সাঈফ ইবনে রফিক

সাঈফ ইবনে রফিক

সাঈফিজম: নিষ্পেষণের মর্মযাতনায় সঙ্কট উত্তরণের উপায়

আবু তাহের সরফরাজ

প্রকাশিত : ডিসেম্বর ২৯, ২০২৩

যে সমাজে আমরা বসবাস করছি, সেই সমাজে আমরা বসবাস করতে চাই না। এরপরও বাস করতে হয়। বর্তমান সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতি জটিল এক পরিক্রমায় ঘূর্ণায়মাণ। যেন সময়ের কৃষ্ণগহ্বর। এই গহ্বর ন্যায়নীতি ও সততার বোধকে গিলে খাচ্ছে প্রতিদিন, প্রতিমুহূর্তে। কোণঠাসা হতে হতে সাধারণ মানুষের ভেতর বেড়ে উঠছে ক্ষোভ, কিন্তু সেই ক্ষোভ প্রকাশের ভাষা তাদের জানা নেই। অথবা জানা থাকলেও ক্ষোভ তারা প্রকাশ করছে না। আর কেউ যদি তা প্রকাশ করেও, তাহলে রাষ্ট্রদোহী কিংবা কাফির হিসেবে আখ্যায়িত করে তাকে হাপিশ করে দেয়া হচ্ছে। সমাজ ও রাষ্ট্রের এই চালচিত্র আমাদের সাম্প্রতিক কাব্যসাহিত্যে খুব একটা দেখা যায় না। বেশিরভাগ কবি মত্ত থাকেন কল্পনার ঘোড়দৌড়ে। আমি-তুমি, তুমি-আমি অথবা ফুলপাখিলতাপাতা আমার বারান্দায় আইভিলতা— এই জাতীয় মনোলোভা চিত্রকল্প তাদের কবিতাকে পৌনঃপুনিক করে রেখেছে।

কিন্তু সাঈফ ইবনে রফিক সেই পথে তার কবিতার ঘোড়াকে ছোটায়নি। যাপিত সময়কে ধারণ করে সাঈফ উপলব্ধি করে নিষ্পেষণের মর্মযাতনা। জনসাধারণ এই মর্মযাতনায় ক্ষুব্ধ। কিন্তু তা প্রকাশের শৈল্পিক উপায় তাদের জানা নেই। কারণ, তারা কবি নয়। সকলেই কবি হতে পারেও না। কেউ কেউ কবি। সাঈফ যেহেতু কবি, সেহেতু সে জনসাধারণের প্রতিনিধি হিসেবে কবিতার ভেতর দিয়ে প্রকাশ করে যাপিত বাস্তবতার বিরুদ্ধে শৈল্পিক প্রতিবাদ। সাঈফের বোধের জগতে ধ্বনিত হয়ে ওঠে মানুষের শাশ্বত সেই আকাঙ্ক্ষা, শুভবোধ মুক্তি পাক। কেউ কেউ বলবে, কবিতায় এসব স্লোগান আজকাল আর চলে না। আমি বলব, তারা কবিতা বোঝে না। কবিতা সর্বগ্রাসী। কবিতা সর্বভূতে বিরাজমান। সবকিছুই কবিতা। অন্তর্জগতের গূঢ় অনুভূতি থেকে শুরু করে সমাজ, রাষ্ট্র ও রাজনীতি— সবকিছুই কবিতার শৈল্পিক নিগড়ে বাঁধা পড়তে পারে। তবে তার জন্য কবিকে জানতে হয় শিল্পকৌশল।

আমরা তো জানিই, জীবন কুৎসিত। আর তাই, কুৎসিত জীবনকে সৌন্দর্যমণ্ডিত করে শিল্প আমাদেরকে বেঁচে থাকার রসদ যোগায়। যাপিত জীবনের যে কোনো বিষয়কেই শিল্পের মোড়কে উপস্থাপন করা যায়। কে কত শৈল্পিক উপায়ে উপাস্থাপন করছে, সেটাই বিবেচ্য। কী উপস্থাপন করছে, সেটা বিবেচ্য নয়। বর্তমান সভ্যতা যে সঙ্কটে প্রতিমুহূর্তে দিশেহারা, সেই সঙ্কট উত্তরণের উপায় ইসলাম অনেক আগেই দেখিয়ে দিয়ে গেছে। ইসলাম পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান। ব্যক্তিজীবন থেকে আরম্ভ করে সমাজ ও রাষ্ট্র কিভাবে পরিচালিত হবে, তার খুঁটিনাটি সব বিষয়ে কোরআন ও হাদিসে উল্লেখ করা আছে। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, ইসলামি বিধানকে এখন বেশিরভাগ মানুষ বাঁকা চোখে দ্যাখে। ইসলামের নাম শুনলে অনেকের শরীরে চুলকানি শুরু হয়ে যায়। এর কারণও আছে। সাধারণত এই দেশে যারা ইসলামের ধারক ও বাহক, তারা যে ইসলামের কথা বলে সেই ইসলামের সঙ্গে কোরআন ও হাসিদের কোনো সঙ্গতি নেই। মানে, প্রচলিত ইসলাম প্রকৃত ইসলাম নয়।

মহানবি (স.) বলেছেন, তোমরা নিচু স্বরে কোরআন পড়ো। উঁচু স্বরে পড়লে তোমার আশপাশের ভাইদের সমস্যা হতে পারো। তুমি তো আর জানো না যে, কে কোন অবস্থায় রয়েছে। কোরআন আল্লাহর বাণী। সেই বাণী যদি নিচু স্বরে পড়তে হয়, তাহলে আর বাকি রইল কী! অথচ শীত মওসুম এলেই আমাদের দেশে শুরু হয়ে যায় ওয়াজের ডামাডোল। চারদিকে মাইক লাগিয়ে ওয়াজিগণ যেভাবে চিৎকার করতে থাকেন, তাতে কী অবস্থা সৃষ্টি হয়— ভুক্তভোগী সকলেই তা জানেন। প্রচলিত ও প্রকৃত ইসলামের এটা একটি উদাহরণ। এরকম অসংখ্য বিষয় রয়েছে। এসব দেখেশুনে সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত মানুষ ধারণা করে নিয়েছে, প্রচলিত ইসলামই প্রকৃত ইসলাম। অথচ তারা যদি কোরআন ও হাদিস পড়তেন, তাহলে তাদের ভুল ভাঙতো। ফলে ইসলামবিদ্বেষী মনোভাব এখন ঘরে ঘরে। যদিও অনেকে নামাজ পড়েন, সিয়াম সাধনা করেন, কিন্তু এসব ইবাদতের মর্ম তারা ধারণ করতে পারেন না।

এসব বিষয় নিয়ে আমাদের সাহিত্যিকরা লেখেন না। বরং ইসলামবিরোধী লেখাতেই তাদের বেশি আগ্রহ। সাঈফ ইবনে রফিক ব্যতিক্রম। তার বেশিরভাগ কবিতায় ইসলামি ভাবাদর্শ চোখে পড়ে। সমসাময়িক প্রেক্ষাপটে নানা ঘটনার ভেতর দিয়ে সাঈফ ইসলামি আদর্শকে তার কবিতায় তুলে আনে। মগজের আরাম কবিতায় দেখা যায়, শয়তান এসে সাঈফের মাথার চামড়া কেটে মগজের ভেতরটা চুলকে দিল। এরপর সাঈফ সবকিছু নতুনভাবে দেখতে শুরু করল। কেবল তা-ই নয়, ঘোষণা দিয়ে সে শান্তির ধর্ম ইসলাম ত্যাগ করল। এরপর শান্তিতে নোবেল পুরস্কার চেয়ে বসলো। কী স্যাটায়ার! মগজের চুলকানিতেই হরহামেশা মানুষ ইসলামকে নিন্দেমন্দ করছে। অথচ প্রকৃত শান্তির পথের দিশারী যে এই জীবনব্যবস্থা, তা কেউ-ই বুঝতে পারছে না। ফলে বাড়ছে সভ্যতার সঙ্কট। কোরবানি ঈদের আগদিয়ে বিভিন্ন কোম্পানি ফ্রিজ বেচার জন্য নানা প্রলোভনে ডিসকাউন্ট দিতে থাকে। কার কোরবানির গরু কত বড়, তা নিয়ে চলে প্রতিযোগিতা। এসব দেখে সাঈফের কলমে আর্তনাদ জেগে ওঠে:

গরু নিয়া যে উল্লাস দেখবে ঢাকা শহর—
তাতে লজ্জা পাবে মূসার সেই গো-পূজারি অনুসারীরাও।

জান্নাত ও জাহান্নাম কবিতায় সাঈফ লিখছে:

মানুষ বুঝল না,
দুনিয়াকে জান্নাত বানাতে পারলে মদ হালাল হতো
কেয়ামত আসতো না।
এটা খুব একটা কঠিন ছিল না।

খুবই সহজ সূত্র দেখিয়ে দিচ্ছে সাঈফ, অথচ মানুষ তা বুঝতে পারছে না। মানুষ ছুটছে ভোগের দিকে। ভোগেরও যে শৈল্পিক রূপ আছে, মানুষ তাও বুঝতে পারছে না। সভ্যতার এই ক্রান্তিলগ্নে বর্তমান সময়ের আর কোনো কবির কবিতায় আমি আত্মার আর্তনাদ শুনতে পাই না। সাঈফের কবিতায় ইসলামি আদর্শকে সুউচ্চ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করা হয়েছে। অথচ আরসব কবি ইসলামের পক্ষে তো দূরের কথা, ইসলামের বিপক্ষে কবিতা লিখতে পারলে ‘কিছু একটা করলেন’ ভেবে আত্মতৃপ্তি পান। এদেরই বিপরীতে দাঁড়িয়ে সাঈফ সভ্যতার সঙ্কট কাটিয়ে মুক্তির উপায় জানিয়ে দিচ্ছে তার কবিতায়:

ফিজিক্স দিয়ে আল্লাহকে খুঁজো না
হে আধুনিক।
যুক্তি তোমাকে জিততে শেখায়
অথচ আত্মসমর্পণেই নিহিত তোমার সার্বভৌম মুক্তি।

এই উচ্চারণ প্রকৃত মুসলিমের উচ্চারণ। মুসলিম শব্দের মানে, যে আত্মসমর্পণ করে। কিন্তু প্রচলিত মুসলিমরা আল্লাহর বিধানের কাছে কতটা আত্মসমর্পণ করেছে, তা বোঝা যায় আজকের সমাজব্যবস্থার দিকে তাকালে। ঘুষের টাকা পকেটে নিয়ে মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়ছে মডারেট মুসলিম। সুদের টাকায় খাচ্ছে সেহরি ও ইফতারি। মুসলিমের এই দুরাবস্থা দেখে কাতর হয়ে ওঠে সাঈফ ইবনে রফিক। এই কাতরতা কবিতায় প্রকাশ করা ছাড়া তার তো আর কিচ্ছু করার নেই। চারদিকে মূল্যবোধের অবক্ষয়। একজন মানুষ অপেক্ষা করছে আরেক মানুষকে কখন ঠকাবে। পুঁজির পাহাড় নিয়ে বসে আছে কেউ কেউ। আর তাদের পায়ের ছায়ায় বসে স্তুতি গাইছে আজকের কবি-সাহিত্যিকসহ (অ)শুভবোধ সম্পন্ন মানুষ। এই দৃশ্য সাঈফের মানবতাবাদী চোখ সইতে পারে না। তাই তার কবিতায় দেখতে পাই:

কবি নয়, নিজেকে দালাল বল।
বল, তুই একটা গুটিবাজ।
কবিতা গ্যাং গড়ে সাহিত্যপাড়ায়
সংঘবদ্ধ ক্রাইম করে বেড়াস।

কী সাঙ্ঘাতিক চাবুকের আঘাত! কবিতা শুদ্ধ শিল্প। অথচ সেই শিল্প এখন চর্চা করা হচ্ছে নানাবিধ সুবিধে পেতে। এবং এইসব গুটিবাজদের সুযোগ করে দিচ্ছে গণমাধ্যম। আমাদের দেশের প্রতিটি গণমাধ্যমের সাহিত্যিক ম্যাপ আছে। এই ম্যাপের বাইরে তারা কাউকে পরিচিত করে তোলে না। আর যেহেতু এ দেশের পাঠক গণমাধ্যমমুখি, ফলে শুদ্ধ শিল্পচর্চা যারা করছেন, তারা নিভৃতেই থেকে যাচ্ছেন। সাঈফ দীর্ঘবছর সাংবাদিকতা করেছে। একটা দৈনিক পত্রিকায় একটা সময়ে আমরা একসঙ্গে কাজ করেছি। সাঈফ এখন সাংবাদিকতা ছেড়ে দিয়েছে। সাংবাদিকতা এখন আর আগের অবস্থানে নেই। কোন অবস্থায় আছে সেটা নিউজ কবিতায় সাঈফ জানিয়ে দিয়েছে:

কে কাকে বিয়ে করল
কে কাকে ছাড়লো
কে কাকে নিয়ে পালালো
এইসব মুখরোচক গল্পে আড্ডা জমতেই পারে
অবদমনের সুড়সুড়িতে গসিপ-গুজব হতে পারে।
তাই বলে এগুলো মেইনস্ট্রিম মিডিয়ার নিউজ হতে পারে কি?

কথাচ্ছলে লিখতে লিখতে খুব মনে পড়ছে আজিজ সুপার মার্কেটে আমাদের যৌবনের দিনগুলি। একঝাঁক তরুণ কবিতার স্বপ্ন চোখে নিয়ে আজিজেই কাটিয়ে দিতাম ঘণ্টার পর ঘণ্টা। দিন ও রাত এক করে সে কী আড্ডা! কখনো পকেট খালি। পেটও খালি। তবু আড্ডার জৌলুশে এতটুকু ভাটা পড়তো না। বন্ধুদের বেশিরভাগই দৈনিক পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদকদের সঙ্গে খুব তেলাতেলি করতো। ফলে দৈনিকে তাদের কবিতা প্রকাশিত হতো। আরও পরে মিডিয়ার ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের পিট চুলকে দিতে শুরু করলো বন্ধুরা। ক্ষমতাধররাও তাদের পিঠ চুলকে দিল। কর্মসংস্থান পেল। এদিক-ওদিক সভা-সেমিনারে দৌড়ঝাপ শুরু করে দিল। সাঈফকে বরাবর দেখেছি, এসব থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকতে। কবি হতেই হবে, এরকম ধনুকভাঙা পণ ওর ছিল না। আর তাই নিজের কবিসত্তাকে অন্যের কাছে খাটো করতে ওকে কখনো দেখিনি। আমার ধাতের মানুষ বলেই হয়তো সাঈফের সঙ্গে আমার সখ্য গাঢ় হয়ে ওঠে। এত বছরেও সেই সম্পর্কে এতটুকু চিড় ধরেনি।

আজকে যেসব কবিবন্ধু গুটিবাজি করে সহিসালামতে আছে, তাদের বেশিরভাগই আর কবিতা লেখে না। হয়তো লিখতে পারেও না। কিন্তু সাঈফ লিখেই যাচ্ছে। যতদূর জানি, কোনো পত্রিকায় সাঈফের কবিতা ছাপা হয় না। আমার সম্পদনায় অনলাইন নিউজ পোর্টাল ছাড়পত্রতে মাঝে মাঝে সাঈফ কবিতা দ্যায়। আমিও আগ্রহ নিয়ে সাইটে তুলে দিই। তার কবিতাকে আমি বলব, সাঈফিজম। প্রশ্ন উঠতে পারে, ইজম কেন? কবিতার মধ্যদিয়ে সাঈফ কি কোনো মতবাদ প্রচার করতে চাইছে? না, তা অবশ্যি চাইছে না। তবে মানবিক ও নৈতিক অবক্ষয়ের এই সময়ে শান্তির বার্তা পাওয়া যাবে সাঈফের কবিতায়। সমকালীন যে কোনো সঙ্কট কাটিয়ে উঠতে একমাত্র ইসলামি বিধানই যে সর্বজনীন ও কল্যাণকর, সাঈফ সেই মতবাদই শিল্পের বাতাবরণে প্রচার করতে চেয়েছে। এটাই সাঈফিজম।

 

আলোচক: কবি, কথাসাহিত্যিক ও বিজ্ঞান লেখক