সাঈফ ইবনে রফিকের আত্মগদ্য ‘পূন্যস্নান’

প্রকাশিত : জুলাই ২১, ২০২০

ঘুম ভেঙে দেখি, আমি বিছানায় নেই।
চকচকে মোজাইক করা এক সুদৃশ্য আলোকিত ঘরে শুয়ে আছি। ক্যালিগ্রাফি আর মধ্যপ্রাচীয় নকশা দেখে মসজিদ মনে হচ্ছে। কিন্তু ভাবছি, আমি এই মসজিদে কেন? এমন চাকচিক্যের মসজিদে তো স্বয়ং আল্লাহরও থাকার কথা না! এখানেতো আমার কোনো কাজই নেই!

ভাবতে ভাবতে শোয়া থেকে উঠে বসলাম। দূরে দূরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে কয়েকজন ভদ্রলোক নামাজ পড়ছেন। পোশাক দেখে নিশ্চিত হলাম, এরা বাঙালি নয়। এরমধ্যে কথা বলতে বলতে কয়েকজন ঢুকলেন। ভাষাটা বোঝার চেষ্টা করলাম। না আরবি, না উর্দু। ফার্সি হতে পারে।

আমাকে উঠতে দেখে এক ভদ্রলোক দৌড়ে এলেন। বললেন, তাড়াতাড়ি উঠুন। পীর সাহেব আপনাকে ডেকেছেন। আপনাকে সাক্ষাৎ দেবেন। আমি প্রশ্ন করলাম, কোন পীর? আমি এখানে কেন? আমিতো কারো সাথে দেখা করতে চাইনি!
তিনি বললেন, আপনার সব প্রশ্নের উত্তর তিনিই দেবেন। উঠুন রেডি হন।

গোসলখানা দেখিয়ে বললেন, গোসল করে এসে এটা পরবেন। সেরওয়ানি টাইপের ঝলমলে কুর্তা দেখে বললাম, এটা কেন?
ভদ্রলোক মিতভাষী। বললেন, ড্রেস কোড।

গোসল করে পোশাক পরে বের হওয়ার পর ভদ্রলোক আমার মাথায় একটা পাগড়ি বেঁধে দিলেন। বললেন, আপনি রেডি। চলুন আপনার সাক্ষাৎ হয়ে যাক।

রওজার দরজায় দাঁড়িয়ে ভদ্রলোক বললেন, আমি এই মাজারের খাদেম। তবে আমার এখন ভেতরে প্রবেশের অনুমতি নেই। আপনাকে একাই ঢুকতে হবে।
ঢুকলাম। না। প্রত্যাশিত কবর নেই। আগরবাতি নেই। বালা-মুসিবত দূর করার দাবি নিয়ে সিজদারত ভক্তও নেই।

এক আলিশান রাজদরবার। একটা প্রকাণ্ড সিংহাসনে এক রাজা একা বসে আছেন। আলোছায়ার খেলায় তার চেহারা অস্পষ্ট। খাঁটি বাংলায় আমার পরিচিত একসেন্টেই বললেন, নির্ধারিত মন্ত্রে আমাকে না ডাকলে, নির্ধারিত আমল না করলে কেউ আমার দেখা পায় না। তুমি পেয়েছো। কারণ হালাল রুজির অনুসন্ধানের চাইতে বড় কোনো এবাদত নাই।

বললাম, আপনি কে? আর আমার আগ্রহ ছাড়া আমাকে এভাবে ডেকে দেখা দেয়ার কারণইবা কী?

বুজুর্গ বললেন, স্রষ্টা অনুসন্ধানে তোমার পদ্ধতিগত ত্রুটি থাকলেও ব্যাপারটা ভালো লেগেছে। তুমি নিজের মধ্যে নিজেকে খুঁজছো, অথচ কি খুঁজছো— তোমার সচেতন মন তা জানে না।

আমি মন্ত্রমুগ্ধ বাকরুদ্ধ হয়ে গেছি। তর্ক করার মতো যুক্তি খুঁজে পাচ্ছি না। শুধু বললাম, হে রাজাধিরাজ, আপনার চেহারা আমি পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি না।

হাসতে হাসতে তিনি সিংহাসন ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। সিঁড়ি ভেঙে আমার কাছে এলেন। বললেন, এবার ডানে তাকাও।
প্রকাণ্ড আয়নায় আমরা প্রতিফলিত। বুজুর্গের চেহারা অবিকল আমার মতো। একই মানুষের যেন দুটি সংস্করণ। শুধু তার পাগড়িটা উজ্জ্বল লাল, আমারটা হালকা গোলাপি!

আমার মাথা কাজ করছে না। ভয় লাগছে। মনে হচ্ছে, আমি আসলে মরে গেছি। আর কোনোদিনই ফিরতে পারবো না দুনিয়ায়। তেরেসা আর হাজরে আসওয়াদ আর ওদের মায়ের মুখটা মনে পড়ছে। ওরা আমাকে বিছানা থেকে উধাও দেখলে কি করবে? গুম-খুনের মামলা হইচই অযথা হয়রানি হবে নাতো? নাকি আমার লাশ ওখানে পড়ে আছে আর আমি এখানে!
বুজুর্গকে জিজ্ঞেস করলাম, আমি কি মরে গেছি?

তিনি আবারও হাসলেন। আমার সিনায় আঙুল ছুঁলেন। মনে হলো, আঙুল থেকে একটা সূঁচালো ফলা বেরিয়ে আমার বুকে ঢুকে পড়েছে। প্রচণ্ড ব্যথায় ককিয়ে উঠলাম। চিৎকার।

শান্ত কণ্ঠে তিনি বললেন, আমাদের তরিকাটা সন্দেহাতীত বিশ্বাসের, প্রেমের। কোনো সন্দেহ, বিদ্বেষ, শ্রেণিকরণ, সাম্প্রদায়িক ভাবনা যেন তোমার মনে জায়গা না পায়!

সত্যিকারের ঘুমটা ভাঙার পর দেখলাম, আমি আমার বিছানাতেই আছি। বুকের বাম পাশে তখন ব্যথাটা কমে আসছে। ঠিক ব্যথাও না, অদ্ভুত একটা অনুভূতি। মনে হচ্ছে পূন্যস্নান! একটা নিষ্পাপ ফিলিং। চোর পালানোর পর বুদ্ধি আসার মতো এখন অনেক প্রশ্ন ঘুরছে মাথায়, সময়মতো যা মনে পড়লো না!