`স্রষ্টার প্রমাণ দাও` বলার যোগ্যতা নাস্তিক রাখে না

আসিফ মাহমুদ

প্রকাশিত : ডিসেম্বর ০৩, ২০২০

ডিভাইন রিয়েলিটি বইটা একটু একটু করে পড়ছি। একটু একটু করে পড়ার গুরুত্ব আছে, বিষয়গুলো ভালোমতো আত্মস্থ হয়। আবার আপনাদের সাথে টুকটাক শেয়ার করবো বলেও ভেবেছি। এতে আপনাদেরও উপকার হলো, আমারও ভালোমতো শেখাও হলো। আজকে এমন একটা বিষয় নিয়ে কথা বলবো, যেটা নাস্তিকতার ভিত সম্পূর্ণ ভেঙে দেয়।

আচ্ছা, একজন নাস্তিক যখন বলে, ‘স্রষ্টা যে আছেন, এটার প্রমাণ কী? প্রমাণ নেই, তাই স্রষ্টায় বিশ্বাস করি না।’ এইযে `প্রমাণ` শব্দটা সে ব্যবহার করলো, কোনো কিছু প্রমাণিত হয়েছে কিনা সে এটা কীভাবে বুঝবে? নিজস্ব reasoning বা যুক্তির মাধ্যমে, তাই তো? যুক্তি বিষয়টা কী? যুক্তি বিষয়টা হলো এমন, যা আমাদের কিছু নির্দিষ্ট `প্রতিজ্ঞা` বা premise থেকে উপসংহারে যেতে সহায়তা করে। একটা উদাহরণ দিচ্ছি।

১. সব ব্যাচেলররাই অবিবাহিত।
২. আবিদ একজন ব্যাচেলর।
৩. সুতরাং, আবিদ অবিবাহিত।

এখানে এক ও দুই হচ্ছে প্রতিজ্ঞা বা premise, আর তিন হচ্ছে কনক্লুশন। এখন এক ও দুই সত্য হলেই তিন সত্য হতে বাধ্য, এটা যেকোনো সচেতন মানুষমাত্র বুঝতে পারে। প্রশ্ন হচ্ছে, কেন? কেন এক ও দুই সত্য হলেই তিন সত্য? এই জিনিসটা কীভাবে কাজ করে? এটা তো কোনো ফিজিক্যাল ঘটনা না? অটোম্যাটিকালি আমাদের ব্রেইন এটাকে কীভাবে ফাংশন করে? আরেকটা উদাহরণ দেই।

১. আবিরের কাছে তিনটা আবটাশ আছে।
২. আবটাশগুলো নীল রঙের।
৩. অতএব আমরা বলতে পারি, কিছু কিছু আবটাশ অবশ্যই নীল রঙের হয়।

এই আর্গুমেন্ট কি যৌক্তিক? অবশ্যই যৌক্তিক। কিন্তু খেয়াল করুন, `আবটাশ` কী জিনিস তা কিন্তু আপনি জানেন না। এমনকি আবটাশ শব্দটা আমার নিজের বানানো। এরকম কিছুর অস্তিত্ব ফিজিকাল ওয়ার্ল্ডে নেই। অর্থাৎ, আপনার জীবনে কখনোই আপনার `আবটাশ` নামক কোনোকিছু এক্সপেরিয়েন্স করার হয়তো সুযোগ হবে না, কিন্তু তারপরপ আপনি এক ও দুই নম্বর প্রতিজ্ঞা থেকে তিন নম্বর উপসংহারে পৌঁছাতে পারছেন। প্রশ্ন হচ্ছে, কীভাবে পারছেন?

আপনি যদি আস্তিক হন, উত্তরটা আপনার জন্য সহজ। আপনার ভেতর একটা reasoning capacity বা যুক্তিচর্চা করার ক্ষমতা আছে, যা আপনার ভেতর in built আছে। এই ক্ষমতা আপনাকে দিয়েছেন সৃষ্টিকর্তা। তিনি সকল যুক্তির আধার, তিনি তাই তাঁর সৃষ্টির মধ্যে যুক্তির এই গুণটি স্থাপন করে দিয়েছেন৷ ফলে, আমরা রিজনিং করতে পারি। কোনো এক্সপেরিমেন্ট করে এটা নিয়ে একটা উপসংহারে পৌঁছাতে পারি। অর্থাৎ, ফিজিকাল এক্সপেরিমেন্ট এবং উপসংহারের মাঝখানে যুক্তি দেয়ার যে অদৃশ্য ব্রীজ, তা স্রষ্টা আমাদের মাঝে তৈরি করে দিয়েছেন।

কিন্তু একজন নাস্তিকের জন্য বিষয়টা এত সহজ নয়। অধিকাংশ নাস্তিক বিশ্বাস করে, এই পৃথিবীর সবকিছুই ফিজিক্যাল প্রসেসের মাধ্যমে হয় আর সবকিছুকেই ফিজিক্যালি ব্যাখ্যা করা সম্ভব। একে বলা হয়, ফিলোসফিকাল ন্যাচারালিজম। কিন্তু খেয়াল করেন, ‘সবকিছুকে ফিজিক্যালি ব্যাখ্যা করা সম্ভব’ এই লাইনটা বা প্রতিজ্ঞাটা ইটসেল্ফ একটা `মেটাফিজিকাল আর্গুমেন্ট`। অর্থাৎ, এই প্রতিজ্ঞাটাকেই ফিজিকালি প্রমাণ করা সম্ভব নয়। তাহলে তো এটা অসত্য একটা প্রতিজ্ঞা!

যাই হোক, যদি ধরে নিই, সবকিছুকে ফিজিক্যালি ব্যাখ্যা করা সম্ভব তাহলে reasoning ability বা যুক্তি প্রয়োগের ক্ষমতাকে কি ফিজিক্যালি ব্যাখ্যা করা যায়? নাস্তিকদের মতে, মানুষ created নয়, মানুষ evolved. অর্থাৎ, মানুষ বিবর্তিত হয়েছে। তার মানে হচ্ছে, মানুষ শুধুমাত্র কিছু অঙ্গের সমন্বয় ছাড়া আর কিছুই নয়। তাহলে মানুষ রিজনিং কীভাবে করে? বলতে পারেন যে, মানুষের ব্রেইন আছে। কিন্তু ব্রেইনকেও যদি ফিজিক্যালি ব্যাখ্যা করেন তাহলে দেখবেন, ব্রেইন কিছু কেমিক্যাল রিয়েকশন ছাড়া আর কিছুই না। তাহলে এই ফিজিকাল ব্রেইন কীভাবে এই নন-ফিজিকাল reasoning বা যুক্তি খাটায়?

অনেক নাস্তিক যুক্তি দেয় যে, মানুষের ব্রেইন যুক্তি দেয়ার ক্ষমতা বিবর্তনের মাধ্যমে অর্জন করেছে। কিন্তু কেন? বিবর্তনের জন্য ও টিকে থাকার জন্য যুক্তি evolve করা তো জরুরি নয়। আর জরুরি না এরকম কোনো জিনিসই বিবর্তনের সাথে নিশ্চিতভাবে জুড়ে দেয়া যায় না। তাহলে কীভাবে মানুষ যুক্তি প্রয়োগের ক্ষমতা অর্জন করলো?

বিজ্ঞান পরীক্ষামূলক প্রমাণের ওপর নির্ভর করে। কিন্তু মানুষের যুক্তি প্রদানের ক্ষমতা বা reasoning ability ফিজিক্যালি পরীক্ষা করা বা প্রদর্শন করা যায় না। এটা একটা অন্তর্নিহিত গুণ, একটা abstract বিষয়। এটার অস্তিত্ব বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণযোগ্য নয়। বিজ্ঞান ফিজিক্যাল প্রসেসের ওপর নির্ভর করে। আর ফিজিকাল প্রসেস হচ্ছে blind, non rational. কিন্তু আমাদের reasoning capability হচ্ছে not blind এবং rational. তাহলে মানুষ যদি কেবলই physical process এর ফলাফল হতো, বা বিবর্তিত একটি প্রাণী হতো, তাহলে এই blind এবং non-rational process এর মাধ্যমে কিভাবে মানুষের মধ্যে একটি not blind ও rational ক্ষমতা চলে এলো? এটা তো অনেকটা universe from nothing নামক ফ্যালাসির মতো। কোনোকিছু কি nothing থেকে আসতে পারে? পারে না। অবশ্যই, rationality থেকেই rationality আসতে পারে। আর স্রষ্টা হচ্ছেন most rational, সুতরাং, মানুষের মধ্যে rationality স্রষ্টাই ইনপুট দিয়েছেন।

এখন নাস্তিকরা বলতে পারে, এটা একটা assumption. অর্থাৎ, আমরা ধরে নিচ্ছি যে আমরা যুক্তি দিতে পারি। আস্তিক-নাস্তিক নির্বিশেষে সবার জন্যই একটা assumption এটা। আস্তিকরা স্রষ্টার অস্তিত্বকে assumption হিসেবে নেয়, নাস্তিকরা reasoning capability কে নিতেই পারে। বেশ, কিন্তু কোনোকিছু ধরে নিলে বা assumption হিসেবে নিলে, সেই জিনিসটাকে ধরে নেয়া ব্যক্তির worldview এর সাথে consistent বা সামঞ্জস্যশীল হতে হয়। স্রষ্টার অস্তিত্ব আছে, এই assumption আস্তিক worldview এর সাথে পরিপূর্ণভাবে সামঞ্জস্যশীল৷ কিন্তু নাস্তিকদের assumption কি তাদের worldview এর সাথে যায়? নাস্তিকদের worldview হচ্ছে ন্যাচারালিস্টিক। একটু আগেই বলেছিলাম, philosophical naturalism এর মতে reasoning capability এর মতো কোনো জিনিসের অস্তিত্ব নেই। অর্থাৎ, নাস্তিকদের assumption তাদের worldview এর সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ। তাই, হয় তাদেরকে assumption ছাড়তে হবে, নাহলে worldview. এবার তারা ডিসাইড করুক।

সুতরাং, নাস্তিকতা মানুষের rational capability, reasoning capability বা যুক্তি দেয়ার ক্ষমতা জাস্টিফাই করতে পারে না। জাস্টিফাই করতে গেলে নিজেদের ওয়ার্ল্ডভিউ ছাড়তে হয়। তাই নাস্তিকরা `স্রষ্টার প্রমাণ দাও` এই কথাটা বলার যোগ্যতা রাখে না। বরং burden of proof তাদের ওপরই বর্তায়। আর burden of proof তাদের ওপর গেলে, আগে তাদেরকে স্রষ্টায় বিশ্বাস করে এই ব্যাপারটা জাস্টিফাই করতে হবে যে, তাদের রিজনিং করার ক্ষমতা আছে। তারপর তারা যুক্তি দেখাবে, প্রমাণ দেখাবে, অথবা প্রমাণ নেবে।