শ্রেয়া চক্রবর্তী

শ্রেয়া চক্রবর্তী

শ্রেয়া চক্রবর্তীর আত্মগদ্য ‘বিষামৃত’

প্রকাশিত : জুলাই ২৮, ২০২০

I am hungry. I am thirsty. The food is ready to be eaten, sucked and chewed

একথা আমাকে লিখেছিল আমার ইংরেজির গৃহশিক্ষক। আমি তখন বছর ষোলোর, সদ্য মাধ্যমিক উত্তীর্ণ কিশোরী। আর উনি ছেচল্লিশ সাতচল্লিশ। টেবিলের এপাশে বসেছিলাম মন্ত্রমুগ্ধের মতো। ‘কি আছে আমার মধ্যে যার জন্য সব মেয়েরাই আমার শিকার হয়ে পড়ে’— এই ছিল তার জবাব আমার দ্বিধান্বিত বিস্ময়ের কাছে।

সম্পর্ক বলবো না, এই যোগাযোগ আমাকে অনেকটাই ওলট পালট করেছিল। বয়সের সাথে সাথে বুঝতে শিখেছিলাম খাদ্য খাদকের ইক্যুয়েশন। বয়স বাড়তে বাড়তে চিনতে শিখেছিলাম যৌনতার বহু পরিভাষা, মানুষ থেকে মানুষে যা বদলে যায়। অন্যের দিকে আঙুল তোলা খুব সহজ। কিন্তু মাঝে মাঝে নিজেকেও দেখতে হয় শব ব্যবচ্ছেদের মতো অ্যানাটমিক্যালি। মানুষ নিজের কাছে নিজেই সর্বাধিক অস্পষ্ট হয়ে থাকতে ভালোবাসে।

মাঝে মাঝে আমার মনে হতো, দেশের যৌনপল্লীগুলির পুনরুদ্ধার ও আপাদমস্তক সংস্কার প্রয়োজন। বিদেশে এ বিষয়গুলি যথেষ্ট স্পষ্টতার সাথে হয়। যা খুব স্বাভাবিক, যা ছাড়া মানুষ বাঁচে না তাই নিয়ে এত স্টিগমা কেন? কোথাও পড়েছিলাম, ভারতবর্ষে যৌন অপরাধ খুব বেশি হয় তার কারণ এদেশে সেক্সুয়াল স্টার্ভেশন খুব বেশি। কিন্তু অলিতে গলিতে গণিকারা যৌন পসরা খুলে বসলেই যে সমস্যা শতভাগ মুছে যাবে এমনটাও নয়। তার কারণ, যৌন চেতনা বা যৌনতা কেবল শারীরিক নয়, তার অনেক বেশি মানসিক, মনস্তাত্ত্বিক। তাই কেবল শরীরটুকু নিবৃত্ত হলে যাবতীয় বিকারের নিরসন সম্ভব নয়। মানুষের সবচেয়ে গভীর তলানিটুকু তার গ্লানি অসহায়তা জটিল থেকে জটিলতর কমপ্লেক্স যৌনতার মধ্য দিয়েই নিবৃত্তির পথ খোঁজে।

যৌনসুখ মানুষ তাই নানাভাবে নেয়। নানাভাবে অর্থে সর্বাঙ্গ দিয়ে। চরিতার্থতা আসে নানা উপায়ে। ছোট ছোট শিশুদের মধ্যেও মাস্টারবেশনের প্রবণতা দেখা যায়, তার কারণ যৌনতা শরীরে আসার অনেক আগে থেকেই থাকে মনের ভেতর সুষুপ্তির আড়ালে। বাসে ট্রেনে রাস্তা ঘাটে যেসব তথাকথিত ভদ্রলোকেরা বিপরীত লিঙ্গের গায়ে হাত দিয়ে যৌন চরিতার্থতা লাভ করে তার সবটাই যে স্টার্ভেশন থেকে আসে তা হয়তো নয়। ওভাবে ওটা করার মধ্যে দিয়ে যে আনন্দ তাকে আমরা `বিকৃত` বলি, কারণ ওটা কনসেন্সুয়াল নয়। স্ত্রীর কাছে, পরস্ত্রীর কাছে, কিংবা নিদেনপক্ষে গণিকার কাছে যে বিষয়টা সরাসরি পাওয়া যেতে পারে, সেটার জন্যও কেউ কেউ বয়সে অনেক ছোট প্রায় কন্যাসমা পাওয়ার ইক্যুয়েশনে নিচে থাকা নারীদের প্রভাবিত করে। এর কারণ নিজের ব্যক্তিত্ব মেধা প্রতিপত্তির প্রভাবে কাউকে মোহিত করে ফেলা, তারপর ভাবের ঘোরে তাকে নাকানি চোবানি খাওয়ানো, আস্তে আস্তে ভেজে ভেজে তাকে বিছানা অবধি আসার জন্য কাতরাতে দেখার যে জার্নিটা তার মধ্যেও এক লেডিকিলার সুলভ স্বর্গীয় সুখ আছে, যেটা বাজারে কিনতে পাওয়া যায় না।

এর মধ্যে কোনো যোগাযোগ যদি সম্পর্কে টার্ন নেয়, যদি প্রেম আসে নীরবে, সে অবশ্যই আলাদা ব্যাপার। প্রেম হলে মানুষ আর কম্প্রোমাইজ করে বাঁচে না। প্রেম হলে মানুষ সব তছনছ করে, কাঙ্ক্ষিতকে পাওয়ার জন্য দুনিয়া ওলট পালট করতে পারে। কোনো এক যোগাযোগ থেকে সম্পর্কে টার্ন নেয়া ইক্যুয়েশনে কোনো নারী যদি প্রশ্ন করে, ‘তবে আমার কি হবে? আমি কোথায় যাব?’, তবে ধরে নিতে হবে সেখানে প্রেমের আভাস ছিল। সেখানে নিছক যৌনতার অতিরিক্ত চাওয়া-পাওয়ার দাবি ছিল, এবং সেসব চাহিদাগুলি নিবৃত্তি না হওয়ার অভিমান তথা রাগে যদি কেউ অপরপক্ষের দিকে আঙুল তোলে তবে মাথা তো নত হওয়ায়ই কথা। কিন্তু আমি বুঝবো এটা নিছক যৌন নিপীড়নের ঘটনা নয়, সেটা হলে আওয়াজ ওঠার কথা অনেক আগেই।

যৌনতা এমনই এক বিষামৃত, যা মেপে খেলে অমৃত আর বেশি খেলে বিষ। এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, দোষ তবে কি একা পুরুষের? যদিনা উল্টোদিকের মানুষটি মাইনর হয় এবং যদি না থাকে জোর খাটানোর প্রশ্ন, তবে দোষ কখনোই কেবল পুরুষের নয়। আর যেখানে দোষ একা কারোর ওপর বর্তায় না, সেখানে একে দোষ বলা যায় কিনা সেও এক প্রশ্ন বটে। আমার বিশ্বাস, সমাজের মধ্যে পাওয়ার ডায়নামিক যত শিফ্ট হবে, ‘সম্পদের অধিকার’ যখন পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও একই শ্লাঘার সাথে ভোগ করতে থাকবে তত বোঝা যাবে যে, এই খাদ্য-খাদকের রোল প্লেয়িং কোনো বিশেষ লিঙ্গের সাথে আনইকুইভোকালি অ্যটাচড নয়। মানুষের প্রবণতা আসলে সঞ্চয়ে, শরীরের সঞ্চয়ে, বস্তুর সঞ্চয়ে এবং এই সঞ্চয়ের প্রবণতা লিঙ্গ নিরপেক্ষ। কেবল প্রেম যা মৃগনাভির মতো উবে যায়।

আমি শুধু প্রেমের কাছেই আত্মসমর্পণ করেছি। ‘না আসলে দেখে নেব কেমন রেজাল্ট করো’ এমন হুঙ্কার আমিও শুনেছি। না যাওয়ার মূল্যও চোকাতে হয়েছে। কিন্তু ভয়ের কাছে নিজেকে সমর্পণ করিনি। বহু বছর পর একদিন সন্ধ্যার পথে দেখলাম তাকে । তার কথা লিখেছিলাম `ভূত বিলাসের ঘর` এ। আমি ছিলাম গাড়িতে। সে পথে। গাড়ির কাচের ভেতর থেকে দেখেছিলাম, কয়েক মুহূর্তের জন্য আমার প্রাচীন ইংরেজি মাস্টারের দৃষ্টি আমার ওপরেই স্থির হয়েছিল, কী ভীষণ তীক্ষ্ম! ঠিক যেন টিকটিকির চোখ ঈষৎ অসাবধানতা বশত শিকার হতে হতে ফসকে যাওয়া ফড়িংটার দিকে চেয়ে আছে...

আমরা শুধু ফ্যাক্টসগুলো জানি। ঘটনাগুলো নির্দিষ্ট, গল্পটা নয়। গল্পটাই হলো লেখকের অবজার্ভেশন, গল্পটাই হলো লেখকের চেতনা, আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে লেখক যা নির্মাণ করেন। দুজন লেখকের হাতে একই ঘটনা দুরকম গল্প হয়ে ফিরে আসে। একই ব্যক্তি কারো গল্পে ভিলেন তো কারো গল্পে ট্র্যাজিক হিরো। তাকে শেষ অবধি জানার বোঝার ও অধ্যয়ন করার ধৈর্য সাধারণ মানুষের কাছে নয়, লেখকের কাছে অবশ্যই কাম্য।

ক্ষমতা মানুষকে রাক্ষস বানায় না। ক্ষমতা মানুষের অন্তর্গত যা কিছু তাকেই উন্মোচিত করে। চেয়ারে কে কিভাবে বসবে ধ্যানাসনে না ঠ্যাংয়ের ওপর ঠ্যাং তুলে, সেটা সেই মানুষটির নিজস্ব বোধ, ক্ষমতায় না থাকলেও তার ভেতরে যা ছিল এবং থাকবে, পার্থক্য শুধু এটুকুই ক্ষমতা তাকে মূলত দ্বিধাহীন করে তোলে।

অতঃপর ক্ষমতা যে মানুষকে দুরাচারী বানায়, এমন নয়। বানায় সে, যে তার মনের ঘরে বসত করে। আমি এমন অনেক কেল্টু বিল্টুকে চিনি যারা কোনো ক্ষমতায় নেই। কিন্তু খিদে অপার। এদের রিচ কতটুকু? ওই পাড়ার মিষ্টু বৌদি, আপিস কলিগ কিংবা অধুনা সোস্যাল মিডিয়ার দৌলতে পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনার মতো কিছু অসংগত প্রেমালাপ। দৈবাৎ যদি কিছু ঘটে যায় সে তো মেঘ না চাইতে জল। এই ধরনের কেল্টু বিল্টু যদি আপন মহিমায় কেষ্ট বিষ্টু হয়ে ওঠে, তবে কি তারা বদলে যাবে? চেয়ার তাকে বদলে দেবে? তবে তো চেয়ারকেই প্রণাম করতে হয়, মানুষকে নয়। এমন মানুষেরা সমাজের যে স্তরে যাবে যে কাজের সাথে যুক্ত হবে সেখানেই কেয়ামত করবে। সে যদি সমাজের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলোর মধ্যে একটিও হয় তবেও তার প্রবণতা আপন স্বভাবে নিজ লক্ষ্যভেদে বয়ে যাওয়ার দিকেই থাকবে। আমরাই বা সমাজের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলোর জন্য মানুষ নির্বাচন কিভাবে করি? সেখানে যোগ্যতম মানুষটিকে বেছে নেয়ার জন্য তার মানবিক মূল্যবোধ তার মানসিক ভারসাম্যের পরীক্ষা নেই কি? নেই তো কিছু সার্টিফিকেট। আর কিছু প্রশ্নের উত্তর, মানুষটির তথ্যভিত্তিক জ্ঞানের বাইরে যে মূল্যায়নে আর কিছুই উঠে আসে না। সততা, সংযম, সহমর্মিতা এসব সত্যিই খুব বড় গুণ। এ সমাজে আপনি কত শতাংশ মানুষের কাছে এগুলো আশা করেন। আপনি একেবারে নিশ্চিত যে পরীক্ষা অনিবার্য হলে এই সকল মূল্যবোধের পরীক্ষায় আপনি নিজেও উত্তীর্ণ হবেন। মনে মনে অনেকেই অনেক কিছু চায়। সবাই সুযোগ পায় না। সামনে সুযোগ এসে হাত বাড়ালে বোঝা যায় কে কত বড় মুনি ঋষি।

এবার এই প্যারাটি মন দিয়ে পড়ুন। শুনুন আমিও এটাই চাই যে, কোন ক্ষেত্রে যোগ্যতমের ঊর্ধ্বতন হোক, সে হোক শিক্ষায় অথবা শিল্পে। আমি কোনো প্রফেসরকে তোষামদ করে শিক্ষা ক্ষেত্রে ডিগ্রি নেইনি। শুধু নেইনি নয়, নেয়ার কথা ভাবিওনি। কোনো পত্রিকায় কবিতা ছাপাবো বলে কারোর সাথে ছেনালিপনা করিনি। কোনো পুরস্কার হাতানোর জন্য কোনো কবির সাথে শুইওনি। তাই সত্যকে সত্য আর মিথ্যাকে মিথ্যা বলতে আমার কোনো দ্বিধা নেই। আইনে এমন কোথাও লেখা আছে কি যে, কোনো শিক্ষক এবং ছাত্রীর মধ্যে যৌন সম্পর্ক নিষিদ্ধ যদি তা মিউচুয়াল কনসেন্টে হয়? কিংবা একাধিক যৌন সম্পর্ক নিষিদ্ধ? অথচ এই সমাজেই আমরা আইন করে বিবাহ নামক একটি মনোগ্যামি প্রতিষ্ঠানকে রীতিমতো দুবেলা ধূপ ধুনো দিয়ে পুজোও করছি। তার মানে, হিপোক্রিসি এই সিস্টেমের গোড়াতেই। সমাজের নামে আমরা আসলে একটা ডাবল স্ট্যান্ডার্ড লাইফ কাটাচ্ছি। এই হিপোক্রিটিক্যাল সমাজতন্ত্রের মধ্যে নিজেকে টিকিয়ে রাখার জন্য আমরা নিজেদের মতো করে বেশ কিছু অলিখিত স্ট্যান্ডার্ডও সেট করেছি, যেগুলো হলো মরালিটি, নৈতিকতা, সোস্যাল লাইসেন্স ইত্যাদি। আর এসবের ওপরেও একটা জিনিস থাকে, সে হলো মানুষের নিজস্ব শুভবোধ। কিন্তু আন্ডার দ্য টেবল যে এগ্রিমেন্ট হয়ে যাবে সেগুলো আমি বা আপনি কি করে ঠেকাবো? ঠেকাতে পারিনি কোনোদিন, কারণ দেয়া-নেয়াটা এসব ক্ষেত্রে মিউচুয়াল হয়। তাহলে হৈ চৈ কখন হয়? হয় তখনই যখন অলিখিত চুক্তিতে থাকা একজন ব্যক্তি তার সুবিধামতো শর্তগুলো থেকে বঞ্চিত হয় অথবা তার পাওনাগণ্ডা না আদায় করতে পারে। সুতরাং যা বোঝা গেল এই ধরনের লোচা না হওয়া অবধি সব কিছুই সুন্দরভাবে সামলে নেয়া যায়, পিএইডি থেকে পুরস্কার অবধি। এইভাবে অনেকটাই ছিনিয়ে যায়, অন্যায্যভাবে। বঞ্চিতও করা যায়। কিন্তু ঠিক কতটা?

যৌনাস্ত্রকে ব্রহ্মাস্ত্র বানিয়ে শিক্ষাক্ষেত্রে কিছু কিছু মানুষকে সুবিধা নিতে দেখেছি বৈকি। কিন্তু কেবলমাত্র ওই পথ অবলম্বন না করার দরুণ শূন্যে পৌঁছে গেছে, এমনটা কি হয়! কবিতার জগতেও নিজেকে ব্যবহৃত হতে দিয়ে বেশ নাম কামিয়েছে কেউ কেউ। কিন্তু তাদের কবিতাগুলো পড়লেই বোঝা যায়, কিস্যুটি হয়নি। আর যে ও পথ মাড়ালো না, হয়তো পেলো না কিছু পুরস্কার, কিন্তু চাইলে তার অনির্বচনীয় সৃষ্টির হাত কে কেড়ে নিতে পারে? অন্যায়ের প্রতিবাদ হোক। হতেই হবে। শিক্ষাক্ষেত্রে আঁতাত কখনোই মেনে নেয়া যায় না। কিন্তু তাই বলে পৃথিবীর যাবতীয় অশুভ ধুয়ে মুছে ফেলা যাবে না। সেগুলো নিয়ে আতঙ্কিত হয়ে পড়লেও চলবে না। সব কিছুর পরেও একটা রাস্তা থাকে, নিজের মতো করে হেঁটে চলার, মাথা উঁচু করে।

লেখক: কবি ও কথাসাহিত্যিক