শ্রেয়া চক্রবর্তীর উপন্যাস ‘বেহেস্ত’

পর্ব ৩

প্রকাশিত : অক্টোবর ১০, ২০২০

বেহেস্তের নিজস্ব একটি রং আছে। রাত ঠিক যে সন্ধিক্ষণে ভোর হয়ে প্রকাশিত হয়, অন্ধকার থেকে আলোয় বিগলিত হওয়ার মুহূর্তে সূর্যের বিচ্ছুরিত ওম লাগা তার যে ঈষৎ বিষণ্ণতায় মোড়া অথচ দীপ্তিমান বিভা, বেহেস্তেরও যেন ঠিক তাই। এ শহর মানুষকে বেঁচে থাকার মতো আশান্বিত করে তোলে। যেমন সে করেছে আমাকে। বহুদূর থেকে নিজের পরিচিত জগতের সাথে যাবতীয় যোগসূত্র বিচ্ছিন্ন করে এই যে এসেছি আমি কেবল আমার বালিকাকে নিয়ে, নতুন জীবনের সাথে ঘনিষ্ঠ হতে কোনো দ্বিধা সে রাখতে দেয়নি আমাকে। আমার একলার এই যে সামান্য জীবন তার সাথে দিব্য খাপ খাইয়ে নিয়েছি আর ছুটে চলেছি আরও প্রগাঢ় আরও অর্থবহ কোনো এক বেঁচে থাকার দিকে।

অনেক সকাল সকাল ঘুম ভাঙে আমার। মিশ্মিকে না জাগিয়েই চা বসাই অভেনে। তারপর এসে দাঁড়াই জানলার পাশে। পর্দা সরিয়ে দেখি বহুদূরে পাহাড়ের রেখা। দু’একটি মানুষ আমারই মতো সদা জাগরণের বিভ্রমে বিছানা ছেড়ে তখনই নেমে পড়েছে রাস্তায়। দৃষ্টি বিনিময় হলে কেউ কেউ হেসে জানান দেয় সকালের সম্ভাষণে। চা খেয়ে স্নান সেরে মিশ্মিকে জাগানো আমার কাজ। তার সুখস্বপ্ন ভঙ্গ হয়। ওইটুকু মেয়েকে দুধের বোতলসহ ক্রেজে দিয়ে রওনা হই আমি আরেকটি সূর্যাস্ত বেলায় ফিরে আসব বলে।

এমনই একদিন ফেরার সময় ট্রেন মিস হলো আমার। সরাসরি ক্যাব ধরলাম ডাউন টাউনের। দীর্ঘ এক পথ। গাড়ি হাইওয়ে ধরে চলতে লাগলো। ক্যাবের জানলার কাচ নামিয়ে আমি ফুরফুরে হাওয়ার প্রবেশ পথ করে দিলাম। আমার চুল অবিন্যস্ত হতে লাগলো। অন্ধকার ভেদ করে অতিদ্রুত এগোচ্ছে গাড়ি। দূরে দৃষ্টি যতদূর যায় অনুমেয় মানুষের বসতি বিশেষ নেই। কিছুদূর পরপর গ্যাস স্টেশন আর মোটেলের আলোগুলি নিষ্প্রাণভাবে জ্বলছিল। তখনো ভাবতে পারিনি নতুন শহরে কি বিপদের সম্মুখীন হতে চলেছি আমি।

হঠাৎ ব্রেক দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো ক্যাব। ক্যাব ড্রাইভার এক মধ্যবয়সী লোক ক্যাবে ওঠার সময় তাড়াহুড়োয় যার মুখটাও আমি ঠিকভাবে দেখিনি, এবার চকিতে আমাকে প্রাথমিক বিস্ময় প্রকাশের সুযোগটুকু না দিয়েই একটি তীক্ষ্ম ফলা ছুরি আমার চোখের সামনে নাচাতে নাচাতে বললো, টাকা-পয়সা যা আছে, দিয়ে দাও।

লোকটি সম্ভবত ড্রাঙ্ক ছিল। আমি যথেষ্ট ভয় পেয়েছিলাম, কিন্তু সেটা লোকটিকে বুঝতে না দিয়েই ব্যাগ থেকে পার্স বের করে তার হাতে দিয়ে দিলাম। এই অপরিচিতের শহরে আত্মরক্ষার্থে আর কী করতে পারি, বুঝে উঠতে পারলাম না। ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে সেদিনই আমার স্যালারি হয়েছে। কিন্তু লোকটি কি স্টকার? মনে পড়লো, এখানে ক্যাব নেওয়ার আগে ড্রাইভারদের রেজিস্ট্রেশন নম্বর কনফার্ম করতে হয়, কিন্তু আমি তা করিনি। এর মধ্যেই লোকটি ক্যাবের দরজা খুলে আমাকে নেমে যেতে বলে। ক্যাব দাঁড়িয়ে ছিল হাইওয়ের ধারে। আমি চুপচাপ নেমে যাই। আমার সামনে দিয়ে হুঁশ করে উধাও হয়ে যায় ক্যাবটি।

কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকি ভয় ও বিস্ময় মিশ্রিত এক অদ্ভুত শূন্যতার ভেতর। এতখানি পথ কিভাবে অতিক্রম করবো একা? কি করে পৌঁছবো মিশ্মির কাছে? আবার মেয়েকে দেখতে পাব তো? ভাবতে ভাবতেই হাঁটতে শুরু করি। হাঁটতে হাঁটতে মন চলে যায় অতীতের একদিনে।

কোম্পানির এক উচ্চপদস্থ অফিসার ফ্রিতি নদীর ওপারে এক বাংলোতে একা থাকত। তার রাতের খাবার যেত বাবুজীর রেস্তরাঁ থেকে, রোজই পৌঁছে দিত রুশি, যে ছেলেটি বাবার সাথে রেস্তরাঁয় কাজ করতো। সেদিন কোনো কারণে সে আসেনি। বাবুজী আমাকে বললেন খাবারটা পৌঁছে দিয়ে আসতে। বিকেলের দিকে আমি রওনা দিলাম। যে লোকটিকে ডেলিভারি দিতে যাচ্ছিলাম তার নাম মিস্টার ওনাম। কাঠের সেতু টপকে অনেকটা পথ হেঁটে মিস্টার ওনামের বাংলোর কাছে যখন পৌঁছলাম তখন আসন্ন সন্ধ্যা। বেল বাজাতেই দরজা খুলল এক মধ্যবয়সী লোক। জিজ্ঞাসা করলাম, আপনি মিস্টার ওনাম?

লোকটা হেসে ঘাড় নাড়ল।
আমি খাবারের ক্যারিয়ারটা এগিয়ে দিতে সে আমাকে ভেতরে ডাকল। আমি ইতস্তত করে বললাম, এক গ্লাস জল হবে?
অনেকটা পথ হেঁটে এসেছি, পিপাসা পেয়েছিল। আমি ভেতরে ঢুকতেই লোকটা দরজাটা বন্ধ করে দিল। টেবিলের ওপর একটা জলের জগ রাখা ছিল। আঙুল দিয়ে ইশারা করে সেদিকে দেখালো। আমি খুব সঙ্কোচের সাথে সেদিকে এগোচ্ছি এমন সময় অতর্কিতে আমাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো লোকটা। আমি তাকে ছাড়ানোর জন্য এক ঝটকা দিতেই আমাকে ঠেলে মেঝেতে ফেলে আমার ওপর চড়ে বসলো আর আমি আত্মরক্ষার জন্য প্রচণ্ড চিৎকার করতে শুরু করলাম। কিন্তু ওনামের বাংলোর এক কিলোমিটারের মধ্যে কোনো জনবসতি নেই। কাজেই এই অকূল পাথারে আমাকে বাঁচাতে যে কেউ আসবে না তা আমি বুঝেছিলাম।

লোকটা যখন পশুর মতো আমার মাংস খুবলে খেতে উদ্যত, দাঁত দিয়ে ওর কানটা কামড়ে ধরেছিলাম। সে কামড়ে এত বিষ ও তীক্ষ্মতা ছিল যে, কান দিয়ে গলগল করে রক্ত বেরোতে লাগলো। যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে লোকটা তখন আমার ওপর থেকে নেমে পড়েছে। আমি কোনোরকমে উঠে দরজা খুলে দৌড়তে শুরু করলাম। কতদূর দৌড়েছিলাম, মনে নেই। জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যাওয়ার আগে দেখেছিলাম কোনো এক গাড়ির হেডলাইটের আলোয় চাপ চাপ অন্ধকার ধাঁধিয়ে উঠছে, আর সেই আলোর ভেতর থেকে কেউ একজন এগিয়ে আসছে আমার দিকে।

অতীত চারণার নেশায় বুঁদ হয়ে হাইওয়ে ধরে হেঁটে চলেছি যখন উদভ্রান্তের মতো, ঠিক সেই সময় পাশ থেকে কেউ একজন কানের কাছে বলে উঠলো, লিফ্ট?

আমার যেন সম্বিৎ ফিরলো। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম পাশে এসে দাঁড়িয়েছে একটি গাড়ি। উইন্ডোর কাঁচ নামিয়ে এক জোড়া জিজ্ঞাসু চোখ আমার দিকে তাকিয়ে আছে। এক মুহূর্তের জন্য মনে হলো, স্টিয়ারিং এ যে বসে আছে, অন্ধকারে অচেনা শহরের রাস্তায় পথ হারানো মেয়েকে ঘরে পৌঁছে দেওয়ার জন্য এসেছে যে, সে আর কেউ নয়, সে আমার জুমেরান। জুমেরানের জন্য সেদিনও আমার হৃৎপিণ্ড সেই প্রথম দিনের মতোই স্পন্দিত হচ্ছিল। আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো গাড়িতে উঠে পড়লাম। চলবে