স্বকৃত নোমান

পর্ব ৩

মহাকালে রেখাপাত

প্রকাশিত : নভেম্বর ২০, ২০১৯

বেশিরভাগ অধ্যাপকের প্রবন্ধ পড়ার সময় মনে হয়, বাংলা সাহিত্য এখনো ঊনিশ-কুড়ি শতকেই পড়ে আছে। এক কদমও এগোয়নি। ভাষার যা ছিরি, পড়তে গেলে দাঁতটাত ভেঙে পড়ার দশা হয়। কোনো কোনো প্রবন্ধে দেখা যায়, উদ্ধৃতির আধিক্যে প্রবন্ধকারের বক্তব্য খুঁজে পাওয়া যায় না। উদ্ধৃতি, টীকা, টিপ্পনির কথা থাক। এসবের কথা বলতে গেলে প্রাবন্ধিকরা বলবেন একাডেমিক প্রবন্ধে উদ্ধৃতি, টীকা, টিপ্পনি ব্যবহার করতে হয়। অধ্যাপক কাম প্রাবন্ধিকদের নাম তো বলাই যাবে না। বললে ‘চাকরি থাকবে না।’ আর কবি শোয়েব সর্বনাম বলবেন, ‘সাহিত্যপুলিশ নিপাত যাক।’ গল্পকার মোজাফফর হোসেনও বলে বসতে পারেন, ‘নিজের লেখা বাদ দিয়ে এসব নিয়ে লাগলেন কেন?’ সুতরাং নামও থাক।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ইংরেজি-বাংলা বিভাগের বেশিরভাগ অধ্যাপক ছাত্রজীবনে বা পিএইচডি করার সময় যা পড়ছেন তা-ই ছাত্রদের পড়ান। সেসব পাঠ বিশ শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত। এরপর যে বিশ্বব্যাপী সাহিত্যকর্ম হয়েছে, কবিত-গল্প-উপন্যাস-নাটক লেখা হচ্ছে―তার খোঁজ রাখার বিশেষ প্রয়োজন মনে করেন না তাঁরা। তাঁরা প্রয়োজন মনে না করলে ছাত্রদের তো মনে করার কথা না। এমনই এক অধ্যাপকের একটি প্রবন্ধের বই একটি বিশেষ পুরস্কারে ভূষিত হওয়ায় আগ্রহ নিয়ে কিনেছিলাম। ভাষার দশা দেখে এতই বিরক্তি লাগল যে, পরদিন অফিস থেকে ফেরার সময় মুদি দোকানে খরচ আনতে গিয়ে আলগোছে বইটা রেখে আসি। ভাবটা এমন―যেন আমি ওটা ভুল করে রেখে এসেছি। ভেবেছিলাম দোকানদার বইটা ছিঁড়ে খরচাপাতি বিক্রি করে দেবে। কিন্তু না, পরদিন দোকানে যেতেই মহান সৎলোকের মতো বইটা বাড়িয়ে ধরে দোকানদার বলল, ‘নেন, বইটা মনে হয় আপনার, কাল রেখে গেছিলেন।’ কী আর করি! ওই জিনিস আবার ফেরত নিতে হলো বাসায়। পরে এক লাইব্রেরিতে দিয়ে দিই।

আরেকবার সাড়ে পাঁচশো টাকায় একটা প্রবন্ধের বই কিনে পড়তে গিয়ে মেজাজ এতই খারাপ হয়েছিল যে, বইটাতে গ্যাসলাইটের আগুন ধরিয়ে দিয়েছিলাম। প্রচ্ছদটা এতই মজবুত, আগুনে কাজ হলো না; খানিকটা পুড়ে আগুনটা নিভে গেল। আরেকবার জনৈক অধ্যাপকের লেখা একটি প্রবন্ধের বই কিনলাম। ধরা যাক বইটি বাংলাদেশের সাহিত্য নিয়ে। দেখা গেল সাহিত্য বিষয়ে লিখতে গিয়ে তিনি দেশভাগ, ভাষা আন্দোলন, গণঅভ্যুত্থান, মুক্তিযুদ্ধ, পঁচাত্তর ও স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের ইতিহাস লিখে ফেলেছেন। ফাঁকে ফাঁকে ঢুকিয়ে দিয়েছেন সাহিত্য।

একবার এক বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের জনৈক অধ্যাপকের সঙ্গে আলাপ হচ্ছিল। আলাপে বুঝলাম অধ্যাপক সাহেব শারীরিকভাবে একুশ শতকে বেঁচেবর্তে আছেন বটে, কিন্তু মানসিকভাবে তিনি বিশ শতকের মানুষ। প্রাবন্ধিক বলতে তিনি বোঝেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, ভুদেব মুখোপাধ্যায়, শিবনাথ শাস্ত্রী, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, অক্ষয় কুমার মৈত্রেয়, প্রমথ চৌধুরী, বেগম রোকেয়া প্রমুখ। এর পরেও যে বাংলা সাহিত্যে প্রবন্ধ লেখা হয়েছে, তিনি খুব একটা জানেন-টানেন না। আর ঔপন্যাসিক বলতে তিনি বঙ্কিম, শরৎচন্দ্র, বিভূতি, তারাশঙ্কর, মানিক, কমলকুমার, সুনীল, শীর্ষেন্দু, সমরেশ, হুমায়ূন প্রমুখকে বোঝেন। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস তার খুব একটা পড়া নেই, শওকত আলীর দু-একটা গল্প পড়েছেন। দেবেশ রায়, অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়, সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ, শহীদুল জহিরের নামই শোনেনি। ভাগ্যিস সৈয়দ শামসুল হকের ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’ দেখেছিলেন, নইলে তাঁর নামটিও হয়ত জানা হতো না। জানতে চাইলাম শাহাদুজ্জামান, জাকির তালুকদার, আহমাদ মোস্তফা কামাল, প্রশান্ত মৃধা প্রমুখের গল্প-উপন্যাস পড়েছেন কিনা। কিংবা ফরিদ কবির, শামীম রেজা, সরকার আমিন, চঞ্চল আশরাফ, শোয়াইব জিবরান, আলফ্রেড খোকান, মাসুদ পথিক প্রমুখ বা অরবিন্দ্র চক্রবর্তী মতো তরুণ কবিদের লেখাজোখা পড়েছেন কিনা। তিনি মাস্টারি ভাষায় ভাবগম্ভীর গলায় বললেন, ‘আমি এখনকার লেখাজোখা পড়ি না। কিচ্ছু হয় না।’ কবিদের মধ্যে তিনি এক চেনেন নির্মলেন্দু গুণকে, আরেক দাউদ হায়দারকে। অনেক কষ্টে মনে করতে পারলেন আল মাহমুদের নাম। বাংলাদেশের আর কোনো কবির নাম ঠিক জানা নেই তাঁর।

আরেকবার শাহবাগে দেখো এক বিশ্ববিদ্যালয়ের জনৈক প্রভাষকের সঙ্গে। পরিচয় পর্বে আমার নামটি বললে তিনি উচ্ছ্বসিত গলায় বললেন, ‘ও আচ্ছা আচ্ছা, আপনার কবিতা পড়েছি।’ আমার মাথায় ভর করল ঘাউরামি। বললাম, ‘আপনি নিশ্চিত আমার কবিতা পড়েছেন?’ বললেন, ‘হ্যাঁ। সেদিনও তো কোন এক লিটলম্যাগে পড়লাম।’ আমি বললাম, ‘দেখেন ভাই, আপনি আমাকে চিনতেই হবে এমন কোনো শর্ত নেই। দেশের কত লেখকের সাথেই তো আমার পরিচয় নেই। তারা কী লেখেন জানি না। না জানাটা অত দোষের না। কিন্তু জানার ভান করাটা দোষের।’ এরপর ওই শিক্ষকের সঙ্গে আর কোনোদিন দেখা হয়নি। শুনেছি, এখন তিনি আমার বিরুদ্ধে বিভিন্ন জায়গায় লাগিয়ে বেড়ান। অর্থাৎ বদনাম করে বেড়ান।

আবার ব্যতিক্রমও কিন্তু আছে। সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, খালেদ হোসাইন, শামীম রেজা, আহমাদ মোস্তফা কামাল, প্রশান্ত মৃধা, রায়হান রাইন, সুমন রহমান, হামীম কামরুল হক, রাহেল রাজিবের মতো সাহিত্যপোকারাও সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। মাঝেমধ্যে ভাবি, নিয়মটা যদি এমন হতো― দেশের সবচেয়ে উজ্জ্বল কবি, কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, নাট্যকাররা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা-ইংরেজি-ইতিহাস-দর্শন বিভাগে ক্লাস নিচ্ছেন। তাঁদের ছাত্রছাত্রীরা শুধু ক্লাসের বইই পড়ে না, পড়ে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সাহিত্যের নানা ধরনের বই। তাহলে ব্যাপারটা কেমন হতো? বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর চিত্র কেমন হতো? এই ভাবনার কথা বলার সুযোগ নেই। বললে কেউ কেউ বলে বসতে পারেন, ‘ও বুঝছি। স্বকৃত নোমান নিজেকে অনেক বড় পণ্ডিত ভাবা শুরু করেছে। সম্ভবত কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢোকার ধান্দা করছে।’ সুতরাং চুপ থাকাই ভালো।

মহাকালে রেখাপাত
২০.১১.২০১৯