সমাজের কে কী কইলো সবটারে উষ্টা মাইরা ফালায়া দেন

জগলুল আসাদ

প্রকাশিত : আগস্ট ০৩, ২০২০

আপনি দেখবেন, ঈদ এলেই বা ধর্মীয়ভাবে তাৎপর্যপূর্ণ কোনো দিন এলেই ‘অতিপ্রগতিপন্থি’ বন্ধুরা আপনেরে ‘সঠিক’ পথ দেখানোর একটা ‘মহান’ দায় বোধ করবে। যেমন, ঈদ এলে বলবে, বনের পশুর (আসলে, কোরবানি দেয়া হয় গৃহপালিত পশুকে) চেয়ে মনের পশুরে কোরবানি দ্যান। পশু কোরবানিতে তারা দেখতে পাবেন রক্তারক্তি ও আদিম অসভ্যতা। অথচ ভোগবাদীতায় তাড়িত এলিট সমাজকে তৃপ্ত করতে রুদ্ধ কক্ষে প্রতিদিন বিশ্বব্যাপী কোটি কোটি প্রাণীকে ইন্ডাস্ট্রিয়ালি সহিংস উপায়ে নানা কিসিমের খাবারে রূপান্তরিত করা হয়, আমাদের গোচরে বা অগোচরে। সারা বছর মাংসের হাড্ডি চিবাইয়া কোরবানি ঈদে তারা দেশের প্রাণিজ সম্পদ নষ্ট হওয়ার আর প্রাণীকে কষ্ট দেয়ার বুলি ঝাড়বেন। রমজান এলে ইফতারে বা সাহরিতে তারা দেখবেন ভোগবাদিতা। পত্রিকায় তারা রিপোর্ট করবেন, ফাস্টিং না ফিস্টিং?

মনে রাখবেন, আপনি একমাত্র আপনার দ্বীনি অবস্থান থেকেই ‘তাযকিয়ায়ে নাফস’ (মনের পশুরে কুরবানি!), কানায়াত (অল্পে তুষ্টি), মুহাব্বাতে খালক (সৃস্টির প্রতি ভালবাসা), হক্কুল ইবাদের (জীবের/প্রাণের প্রতি দায়িত্ব) সিফত (গুণাবলি) অর্জন করতে পারবেন। তারপরও আপনেরে কিন্তু শুনতে হইব, আপনিও লোভি, পরকালে হুর আর সূরা পাওয়ার লোভে ধর্মকর্ম করেন। আপনি যদি জিকির-আযকারে লিপ্ত থেকে দুনিয়াবিমুখ হন, তখন এই শ্রেণি কইবে, এই মুসলমানেরা দুনিয়ার অনুপযুক্ত, এদের সামাজিক কোনো ভূমিকা নাই। কিন্তু পাশাপাশি যখন আপনি রাষ্ট্র ও সমাজের মধ্যে আপনার হিস্যা চাইবেন, সমাজ-রাষ্ট্র নিয়া কথা কইবেন, তখন আপনাকে শুনতে হবে, আপনি দুনিয়াদার হয়া গেছেন। সুতরাং, নিজের কাজকে শুধু কুরান-সুন্নাহ দিয়া মাপতে হইবো। সমাজের কে কী কইলো সবটারে উষ্টা মাইরা ফালায়া দেন!

সো, আপনি আপনার ধর্মকর্ম নিয়া শরমিন্দা থাইকেন না। যে আপনার দ্বীনকে ওউন করে না তার কওন ও বলন দিয়া নিজেরে না মাপি! বলুন, মুসলমান বলিয়া লজ্জা নাই। ইমানের ঘোষণায় দৃঢ়তা চাই। কোন হীনমন্যতা চলবে না। ‘তাহাদের দ্বীন` আপনি গ্রহণ না করা পর্যন্ত সমালোচনা কিন্তু থামিবে না।

কোনো হাইজিন-বিশারদের বয়ানে না, ‘পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ইমানের অঙ্গ বা ইমানের অর্ধেক’ হাদিসে নববির এই চেতনায় কুরবানির পর রক্ত পরিচ্ছন্ন করি যেন, কুরবানীস্থলের দুর্গন্ধ দূর করি যেন দ্রুত। পরিবেশকে পরিচ্ছন রাখা ও অপরের কষ্টের কারণ না হওয়া আমাদের সম্পূর্ণতই ইমানি দায়িত্ব। কারও চাপিয়ে দেয়া পশুপ্রেমের বা পশুঅধিকারের ন্যারেটিভ মেনে পশুর প্রতি দয়ার্দ্র হই না আমরা। নবিজির এই কওল, ‘যখন যাবেহ করবে তখন দয়ার সঙ্গে যবেহ করবে। তোমাদের সবাই যেন ছুরি ধারালো করে নেয় এবং তার যাবাহকৃত জন্তুকে কষ্টে না ফেলে।’ আমাদেরকে নির্বাক প্রাণের প্রতি রহমশীল করে, তাকে কষ্ট দিয়ে হত্যা না করতে অনুপ্রাণিত করে। লিবারেল সেকুলার সোসোইটির কোন ভাবাদর্শ, অধিকারের অন্যকোন বিবরণী দ্বারা প্রভাবিত হয়ে মুসলমান পশুপ্রেম বা মানবপ্রেম প্রদর্শন করে না। মুসলমানদের স্বয়ংসম্পূর্ণ দ্বীনিব্যবস্থা আছে, যা পূর্ণ, যার নীতিমালা অপরিবর্তনীয়, যা আল্লাহ সুবহানাহুতায়ালা প্রদত্ত।

আরেকটা কথা, ধর্মের পরমার্থিকতাকে নষ্ট কইরেন না,খালি সব কিছুর সামাজিক তাৎপর্য খুঁজবেন না। নিজের হৃদয়ের দিকেও নজর দিই । রিচুয়াল বা আচারকে তুচ্ছ মনে করবেন না, রিচুয়ালের শক্তি আছে। দিল দিয়ে রিচুয়ালগুলো পালন করি যেন। তাছাড়া, এমনিতেই প্রতিটি ইবাদতের সামাজিক বাই প্রোডাক্ট আছে। আলাদা করে অলয়েস এটা নিয়ে না ভাবলেও চলবে, যদিও ভালো বামপন্থী বা গুড সেকুলাররা আপনেরে সমাজ দেখাইবো শুধু। বাট, খুব গুরুত্বপুর্ণ হচ্ছে এই বোধ যে, আপনার সামাজিকতা আপনার আধ্যাত্মিকতারই অংশ। প্রাণ, প্রকৃতি, মানুষের প্রতি আপনার দায়িত্ব আপনার স্পিরিচুয়ালিটির পার্ট।

কোরবানির ঈদের একটা তাৎপর্য হচ্ছে, সৎকর্মকে শুধু স্মৃতি করে না রেখে কর্মের ধারাবাহিকতায় সেটাকে উৎযাপন। ঈব্রাহীমের (আ.) ত্যাগের স্মৃতিকে সকলে মিলে পশু কোরবানির মাধ্যমে উদযাপন করা হয়। ইব্রাহিম (আ.) নিজের প্রিয় জিনিস, অর্থাৎ তার সন্তানকে কোরবানি দিতে গিয়েছিলেন। পরে সেটা পশু কোরবানি দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়। এটার প্রতীকী মানে আছে বটে। কতটা ‘প্রিয়’কে আমরা ত্যাগ করতে পারলাম, কতটা ত্যাগ হলে আপনার আমার কিছুটা ত্যাগ হয়, এ সবই ইবাদতের বিবেচ্য বিষয়। সুরা হজ্জে তো বলাই হয়েছে, কোরবানির রক্ত মাংশ খোদার কাছে পৌঁছায়না, পৌঁছোয় শুধু তাকওয়া (খোদার সন্তুষ্টি পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা বা খোদাভীতি)। তার মানে, এ জগৎ শুধু কাজটাই দেখে, দৃশ্যমান ফলাফলটাকেই বিবেচনা করে। দুনিয়া আপনার মোটাতাজা গরুটাকে দেখে, কিন্তু খোদাই শুধু দেখেন আপনার আমার হৃদয়ের অবস্থাটুকু, নিয়তের হালতটুকু। দুনিয়া দেখে ‘জাহির’কে, আর খোদা দেখেন তা-ই যা অগোচরে থাকে সকলের, পুলিশের, সমাজের বা রাষ্ট্রের।

জগৎ শুধু দ্যাখে কর্ম ও কর্মের ফলটুকু, আল্লাহতায়ালার নজর কর্মের উদ্দেশ্যর দিকে, যা হৃদয়ের পরিমণ্ডল। ‘নিয়ত’ জানা জগতের অসাধ্য, বেশিরভাগ সময় অপ্রয়োজনীয়ও বটে। কিন্তু আল্লাহ দেখেন অন্তর ও কর্মের লক্ষ্য। নিয়ত গুণেই কর্মের বিচার (ইন্না মা’আল আমালুবিন্নিয়াত)। এ হাদিস ইসলামের মর্মভাবের অতুলনীয় প্রকাশক। কর্মের ফল দেখবে, বিচার করবে জগৎ; আর কর্মের উদ্দ্যশ্য দেখবেন আল্লাহতা’য়ালা। কোরবানিতে নিয়তের এই পরিশুদ্ধির চর্চা হয়!

আল্লাহ দেখেন ত্যাগের অনুভুতি ও তাকওয়া, এই বোধ তৈরি করে নতুন মানুষ। এই জাদীদ মানুষই তৈরি করবে নতুন সমাজ, মানবিক ও ইনসাফপুর্ণ। ইসলামের জাগতিক প্রত্যাশা এই। আর, ইহজগতের শস্যক্ষেত্রকে আল্লাহতায়ালার নির্দেশ মোতাবেক আবাদ করলেই সুফল পাওয়া যাবে পরকালে।