হামাসের প্রতিরোধ: সুমুদের ঐতিহাসিকতা

তরিকুল হুদা

প্রকাশিত : মে ১২, ২০২১

ইতিহাস বর্তমান। হামাস প্রতিবারেই ইতিহাস রচনা করছে। আগের ইতিহাসকে পার করে যাচ্ছে। আবার শুরু থেকে তাদের এই পুরাটা সময়জুড়ে চলা প্রতিরোধই ইতিহাস। সাথে সমান তালে চালাইতেছে ফিলিস্তিনের জনগণ। এই ইতিহাস হামাস বা জনগণ রচনা করে চলতেছে এমন এক সময়ে, যখন আত্মনির্মাণের জন্যে হুমকি, দখলদারি আধিপত্যের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ, সংগ্রাম, সহিংস সশস্ত্রতাকে সেই ইতিহাস থেকেই গুম করে ‘নাই’ করে দেয়ার সকল আয়োজন সম্পন্ন লিবারেল বয়ানের ভিতর দিয়ে।

এবারেও আমরা দেখলাম কখনও রাষ্ট্রের বা ব্যক্তির নিরাপত্তা, কখনো মানব অধিকার, কখনো শান্তি ইত্যাদির দোহাই দিয়ে এই মরণপণ টিকে থাকার লড়াইকে দমানো হচ্ছে। মার্কিন আন্তর্জাতিক মুখপাত্রকে সংবাদ সম্মেলনে যেই ভাষা, যেই কৌশল ব্যবহার করে ফিলিস্তিনীদের টিকে থাকার লড়াইকে, আত্মমর্যাদা রক্ষার সংগ্রামকে চুপ করে দিতে, গুম করে ‘নাই’ করে দিতে, সম্পূর্ন এড়ায়ে গিয়ে অপ্রাসঙ্গিক করে দিতে দেখলাম, আরো যত ভূখণ্ডের ভিতরে হারাতে দেখলাম, গাজাকে যতভাবে ঘিরে থাকতে দেখলাম, তার বিপরীতে সুসংহত রেখে নিজেদের লড়াই ক্ষমতা বাড়ানোটাই এই বিশাল অগ্রগতি।

এত কিছুর পরেও হামাসের রকেটের পরিধি বাড়তে বাড়তে তেল আবিব পর্যন্ত পৌঁছে গেল। ইসরাইলি আর্মড পুলিশ আর সেনাবাহিনীর অস্ত্র, গোলাবারুদ, সুরক্ষা পোষাক যতই ডেলিকেট হচ্ছে, ফিলিস্তিনিদের সাহস আর ইসরাইলের আধিপত্যের শক্তিকে উপেক্ষার হাসিও ততই প্রাণবন্ত হচ্ছে। প্রযুক্তি, শক্তি কিছুতেই এই স্পিরিটকে বশে আনতে পারছে না। কী অদ্ভুত! ২০১৪ সালের গাজা হামলার সময়ে ফিলিস্তিন গবেষক লিনা মেয়ারির লেখায় এই স্পিরিটের আখ্যান নিয়ে জানছিলাম। ‘সুমুদ’ বা অদম্যতা এমনি এক অদ্ভুত শক্তি যে, তার ভিতর দিয়ে কঙ্ক্রিটলি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র অলরেডি তাদের প্রত্যেকের সত্তায় গাথা আছে।

এখন বাস্তবে তা আছে নাকি নাই, এটা কোনোই ইস্যু না। আবার এটা ফ্যান্টাসিও না। বরং উনাদের সত্তার মর্ম। যাপনের প্রতিটা সাধারণ বা অসাধারণ মুহুর্তের ধ্রুব বোধ। এই শক্তি নিয়েই তারা প্রতিদিন প্রতি মুহূর্ত পার করে। সশস্ত্র বা নিরস্ত্রদের ভিতর এই শক্তির জায়গায় কোনোই ভেদ নাই। হামাসের সবচাইতে দুর্দান্ত কমান্ডো আর গ্রামের জট পাকা চুলের সেই বালিকার কল্বের ভিতর নাই কোনো ফারাক। ঠিক এই কারণেই আরেক জেরুজালেম ভিত্তিক ইহুদি গবেষক ফিলিস্তীনিদের আখ্যা দিছিলেন (নাম মনে নাই) অন্টোলজিকাল এনিমি বা মর্মগত শত্রু হিসাবে। আপনার চশমা যদি মার্কসবাদী হয়, আর তার পরে যদি আবার দেরিদীয় জার্গন ভুলভাবে মুখস্থ কইরা যদি খালি অমুক-তমুক বাইনারি করতে থাকেন, তাইলে জনাব দিজ ইজ নট ইওর কাপ অফ টি। পুঁজি বা অর্থনীতি বা শ্রেণি একে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না জনাব।

ফিলিস্তিনিদের এই স্পিরিট, মতাদর্শিক যোগ্যতা, আত্মমর্যাদাকে আপনি কিভাবে দেখেন? খুব বাড়াবাড়ি করছে, তাই না? নিছক আবেগ? বা ফ্যান্টাসিও বলা যায়, তাই না? হুদাই লাফালাফি করে বয়োজ্যেষ্ঠ, নারী আর শিশুদের মতো নিরাপরাধদের বিপদে ফেলানো। মোটেও না। বরং লড়াই থেকে আপনে যে নিজেকে গুটায়ে নিছেন, আপনে যে এখন রাজনীতি বলতে শুধু ক্ষমতাসীনদের ম্যানেজ করাকে বুঝেন, অথবা ক্ষমতা পরিবর্তনের ব্যবস্থাপনার কথা বুঝেন, নিজের প্রতিষ্ঠানকে টিকায় রাখার জন্যে স্টাটাস কোর সাথে মাখামাখিরে বুঝেন, আপনে যে রাজনৈতিক লড়াইরে সংস্কৃতির প্যানপ্যানানিতে নামাইছেন, এটাই আপনার ট্রমা এবং ফোবিয়া থেকে তৈরি ভীতি সৃষ্ট ভাবাবেগ। তাই আপনে এখন সৈনিক হন, জেনারেল হন, কি ডাক্তার বা পুলিশ হন, আলেম হন, শিক্ষক অথবা ছাত্র বা তালিবে ইলম ইত্যাদি যাই হন না কেন, একজন মুৎসুদ্দী-মোসাহেব ছাড়া আর কিছুই হয়ে ওঠতে পারেন না।

আপনারে বাগে আনতে ক্ষমতাধারীরা যেই কৌশল খাটায় তার মূলকথা হলো, রাজনৈতিক জীবনকে নিছক সাংসারিক ব্যবস্থাপনার জীবনের ভিতর বেধে ফেলা। তখন এই অর্থনৈতিক মানুষের কাছে রাজনীতি হয়ে ওঠে নিছক জীবন ব্যবস্থাপনা, চাকরি বাকরি, আয় উন্নতি, শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি ইত্যাদি। মর্যাদা পরিণত হয় মেনে নেয়ার আরামে। রাজনৈতিক মর্যাদার মতাদর্শিক লড়াই হয়ে দাঁড়ায় বিদ্যমান ক্ষমতা কাঠামোর তোষামোদিতে। আপনে না পারতেই পারেন, অসুবিধা নাই। কিন্তু সেই হীনমন্যতা থেকে যারা পারতেছেন তাদের ছোট করবার গিয়া নিজেরে ছোট কইরা ফেলায়েন না। এই মুৎসুদ্দি চরিত্রকে ছাপায়ে উঠতে পারছে হামাস। আর তাই তো তাদের রকেটের পাল্লা এত দূর পর্যন্ত যায়। আর তাই তাদের নারীরা বন্দি স্বামীর জন্যে অপেক্ষা করে দশক ধরে, তাই তো তাদের মায়েরা সন্তানদের শাহাদাতের খবর শুইনা চিল্লায় উইঠা বলে, আলহামদুলিল্লাহ!