সরকার আবদুল মান্নানের স্মৃতিগদ্য ‘ঘুড়ি ওড়ানোর দিনগুলো’

প্রকাশিত : জুন ১১, ২০২০

বায়না ধরলাম, ঘুড়ি কিনে দিতে হবে। মাকে জ্বালাতন করছি। চিৎকার-চেঁচামিচি করছি। লাল রঙের একটি ঘুড়ি চাই-ই চাই। মা লাঠি হাতে দৌড়ানি দেন। তখন একটু দূরে যাই। আবার কাছে আসি। মার শাড়ি ধরে টান দিই, টানাটানি করি। মা ত্যাক্ত-বিরক্ত হয়ে ওঠেন। বলেন, আমি টেহা পামু কইথিকা। যা, তোর বাপেরে ক । ঠাহুরের কাছে যা।

বাবার কাছে যাই না, যেতে হয়ও না। মা কোথা থেকে ছআনা পয়সা এনে দেন। তাই দিয়ে প্রথম ঘুড়ি কিনি। বামের বাজারে ঘুড়ির দোকান আছে কিনা, জানি না। কিন্তু প্রতিবেশী খলিল ভাইজুর দোকানে এই সময় ঘুড়ি থাকে। খলিল ভাইজুর সংক্ষিপ্ত নাম খাইল্লাইজু। চৈত্র মাস থেকেই খইল্লাইজু, তার স্ত্রী কাঞ্চন বুবু আর তার বড় ছেলে জাহাঙ্গীর বিচিত্র রঙের কাগজ দিয়ে ঘুড়ি বানায়। চার আনা থেকে তিন টাকা পর্যন্ত দামে বিক্রি হয় প্রতিটি ঘুড়ি। বানানোর সময় দেখায় না কাউকে। ঘরের ভিতরে বসে বসে চলে ঘুড়ি বানানোর কাজ। দোকানে গিয়ে আমরা প্রতিদিন নতুন ঘুড়ি ঝুলতে দেখি। আর ভাবি, এত নতুন ঘুড্ডি আইয়ে কইত্তিগা।

মার দেয়া ছয় আনা পয়সা নিয়ে খইল্লাইজুর দোকানের দিকে ছুটলাম। মাটিতে পা লাগে না যেন। কিন্তু যাওয়া এত সহজ নয়। পথে মানিক ভাই খপ করে ধরে ফেলল।
যাস কই? আত কী?
বললাম, মাইনদা, ছাইড়া দেন। ঘুড্ডি কিনুম।
ঘুড্ডি কিনবি  পইসা পালি কই?
মায় দিছে।
চল। তোরে ঘুড্ডি কিন্না দেই। ভালা দেইখ্যা কিন্না দিমু।

আমি চিৎকার চেঁচামিচি করতে লাগলাম, আমনের কিন্না দেওন লাগব না। আমিই পারমু।
মাইনদা ডাকাত। ঘুড়ি কেনার নাম করে সোজা মেরে দেবে এক পয়সা বা দুই পয়সা। আর সেই পয়সায় পাতার বিড়ি কিনে খালের পাড়ে বসে বসে টানবে। আমি তারে চিনি। বললাম, বিড়ি খাইবেন, না? জেডারে কইয়া দিমু।
কাজ হলো। ছেড়ে দিয়ে বলল, যা ঘুড্ডি কিনগা। ভালা দেইখ্যা কিনিস।
ছাড়া পেয়ে আবার দৌড় দিলাম। সোজা গিয়ে পৌঁছলাম খইল্লাইজুর দোকানে।

দোকানে গিয়ে আমি অবাক। অনেক রকমের ঘুড়ি। কোনোটা বিশাল আকৃতির। মাথায় ধনুক লাগানো। নাম ডাউশ ঘুড়ি। কেউ কেউ বলে ডাব্বুশ ঘুড্ডি। ভয়ে ভয়ে খইল্লাইজুর জিজ্ঞাসা করলাম, খইল্লাইজু, ওইডার দাম কত?
বাঁশি লাগাইন্যা ডাব্বুশডার?
হ।
ওইডার তো অনেক দাম, তিন টেহা।
পিলে চমকানোর অবস্থা আমার। ছআনা পকেটে নিয়ে তিন টাকার ঘুড়ি স্বপ্নে দেখাও ঠিক না। এক এক করে ঘুড়ির খোঁজ নিতে লাগলাম খইল্লইজুর কাছে। তিনি খুবই সদাসয় মানুষ। আমাদের আদর করেন খুব। পাট, পয়সা, কাচের বোতল, লোহার টুকরো এই সব ছাড়াই কখনো কখনো কটকটি গুরের সামান্য টুকরো, কাঠি লজেন্স কিংবা এক মুট বাদাম, ছোলাভাজা, বুটভাজা হাতে তুলে দেন হাসিমুখে।

ঘুড়ি নিয়ে এত খোঁজখবরে খইল্লাইজু বিরক্ত হন না। উৎসাহবোধ করেন। ঘুড়ি বিষয়ে তিনি যে খুবই জ্ঞানী সেটা জানানোর লোক পাওয়া গেছে। খুব প্রশান্তির সঙ্গে বিড়িতে টান দিয়ে বললেন, জানো ছোট ভাই, এই ঘুড্ডিটা অইল পইখের বাচ্চা, পঙ্খি। চিল যেমনে আসমানে ওড়ে মাডির দিকে চাইয়া চাইয়া, ঠিক হেইরম ওড়ে। আর এইডা অইল হাপ। বিশাল লেঞ্জুর। যখন ওড়াইয়া দিবা, তহন লেজ ছুঁইব মাটি আর সে যাইব শূন্যে। আস্তে আস্তে উপরে উঠব লেজ। আর আকাশে লেজটারে মনে অইব বিশাল একটা হাপ— শইলে ঢেউ তুইল্যা তুইল্যা চলতাছে। দাম তিন ট্যাহা। আর ওই যে পাশে, ওইডার নাম কানা পঙ্খি। ওড়নের সময় কোনো দিকে চায় না। খালি ওড়ে আর ওড়ে। ওইডার দামও তিন ট্যাহা। কোনডা নিবা?

আমি খুব হতাশ হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, ছয় আনা দামের নাই, খইল্লাইজু?
আমার হতাশাকে শূন্যে ওড়িয়ে দিয়ে ঠোঁটের কোনো হাসি ঝুলিয়ে খইল্লাইজু বললেন, আছে ছোট ভাই, আছে। সবইতো চার-ছয় আনা দামের। খাড়াও, দিতাছি, বলে তিনি বাক্সের পিছন থেকে ঘুড়ির একটি স্তূপ হাজির করলেন আমার সামনে। এই নেও। কোনডা নিবা?

স্বপ্নের মতো সুন্দর ঘুড়িগুলো। কত যে বিচিত্র রঙের, তার ইয়ত্তা নেই। লাল, নীল, হলুদ, সবুজ। আর এই সবগুলো রং এক সঙ্গে থাকায় রং আর রঙের ছায়াগুলো মিলেমিশে অসংখ্য রঙের আভা তৈরি করেছে। তার সঙ্গে আছে মেটো ও হালকা হলুদ রঙের বাঁশের চিকন চিকন কঞ্চি— লম্বাকারে এবং ধনুকের মতো। আছে ঘিয়ে রঙের সুতার বাঁধন, উড়ানোর ব্যবস্থা। খাইল্লাইজুকে বললাম, সুন্দর। সবগুলি সুন্দর।

খইল্লাইজু ঠোঁটের কোণে হাসি মাখিয়ে বললেন, তয় কোনডা নিবা ভাই, নেও। আমি লাল রঙের ঘুড়িটি নিয়ে সুতার মাথায় ধরে মাপজোখ পরখ করে নিলাম। হ, চলব। খইল্লাইজুর হাতে ছয় আনা পুরে দিয়ে এক দৌড়ে বাড়ি পৌঁছলাম। এর মধ্যেই জুটে গেল হান্নান, নবু, গফুর, প্রভাতি, রহিমা, রুশু।

আমার গুরুত্ব বেড়ে গেল মুহূর্তে। গফুরের ঘুড়ি পুরনো। হান্নানের ঘুড়ি বিলের পুকুর ধারে-তাল গাছের মাথায়। কিন্তু তাতে যায় আসে না কিছু। মাঠে গিয়ে প্রাণ ভরে মজা আর হৈচৈ করার জন্য অনেক ঘুড়ির প্রয়োজন নেই। দু-একটি ঘুড়ি থাকলেই হলো। বাড়িতেই আমরা যখন চিৎকার করতে শুরু করলাম, হৈচৈ আর কোলাহল করতে লাগলাম, তখন শুনলাম বড় জেঠি বলছেন, এডিয়ে শুরু করছে কী? বিলে যায় না কিলিগা? যা যা। সবাই বিলে যা। যত পারছ বিলে গিয়া চিৎকার চেঁচামিচি কর। কেউ কিছু কইবো না। যা বিলে যা।

মনখুলে চিৎকার-চেঁচামিচি করার জন্য নাটাই আর ঘুড়ি হাতে নিয়ে দক্ষিণের পুকুরপাড় দিয়ে সোজা চলে যেতাম মাঠে। ফসলের মাঠভর্তি মরিচ, ছোট ছোট পাট আর হাঁটু সমান ধানগাছ। আমরা সেই সবুজ ছড়ানো খোলা প্রান্তরে অসীম নীল আকাশের নিচে ঘুড়ি উড়িয়ে দিতাম আর টেনে টেনে সুতা ছেড়ে দিয়ে, টেনেটেনে সুতা ছেড়ে দিয়ে, প্রয়োজনে দৌড় দিয়ে ঘুড়ি অনেক অনেক উপরে উঠিয়ে দিতাম। এক সময় ঘুড়িটি এত উপরে উঠে যেত যে, তখন আর ঘুড়িটিকে পৃথিবীর কিছু বলে মনে হতো না। মনে হতো, ওই অনেক উঁচুতে আর বিপুল নির্জনে উড়ে বেড়ানো ঘুড়িটি অন্য কোনো গ্রহের, আমাদের কেউ নয়। আনন্দের মধ্যে কোথায় যেন গোপন একটা কষ্ট বোধ করতাম। সেই কষ্ট কাউকে বলার নয়, কওয়ার নয়। অথচ আমি জানতাম, ঘুড়িটি যত বেশি উপরে উঠবে ততই সবাই আমার প্রশংসা করবে। বলবে, মন্নান ঘুড়ি উড়াইতে জানে ভালা। অনেক উপরে উডাইতে পারে।

তারপর যে কারো ঘুড়ি উড়ানোর অলিখিত অধিকার পেয়ে যাব আমি। এর মধ্যে কাটাকাটি খেলার দিনক্ষণ ঠিক হতো একদিন। দুই গ্রামের শিশুদের মধ্যে সমজোতার ভিত্তিতে যখন সেই মহা উৎসবের দিন ঠিক হতো তখন থেকেই শুরু হতো ঘুড়ি কেনা, ঘুড়ি বানানো ও সুতায় মাজনা দেওয়ার আয়োজন। সমস্ত ঘুড়ির আয়তন প্রায় সমান হতে হবে। এখানে রকমফের রঙে আর মাঞ্জায়। সুতার মধ্যে মাঞ্জা লাগিয়ে ধারালো করা হতো। এরারুট আর সাধারণ কাচের গুড়া মিশালেই ভালো মাঞ্জা হয় না। এর জন্য দরকার ধারালো বালি, হারিকেনের ভাঙা কাচ। গাবের কস। তার পর আছে সুতায় লাগানোর কৌশল, শুকানোর কৌশল। সব কিছু পরিমান মতো করার জন্য প্রয়োজন দক্ষতা, প্রয়োজন যত্ন ও পরিমানবোধ।

সুতায় মাঞ্জা দেয়ার ওস্তাদ ছিলেন মাইনদা। কিন্তু মুসকিল হলো, বিড়ির প্যাকেট পেলে সে প্রতিপক্ষেরও মাঞ্জা করে দেবে। কী বুদ্ধি করা যায়? কীভাবে ঠেকানো যায় মাইনদাকে? শেষ পর্যন্ত সিন্ধান্ত হলো, মাইনদাকে একটি নয়, দুটি প্যাকেট দেয়া হবে আর তার পিছনে লাগিয়ে দেয়া হবে গফুরকে। গফুর তার সঙ্গে সঙ্গে থাকবে। অর্থাৎ প্রতিযোগিতার দিন পর্যন্ত গফুর গোয়েন্দাগিরি করবে। গোয়েন্দাগিরির জন্য সাজু, রুশু, নবু—এমন অনেকেই আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এমন একটি রোমাঞ্চকর ব্যাপার কেউ মিস করতে চায়। যাই হোক, এদের মধ্যে সবচেয়ে বোকা গফুরকেই দায়িত্ব দেয়া হলো। কমপক্ষে বানিয়ে বানিয়ে গল্প বলার প্রতিভা তার নেই। মাইনদার বিষয়ে সে কল্পকাহিনী ফাঁদতে পারবে না।

মাইনদাকে প্রস্তাব দেয়া হলো। মাঞ্জা বানিয়ে সুতায় লাগিয়ে দিতে হবে। খুব ধারালো হয় যেন। বিনিময়ে দু-প্যাকেট বিড়ি। আর শর্ত হলো, হেলালাদের সুতার মাঞ্জা করে দেয়া যাবে না। গফুরু সব সময় তার সঙ্গে থাকবে। মাথা বানিয়ে দেয়া, পিঠের ঘামাচি ফুটিয়ে দেয়া, আঙুল ফুটিয়ে দেয়া, বিড়ি এনে দেয়া, আগুনের ব্যবস্থা করা ইত্যাদি গফুরই করবে। এমনকি তার কবুতরের খাঁচা পরিষ্কারেও সাহায্য করবে গফুর। এছাড়া অন্য কোনো কাজে যদি মাইনদার অন্য কাউকে দরকার হয় তাহলে বলা মাত্রই তাকে এনে সম্মুখে উপস্থিত করা হবে। মাইনদা রাজি হলো এবং এক সময় সে নিজেকে আমাদের প্রতিপক্ষের প্রতিদ্বন্দ্বী বানিয়ে ফেলল। বলল, হেলালের বাচ্চা, তোরা জিতবি? দেখাইতেছি খেলা। এমন মাঞ্জা দিমু, বেলেটের মতো কাইট্টা সব ছাফা কইরা দিমু না! ও হান্নান, প্যাঁচ মারতে জানস তো? নইলে আজ বিকেলে তোগরে প্যাঁচ খেলানোর টেনিং দিমু।

মাইনদার উৎসাহ দেখে আমাদের মধ্যে রীতিমতো একটা যুদ্ধের চেতনা তৈরি হলো। মাইনদার সঙ্গে যুক্ত হলো পাড়াপ্রতিবেশী বেশ কয়েকজন বড় ভাই, বড় আপা, ভাবি ও চাচা-চাচি। শুনছি সানকিভাঙায়ও একই রকম সাজ সাজ রব। গোয়েন্দাদের কাছ থেকে অনেক সত্য-মিথ্যা খবর, অনেক আজগুবি গল্প শুনতে পাচ্ছি। কিন্তু তখন কোনো খবরই আমাদের কাছে মিথ্যা বলে মনে হতো না। এমনকি ব্লেড-এর ধারালো প্রান্ত মাঞ্জায় ব্যবহার করার গল্পও আমরা অকপটে বিশ্বাস করে নিতাম। প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্যই যে সানকিভাঙার গোয়েবলসরা এই সব ছড়াচ্ছে তা মনে হতো না আমাদের।

এক সময় কাটাকাটির দিন এলো। দুপুর থেকে জাহিরাবাদ সানকি ভাঙার সীমানায় শুরু হলো ঘুড়ি ওড়ানোর খেলা। বিশ-পঁচিশটি ঘুড়ি নিয়ে খেলার আয়োজন। প্রচুর লোকের সমাগম হয়ে গেল। বিচিত্র রঙের ঘুড়িগুলো যখন আকাশে ওড়ল তখন আকাশে শুরু হলো রঙের খেলা। বাতাসে বাতাসে ছড়াতে থাকল রঙের ঢেউ। ঘুড়িগুলো যখন গোত্তা দেয় তখন মনে হয় বাতাসের ঢেউয়ে রঙের ঘূর্ণন তৈরি হলো। আর বিচিত্র রঙের ঘুড়ি থেকে রঙ নিয়ে সূর্যের আলোও যেন রঙিন হয়ে উঠছিল। সেই রং লাগছিল আমাদের মনে। ঘুড়ি কাটা পড়ছে এদলের সেদলের। এই নিয়ে কারো ভ্রুক্ষেপ নেই। বরং কাটাপড়া টালমাটাল ঘুড়িটিকে ধরার জন্য ছুটে যাচ্ছে শিশুরা। হৈচৈ করে দৌড়ে যাওয়ার সেই দৃশ্য ছিল দেখার মতো। সুতাছেড়া ঘুড়িগুলো মনে হয় ওড়ে যাচ্ছে কোন নিরুদ্দেশের উদ্দেশে। কিন্তু সব সময়ই তারা ঝুলতে থাকে উচুঁ গাছের মগডালে। কেন? কী দরকার? মাঠে গিয়েও তো পড়তে পারে ওরা। কিন্তু ক্বচিৎ তা হয়। আকাশে ওড়ারই স্বাদ নিতে চায় গাছের মগডালে ঝুলে ঝুলে, ওড়ে ওড়ে। আর গাছগুলোরও যেন আল্লাদের শেষ নেই। মা যেমন শিশুকে আদর করে দোল খাওয়ায়, গাছগুলোও তেমনি রঙিন ঘুড়িগুলোকে প্রজাপতির মতো দোল খাওয়ায়।

আমরা নানাভাবে চেষ্টা করতাম ঘুড়িগুলো পাড়ার জন্য। কখনো অক্ষত অবস্থায় পেড়ে নিয়ে মালিকানার জন্য ঝগড়া লাগিয়ে দিতাম। তখন টানাটানি আর কাড়াকাড়িতে ঘুড়িটি অক্ষত আর থাকতো না। কখনো ঘুড়িটি কিছুতেই পাড়তে পারতাম না। তখন ত্যাক্তবিরক্ত হয়ে ঢিল ছুড়তে শুরু করতাম। ঘুড়ির দফারফা করে ছাড়তাম। ওদিকে কাটাকাটির স্থলে কি যে কাণ্ড হতো তা বর্ণনাতীত। এতো মানুষের এতো রকম ব্যাপার, এতো রকম গল্পঘটা সত্যি বর্ণনা করার মতো নয়। সব কিছু ছাড়িয়ে কেবল মনে পড়ে অজা পাগলার বউ জমিলা ফুফুর কথা। তিনি ছিলেন আমাদের সার্পোটার। কিন্তু কোন দলের ঘুড়ি কোন দল কাটছে তা বোঝার ক্ষমতা জমিলা ফুফুর ছিল না। তিনি উড়ন্ত ঘুড়িগুলোর দিকে হা করে চেয়ে থাকতেন আর হাজরটা প্রশ্ন করতেন। অ রুশু, গোত্তা দিল কেগ ঘুড্ডি? আমগ না হেলাইল্লাগ? ওই লালডারে কাডেনা কিলিগা? ওইডা বেশি বাড়তাছে।

রুশু আপা মহা বিরক্ত, বুড়ি, ওইডা তো আমাগ ঘুড্ডি। ওইডা কাটতে দোয়া করছ কিলিগা? আমরা হাইরা জামুনা তাইলে?
শুনে ভুল বুঝতে পারে জমিলা ফুফু।
তোবা! তোবা! আমি পড়তাছি দোয়া কুনুদ, আমাগ জিতনের লইগ্যা, আর কিনা কি বুঝতেছি। মাপ কইরা দে রুশু আমারে।

শেষপর্যন্ত আমরা যখন হেরে গেলাম তখন সব চেয়ে বেশি কষ্ট পেলেন জমিলা ফুফু। আর ভিক্ষা করে ফিরে আসা স্বামী অজা পাগলার কাছে নিজের ভুলের জন্য কি যে মনস্তাপ প্রকাশ করতেন তা আর বলার নয়। অজা পাগলাও স্ত্রীকে সাধ্য মতো সান্ত্বনা দিতেন। আমাদের ছোটদের জীবনের এইসব ঐতিহাসিক ঘটনার একটুকুও ছাপ পড়ত না বড়দের জীবনে। বলতে কি, তারা পাত্তাই দিত না। মুহূর্তের জন্য কিছুটা আলোড়িত হলেও পরে আর মনেও রাখত না। আমার কাছে মনে হতো, বড়য়া অদ্ভুত প্রাণী। এই অদ্ভুত বড়দের মধ্যে একমাত্র ব্যতিক্রম ছিলেন জমিলা ফুফু— সবার কাছে অবহেলিত, ছাই ফেলতে সবার ভাঙা কুলো। আমাদের ঘুড়ি কাটাকাটি যখন শেষ হয়ে যেত, আমরা যখন অন্য কোনো বিষয় নিয়ে উত্তেজিত হয়ে থাকতাম, তখন জমিলা ফুফুই ঘুড়ি কাটাকাটির সেই দিনের গল্প করতেন। এত কল্পনা করে তিনি কথা বলতে পাড়তেন যে, মনে হতো ঘুড়ি কাটাকাটির খেলাটা আমাদের ছিল না। অন্য কোনো গ্রহের শিশুদের খেলা ছিল সেটি। জমিলা ফুফু সেই গ্রহের শিশুদের ঘুড়ি কাটাকাটির গল্প বলছেন।

আমরা মুগ্ধ হয়ে শুনতাম আমাদেরই গল্প। শেষ বৈশাখের চন্দ্রালোকিত রহস্যময় রাত মধুর হয়ে উঠত। আর সেই রাতের আশ্চর্য আপনজন মনে হতো জমিলা ফুফুকে। আমাদের জীবনের তাৎপর্যময় ঘটনাগুলো তিনিই গল্প করে তুলতেন। আর সেই গল্পের নায়ক-নায়িকা আমরাই। অথচ এহেন মহান ফুফুকে কেন যে সবাই পাট পাতার তুল্যও গ্রাহ্য করত না, তা বুঝতে পারতাম না আমরা। একদিন শুরু হবে বড়দের ঘুড়ি উড়ানোর খেলা। যারা নাইন-টেনে বা কলেজে পড়ে তারা ওড়াবে ঘুড়ি। আমাদের ছোটদের মতো ছোট ছোট ‘পেতি ঘুড্ডি’ না। বিশাল বড় ডাব্বুশ, যার মাথায় ধনুকের মতো বাঁশি লাগানো থাকবে, আর থাকবে বিশাল লেজ। ওড়বে বাক্স ঘুড্ডি। বাক্স বটে। উপড়ে আর নিচে খোলা। ওড়বে পঙ্খিরাজ। এত বড় লেজ থাকবে যে পাখি ওড়ে, না লেজ ওড়ে তা বোঝা মুশকিল হবে। দূর থেকে মনে হবে লেজ ওড়ে। খাইল্লাইজু যেমন বলেছেন, সাপের মতো শরীরে ঢেউ তুলে লেজ উড়াবে। সেই সর্পিল দীর্ঘ লেজের অনেক উপরে থাকবে পাখি। ভালো করে দেখলে দেখতে পাবে, নইলে নয়।

আবু বকর ভাই, সিরাজ ভাই, গোলাম হোসেন ভাই, মাইনদা, শাহজাহান ভাই— এরা সবাই ঘুড়ি বানাতে ব্যস্ত। কেউ বানায় ডাব্বুশ, কেউ বাক্স, কেউ পঙ্খিরাজ। এক বাড়িতে নয়, এক মহল্লায়। আমাদের আনন্দের সীমা নেই। এই বাড়ি থেকে ওই বাড়ি, ওই বাড়ি থেকে ওই বাড়ি। সরকার বাড়ি, হাওলাদার বাড়ি, মাঝি বাড়ি, বন্দুকসি বাড়ি, পাটোয়ারি বাড়ি। ঘুরে ঘুরে আমরা ঘুড়ি বানানো দেখছি। কত জ্যামিতি। কত মাপজোখ। কত উপায়-উপকরণ। দেখে দেখে আমরা অগ্রজদের প্রতি মুগ্ধ।

খাড়াইয়া রইছছ কেন? দেহছ কী। ছুরিডা লইয়ায়। আবু বকর ভাই তার ভরাট গলায় এক জনকে নিদের্শ দিলে তিনজন দৌড়াই। কে কার আগে ছুরি এনে দিয়ে ধন্য হতে পারি। আবু বকর ভাই খুব ভালো। শুনেছি ছড়া-কবিতা লেখে গোপনে। চিঠিও লেখে। সেই চিঠি পাঠিয়ে দেয় পাটোয়ারি বাড়িতে। গফুরকে দিয়ে পাঠায়। গফুরের হাতে কাঠি লজেন্স, গজা, তালমিশ্রি দেখলে আমরা বুঝতে পারি আবু বকর ভাই দিয়েছে। কিন্তু শুধু গফুরকেই নয়, তার ডাব্বুশ ঘুড্ডি বানানো দেখতে গেলে আমাদেরও দেয়।

নে বাদাম খা। কথা কবি না। এইডা─ সেইডা ধরবি না। ঠিক ? বইয়া বইয়া শুধু দেখবি, কেমনে বানাই।
তারপরও আমরা ধরি। এটা-সেটা নেড়েচেড়ে দেখি। তাতে যে এই আগ্রজরা খুব বিরক্ত হয়, তা নয়। বরং ছোটরা তাদের ঘিরে না থাকলে যেন তাদের কাজে মাহাত্ম্য প্রকাশ পায় না। তাদের এই বিপুল কাজের স্বীকৃতিও যেন মিলে না।

সিরাজ ভাই গুলতি বানানোর কায়দা-কানুন খুব ভালো বোঝে। সুরুজ, সবুর আর পানুকে সে গুলতি বানিয়ে দিয়েছে কয়েকবার। আমরাও সেই সুযোগ নেওয়ার অপেক্ষায় আছি। সিরাজ ভাই সেটা জানে। আবু বকর ভাইয়ের কাছে আমরা সারাক্ষণ ঘুর ঘুর করি বলে সে আমাদের উপর খুবই বিরক্ত ।
কী রে ওই হানে সারাক্ষণ কী করছ। গুলতি বানাইয়া দেয় কে তোগরে? আমি না বকর? কইছ পরে গুলতি বানাইয়া দেওয়ার কথা?

দুই শাখাঅলা একটি জামের ডাল কেটে তার মধ্যে রাবার গুললি বানানোতে সিরাজ ভাইয়ে জুড়ি নেই। আমরা একটু ভয় পেয়ে গেলাম। সিরাজ ভাই বিমুখ হলে গুলতি পাবো কোথায়। এখন আমরা সিরাজ ভাইয়ের কাছে গিয়ে ঘুরাঘুরি করি, তার ফাই-ফরমাসের জন্য অপেক্ষা করি। একদিন-দুদিনের মধ্যে অনেকগুলো ঘুড়ি তৈরি হয়ে গেল। বিশাল বিশাল ঘুড়ি। একটি ঘুড়ির লেজের সঙ্গে নাকি বাতি লাগিয়ে দেবে। ছোট লণ্ঠনের সেই আলো দিনের বেলা দেখা যাবে না, রাতের বেলা দেখা যাবে। আর সেই আলো দেখতে তারার মতোই মনে হবে, তারাদের থেকে আলাদা করা যাবে না। আমাদের বিস্ময়ের সীমা নেই।

তুই দেখছছ? বাত্তিঅলা ঘুড্ডি বাপের জন্মেও দেহি নাই। বিস্ময়ের সঙ্গে বলে আবুল হোসেন। হাজেরার কিছুতেই বিশ্বাস হয় না। বলে, হ, তোরে কইছে, কুপি লইয়া ঘুড্ডি আসমানে উড়ব! গোত্তাগুত্তি করার সময় আগুন নিব্বা যাইব না?

কিন্তু একদিন বিস্ময়ের সঙ্গে আমরা লক্ষ করি, সন্ধ্যার কিছুক্ষণ পূর্বে লাল রঙের একটি বাতি নিয়ে কয়েকটি ঘুড়ি ঠিকই আকাশে উড়তে লাগল। আমাদের আগ্রহ আর কৌতুহলের সীমা অতিক্রম করতে করতে যখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে তখন ঘুড়িটা কোথায় উবে যায়, থাকে শুধু লাল লঙের এক বিন্দু আলো। সেই এক বিন্দু আলোর সঙ্গে দূর আকাশের তারাদের আলোর অনেক তফাত। তারাদের আলো শান্তস্নিগ্ধ ও অচঞ্চল। সেই আলো যেন আমাদের পরিচিত নয়— পর, অনাত্মীয়। ইচ্ছা করলেই আমাদের ঘরে নিয়ে আসতে পারি না। কিন্তু লাল রঙের গেঁয়ো এই আলো আমাদের একান্ত আপন। সীমাহীন আকাশের বুক থেকে ইচ্ছা করলে এখনই একে নিয়ে আসতে পারি আমাদের ঘরে।

এক সময় যখন চোখ জুড়ে ঘুম নেমে আসত তখন স্বপ্নের মধ্যে আমিও ঘুড়ি হয়ে আকাশে উড়ে বেড়াতাম। পুকুরে, খালে, বিলে ডুব দিয়ে মাছের পিছু পিছু ঘুরে বেড়ানোর মতো অসীম নীল আকাশে আমিও যেন সুতা ছেড়া ঘুড়ির পেছনে উড়ে বেড়াচ্ছি। সেই মধুর দিনগুলো আর মধুরতর স্বপ্নগুলো আমার জীবনের অফুরন্ত সঞ্চয়। জীবন সত্যি সুন্দর, সত্যি আনন্দময়।

লেখক: শিক্ষাবিদ ও কথাসাহিত্যিক