সৌভিক রেজার গদ্য ‘প্রতিনায়ক নিয়ে সামান্য দু’চার কথা’

প্রকাশিত : মে ০৬, ২০২১

বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সবচেয়ে রহস্যময় দল হচ্ছে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল। এটা এ-কারণে নয় যে, যাকে অথবা যাদের কেন্দ্র করে দলটি গড়ে উঠেছিল, সেই ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ ছিলেন রহস্যময় মানুষ। রহস্য বরং এই কারণে যে, প্রচলিত বয়ানে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে দেশ স্বাধীন হচ্ছে ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১ সালে আর সেই দল থেকেই বেরিয়ে গিয়ে জাসদের জন্ম হচ্ছে ১৯৭২ সালের ৩১ অক্টোবর।

সময়ের ব্যবধান বলা যায় দশ মাসের ব্যবধানে। এই দশ মাসের মধ্যে দেশে কী এমন ঘটনা ঘটে গেল যে, মূল দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আলাদা একটি দল গঠন করতে হলো? এই দল গঠনের কারণগুলো এখনও পর্যন্ত স্পষ্ট নয়। জাসদের নেতারাও এই বিষয়ে তেমন পরিষ্কার করে বলতে চান না, তেমনি এই দলের ইতিহাস যিনি লিখছেন, মহিউদ্দিন আহমদও, প্রাণান্তকর চেষ্টা করেও রহস্যের জট খুলতে পারেননি। তিনি বরং একের পর এক বই লিখে জট আরও বাড়িয়ে চলেছেন। সেই জটের সাম্প্রতিক নিদর্শন ‘প্রতিনায়ক’ বইটি। প্রকাশক: প্রথমা। প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি ২০২১।

জাসদের জন্ম নিয়ে সবাই নিউক্লিয়াস, নিউক্লিয়াস করেন। শুনে-শুনে মাঝে-মাঝে মনে হয়, স্বাধীনতার আন্দোলন বিশেষ করে ষাটের দশকের পাকিস্তান-বিরোধী আন্দোলন গড়ে ইউঠেছে এই নিউক্লিয়াসের কল্যাণে। যার নেতৃত্বে ছিলেন `মহাননেতা` সিরাজুল আলম খান। কখনও-কখনও জাসদের বয়ানে তাকে ভাসানী-মুজিবের চেয়েও বেশি সক্রিয় দেখানোর প্রবণতা রয়েছে। অবশ্য তিনি যেনে পথ্যের কারিগর, সেটিও উল্লেখ করা হয়। মহিউদ্দিন আহমদও করেছেন। কিন্তু এই নিউক্লিয়াস মুক্তিযুদ্ধের সময় কী এমন অবদান রেখেছে যে, তা না হলে দেশের স্বাধীনতা বিলম্বিত হতো, সেটা বুঝে ওঠা মুশকিল।

`প্রতিনায়ক` বইটার ভরকেন্দ্র সিরাজুল আলম খান। এই বইটির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তাকে কেন্দ্র করেই বইটি লেখা। শুধু তা-ই নয়, তার বয়ানকেই বিশ্বাস যোগ্যতার একমাত্র সূত্র হিসেবে লেখক প্রতিষ্ঠিত করতে আপ্রাণ চেষ্টা করে গেছেন। তিন লিখেছেন, একসময় সিরাজুল আলম খান ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ডান হাত। তাদের মধ্যকার সম্পর্কের রসায়ন তৃতীয় ব্যক্তির পক্ষে সবটা বোঝা কঠিন। (পৃ.৩৩৬)। এ যেন রোমান্টিক রবীন্দ্রনাথের `জীবন-দেবতা`র আলোচনা পড়ছি, ইতিহাস নয়। তারপরই লেখক বলতে সচেষ্ট হয়েছেন, এ প্রসঙ্গে সিরাজুল আলম খান নিজে যেটুকু বলবেন বা অন্যকোনো চাক্ষুষ সাক্ষীর বয়ান থেকে যা জানা যাবে, সেটুকুই ইতিহাসের উপাদান হতে পারে। (পৃ.৩৩৭)।

কেন শুধু সিরাজুল আলম খানকে বেছে নেয়া হলো, তার তেমন একটা জবাব এই বই থেকে পাওয়া যায় না। আর চাক্ষুষ দেখাটাও বা কতখানি দেখা?—সেটাও তো একটা প্রশ্ন হতে পারে।

ইতিহাসের সেই উপাদানের খোঁজে লেখক সিরাজুল আলম খানসহ বারো রকমের মানুষের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। যাদের মত-পথ এখন একদমই আলাদা। মোটামুটি সবাই নিজেকে বাঁচিয়ে নিজের-নিজের সুবিধামতো বয়ান দিয়েছেন বটে, কিন্তু সেখান থেকে পাঠক তো দূরের কথা, লেখক নিজেও কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছোতে পারেননি। যে-কারণে পুরো বইটা বারোভাজায় পরিণত হয়েছে, যা মুখরোচক বটে কিন্তু আদতে পুষ্টিহীন!

মুজিব বাহিনীর গঠনের নেপথ্যের কারণ সম্পর্কে কিছুই জানা যায় না। কেন এই বাহিনী প্রবাসী সরকারের বিরোধিতা করেছিল, যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বামপন্থীদের হটাতে চেয়েছিল, ভারত সরকার একদিকে প্রবাসী সরকারকে সমর্থন দিচ্ছে তাহলে অন্যদিকে কেন জেনারেল উবানকে দিয়ে গঠন করা `মুজিব বাহিনী`কেও অস্ত্র সহায়তা করছে—সেসব প্রশ্নেরও উত্তর নাই।

মুজিব-সিরাজুল আলম খানের সম্পর্কে রসায়নের কথা মহিউদ্দিন আহমদ বলেছেন। কিন্তু সারা দেশে যেখানে জাসদের নেতাকর্মীরা আওয়ামী ও রক্ষী বাহিনীর হাতে নির্বাচারে নির্যাতিত হচ্ছে, তখনও গুরু-শিষ্যের মধ্যকার সম্পর্কটি একেবারে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়নি। (পৃ. ৩৩৭)। শুধু তা-ই নয়, আন্ডার গ্রাউন্ডে সেল্টারে থাকা সিরাজুল আলম খানের জ্বর হবার খবরও মুজিবের কাছে অজানা থাকে না। (পৃ.৩৩৮) এর মানেটা কী দাঁড়ায়? জাসদের সঙ্গে তাহলে শুরু থেকেই গাদ্দারিটা করছে কে? যাকে সময়ের এই পর্যায়ের ইতিহাসের প্রধান উৎস হিসেবে ভাবা হচ্ছে, তিনিই কি সেই মূল হোতা? আমরা আপাতত কোনো উত্তর দিচ্ছি না। প্রশ্নটা শুধু রেখে যাচ্ছি।

একদিকে হাজার-হাজার কর্মীর আর্তনাদ অন্যদিকে একজনার জ্বরের সংবাদে আরেকজনের বিহ্বলতা। বিহ্বলতা যিনি জ্বরাক্রান্ত, তারও। তবে এটা সংকোচের নয়; একে কি সংকটের বিহ্বলতা বলবো? নাকি নীতি-নৈতিকতার, আদর্শের সংকট?

সিরাজুল আলম খানের বর্তমান পরিণতি কম-বেশি সবারই জানা। নেপথ্যের মানুষ নেপথ্যেই রয়েছেন। কোনো সার-সংকলনে হাত দেন নাই। কোথায়-কোথায় দলের বা নেতাদের ভুলছিল, কোথায় ঠিক ছিল—সে-বিষয়ে এতদিনেও তিনি মুখ খুলতে নারাজ। একে আত্ম-অহমিকা ছাড়া আর কী বলা যায়? এতো একেবারেই ফ্যাসিবাদী মানসিকতার লক্ষণ। জাসদের মধ্যে নেতৃত্বের মতভেদ সম্পর্কে বলতে গিয়ে মহিউদ্দীন আহমদও জানিয়েছেন, সিরাজুল আলম খান রাজনৈতিক বিতর্কে অভ্যস্ত নন। ভিন্ন মতকে তিনি `বিদ্রোহ` হিসেবে দেখলেন এবং ভিন্ন মতালম্বীদের ডানা ছেঁটে দিতে চাইলেন। (পৃ. ৩৮৭) একজন মহাত্মার কী মহান রাজনৈতিক চরিত্র। তিনি কিনা বিতর্কে অভ্যস্ত নন। রাজনৈতিক সংস্কৃতির কী এক অপূর্ব নিদর্শন!

খান সাহেবের এখনকার জীবন যাপন সম্পর্কে লেখক জানিয়েছেন, ‘ধানমন্ডির ২৭ নম্বর সড়কে অক্সফোর্ড স্কুলে সন্ধ্যার পর সিরাজুল আলম খান বসেন। এখানে লোকজন আসে, কথাবার্তা হয়।’ খুব ভালো ব্যাপার। তারপর? খানের বিশ্বস্ত প্রদায়ক মহিউদ্দিন আহমদ মারফত আমরা জানতে পারছি, খান প্রতিবছর কয়েক মাসের জন্য বিদেশে চলে যান। বিশেষ করে নিউইয়র্কে। খুব শীত পড়লে ফিরে আসেন। (পৃ. ৪২৩) এই তথ্যটুকু পড়বার সঙ্গে-সঙ্গে অকালে কবরে শায়িত জাসদের নিবেদিত-প্রাণ তরুণ কর্মীদের কথা মনে পড়ে। এই সবুজ পৃথিবীর প্রতি যাদের দাবি সিরাজুল আলম খানদের চেয়ে কোনো অংশেই কম ছিল না!

আমরা এতক্ষণে `প্রতিনায়ক` বইটির বিষয়ে আমাদের প্রাথমিক পর্যালোচনা সমাপ্ত করছি। ধারণা করি, সিরাজুল আলম খানের এই রকম বিদেশে আসা-যাওয়ার মধ্যে দিয়ে দেশের মঙ্গলের জন্যে নতুন কোনো তত্ত্ব তৈরি হবে। ততক্ষণে হে বিচক্ষণ পাঠক/পাঠিকা, আপনারা `বারোভাজা` হজম করতে থাকুন। তবে মনে রাখুন, এটি স্বাদযুক্ত কিন্তু আদতে পুষ্টিহীন!

লেখক: অধ্যাপক (বাংলা বিভাগ) রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

একুশে বইমেলা ২০১৮