শৃঙ্খলা ভেঙেচুরে নতুন শৃঙ্খলাসৃজনের কলাকার কবি উৎপলকুমার

মাসুদ খান

প্রকাশিত : জানুয়ারি ০৯, ২০২১

কবি উৎপলকুমার বসু। একেবারে প্রথম থেকেই, তাঁর পয়লা পুস্তক ‘চৈত্রে রচিত কবিতা’ থেকেই, অনন্য তিনি। জীবনানন্দের গড়ে তোলা প্রশস্ত পথে উঠে পড়বার অব্যবহিত পরেই সেখান থেকে বাঁক নিয়ে তিনি হাঁটতে শুরু করেন অনেকটা-একাই-গড়ে-তোলা নতুন এক পথে। সে-পথ এক নির্বিষয় গূঢ়লেখ কবিতাতরঙ্গের। সে-তরঙ্গের তুঙ্গ রূপ আমরা দেখব ‘পুরী সিরিজ’ ও ‘আবার পুরী সিরিজ’ পর্বে। আমরা এও দেখতে পাব, পথ নির্মাণ করতে করতে এগিয়ে চলা এই কবি একটা পর্যায়ে এসে আরো একটা বাঁক নিয়ে ধীরে ধীরে চলে যাচ্ছেন এক অপরূপ ভাবসারল্যের ভূগোলের দিকে, এক প্রশান্ত সন্ন্যাসশাহির দিকে।
পাঠবস্তু, যে কোনো পাঠবস্তু, উস্কিয়ে দেয় অনেকান্ত পাঠ-- সরল ও বক্র, আলোকিত ও অন্ধকার, সোজা ও উল্টানো, ব্যাজ ও নির্ব্যাজ, উল্লম্ব ও তির্যক পাঠ...। টেক্সট বা পাঠবস্তু মাত্রই সংকেতবদ্ধ। ভিন্ন-ভিন্ন পাঠক ভিন্ন-ভিন্নভাবে মর্মোদ্ধার করে সেই টেক্সটের; যোগাযোগ ঘটায় নিজের মতো ক’রে। কিংবা আধুনিক যোগাযোগবিজ্ঞান যেমনটা বলে থাকে-- সংকেতবদ্ধ পাঠবস্তুকে পাঠক শুধু ডিকোডই করেন না, পুনরায় সংকেতবদ্ধ করে নেন নিজ-নিজ অনুভব ও উপলব্ধি অনুযায়ী। লেখকের মতো পাঠকও তখন অবতীর্ণ হন ভিন্নতর এক সৃজনকর্তার ভূমিকায়। টেক্সট পাঠককেও ব্যাপৃত করে অন্য এক সৃজনলীলায়।
যে কোনো টেক্সটের বেলাতেই খাটে বিষয়টি। তবে বাংলাভাষায় উৎপলকুমার বসুর হাতে সূচিত যে বিষয়হীন গূঢ়লেখ কবিতাধারা, তাতে তা খাটে আরো নিবিড়ভাবে, নতুন মাত্রায়। কবির টেক্সট এমনই যে তা পাঠককে বাধ্য করে সক্রিয় অংশগ্রহণে, নিহিত সংকেতরাজির মর্মোদ্ধারে।
একজন কবি আসলে কী করেন? বাইরের জগতের যে-কোনো সংকেত, যে কোনো ঘটনা, কবির অন্তর্জগতে প্রবেশ করে তাঁর সদাজাগর ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে। বহির্জগতের সেই সংকেতের ছাপ নিয়ে নেন কবি তাঁর সংবেদী চেতনায়। কবির ভেতরে তৈরি হয় সে-সম্পর্কিত অনুভূতি ও উপলব্ধি। আর সেই অনুভূতি ও উপলব্ধির প্রতিফলন ঘটান তিনি এমন এক কাব্যজগৎ সৃষ্টির মধ্য দিয়ে যে, সেই জগৎ এই প্রচলিত জগতের বস্তু-বিষয়-বাস্তবতা, শব্দ-নৈঃশব্দ্য এসব দিয়েই গড়ে ওঠে বটে, কিন্তু গাঁথা হয়ে ওঠে এক ভিন্নতর সম্পর্কসূত্রে, বিন্যস্ত হয় যেন এক অপ্রাকৃত বিন্যাসে, এক আপাতছদ্ম যুক্তিপরম্পরায়। এজন্যই, কবি যা সৃষ্টি করেন তাকে বলা হয় ‘বিকল্প জগৎ’, ‘বিকল্প প্রকৃতি’, যেখানে খেলা করে অন্য আলো-ছায়া, অন্য মেঘ-বিজলি-ঝড়, অন্য নিসর্গ-- ভিন্ন চালে, ভিন্ন লজিকে। প্রথাগত যুক্তিশৃঙ্খলার গভীর বিপর্যয় সাধনের মধ্য দিয়ে কবি রূপায়িত করে তোলেন এক অলৌকিক নৈরাজ্য-বিন্যাস। তারপর তার সেই স্বরচিত বিশৃঙ্খলার ভেতর থেকে সৃজন করতে থাকেন ভিন্নতর এক নান্দনিক শৃঙ্খলা, এক ভাষাতীত ভাষাপ্রপঞ্চ। শৃঙ্খলা ভেঙেচুরে নতুন শৃঙ্খলা। ‘অর্ডার অব ডিসঅর্ডার’-এর গণিত... গণিতের উচ্চতর কীর্তিকলাপ।
এবার দেখে নিই কেমনধারা জগৎ গড়েন কবি উৎপলকুমার বসু, কেমনই-বা সে-জগতের বিন্যাস ও শৃঙ্খলা।
উৎপলকুমারের গড়ে-তোলা সেই বিকল্প জগতের কোনো-কোনো মানুষ সারাটা সকাল সপরিবারে হাসতে থাকে উত্তর-না-মেলা এক কৃশগণিতের দিকে তাকিয়ে। সেখানে মৃত্যুর অব্যবহিত পরে দেখা হয় সবুজ জবার সঙ্গে, যে-জবা বলে ওঠে, “আমাকে কি মনে পড়ে, আমি রমণীবাবুর রেল-কোয়ার্টারে ফুটে থাকি?” কবির স্বরচিত ভূমণ্ডলে মাঝে মাঝে ভুলভাবে ফোটে শিমুল, নতভাবে জাগে বিকেল, ফিরে আসে জ্যামুক্ত নক্ষত্রমণ্ডলী, সন্ন্যাসিনীদল গান গায় পূর্বস্থলীর মাঠে, আর মরণশীল উদ্ভ্রান্ত মোরগ মৃত্যুর পরেও উড়ে চলে লালটালি বারান্দার দিকে। সেখানে বনের ভিতরে একা একা ঘোরে সকালের উদ্দেশ্যবিহীন দমকল আর বসন্তে সেলাইমেশিন পাবার সম্ভাবনা জাগে উঁচু অশোকের ডালে। সেই রাজ্যে কবিদের মানস-মানসীরা তাদের ব্যক্তিগত বসন্তদিনের চটি হারিয়ে ফেলে বাদামপাহাড়ে, আর তার পরপরই কবিরা হারায় তাদের ব্যক্তিগত লিখনভঙ্গিমা। সেখানে ঘুম আর বোঝাপড়ার মাঝখানে ধ্বনিবহুল ধানক্ষেত, সঙ্গীতময় সরীসৃপ। সেখানে গাছে গাছে কোকিল ডাকতে থাকে “কোকেইন কোকেইন”। সে-দেশে মশলা-ঝাড়ার গান থেমে গেলে উৎকেন্দ্রিক কুলা মায়ের ও দাসীর হাতে ঘেমে ওঠে ততোধিক। সেখানকার কৃমিরাও জাতীয়তাবাদী।
কবির সেই ভূগোলে তুলা উড়ে চলে আফিমবীজের চেয়েও পরিণতিহীন লক্ষ্যে। গন্ধকমেশানো জলে স্নান করে জেলঘুঘুদের আত্মা। সেখানে বামন ঘোড়ার পিঠে ন্যস্ত হয়ে কবিতার ব্যাখ্যা চায়, আর ব্যাখ্যা চাইতে বারণ করেন সে-রাজ্যের কবি ও কথক, বরং পরামর্শ দেন মফসসলে গিয়ে সামুদ্রিক মাছের সম্পাদনা করবার। সেই রাজ্যে ফুলের আক্রোশে ছিন্নভিন্ন হয় ঘর। অবশ্য তার আগে গন্ধ দিয়ে সতর্কসংকেত পাঠায় সেই ফুল। সেখানকার নবদ্বীপে, ফরাসি-শেখার ক্লাশে, বকুলবাগান থেকে চৌরঙ্গীপাড়ায় হেমন্তের কোনা ধরে শুয়ে থাকে মানুষেরা, সৌন্দর্য ও মশার জ্বালায়। তারা দুঃস্থদের গ্রামাঞ্চলে গিয়ে বিলি করে ঈগলের অপবাদ, পাখিদের অপবাদ। সে-জগতে শকুনতাড়িত সূর্য হেলে পড়ে কম্পাসকাঁটায় আর দূর বিমানের ধাতু-আলেয়ায় বিপুল এয়ারোড্রাম পড়ে থাকে বৈমানিকবিহীন। তারপরও, জ্বলন্ত পেট্রলরেখা ধরে আগুন ছুটে চলে শোধনাগারের দিকে।
সেই মহাদেশে হেমন্তে হলুদ পাতার নিচে কবি আবিষ্কার করেন নমনীয় এক ধাতু, আর তার স্প্রিং-এ, তার প্রসারণশীলতায় কবি লাফাতে চান আগামী বসন্ত অবধি। সে-দেশে শিকড় থেকে ফুলের জানুর ভেতর পর্যন্ত বয়ে চলেছে শতশত আলপিন। কবি বুঝতে পারেন, এসব আর কিছু নয়, তাঁরই মানসীর আহ্লাদ। বুঝতে পারেন-- তাঁর মানসীর পরিণতি বলে কিছু নেই; শুধু বারবার সে গভীর ফাল্গুনে স্ত্রীলোকের মতো (যেন-বা মায়ের মতো, স্ত্রীর মতো, উন্মাদের শপথের মতো, স্ত্রীলোকের গর্ভ-উন্মাদনার মতো) ফিরে ফিরে আসছে সময় হলেই।
উৎপলকুমার বসুর কবিতার বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে বিষয়হীনতা। তাঁর কবিতায় থাকে না সুনির্দিষ্ট কোনো টপিক বা থিম। কোনো একটি বিষয়কে ঘিরে আবর্তিত হয় না তাঁর কবিতা। অসংখ্য ছোট-ছোট বিষয়, টুকরো ঘটনা, বাগধারা, সংলাপচূর্ণ, দৃশ্যকণা, আচমকা সংবাদ, দমকা প্রবাদ, অনুভবের ক্ষণিক উদ্ভাস... এসবের বর্ণাঢ্য সংশ্লেষ ঘটে তাঁর লেখায়। উৎপলের কবিতার আরো একটি বড় বিশেষত্ব হলো ‘অনুষঙ্গ’র অবাধ লীলাবৈচিত্র্য। কবিতার স্তরে স্তরে আমরা ঝলকে উঠতে দেখি বিচিত্র সব উৎস থেকে আহৃত রকমারি প্রসঙ্গ, অনুষঙ্গ, খণ্ডচিত্র, খণ্ডভাষ্য...। অবাধে, অবলীলায়, অতর্কিতে, এবং উপর্যুপরি। বাংলাকবিতায় এ এক অন্যরকম ধারা-- ‘ফ্রি অ্যাসোসিয়েশন’ বা ‘অবাধ অনুষঙ্গ’-প্রবাহের পরাকাষ্ঠা। চেতন ও অবচেতনের এক গোধূলি-অঞ্চল থেকে উৎসারিত অনর্গল রাশপ্রিন্ট। এক স্বয়ংক্রিয়, স্বতোৎসার-লিখনের ক্ষুরধার স্রোত। দৃষ্টান্ত হিসাবে প্রথমেই মনে পড়বে “পুরী সিরিজ” ও “আবার পুরী সিরিজ”-এর ব্যতিক্রমী কবিতারাশি--

ও শ্বেত বৈধব্য, পাখি, তুমি কারাগার
রৌদ্র থেকে ফেলে দাও গরাদের ক্রমপরম্পরা
গরাদের মধ্য থেকে মাল্যবান পাহাড়ের ব্যাকুল লাক্ষাবনে
আমারও মস্তিষ্ক, নেশা, চৈতন্য, সমাধি
পাদ্রীদের, সন্ন্যাসিনীদের হাতে চলে গেছে।

“তোমার ঈশ্বরপ্রদত্ত গাধা কিন্নরছাগল তোমার ঘরপোষা চিতা আর ধনেশের যৌথ ঘোরাঘুরি আমি স্বাধীনতা পেয়েছি এবং বিদ্যুৎ তাঁতের কল হাতঘড়ি সোডাকারখানা পেয়েছি এবং অতিরিক্ত মুনাফায় যারা শ্রমিকের বাড়িগুলি তৈরি করে দেয় তারা আংশিক বশ্যতা মেনেছে এ-কথা সরকার ক্রমাগত বলে যায় আমি যথোচিত নেশাতুর তাই সার্বভৌম বেশ্যাদের প্রকৃতিজগতের আর দারুপুতুলের ছবিগুলি মনে পড়ে আজ ভোরে নিজেই উল্টে দেখছি অব্যবহৃত পুরনো দিনের অস্ত্র আমার ব্যক্তিগত চর্বিমাখানো আত্মা ভেবে দেখছে পদ্মিনী ও রাজপুতজীবনপ্রভাত তারই কথা অন্ধকার ভোরে আজ প্রয়ঃপ্রণালীর কাছে সুন্দর বেজিটি নিয়ে আমি একা বেড়াতে গিয়েছি...”
“যদি স্পষ্ট মনে পড়ে আমার পানীয় ছিল সারাৎসার-- পৃথিবীকে ভরাট লেবুর মতো মনে হয়েছিল- ব্যথা-বেদনার দূর মাস্তুল, কুম্ভীপাক ঘুরে গিয়েছিল দেখে আমারই মুঠোর মধ্যে ওই গোল অর্থহীনতা-- ফাঁপা, নিষিক্ত ও সহিষ্ণু জীবন ও জীবনব্যাপী কলরোল-- আমার পানীয় ছিল বাঁদরত্রাসিত কোনো তীর্থভূমি-- আবিষ্কার, অনটন, আপন বিবেক নিয়ে কুমারীরও এত লজ্জা হয় না আমার যত হয়েছিল-- যথেষ্ট বিদ্যা শেখা হয়েছিল প্রদোষের অন্ধকারে-- পিঁড়ির আড়াল থেকে সতর্ক ও-ইঁদুরের চলাফেরা দেখে... ... ... ... ... ... যদি স্পষ্ট মনে পড়ে আমার সৌভাগ্য ছিল অরুন্তুদ ভাগ্যবিপর্যয়, অল্প আগুনে সেঁকা কালো জিরে, গন্ধবহ-- অথবা বাবার চটি... ... ... ... ততোধিক ভুল স্মৃতি, মিথ্যাবাদ, খেলাধুলা, বলের লাফানো আর মেঘের ভিতর থেকে আবির্ভূত জীবনের প্রথম এয়ারোপ্লেন-- তা-ও সত্য নয়।”
পঙক্তিতে পঙক্তিতে কবি ঘটিয়ে তোলেন অভাবিতপূর্ব সব ঘূর্ণিপুঞ্জ-- ছোট-ছোট কিন্তু শক্তিশালী সব চোরাঘূর্ণি। তাঁর কাব্যের কেলাসদ্রবণে তৈরি হতে থাকে চূর্ণ-চূর্ণ সৌন্দর্যস্ফটিক। একইসঙ্গে ঘটতে থাকে স্ফটিকচূর্ণের জমাট বাঁধন। চূর্ণ-চূর্ণ স্ফটিকেরা দ্রবণের ভেতর ঘুরে-ঘুরে জমাট বেঁধে তৈরি করে ফেলে প্রকাণ্ড এক সৌন্দর্যস্ফটিক।
আরো একপ্রকার ব্যতিক্রমী ঘটনা ঘটতে দেখা যায় উৎপলের কবিতায়। হঠাৎ হঠাৎ বিচিত্র সব সাংকেতিক শব্দ, শব্দবন্ধ ও চকিত দৃশ্যকণার জাক্সটাপোজিশন-- অবাধ, এলোপাথাড়ি।

‘ধোঁয়াপাহাড়-- শুয়োরমাথা বন--...
আমরা পকেটব্যাধ-- চামড়াচর্চিত-- পাতা ও প্রশাখার সন্তান-- গোধিকারাধা তুমি...’

‘কেলা, কেলাসিত, কেলামঞ্জরী, জলকেলি, আমি একেলা, কারবাইট
কেলা, মিলিয়ে ফেলা, কেলা বেচা, রথ দেখা--
আজ ত্রিশ বছর জাতির সেবায় নিয়োজিতম্, ত্রিঙ্কোমালী বেকারিভ্যান,
সনেট মাইক, রুটিওয়ালা ওয়া-ওয়াসিম, দরগা রোড, বাবাবনেট,
টায়ারতন্ত্র, গোপন গ্যারেজ, ঝুঁটিওয়ালা পাখপাখালি, রথবাজার,
কাচের কাপ, কাপের প্লেট, গয়গবাক্ষ খাঁচার মধ্যে, ট্যাপের জলে
কপোতাক্ষ...’

‘হয়বদন গিটার তু তু বাঁশি জেব্রা ঢোল ঝিয়ের পেটে মায়ের জন্ম নাইকুণ্ডলি মাইক
হাঃ হাঃ শ্যামলবাবু ট্যাক্সি ভাড়াটা আগেই নিয়ে রাখুন...’

এমনতর সাংকেতিক শব্দপুঞ্জ যখন অতর্কিতে একের পর এক আছড়ে পড়ে পাঠকের মনে ও মগজে, তখন মনে হতে থাকে এরা শুধু নিছক কিছু শব্দ বা শব্দবন্ধ নয়, এরা যেন দূরকালের কোনো আধো-চেনা-আধো-অচেনা ভাষার নিগূঢ় সংকেতলিপি-- পাঠোদ্ধারে উন্মুখ।
বহুদূর অভিলাষপুর, আরো দূর দিকচক্রবাল, কল্পনাপূরণপ্রান্ত, যেখানে আকাশ বিশাল ফাঁপা গম্বুজের মতো গোল হয়ে নেমে এসে মিশেছে ভূমণ্ডলের সাথে। আমরা যতই এগুতে থাকি ওই দিগন্তরেখার দিকে, ততই সরে সরে যেতে থাকে আকাশ। নাগাল আর পাওয়া যায় না কিছুতে। কিন্তু আমাদের এই জন্ম-ভ্রামণিক কবি, এই ব্যতিক্রমী অশ্বারোহী, যখন এক দিগন্ত থেকে আরেক দিগন্তের দিকে তুরন্ত তাড়িয়ে উড়িয়ে নিয়ে চলেন তাঁর কল্পনার কেশর-হাঁকানো অশ্ব-- রাশমুক্ত, দুর্বিনীত-- তখন, সেই তূর্ণভ্রমণকালে, মাঝেমাঝেই তিনি পাকড়ে ফেলেন দিগন্তের আকাশটাকে। পাকড়ে ফেলেনই না শুধু, অতিক্রম করে যান নভোসীমা। গোল হয়ে নেমে আসা নীলিমার ওই কুহকী চাঁদোয়া উঠিয়ে তার তলা দিয়ে পার হয়ে চলে যান অন্য ব্রহ্মাণ্ডে, ইউনিভার্স থেকে মাল্টিভার্সের ভুবনে। এমনই অনিঃশেষ এই কবির কল্পনাসফর।
উৎপলের কবিতার ভাঁজে ভাঁজে কল্পনার অপরিমেয় লীলা। বিচিত্র ভুবন থেকে আহরণ করে আনা অভাবিতপূর্ব সব কল্পদৃশ্য, কল্পচিত্র, কল্পভাব, কল্পোক্তি...। তারা উপর্যুপরি উদ্ভাস দিতে থাকে পঙক্তিতে পঙক্তিতে, চলতে থাকে এক অভিনব সংশ্লেষণক্রিয়া আর পুনর্বিন্যস্ত হতে থাকে তারা এক অলৌকিক-প্রায় বিন্যাসে। বোধবুদ্ধি গুঁড়িয়ে দেওয়া এক কল্পলীলার লীলাকর, কবি উৎপলকুমার। এক স্বতোৎসার-লিখনের জাদুকর, কবি উৎপলকুমার। শৃঙ্খলা ভেঙেচুরে অন্য এক অভিনব শৃঙ্খলাসৃজনের কলাকার, কবি উৎপলকুমার।
তবে কবি যে কেবল সৃষ্টিসুখের উল্লাসে সৃষ্টি করেই চলেন একের পর এক নান্দনিক নৈরাজ্য, তা নয়। তাঁর কবিতায় মাঝে মাঝেই ঝিকিয়ে ওঠে এমনসব সারল্যমাখা ভাবুকবচন, যে-সারল্য অর্জন করতে হয় দীর্ঘ সাধনার মধ্য দিয়ে, যে-সারল্য প্রাজ্ঞের সারল্য, যে-সহজতা পরিণত কবির সহজতা। পরিশ্রুত রোদের মতো উজ্জ্বল সেইসব সহজ ভাবসমৃদ্ধ, রূপঋদ্ধ পঙক্তিনিচয়।

“শুধু মানুষই মানুষকে ধন্যবাদ দেয়। কৃতজ্ঞতাবোধে তার দুই চোখ
জলে ভরে ওঠে। তারা ইহলোক সৌন্দর্যে কাটায়-- ব্যয় ও অর্জনে।
ভিন্ন ভিন্ন বস্তু ও প্রাণীর নামকরণেই কত কাল নষ্ট করে। বলে :
‘এদের জেনেছি’। আমরা, বাইরে যারা, অতি কষ্টে হাসি চেপে থাকি।“

“তোমাদের বাড়ি বড়ো দূরে। তারই আগে বহু বাদুড়ের
বিধ্বস্ত ফলের দেশ পার হয়ে এনেছি খবর...
...এখন তোমাকে ভাবি ছিন্নত্বক ফলে ও ছায়ায়...
... তোমার বাড়ি ততদূর মনে হয়-- ওগো প্রিয়, উন্মুক্ত ডানার
লক্ষ বাদুড় ঠেলে যেতে হয় জামের হরণে—“

“গঙ্গার প্রবাহ আর এ-শরীরে রক্তস্রোত ছুটছে সমান্তরাল।
উনি ভাটিয়ালে কথা কন-- আমারটি বলে না কিছুই।
উভয়ের গতি কি সমান? নৌকোয় শুয়ে ভেবেছি অনেকবার।

কিন্তু কার কাছে
জানতে চাইব? শুধু এইটুকুই বলা যায়-- প্রথমটি সমুদ্রে যাচ্ছেন
আর দ্বিতীয়টি টালবাহানায়”।

“সৈন্যরা বৃথাই বন্দুক ছোড়ে, কৃপাণ নিজেরা লড়াই করে, ক্রোধ অদৃশ্যই থেকে যায়।“

“গাছে উঠে বসে থাকি। ফল খাই। ব্যক্তিমানুষের দিকে
আঁটি ছুড়ে মারি। নীচে হাহাকার পড়ে যায়। বেশ লাগে।
মাঝে মাঝে বাউল সংগীত গাই। ওরা শোনে। বাদ্যযন্ত্র
নিয়ে আসে। তাল দেয়। বোধহয় ছবিও তুলেছে। সেদিন
এক গবেষক বাণী চাইল। ভাবলাম বলি : আমার জীবনই
আমার বাণী। কিন্তু সম্ভবত এটি বলা হয়ে গেছে। অতএব
নিজস্ব ভঙ্গিতে, কিছুটা আপন মনে বিড়বিড় করি
‘দেখেছি পাহাড়-- দেখে জটিল হয়েছি।“

“বাড়ি ফিরে দেখি, বারান্দায় টবের গাছে, ছোটো এক
শাদাফুল ফুটে আছে। এ-ও কী সম্ভব! আমার অবিশ্বাসী
দুই চোখ জলে ভরে যায়। আমি চুপ করে ওখানেই
দাঁড়িয়ে থাকি। বহুক্ষণ। যেন কত কাল। এই প্রসূতি
এবং তার শিশুটিকে নিয়ে কী করব ভেবেই পাই না।
প্রতিবেশীদের খবর দেব না তো বটে। কাগজের লোকদেরও
ডাকব। কিন্তু আমাকে যে অবিলম্বে এদের জন্য রৌদ্রের
ব্যবস্থা করতে হবে। সে কোথায় পাবো। আপাতত অস্ফুটে বলি:
আমি একট ঘুরে আসছি। তার আগে তোমাদের এক সীমাহীন
ভালবাসার কথা জানিয়ে যাই যা মানুষকে কাঁদায়
নয়তো কবিতা লেখায়, নয়তো বাজারে পাঠায়।”

এক নান্দনিক নৈরাজ্য ছেড়ে উৎপলের কবিতা এভাবে ধীরে ধীরে সরে এসেছে অন্য এক অপরূপ ভাবসারল্যের রাজ্যে, এক প্রাজ্ঞ পরিণত নাইভিটির দিকে, উত্তরোত্তর। যেন একচ্ছত্র রাজত্বশেষে এক পরাক্রান্ত নৈরাজ্যপতি হেঁটে চলেছেন রাজসিক, প্রসন্ন এক সন্তরাজ্যের দিকে। তাঁর কবিতার এই যে নীরব-অথচ-নিরবচ্ছিন্ন ক্রমরূপান্তর, তা বৈচিত্র্যেরই স্মারক, পরাক্রমেরই পরিচয়বাহক।
জীবনানন্দ দাশের পরে উৎপলকুমার বসুই সম্ভবত সবচেয়ে প্রভাববিস্তারী কবি। সমকালীন কবি ও কবিতামোদীদের ওপর তাঁর কবিতার সম্মোহন, ষড়যন্ত্র ও প্ররোচনা ব্যাপক এবং কার্যকরী।
কুর্নিশ হে কবি, হে অব্যর্থ অর্জুন, বাংলাকবিতায় অর্ডার অব ডিসঅর্ডার-এর উচ্চতর গণিতপ্রণেতা। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অনেক ঋণ তোমার কাছে।