সিরাত ও ফিকহুস সিরাত

তুহিন খান

প্রকাশিত : নভেম্বর ১২, ২০১৯

`সিরাত` আর `ফিকহুস সিরাত`— দুইটা এক জিনিশ না। নামের মধ্যেই এই দুই জিনিশের যে একটা ফারাক আছে, তা পষ্ট। ফারাকটা আরেকটু ভালোভাবে বোঝা যাউক।

`সিরাত` মানে ইতিহাস, জীবনী। একজন মানুষের জীবন বা কোনও ঘটনার সাধারণ ধারাবাহিক বর্ণনা হইলো `সিরাত`। কারুর জন্ম, মৃত্যু, বাল্যকাল, শিক্ষা ইত্যাদির একটা সরল বর্ণনারে বলা হয় `সিরাত`। এই হিশাবে, সিরাত হইলো মোহাম্মদের (স.) জীবনের সরল বিবরণ।

`ফিকহুস সিরাত` একটু আলাদা। `ফিকহ` শব্দের অর্থ গভীর জ্ঞান, বিশেষ জ্ঞান ইত্যাদি। সাধারণ সিরাতের বইগুলায় রাসূলের জীবনী সরলভাবে বয়ান করা হয় কেবল। কিন্তু `ফিকহুস সিরাত`র বইগুলার উদ্দেশ্য থাকে মোটাদাগে দুইটা—

এক. রাসূলের জীবন, জনম থেকে মরণ পর্যন্ত ঘইটা যাওয়া সকল ঘটনারে কম্প্রেহেনসিভলি, মানে সামগ্রিকভাবে দেখা। মানে, তার জীবনের প্রতিটা ঘটনার মধ্যে যোগসূত্র তৈরি করা; গভীরভাবে নীরিক্ষার মাধ্যমে তার সম্পূর্ণ জীবনরে একটা কার্যকারণসূত্রে ব্যাখ্যা করা। কেবল `হিস্ট্রি` হিশাবে না, তার পুরা লাইফটারে একটা `ফেনোমেনা` হিশাবে পাঠ করা।

দুই. এইভাবে পাঠের ভিতর দিয়া, তার জীবনের নীরিক্ষা ও তত্ত্বায়নের মাধ্যমে, প্রামাণ্যতা ও প্রাসঙ্গিকতা তৈরি করা। এই তত্ত্বায়ন ও প্রাসঙ্গিকতার ফিল্ড অনেকগুলা হইতে পারে— ধর্ম, রাজনীতি, জুরিসপ্রুডেন্স, মাকাসেদে শরিয়া ইত্যাদি।

এক কথায়, কেবল সাধারণ `হিস্ট্রি` হিশাবে রাসূলের জীবনী পাঠ হইলো `সিরাত`; আর ওনার সমগ্র জীবনরে একটা জার্নি হিশাবে দেখার মাধ্যমে, ওই জার্নিটারে `টেক্সট` তথা কোরআন ও হাদিসের সাথে মিলাইয়া মিলাইয়া বর্তমানের মধ্যে আবিষ্কার ও সূত্রাবদ্ধ করা হইলো `ফিকহুস সিরাত`।

এমনিতে, ক্ল্যাসিক সিরাত লেখকদের অনেকেই `ফিকহুস সিরাত` নিয়াও কাজ করছেন; মানে, আলি সাল্লাবির মতো যারা খালি `ইতিহাসের গল্প` লেখে নাই, ইতিহাসটাই চর্চা করছে— তারা অনেকেই ছাড়া ছাড়াভাবে `ফিকহুস সিরাত` লেখছেন। তবে প্রথম আলাদা নাম ও শাস্ত্র হিশাবে এই জিনিশের শুরু মুহাম্মদ আল গাজালির হাতেই।

১৯৬৫ সালে মুহাম্মদ আল গাযালির `ফিকহুস সিরাত` বইটা প্রথম পাবলিশ হয়। গাযালি এই বইয়ে মূলত রাসূলের জীবনের একটা কোহেরেন্ট/জমাট পাঠ তৈরি করতে চাইছেন, এবং এর ভিতর দিয়া একটা দাওয়াতি মডেল খাড়া করতে চাইছেন। বেসিক্যালি, মডার্ন টাইমফ্রেমে রাসূলের সিরাতরে উনি একটা নয়া হাইসিয়ত দিতে চাইছিলেন। ক্রিটিকরা ওনার এই বইটারে `ফিকহুদ দাওয়াত` বা `দাওয়াতের নিয়মনীতি` হিশাবে পড়ার কথা বলেন। উনি যেহেতু পলিটিশিয়ান ছিলেন, মানে ইখওয়ান করতেন, ফলে উনি বেসিক্যালি এই লাইনেই আগাইছিলেন। বইটা পরে নাসিরুদ্দিন আলবানির তাখরিজে (হাদিসের প্রামাণ্যতা চিহ্নিত করা) ২০০২-এ সম্ভবত নয়া সংস্করণ হয়। বইটার ইংরাজি তরজমা পাওয়া যায়, রিসেন্টলি `ঐতিহ্যে` বাঙলা একটা তরজমাও দেখলাম।

এই লাইনে বিখ্যাত ও তুলনামূলক অ্যাকাডেমিক্যালি ভালো বই অবশ্য সিরিয়ার রমজান বুতি-র `ফিকহুস সিরাত`। ইংরাজিতে `জুরিসপ্রুডেন্স অব প্রোফেটিক বায়োগ্রাফি` নামে তরজমা হইছে, যদিও `জুরিসপ্রুডেন্স`র মতো নিরেট আইনি শব্দ দিয়া, এইখানে `ফেকাহ`র তরজমা আমার ঠিক মনে হয় নাই। এই বই বের হয় ২০০৯ সালে। এই বইটা অ্যাকাডেমিকালি গাযালির বইয়ের চাইতে ডিফরেন্ট। গাযালির বইটা ছিল মোর দাওয়াতি/পলিটিকাল; এইটা মোর অ্যাকাডেমিক/উসূল বেজড। বইয়ের ট্যাগলাইনে সেই ইঙ্গিত আছে— `রাসূলের জীবন এবং সেই জীবনরে কেন্দ্র কইরা যেসব আইনি ও দাওয়াতি কার্যক্রম তার নিয়মতান্ত্রিক অ্যাকাডেমিক পাঠ`।

ক্রিটিকরা এই বইটারে বেসিক্যালি, রাসূলের জীবনরে শরিয়ত ও দাওয়াতের সাপেক্ষে আবিষ্কারের জন্য গুরুত্ব দেন। এই দুই বই বাদে, আরও একটা, তুলনামূলক কম আলোচিত বই আছে এই বিষয়ে। উম্মূল কুরা ভার্সিটির প্রফেসর ওস্তাদ মুনির গাদবানেরও `ফিকহুস সিরাত` নামে বই আছে। বইটা পাবলিশ হইছিল ১৯৯২ সালে। প্রথম দুইটা বইয়ের চাইতে এই বইটার আলাপ কম; এর ইংরাজি/বাঙলা কোনও তরজমাই চোখে পড়ে নাই। সম্ভবত মুনির গাদবানের নির্ভেজাল পার্সোনাল লাইফ এর জন্য কিছুটা `দায়ী`, আবার উনার রেজিওনের দায়ও থাকতে পারে, যেহেতু উনি আসলে, উপরের দুইজনের মতো, কোনও `বিপ্লবী` রেজিওনের লোক না। ওনার বইতেও সম্ভবত তার কিছু ছাপ আছে, আমি শিওর না।

যাই হোক, এই বইটা গায়ে-গতরে আগের দুইটার চাইতে বড়, প্রায় আটশো পেজ! এবং বইটা অনেক বেশি ওয়েল প্রজেক্টেড। এই বইটায় রাসূলের পুরা জীবনের মেজর স্টেপ ও ঘটনাগুলার একটা ম্যাপিং করা হইছে, ক্যাটাগোরাইজ করা হইছে। আর তারপর প্রচুর কোরআনের আয়াত আর হাদিস দিয়া ওই ম্যাপটারে মজবুত করা হইছে। এই বইটা মূলত একজন দায়ী/পলিটিশিয়ানের জন্য একটা পুরা লাইফম্যাপ তৈরি করছে।

এই তিনটার বাইরে আরো বইপত্র থাকতে পারে, আমি শিওর না। তবে, এই আধুনিক সময়ে রাসূলের সিরাতের কার্যকরী পাঠের জন্য, এই তিনটা বই নানাভাবে গুরুত্বপূর্ণ বইলা মনে হয়। আপনাদের জানামতে, এইরকম আরো বই থাকলে, জানাইয়েন।