শূন্যতায় বসবাস, তবু তুমি অস্তিত্বহীন নও

লুনা রাহনুমা

প্রকাশিত : জানুয়ারি ২১, ২০২১

ইন্টারনেটের সাহিত্যজগৎ এখন ক্ষুদ্র হতে হতে ব্যাকটেরিয়ার সাইজ ধারণ করেছে। কয়েক মাস অণু পরমাণু আর এটমের পেছনে সাংঘাতিক সময় দিয়েছি। ভাবের কথার সারাংশ করো, আবার মনের ভেতর সার-অংশকে পুনরায় সম্প্রসারণ করো। শুরু থেকে শেষ, আবার শেষ থেকে শুরু। মাঝখানে আঁকিবুঁকি। শুধু আঁকিবুঁকি করলে হবে না গো, এলোমেলো সেই ডালপালায় ফুল ফোটাতে হবে ভাষায়, শব্দে, গল্পে, কাহিনিতে, সংলাপে, আকারে, ইঙ্গিতে, রঙে, ঢঙে, গোল গোল গুলা মশগুলা হয়ে।

ফুলের রানি গোলাপ সবসময় না হলেও চলবে। চন্দ্রমল্লিকা, হাস্নাহেনা, রজনীগন্ধা কিংবা গ্লাডিওলাস হলে এক নাম্বারে থাকবেন। দুই নাম্বারে থাকবে টগর, বকুল, মাধবীলতা, বোগেনভিলিয়া ইত্যাদি জাতীয় ফুলের সুবাস। তাও না পারলে, তৃতীয় শ্রেণির ট্রেনের কামরার প্যাসেঞ্জারের মতো হেলায় ফেলে অবহেলায় ফুটে থাকুন গেন্দা, দূর্বা, সন্ধ্যামালতি না হয় লাল, হলুদ, বেগুনি একটা কোনো রঙে কিছু ঘাসফুল হয়ে। তাও যদি না পারেন নিদেনপক্ষে সবুজ ঘাস হয়েই মাটিটুকু ঢেকে রাখবেন। শুস্ক মাটি প্রকাশিত পড়ে থাকলে চলবে না, সাবধান!

পাঠক সেই পাথুরে মাটিতে পড়তে গিয়ে উস্টা খেলে কিন্তু লেখকেরই বিপত্তি বাড়বে। বদনাম হবে সাহিত্য স্রষ্টার। আমার চারপাশে সবাইকে ছুটতে দেখে আমিও দৌড়ে তাল মেলাতে গিয়েছিলাম। রেসের ঘোড়ার মতো চোখে ঠুলি আর কানে তুলো দিয়ে দিগ্বিদিক দে ছুট ছুট ছুট। তারপর দড়াম করে আছাড় খা, চিৎ চিৎ চিৎকার। বুকভাঙা হাহাকার। খুব তেষ্টা পেয়েছে আমার। ক্লান্ত পরিশ্রান্ত হলে গা জুড়িয়ে নেবার মতন প্রবল শখের একটা আশ্রয় ছিল তালপাতার ছাউনি দেয়া শীতল বাতাসের ছোট্ট কুটির কোনো বইয়ের বাগানে। ইদানীং মনে হচ্ছে, সেই বাগানটিও বুঝি নিজের হাতেই কেটেকুটে সাফসতুর করে দিচ্ছি দিন দিনেই।

সেই কবে থেকে আমি সকাল আটটার ট্রেন ধরার জন্য উদ্ভ্রান্তের মতো দৌড়াচ্ছিলাম যেন। আর দৌড়াতে পারি না বাবা। মেদভুঁড়ির মধ্যবয়সী এই শরীর একশো মাইল স্পিডে রেসের ধকল আর কত নেবে! রাস্তার পাশে কাঠের বেঞ্চিটাতে এই বসলাম মাগো বলে। চুলোয় যাক আমার আটটার ট্রেন। আমি এখন এখানে বসে প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিবো। আশপাশে মানুষের হাঁটাহাটি দেখবো, পান খাওয়া-বিড়ি ফোঁকার গন্ধ শুকবো, সংসারের কলহ, এলাকার মেম্বারের রিলিফ চুরির কথা শুনবো। কেউ যদি আগ্রহী হয়, তার সাথে মিনিট দশেক আজাইরা প্যাঁচাল পারবো।

আফা চা লিবেন, চা?
আবার জিগ্গায়! দে, দুই কাপ চা দে।
আফনে তো দেহি একলা এইহানে। আরেক কাপ কে খাইবো?
এককাপ আমার ডান হাতে দে। আরেক কাপ আমার বাম হাতে। হইলো!

টঙের দোকানের ছেলেটি দুই কানের এমাথা সেমাথা এক করে ইয়া বড় একটি হাসি দিলো। দৌড়ে চা আনতে যাবার আগে বললো, হইলো আফা। এক্কেরে ঠিক অইলো।

চয়ন খায়রুল হাবিব সেদিন বলেছে, ভাইরাল হওয়া অণুগল্পগুলো লেখকের জন্য মূল লেখা নয়, ওগুলো এক্সারসাইজ। মাথার চিন্তার জন্য একরকম এক্সারসাইজ। আর সেসব লিখে যদি মাথা ধরে যায়, তাহলে সেগুলোকে এক্সারসাইজও বলা যাবে না, বলতে হবে আর্থাইটিস।

লেখকগ্রুপে সুলতানা মেহেরুন মেরী বলেছে, ২০ শব্দের গল্পে প্রাণ থাকে না। শুধু একটা ম্যাসেজ হয় মাত্র।
গল্পের ভেতর প্রাণ? সেই প্রাণ কি মানুষকে বাঁচিয়ে রাখার প্রাণ? মানুষের প্রাণ বাঁচানোর প্রাণ নয়, গল্পে থাকে মনকে চাঙা করে তোলার প্রাণশক্তি। শব্দের হাত ধরে মনের ভেতরে প্রাণকে নাড়িয়ে দিয়ে যেতে পারে এমন শক্তিধর কয়জন লেখক হতে পারে? তাও আবার একটি হাতের আঙুল গুণেই গল্পের সংখ্যা শেষ করে ফেলা যায় এমন গল্প দিয়ে! ভাবছি।

রওশন জাহান সিমি বলেছে, বিশ শব্দের গল্প? এটা ফাঁকিবাজির একটা উপায়!
আমি ভাবছি, ফাঁকি আসলে কে কাকে দেয় এখানে? লেখক ফাঁকিবাজ কিন্তু পাঠকও তো কম ফাঁকিবাজ না। দীর্ঘলেখা পড়ার ধৈর্য নেই, সারাংশটুকু জেনেই সন্তুষ্ট। ফাঁকিতে ফাঁকিতে ভরে গেছে লেখক আর পাঠকের সমাবেশ। কিংবা বলা যায়, পাঠকের মর্জি চাহিদাই তৈরি করছে ফাঁকিবাজ লেখক?

আমিনা তাবাস্সুম বলেছে, বিশ শব্দে আসলে গল্প হয় না, কথা হয়। সেই কথাও সুন্দর হতে পারে, আনন্দের হতে পারে, দুঃখের হতে পারে, কোনো গভীর বার্তা পৌঁছে দিতে পারে। কিন্তু গল্প? না বাবা, গল্প হয় না।

আবার আমিনা তাবাস্সুমের কথাকেও ভেঙে ভাবতে হয়, অনলাইন পত্রিকার সম্পাদক আশিক মাহমুদ রিয়াদ যখন বিশ শব্দের গল্পকে আমন্ত্রণ জানায়। আমার দুই লাইনের গল্প ‘এতিমখানায় বাচ্চাদের নিজ হাতে খাইয়ে মন্ত্রী-সাহেব চোখের পানি মোছেন। বাড়ি ফিরে ঘর অপরিষ্কার বলে কষে চড় বসান এতিম জামালের গালে।’ মন্তব্যে রিয়াদ বলেছে, গল্পগুলো বিশ শব্দের। কিন্তু, পড়ার পরে চিন্তায় যে ছাপ ফেলে, সেটিই গল্পের সার্থকতা!

জটিলতর জটিলতায় আমার মাথা ঝিমঝিম করতে থাকে। অনেকক্ষণ পরপর পাশ দিয়ে ছুঁটে যাওয়া রিকশা মাঝেমধ্যে দুই তিনবার ঘণ্টি বাজায় টুং টাং। আমার কানে কানে কে যেন বলে যায়, পথিক তুমি কি পথ হারাইয়াছ?

বাঁশের মাচার মতো বেঞ্চিটিতে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়লাম আমি। চোখ বুজে অনুচ্চে বলি, ধীরে রজনী ধীরে...
টঙের দোকানের ছেলেটি এর মধ্যে কয়েকবার এসে ঘুরে গেছে। অপরিচিত এই গ্রামের মোটামুটি ধারণা পেয়ে গেছি আমি এরইমধ্যে। ছোটবেলার মতো হাতের দশ আঙুলে দশটি রিং-চিপসের গোল্লা আংটির মতো ঢুকিয়ে বসে আছি। খেতে ইচ্ছে করছে না। কিন্তু শৈশবে ফিরে যেতে ভালো লাগছে। আচ্ছা, দোকানের বাচ্চা ছেলেটার নাম কি? ওকে দেখে আমার ছোট ভাইটির কথা মনে হচ্ছে খুব হঠাৎ করে। অনেক ছোটবেলায় আমার ভাইটি এলাকার খেঁজুর গাছের উপর একটা মৌচাকে ঢিল মেরেছিল। মৌচাকের হাজার হাজার মৌমাছি কয়েক মিনিটের ভেতর আমার ভাইয়ের শরীর ঘিরে কামড়ে ধরেছিল। মৌমাছির পুরো বহর নিয়ে ছুটতে ছুটতে আমার ছোট্ট ভাইটি দৌড়ে বাড়ি এসেছিল।

ইশ, কী ভয়ঙ্কর ফুলে গিয়েছিল ওর শরীরটি মৌমাছির কামড়ে! এখনো আমার চোখে ভাসে সেই দৃশ্য। আচ্ছা, অনলাইনে সাহিত্যচর্চা আর অণু-পরমাণুর বিকাশ অনেকটা মৌচাকে ঢিল পড়ার মতোই কি? শতশত লেখা জমা পড়ে যায় কয়েক দিনের ভেতর। শতশত মানুষ লেখক বনে যায় কয়েক মাসের ভেতর। যেমন আমিও হয়েছি। আমাদের অণুগল্পগুলোকে ছাপানোর জন্য অনেকগুলো অনলাইন পাতাও তৈরি হয়ে আছে। অণুগল্প ছাপা হলেও যে কত মানুষ লেখকের বন্ধু হতে চায়! ২০০৮ সাল থেকে এপর্যন্ত ফেইসবুক একাউন্টে আমার বন্ধু সংখ্যা ৭৭৪। তিনমাসে বন্ধু রিকোয়েস্ট জমা হয়েছে ৯৬৩টি। তারা কি আমাকে সেলিব্রেটি মনে করছে? আচ্ছা, সকল অনলাইন লেখিক যদি সেলিব্রেটি হয়, তাহলে ননসেলিব্রেটির চেয়ে তারা নিশ্চয়ই সংখ্যায় বেশি? বিচিত্র এই লেখক পাঠকের সমীকরণ।

আফা, আর কতক্ষণ বইয়া থাকবেন এইহানে? আফনের বাড়িত কেউ নাই?

পিচ্চিটার ডাকে সম্বিৎ ফিরে পাই আবার। জিগেশ করি, তোর নাম কিরে?
মোতালিব। আফনের নাম কি?
আমি একটু চিন্তার পড়লাম। আব্বার দেয়া নাম বলবো। নাকি নিজেকে দেয়া নিজের পছন্দের নামটি বলবো? কেন যেন মোতালিবকে আমার একটিও বলতে ইচ্ছে করছে না। মোতালিবের শিশুচোখের উজ্জ্বল কালো ভ্রমরদুটিকে আমার চোখের তারায় কয়েক সেকেন্ডের জন্য বেঁধে রেখে বললাম, শূন্যতায় বসবাস, তবু তুমি অস্তিত্বহীন নও।

আফনের নাম এতো লম্বা আফা? কঠিনও আছে নামডা।
মোতালিবের হাতে চা, সিঙ্গারা, পান, বিড়ির দাম আর বকশিস দিয়ে উদ্দীপ্ত পায়ে বাড়ির পথে আগাচ্ছি আমি। খুব তাড়াহুড়ো আছে আমার, যেন সকাল আটটার ট্রেন ধরতে হবে আমাকে এই বিকেলের নিভে আসা ছাইমাখা পড়ন্ত বেলায়।