সাহাবিরা দ্বীনি কাজ করে কি অর্থ নিতেন?

আরিফুল ইসলাম

প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ০২, ২০২২

সাহাবিরা ছিলেন অনেক বেশি বাস্তববাদী Pragmatic, কিন্তু বস্তুবাদী Materialistic নন। তাদের চিন্তা-ভাবনা পড়লে মাঝেমধ্যে অবাক হই। বাক্সের বাইরে কিভাবে চিন্তা করতে হয় সেটা তারা দেখিয়ে যান।

Necessity এর প্রশ্নে তারা এমন কাজ করেন যেগুলো নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম করেননি বা করার নির্দেশ দেননি। আলোচানা-পর্যালোচনা শেষে তারা এসব কাজ বাস্তবায়ন করেন। যেমন: কুরআন সংকলন।

কোনো নবি-রাসূল দ্বীন প্রচারের বিনিময়ে অর্থ গ্রহণ করেননি। কারণ, তাদের প্রধান ও একমাত্র দায়িত্ব ছিল দ্বীন প্রচার। এটার বিনিময়ে তারা মানুষের কাছে কোনো ধরনের পারিশ্রমিক নিতেন না।

আমাদের সময়ে যখন মসজিদের ইমাম সাহেবকে মাসিক বেতন/ভাতা দেবার কথা ওঠে, তখন কেউ কেউ প্রশ্ন করেন, দ্বীনি খেদমতের বিনিময়ে কি টাকা নেয়া যায়? কোনো নবি-রাসূল তো নিতেন না। ইমাম সাহেব কেন নেবেন?

ইমাম সাহেবের কথা বাদ দিয়ে আরও বিগার পিকচার যদি দেখেন, অর্থাৎ যে কোনো দ্বীনি কাজের বিনিময়ে টাকা গ্রহণ, তাহলে দেখবেন এটাকে কেউ কেউ বাঁকা চোখে দেখে।

কেউ ধরেন, সারাদিন সময় নিয়ে কয়েকটি গ্রাফিক্স ডিজাইন করে দিলো, ভিডিও এডিট করে দিলো। একমাস কষ্ট করে একটি ওয়েবসাইট বা অ্যাপ বানিয়ে দিলো। এগুলোর দ্বারা দ্বীনের খেদমত হবে৷ তারমানে এই নয় যে, যে ব্যক্তি তার মেধা, সময় ও শ্রম দিয়ে এগুলো করলো, তাকে আর্থিক মূল্যায়ন করা হবে না।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নবুওয়াত-রিসালাতের দায়িত্ব ছাড়াও ১২টি দায়িত্ব পালন করেন বলে আলেমরা উল্লেখ করেন। যেমন: বিচারক, রাষ্ট্রপ্রধান ও সেনাপতি।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ইন্তেকালের পর শুধুমাত্র নবুওয়াত-রিসালাতের দায়িত্ব ছাড়া বাকি বড় সব দায়িত্ব যায় খলিফার কাঁধে। যেমন: বিচারক, রাষ্ট্রপ্রধান ও ইমাম।

একজন খলিফা হিশেবে আবু বকর, উমর, উসমান, আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুম যেসব দায়িত্ব পালন করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেগুলো তো পালন করেনই, পাশাপাশি তার কাঁধে ছিল রিসালাতের দায়িত্ব; যা তাঁর প্রধান দায়িত্ব।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর এসব দায়িত্ব পালনের জন্য বায়তুলমাল থেকে বেতন-ভাতা নেননি, এটা সত্য। তারচেয়ে বড় সত্য হলো, এটা রাসূলের জন্য খাস।

কিন্তু, আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু খলিফা হবার আগে ছিলেন ব্যবসায়ী। খিলাফতের দায়িত্বলাভের পর তিনি তার মতো ব্যবসা করতে যান। কিন্তু উমর ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহু তাকে পরামর্শ দেন, ব্যবসা না করে খিলাফতের দায়িত্ব ফুলটাইম পালন করতে। উমরের মতকে সমর্থন জানান আবু উবাইদাহ আমর ইবনুল জাররাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে শুরু করে বাকি সাহাবিরা।

খলিফার জন্য নির্ধারণ করা হয় বার্ষিক ২৫০ দিনার ভাতা, দৈনিক অর্ধেক বকরি। কিছুদিন পর দেখা গেল, সেই অর্থে আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহুর সংসার চলছে না। তিনি আবার ব্যবসা শুরু করতে চান। আবারো উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু তাকে বাধা দেন। এবার সবার পরামর্শের ভিত্তিতে তার দৈনিক ভাতা বাড়ানো হয়। অর্ধেক বকরি থেকে একটি বকরি নির্ধারণ করা হয় এবং বার্ষিক তিনশো দিনার নির্ধারণ করা হয়।

সাহাবিদের কাছে সর্বশেষ উদাহরণ ছিলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। তারা দেখেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যেই কাজের বিনিময়ে কোনো অর্থ নেননি, আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহুকে সেই কাজের বিনিময়ে অর্থ দেয়া হয়। খলিফা হওয়াটা কোনো পেশা নয়। অর্থোপার্জনের জন্য সাহাবিরা খলিফা হননি। কিন্তু, খলিফা হলে তো ফুলটাইম দায়িত্ব পালন করতে হবে। ফুলটাইম দায়িত্ব পালন করলে নিজেদের সংসার চলবে কিভাবে? খলিফাদের জন্য তো আর আল্লাহ আকাশ থেকে মান্না-সালওয়া পাঠাবেন না।

খলিফা হবার পর তাদের ব্যক্তিগত আর্থিক দায়িত্ব যায় খিলাফতের ওপর। বায়তুলমাল থেকে তাদের জন্য ন্যূনতম ভাতা নির্ধারণ করা হয় যা দিয়ে তারা জীবনযাপন করতে পারেন। কোনো সাহাবি এতে আপত্তি জানান বলে শুনা যায় না। কোনো সাহাবি বলেননি, এভাবে অর্থ নেয়া জায়েজ? এভাবে অর্থ নেয়া বিদআত নয়তো, যেহেতু নবিজী সা. নেননি? এভাবে অর্থ নেয়া সুন্নাহর পরিপন্থী নয় তো? রাসূল তো বলেননি খলিফার বার্ষিক ভাতা ৩০০ দিনার দিতে হবে? এটার দলীল কী?

তারমানে এই নয় যে, সাহাবিরা জায়েজ, না-জায়েজ পরোয়া করতেন না। সাহাবিরা তো সন্দেহজনক সবকিছু থেকে দূরে থাকতেন। তাদের দ্বীনি ইলম ছিল পূর্ণাঙ্গ। তারা একপেশে, খণ্ডিত জ্ঞান দিয়ে দ্বীন বুঝতেন না। দ্বীনের পূর্ণাঙ্গ বুঝ ছিল বলেই তারা সিদ্ধান্তগ্রহণে বিচক্ষণতা দেখান।

নবিজি করেননি বলেই করা যাবে না, সবকিছুতেই তারা এমনটা অ্যাপ্লাই করতেন না। এটার কারণ নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিরোধিতা নয়, বরং দ্বীনের সামগ্রিক বুঝ। তারা বুঝতে পারতেন, নবিজি করেননি এমন কাজও করা যায় এবং সেটা শরীয়ত বিরোধী নয়। যেমন: কুরআন সংকলন।

পরিপূর্ণভাবে দ্বীন বুঝতে গেলে সীরাত পড়ার পাশাপাশি সাহাবিদের জীবনী পড়ার কোনো বিকল্প নেই। কুরআন পড়ার পাশাপাশি উলুমূল কুরআন, হাদিস পড়ার পাশাপাশি উলুমূল হাদিস ও ফিক্বহ পড়ার পাশাপাশি উসুলূল ফিক্বহ।

নতুবা এমন এমন প্রশ্নের সম্মুখীন হবো, যেগুলোর উত্তর পাওয়া যাবে না। তখন মনে হবে এগারোটি বিয়ে করাই বুঝি সুন্নাত, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করা সুন্নাত, ঘুমানোর পর নাক ডাকা সুন্নাত! এগুলো যে সুন্নাত না, সেটা বুঝার জন্য ভিন্ন ভিন্ন ডিসিপ্লিন পড়তে হবে।

সাহাবিদের মতো সুন্নতের অনুসরণকারী প্রজন্ম পৃথিবীতে আর আসবে না। সাহাবিদের মতো দ্বীনের বুঝঅলা প্রজন্ম আর আসবে না। কিন্তু আপনি যদি সাহাবিদের জীবনী বুঝতে ভুল করেন, ব্যর্থ হন, তাহলে দলিল দিয়ে (!) সাহাবিদেরকে পর্যন্ত বিদআতী, সুন্নাহর পরিপন্থী বানিয়ে দিতে পারবেন।

তথ্যসূত্র: ড. আলী মুহাম্মদ সাল্লাবী, আবু বকর সিদ্দিক, পৃষ্ঠা ২৭১