সৌদি যতদিন ইসলামের নেতৃত্ব দেবে, মুসলমানদের মুক্তি অসম্ভব

রিফাত বিন সালাম

প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ১১, ২০১৯

মীর মশাররফ হোসেনের মহাকাব্যিক উপন্যাস ‘বিষাদ-সিন্ধু’কে উপন্যাস হিসেবে দেখাই ভালো। এসব গোজামিল গল্প মুসলিমদের আরো পশ্চাৎপদই করেছে স্রেফ। ইমাম হুসাইনের প্রতি যে অন্যায় হয়েছিল তার সূত্রপাত সেই প্রাকইসলামের আমলেই হয়েছিল, কারবালা তার শেষ অধ্যায় মাত্র। আলীর জীবনী পাঠই জরুরি এখন। একইসাথে সুন্নি চিন্তার আসল চেহারাও পরিষ্কার হওয়া উচিত।

হিজরি ৩৫`এর শেষ দিকে হজরত আলীর (আ.) খেলাফত কাল শুরু হয়। প্রায় ২৫ বছর পর আলী তার দায়িত্ব ফিরে পান। কারণ নবি মুহাম্মদ (সা.) দশম হিজরির ১৮ জিলহজ্ব গাদিরে খুম নামক স্থানে আলীকে (আ.) তার স্থলাভিষিক্ত হিসেবে ঘোষণা দিয়েছিলেন। কিন্তু টানা ২৫ বছর আলীর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চলে। এই ষড়যন্ত্র আলীর পুত্র ইমাম হুসাইন (আ.) পর্যন্ত চলেছে। এটা ছিল খোদ মুহাম্মদের আদর্শের বিরুদ্ধেই সুন্নিদের ষড়যন্ত্র। তা না-হলে নবির মৃত্যুর পর, নবির কথামতো ক্ষমতায় বসার কথা আলীর। নবির কথা অনুসরণ করলে আজ হয়তো জ্ঞানে-বিজ্ঞানে এগিয়ে যাওয়া ইসলামকে দেখতাম আমরা।

আলীর খেলাফত স্থায়ী ছিল প্রায় পাঁচ বছর। আলীর ক্ষমতাগ্রহণ ছিল রীতিমতো এক বৈপ্লবিক আন্দোলন। আলীকে তার অধিকার ফিরে পেতে যে ২৫ বছর অপেক্ষা করতে হলো, সেই ‘অধিকার’ আলীর ব্যক্তিগত অধিকার ছিল না, বরং আধুনিক আরবের প্রথামিক অধিকার ছিল, যা প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল নবি নিজেই। ক্ষমতায় বসার পর আলী তার আন্দোলনের ডাকও দেন।

নাহজুল বালাগাতে আলী বলছেন, “হে জনগণ, জেনে রেখো, নবুয়াতের যুগে যে সমস্যায় তোমরা ভুগেছিলে আজ আবার সেই সমস্যাতেই জড়িয়ে পড়লে। তোমাদের মধ্যে একটা ব্যাপক পরির্বতন ঘটবে। যে সকল মহৎ ব্যক্তিরা এতদিন পিছিয়ে ছিলেন তারা এখন সামনের সারিতে চলে আসবেন। একইভাবে যেসব অযোগ্য লোক এতদিন সামনের সারিতে অবস্থান নিয়েছিল আজ তারা পিছনে চলে যাবে। (সত্য ও মিথ্যা বিদ্যমান এবং এতদুভয়ের প্রত্যেকেরই অনুসারীও রয়েছে। তবে সবারই উচিত সত্যকে অনুসরণ করা) মিথ্যার পরিমাণ যদি অধিকও হয়, সেটা এমন নতুন কিছু নয়। সত্যের পরিমাণ যদি কমও হয়, হোক না! অনেক সময় কমওতো সবার চেয়ে অগ্রগামী হয়ে থাকে। আর উন্নতির আশাও এতে রয়েছে। তবে এমনটি খুব কমই দেখা যায় যে, যা একবার মানুষের হাতছাড়া হয়ে গেছে তা পুনরায় তার কাছে ফিরে এসেছে।” (নাহজুল বালাগা, ১৫ নং বক্তৃতা।)

নবি মুহাম্মদের পরে আরবে আর একজনই জ্ঞানী ব্যক্তি ছিলেন, নিঃসন্দেহে সেটা আলী (রা)। নবি তাই বলেছিলেন,"আমি হলাম ইলমের শহর আর আলী হলেন তার দরজা।" যদিও এই হাদিস নিয়ে বিতর্কের শেষ নাই। বিতর্কের প্রশ্ন তুললে তো "সিহাহ সিত্তাহ" অর্থাৎ "নির্ভুল ছয়" এর ইতিহাস নিয়েও প্রশ্ন করা অবান্তর হবে না। ইমাম বুখারীর জন্ম ১৩ শাওয়াল, ১৯৪ হিজরী অর্থাৎ ৮১০ খ্রিস্টাব্দ। এই সময়ের মধ্যে ইসলাম একাধিক গৃহযুদ্ধের সম্মুখীন হয়েছে বিশৃঙ্খল আরব। আলীর মতো নেতাও খুন হয়েছেন। এই সময় সুন্নিরাই হাদিস সংগ্রহের নিয়ন্ত্রক, ফলে আলীর পক্ষে কথা বা লেখার মতো লোক ছিল কমই। আলীর ইতিহাস সম্পর্কে যা ছিল, সেগুলোকেও নানা তরিকায় ভুল প্রমাণ করার চেষ্টা করেছে সুন্নিরা। যে সিফফিনের রক্তাক্ত যুদ্ধের পর হযরত আলী (রা) খিলাফত হারান এবং হযরত মুয়াবিয়া (রা) নতুন খলিফা হন, সে যুদ্ধেও আলীর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা হয়েছে।

আলীই সর্বপ্রথম আরবি ব্যাকরণ ও সাহিত্যের মূলনীতি রচনা করেন। গ্রীক দার্শনিকদের লেখাপত্রও অনুবাদ শুরু হয় আলীর আমলে। "ইমাম আলী (আ.)-এর কাছে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত ঐসব জ্ঞানী-পণ্ডিতদের মাঝে হযরত ওয়ায়েস কারানী (রা.), হযরত কুমায়েল বিন যিয়াদ (রা.), হযরত মিসাম তাম্মার (রা.) ও রশীদ হাজারীর (রা.) মতো অসংখ্য সাধুপুরুষও ছিলেন। যারা ইতিহাসে ইসলামি ইরফানের (আধ্যাত্মবাদ) উৎস হিসেবে পরিচিত। ইমাম আলীর (আ.) শিষ্যদের মধ্যে আবার অনেকেই ইসলামি ফিকাহ (আইন শাস্ত্র), কালাম (মৌলিক বিশ্বাস সংক্রান্ত শাস্ত্র), তাফসীর, কিরাআত (কুরআনের শুদ্ধপঠন শাস্ত্র) ও অন্যান্য বিষয়ের মুল উৎস হিসেবে পরিচিত।" (আল-সিয়া থেকে নেয়া)

উসমানের (রা.) হত্যার পর থেকেই আলী বিরোধীরা অভিযোগ তোলে যে, আলীই এই হত্যার সাথে সংশ্লিষ্ট। আলী সরাসরি এ কথা অস্বীকার করেন। পরবর্তীতে জনগণ তাকে খলিফা নিযুক্ত করতে চাইলে তিনি অস্বীকৃতি জানান। তবুও জণগণ জোরপূর্বক তাকে খলিফা মনোনীত করে। এরপরেও হত্যার সংশ্লিষ্টতা বিষয়ে আলির সম্পর্ক বিষয়ে তর্ক বিতর্ক চলতে থাকে। একপর্যায়ে তা চরম আকার ধারণ করতে থাকে এবং আয়িশাও (রা.) তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে ওঠেন। আলীর বিরুদ্ধে এ যুদ্ধে তিনি পেছন থেকে নির্দেশনা ও নেতৃত্বও দেন। আলীর শাসনকাল ছিল ভয়াবহ, কারণ কেউ আলীকে সহযোগিতা করেনি বরং আলীর বিরুদ্ধে একের পর এক ষড়যন্ত্র করেছে।

৪০ হিজরির ১৯ রমজান বা ৬৬১ খৃস্টাব্দের ২৭ জানুয়ারি মসজিদে কুফায় নামাজ পড়ার সময় খারেজি আব্দুর রহমান ইবনে মুলজাম কর্তৃক হামলার শিকার হন আলী। তিনি নামাজে সেজদা দেয়ার সময় ইবনে মুলজামের বিষ-মাখানো তরবারি দ্বারা আঘাতপ্রাপ্ত হন। আলী তার পুত্রকে নির্দেশ দেন কেউ যেন খারেজিদের আক্রমণ না করে, তার বদলে তিনি নির্দেশ দেন যে, যদি তিনি বেঁচে যান, তবে যেন ইবনে মুলজামকে ক্ষমা করে দেয়া হয়, আর যদি তিনি মারা যান, তবে ইবনে মুলজামকে যেন নিজ আঘাতের সমতুল্য একটি আঘাত করা হয় (তাতে ইবনে মুলজামের মৃত্যু হোক বা না হোক।)। আলী হামলার দুদিন পর ২৯ জানুয়ারি ৬৬১ খৃস্টাব্দে (২১ রমজান ৪০ হিজরি) মৃত্যুবরণ করেন। আল-হাসান তার নির্দেশনা অনুযায়ী কিসাস পূর্ণ করেন এবং আলীর মৃত্যুর ভিত্তিতে তাকে সমপরিমাণ শাস্তি দেন।

তারপরের ঘটনা, সেই পরিচিত কারবালার ঘটনা, এটাই ছিল আলীর আদর্শের উপর সবশেষ আঘাত। আঘাত আজও চলছে। সৌদি আরবের মতো দেশ যতদিন ইসলামের নেতৃত্ব দেবে, ততদিন মুসলমানদের মুক্তি অসম্ভব। আলীর জীবনী আসলেই ইসলামেরই ইতিহাস। শাসক শ্রেণির সাথে জনতার লড়াই। আলী অবশ্যই আরবের সাধারণ জনতার পক্ষে ছিলেন। যেমন ছিলেন মুহাম্মদ (সা.)।

লেখক: কবি, কলামিস্ট ও কার্টুনিস্ট