স্মৃতি ও সত্তার সজীব `ঘাসফুল`
পিয়াস মজিদপ্রকাশিত : আগস্ট ১৮, ২০২০
‘ঘাসফুল` মুভির পরিচালক আকরাম খান একজন কবি। `ছাঁটকাগজের মলাট` লিটলম্যাগে তার কবিতা পড়েছি। যতদূর জানি, তার একটা কবিতা বইয়ের নাম `পাতার ঝুনঝুনি`। কবিতায় যেমন তিনি অন্তরের একান্ত অর্কেস্ট্রাকে প্রকৃতির সহজিয়া রূপরঙরসের ভেতর মিহিমধুর ভাষা ও প্রকরণে বাজাতে ব্যাকুল তেমনি `ঘাসফুল` (২০১৫) মুভি জুড়েও নিরুচ্চার বেদনার কুসুমগুচ্ছ যেন অতি সন্তপর্ণে দর্শকের ভেতরবাড়িতে স্মৃতি ও সত্তার রক্তঘ্রাণ ছড়িয়ে যায়। সে ঘ্রাণ মৃত্যুময় তবে সবকিছু ভেঙেচুরে দেয় না, মানুষের ক্ষয়াক্ত মনের কলোনিটা জাজ্বল্য করে যথাযথ।
মুভিটার শুরুতে যেমন এক নির্জন মফস্বল-কলোনিবাড়ির দেখা পাই আমরা। অকস্মাৎ স্মৃতিচ্যুত এক যুবক তার সত্তার বিপর্যয় নিয়ে ঘুরপাক খায়৷ জীবন তার কাছে তখন মৃত্যুর প্রতিনাম। এর মধ্যে নিজের ঘরে হঠাৎ পাওয়া এক চিরকুট তার সবকিছুতে তালগোল পাকিয়ে দেয়। চিরকুটে লেখা অতীত কি তারই অতীত? যদি হয় তবে কোথায় সেই প্রিয় নারী, হারানো কবিতা! আর যদি নাও হয় তবে সে-ই অতীতের সঙ্গে তার যুক্ততার সুতোগুলো কোথায়? রহস্যের এমন রেশমি গিঁট কি একজীবনে খোলা সম্ভব হয় না নতুন করে গিঁট তৈরি হয় কেবল!
একা একা ঘুরে ঘুরে জলের সাথে কথা কয়। কিন্তু জল তো নয় নেহায়েত জল; জলও হয়ে থাকে পাষাণ, তীব্র-হিংস্র-খল৷ যুবকের ছায়াপথ আসলে গেঁথে আছে তার প্রয়াত পিতার গোধূলি-পৃথিবীতে; যে এক দূর্ঘটনায় অপঘাতমৃত। কিন্তু তার ঔরসে এখনকার জীয়ন্ত যুবক জন্মসাঁতার কেটেছে তার মাতৃগর্ভে। প্রিয়তম পুত্রের প্রয়াণের পর মা তার গর্ভশীলা নারীকে নিয়ে আসে আপন আলয়ে৷ সন্তানহারা মা যেন অপেক্ষায় ছিল নিজ সন্তানের নতুন রূপদর্শনে। একসময় সে এল। যেন পৌত্র নয়, পুত্র হয়ে ধরা দিল তার পিতামহীর কাছে।
আর সেই সন্তানের নিজের মাতা ক্রমশ আবিষ্কার করল তার প্রয়াত প্রেমিকের মাতার কাছে অপত্যস্নেহের অধিক সন্তানের অধিকারবোধে ধরা দিচ্ছে তার নাড়ি-ছেঁড়া ধন। এটা এমনই এক সংকট, যার কোনো সহজ সমাধান নেই; নিজের ভেতর প্রজ্জ্বলিত অগ্নিতে নিরুপায় দাহ হওয়া ব্যতীত। অধিকারের লড়াই অর্থহীন এখানে। এক মা-কে সরে যেতে হয় নিঃশব্দে, আর এক মায়ের তাপিত হৃদয় সন্তানসুধায় শান্ত করতে। এক পর্যায়ে তা প্রতিরোধেও গড়ায়। নিজ সন্তানকে এক নজর দেখার অধিকার থেকেও নিদারুণ বঞ্চিত হয় তার মা।
বুকের পাষাণবেদির কোণায় কোণায় জন্ম নেয়া অনাদৃত ঘাসফুলগুলো শুধু থেকে যায় যা একসময় যুবাবয়সে উপনীত পুত্রকে অদৃশ্য আদর বুলিয়ে দেয়। মাতৃসবুজের তৃষ্ণায় তার জীবনধূসর এই প্রথম যেন একটা প্রতীক্ষা উপহার পায়। মায়ের সঙ্গে দেখা না শুধু, মাকে আবিষ্কারের অনন্তধারা তার নিরালা নদীতে এই প্রথম যেন নিমজ্জনের আনন্দ জাগায়। ছেলেটা কি মায়ের কাছে যাচ্ছে না স্মৃতি ও সত্তার গন্ধ শুঁকছে? আর ঘাসফুলের ঘ্রাণ যে নিচ্ছে, সে কি কেবল বর্তমানের যুবক? নাকি বহু বছর আগে দুর্ঘটনায় নিহত এই যুবকের জনক সমাধির অতীত থেকে সত্তার বহমান গাড়িতে করে যাচ্ছে, যাচ্ছে।
কোথায় আবার! মানুষের অনিবার্য ঘাসফুল-গন্তব্যে, জলের মতোই যার সঙ্গে কথা বলতে হয় অনন্ত একাকী।
লেখক: কবি
























