেখা হয়েছিল। তোমার মুখে এসে পড়েছিল পড়ন্ত বিকেলের আলো।

কথা আমিই শুরু করেছিলাম। ধরো, তুমি পরের স্টেশনে যাবে। আমি আগের স্টেশনে নামবো। দেখা হবে না আর কোনো দিনই।

আমি তোমাকে বললাম, নেমে পড়ো আমার সাথে। একটা দিন একসাথে কাটাই। হয়তো জীবন অন্যরকম হতে পারে!

তুমি যদি হ্যাঁ বলো, দিনটা হবে কবিতার মতো আলাদা, রোমাঞ্চকর। যদি না বলো, তুমি একা একা পরের স্টেশনে নামবে। আমি আগেরটায়।

এবং দুজন দুজনের প্রতিদিনের মতো ম্যাড়ম্যাড়ে জীবন টেনে নিয়ে যেতে থাকবো, কবরের দিকে।

চোখে চিকচিকে আলো নিয়ে তুমি আমার দিকে তাকিয়ে থাকলে...

ধারাবাহিক আত্মহত্যা

একুশতম বার একই নাম্বারে ফোন করার আগে
নিজেই নিজেকে গলাটিপে হত্যা করে নিলাম

এখন আরো ফোন করা সহজতর হবে
আরো সহজ হবে এসএমএস করা

তাও কী সে জানবে না, আমি তাকে মিস করি
যেমন মৃত আত্মাকে মিস করতে থাকে একটা লাশ!

চরিত্রহীনের চোখ

সেই তার প্রথম প্রেম, মুগ্ধ চোখে চোখ রেখে বলেছিলে— তোমার চোখ দুটি জানো, আমার মনে হয় সৈকতে মুখোমুখি দুই অচেনা বন্দর, যেখানে জাহাজেরা ভিড়বে এসে আর অপেক্ষাতুরা আমি মাস্তুল জড়িয়ে ধরে সাগরের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে মরে যাব

আরেক স্নিগ্ধা বলেছিলে কাঁধে চিবুক ঠেকিয়ে— তোমার চোখদুটি আমার প্রেম, কিসের বেদনাতে তাদের এতে কাঁদাও বলো তো

সহপাঠিনী জীববিজ্ঞান ল্যাবের দিকে যেতে যেতে বলেছিলে— তোর চোখের ছুরিতে ডিসেকটেড হতে পারলে আমি বীজ থেকে বের হওয়া তিন দিনের চারাগাছ হয়ে যেতাম রে

কেউ প্রশ্ন করেছিলে— তোমার ঘামের মতোই নোনতা চোখের জল, ভালোবাসলেই বৃষ্টি হতে থাকে কেনে বলো তো! কত জন্মের না পাওয়ার সাক্ষী এই মারণাস্ত্র দুটো?

একজন সরাসরি তাকিয়ে বলেছিলে চোখে— অদ্ভুত ঘোর আছে তোমার চোখে, মায়াপুরী কোথাও নেই বলে আমাকে এলসহোয়্যারপুরীতে নিয়ে যায়

আমার প্রথম বস, চাকরির তখন মাসখানেক, এক সন্ধ্যায় বললেন— কী চোখরে তোর, তাকায়া তো যে কারো পায়ের পাতার রেখা দেইখা ফালাস, তাকাবি না আমার দিকে

একজন এসে লাভিং স্ট্রেন্জার মুডে বললো— তোমার চোখে তাকিয়েই বুঝতে পারি কতটা বিক্ষত হৃদয় তোমার, নিজেকে এতে ফালা ফালা হতে দিলে কেনে বোকা! এতেবার ধ্বংস হতে দিতে হয় নিজেকে!

ভালোবেসে ন্যাংটো হতে হতে একজন বললো— কী সরু তোমার চোখ, আমার কোমরের মতো, আমাকে গিলে ফেলে শরবতসম, তোমার চোখে জলসা ঘরের অনন্ত ঝাড়বাতি দেখা যায়

ভালোবেসে আমাকে ন্যাংটো করতে করতে একজন বলেছিলে— তোমার চোখই আমার ঘরবাড়ি আশ্রয়, অমল বরাভয়, আমি আর কিচ্ছু ভয় পাই না, খুব দ্রুত অন্যের চোখে সে আশ্রয় খুঁজে পেয়েছিলে, আমাকে ভয়—

আমি মুখ লুকিয়ে চোখ লাল করে বাড়ি ফিরি তখন গভীর রাতে, দরজা খুলতে খুলতে মা বলতো— এক্কেবারে বাপের চোখ পাইছে, বদমাইশের চোখ, চরিত্রহীনের চোখ

আমি ব্যক্তিগত আয়নায় আমার চোখের দিকে তাকাই, বড় করুণ আশ্রয়হীন মনে হয় তাদের, জ্বলন্ত, যেনে পৃথিবী পুড়িয়ে দেবে

এমনই বিপজ্জনক চোখ জোড়া আমার, বাম ভ্রুতে কাটা দাগ
আদতে এ দুটো চোখ নয়, ধস্ত ধ্বংস পাখি

অর্ধনারীশ্বর

পুরুষের সমাজে আমি খুব পুরুষ হয়েছি,
মদ না খেলে আমি কাঁদতে পারি না
মদ খেলে একটু নারী হয়ে যাই
নারী ছাড়া কেউ ভালোবাসতে পারে না বলে
মদ খেলে আমি নারী হয়ে গিয়ে
প্রেম ভালোবাসার কথা মনে করে কাঁদি
কাঁদতে কাঁদতে আমি তার দিকে যাই
যে নারী আমাকে ভালোবেসে পুরুষের মতো চলে গেছে
বলে গেছে, মদ্যপান আর বাংলা সিনেমার গান
আমাকে খেয়েছে, আমার পৌরুষ,
একই সাথে নারীত্ব আমার
মানে দাঁড়ালো এই, আমি না-নারী, না-পুরুষ, না-আমি
মানে দাঁড়ালো এই, আমি একটা মদের পিপে
পিপের মধ্যে ঘটর মটর অনন্ত আগামী...

দূর্বা ঘাসের প্রার্থনা

ওগো বটগাছ,
এখানে অপেক্ষা করে একটা দূর্বাঘাস
সবাই অলক্ষ্যে মাড়িয়ে যায়
তুমি তার পদপিষ্ট কচি ডগায়
দেবে নাকি একফোঁটা শিশির-আশ্বাস!

ঝিরিঝিরি ইচ্ছের কবিতা

তখন আমি নদীর ধারে একলা বসে আছি
আসবে তুমি শিমুলে তাই আগুনরঙা হাসি
সামনে নদী স্রোত বয়ে যায় একটা দুটো নাও
ধীর বাতাসে ভাটিয়ালি গাইতেছে মাল্লাও

অকূল দরিয়া, কূল নাই তার, কী যে হাহা-হাহাকার
ভাসে— কান্নার স্রোত, বাতাসে বাতাসে মাঝির গলার
আমি চেয়ে থাকি, দেয় স্রোত ফাঁকি মাঝির বইঠা
শিমুলের ফুল হাওয়ার পুতুল বুক করে দেয় ফাঁকা
নাও চলে যায় মাঝিটাও গায় আরো একগান
আমি বসে থাকি আসবে কখন অপেক্ষা প্রাণ
কাঁই-কুঁই করে বুকের ভেতরে হা হা তুর হাওয়া
চোখ পুড়ে যায় শিমুল শাখায় হয় না তো শেষ চাওয়া

পথ ক্রমে ফিকে তুমিটার দিকে অপসৃয়মান
বঁধূ জল ভরে ফিরে যায় ঘরে কলস ও সে তাহার সমান
সহসা অদূরে চেনা রূপ ধরে নূপুর ধ্বনিরা বাজে
তুমি এলে বুঝি, দুপুর গড়ায় হঠাৎ সন্ধ্যা আসে

সন্ধ্যার বুকে চিরায়ত সুখে পিষে দাও তুমি রাত
একই নৌকায় তুমি আমি আর, আঘাত আঘাত
ঝরা শিমুলের পাতাটির মতো অবিরত ঘোরে নাও
নদী ও আকাশে একা ভাসিতেছে আর মিলনের সুরটাও

সান্ধ্য সংলাপ

আসন্ন হে সন্ধ্যা, পৃথিবীর অপর প্রান্তের পাঁজরে তার
আমার গন্ধ ঢুকিয়ে দাও, বলো তিমির আমারই আরেক
নাম। সে যেনে প্রণাম প্রণাম বলে আমাকে মেখে
বেরোয় অভিসারে..

হাড়ে হাড়ে টের পায় সমস্ত আলিঙ্গনে আমাকেই

প্যারাসমনিয়া

তন্দ্রার ওপার থেকে অস্ফূট ঠোঁটে
গোঙানি-নালিশে কারে তুমি ডাকো!

সমস্ত রাত্রির রেণুমাখা সোনামুখে
তোমার স্বপ্নে স্বপ্নে আঁকো আর কার মুখ!

অথচ আবার ডাকো তুমি,
অপুষ্ট শব্দদের, অস্ফূট সেই ভাষা
মুঞ্জিত চোখে গোঙানির কী কষ্ট!

প্রথমে এলো ডান পা নিতম্বে আমার,
এরপর যৌথ খামারের সমস্ত শর্ত মেনে
গ্রীবাতে গেঁথে দিলে ঘাড়

গ্রীবার খুব কাছে কান, তাতে প্রাণাচ্ছন্ন
সেই নড়বড়ে-ঠোঁট, বিড়বিড় করা গোঙানি-নালিশ,
লালা মদিরায় ভিজে একশা বালিশ

অনন্তকাল চলা এক কাঠগড়ায় হয়েছে প্রমাণ
খুন আমিই করেছি
আসামির মতো তাকাই দশদিকে
পিন পতন নীরবতায় স্তব্ধ আদালত গৃহ, শূন্যচোখ
সমান্তরাল সময়ে তোমার ঘুমন্ত মুখ, আশাবরি ঠাঁট
তাতে লিখিত গোঙানি-নালিশের ব্যাকরণ, আমার ব্যর্থতা-পাঠ

তুমি যায় না তাকানো
এমন নিকটে আমার, মুখ টেনে আনো।।

ঘুম


চোখ থেকে বেরুলো দুটি হাত
ঘুমিয়েছে তারা
চোখের ভেতরে সারারাত