সুফিবাদের মর্মকথা

ছায়াবীথি শ্যামলিমা

প্রকাশিত : আগস্ট ০৮, ২০২০

সুফিবাদ একটি ইসলামি আধ্যাত্মিক দর্শন। আত্মা সম্পর্কিত আলোচনা এর মুখ্য বিষয়। সুফিবাদের একমাত্র মূল বিষয়টি হলো, আপন নফসের সঙ্গে, নিজ প্রাণের সাথে, নিজের জীবাত্মার সাথে পরমাত্মা আল্লাহ যে শয়তানটিকে আমাদের পরীক্ষা করার জন্য দিয়েছেন, তার সাথে জিহাদ করে তার থেকে মুক্ত হয়ে এ জড় জগৎ থেকে মুক্তি পাওয়া। আত্মার পরিশুদ্ধির মাধ্যমে আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনই হলো এ দর্শনের মর্মকথা।

পরম সত্তা মহান আল্লাহকে জানার আকাঙ্ক্ষা মানুষের চিরন্তন। স্রষ্টা ও সৃষ্টির মধ্যে বিদ্যমান সম্পর্ককে আধ্যাত্মিক ধ্যান ও জ্ঞানের মাধ্যামে জানার প্রচেষ্টাকে সুফি দর্শন বা সুফিবাদ বলা হয়। হযরত ইমাম গাজ্জালির (র.) মতে, সবরকমের মন্দ থেকে আত্মাকে পবিত্র করে সর্বদা আল্লাহর আরাধনায় নিমজ্জিত থাকা এবং সম্পূর্ণরূপে আল্লাহুতে নিমগ্ন হওয়াই সুফিবাদ। আরবি সুফ শব্দের অর্থ পশম আর তাসাওউফের অর্থ পশমি বস্ত্র পরিধানের অভ্যাস (লাব্‌সু’স-সুফ)।

এরপর মরমি তত্ত্বের সাধনায় কারও জীবনকে নিয়োজিত করার কাজকে বলা হয় তাসাওউফ। যিনি নিজেকে এইরূপ সাধনায় সমর্পিত করেন ইসলামের পরিভাষায় তিনি সুফি। ইসলামি পরিভাষায় সুফিবাদকে তাসাওউফ বলা হয়, যার অর্থ আধ্যাত্মিক তত্ত্বজ্ঞান। তাসাওউফ বা সুফিবাদ বলতে অবিনশ্বর আত্মার পরিশুদ্ধির সাধনাকে বুঝায়। আত্মার পবিত্রতার মাধ্যমে ফানাফিল্লাহ (আল্লাহর সঙ্গে অবস্থান করা) এবং ফানাফিল্লাহর মাধ্যমে বাকাবিল্লাহ (আল্লাহর সঙ্গে স্থায়িভাবে বিলীন হয়ে যাওয়া) লাভ করা যায়। যেহেতু আল্লাহ নিরাকার, তাই তাঁর মধ্যে ফানা হওয়ার জন্য নিরাকার শক্তির প্রতি প্রেমই একমাত্র মাধ্যম।

তাসাওউফ দর্শন অনুযায়ী এই সাধনাকে তরিকত বা আল্লাহ-প্রাপ্তির পথ বলা হয়। তরিকত সাধনায় মুর্শিদ বা পথপ্রদর্শকের প্রয়োজন হয়। সেই পথ হলো ফানা ফিশ্‌শাইখ, ফানা ফিররাসুল ও ফানাফিল্লাহ। ফানাফিল্লাহ হওয়ার পর বাকাবিল্লাহ লাভ হয়। বাকাবিল্লাহ অর্জিত হলে সুফি দর্শন অনুযায়ী সুফি আল্লাহ প্রদত্ত বিশেষ শক্তিতে শক্তিমান হন। তখন সুফির অন্তরে সার্বক্ষণিক শান্তি ও আনন্দ বিরাজ করে। সুফিগণের মতে, হযরত মুহাম্মাদ (সা.) স্বয়ং সুফিদর্শনের প্রবর্তক। এর সপক্ষে সুফিগণ মুহাম্মাদের (সা.) একটি হাদিস উল্লেখ করেন যা হলো, মানবদেহে একটি বিশেষ অঙ্গ আছে, যা সুস্থ থাকলে সমগ্র দেহ পরিশুদ্ধ থাকে, আর অসুস্থ থাকলে সমগ্র দেহ অপরিশুদ্ধ হয়ে যায়। জেনে রাখো এটি হলো কল্‌ব বা হৃদয়। আল্লাহর জিকর বা স্মরণে কল্‌ব কলুষমুক্ত হয়। সার্বক্ষণিক আল্লাহর স্মরণের মাধ্যমে কল্‌বকে কলুষমুক্ত করে আল্লাহর প্রেমার্জন সুফিবাদের উদ্দেশ্য। যারা তাঁর প্রেমার্জন করেছেন, তাদের তরিকা বা পথ অনুসরণ করে ফানাফিল্লাহর মাধ্যমে বাকাবিল্লাহ অর্জন করাই হলো সুফিদর্শন।

সুফিবাদ উৎকর্ষ লাভ করে পারস্যে। সেখানকার প্রখ্যাত সুফি-দরবেশ, কবি-সাহিত্যিক এবং দার্শনিকরা নানা শাস্ত্র, কাব্য ও ব্যাখ্যা-পুস্তক রচনা করে এই দর্শনকে সাধারণের কাছে জনপ্রিয় করে তোলে। কালক্রমে বিখ্যাত অলিদের অবলম্বন করে নানা তরিকা গড়ে ওঠে। সেগুলির মধ্যে কয়েকটি প্রধান তরিকা সর্বাধিক প্রসিদ্ধি লাভ করে। এগুলো হলো, গাউসুল আজম বড় পির হযরত আবদুল কাদির জিলানি (র.) প্রতিষ্ঠিত কাদেরিয়া তরিকা, সুলতানুল হিন্দ হযরত খাজা মঈনুদ্দিন চিশতি (র.) প্রতিষ্ঠিত চিশতিয়া তরিকা, গাউসুল আজম হযরত আহমদ উল্লাহ মাইজভান্ডারি (ক.) ও গাউছুল আযম গোলামুর রহমান মাইজভান্ডারি (ক.) প্রতিষ্ঠিত মাইজভান্ডারিয়া তরিকা, হযরত খাজা বাহাউদ্দিন নকশবন্দী (র.) প্রতিষ্ঠিত নকশবন্দিয়া তরিকা এবং হযরত শেখ আহমদ মুজাদ্দিদ-ই-আলফে সানি সারহিন্দি (র.) প্রতিষ্ঠিত মুজাদ্দিদিয়া তরিকা।