হারাতে হারাতে কুড়াতে কুড়াতে যাই

পর্ব ৩

সরকার আবদুল মান্নান

প্রকাশিত : এপ্রিল ২৯, ২০২০

চাষাড়া-হাজিগঞ্জ রেল লাইন ধরে হাঁটতে হাঁটতে হাজিগঞ্জ বাজার। তারপর ওই বাড়িটিতে পৌঁছাতে তল্লা পর্যন্ত যেতে হয়। রেল লাইনের ডান পাশে বিশাল একটি সজনে গাছের নিচে এই বাড়িটি। দোচালা টিনের ঘরটি রেল লাইনের সঙ্গে লাগোয়া। অন্য একটি ছোট চৌচালা ঘর অদূরে। তারও পরে গোয়াল। রেল কর্তৃপক্ষ কী করে রেল চলাচলের রাস্তায় এই দোচালা ঘরটি বানাতে দিল, তা আমার বোধগম্য নয়। ঘরে একটি চকি ও একটি টেবিল আছে। এতেই আমি খুশি। এখান থেকে পায়ে হেঁটে কলেজে যেতে পনের থেকে বিশ মিনিটের বেশি লাগবে না। জনপদ থেকে বাড়িটি সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। কাছেপিঠে আর কোনো বাড়িঘর নেই। চারদিকে নিঃসীম নির্জনতা বিরাজমান।

এই কাচারি ঘরে আমি বসে আছি। ঘরটিতে কার-উগুর কিছু নেই। চাল অবধি উদোম। ঘরটির পশ্চিম পাশে স্তূপ করে রাখা আছে জ্বালানি কাঠ, লাকড়ি। তুষের বস্তা আছে কয়েকটি। খইলের বস্তাও আছে একটি। খইল বের করে নিয়ে বস্তার মুখ বন্ধ করেনি। ফলে বস্তা থেকে আরও কিছু খইল বের হয়ে আছে। এ সময় একটি মধ্যে বয়স্ক লোক ঘরে ঢুকলেন। বুঝলাম, তিনি গৃহকর্তা। শরীর জুড়ে বড় বড় হাড় বের হয়ে আছে। লুঙ্গির উপরে স্যান্ডো গেঞ্জি ভেদ করে হাড়গুলো উঁচিয়ে আছে। টিন, তামা বা কাঁসার পাত্র টোল খেলে গর্তের জায়গাটায় যেমন মৃদু অন্ধকার বিরাজ করে এবং উঁচিয়ে থাকা অংশটা বেশি দৃশ্যগ্রাহ্য হয়ে ওঠে— এই লোকটির মুখের গড়নটা ঠিক তেমনি। মুখের হাড়গুলো বিশ্রীরকম উচিয়ে আছে আর গর্তের অংশটা অপরিচ্ছন্ন অন্ধকারের মতো যেন অনাদিকাল ধরে স্থায়ী হয়ে আছে। লোকটিকে দেখে তার প্রতি আমার কোনো সম্ভ্রম জাগল না।

হাতের গামছাটা কাঁধে রেখে তিনি আমার পয়-পরিচয় জানলেন, ঠিকানা জানলেন, মা-বাবা ও ভাই- বোনদের খবরাদি নিলেন। আমি একটি কথাও বেশি বললাম না। তিনি যা জানতে চাইলেন, খুব কম কথায় তার উত্তর দিতে চেষ্টা করলাম। ঠেঙারে প্রকৃতির এই লোকটি যে বড় সুবিধার হবে না, তা কেন যে আমার মনে হলো, বলতে পারব না। কিছুক্ষণ পরে আসেন ওই ভদ্রলোকের স্ত্রী ও একমাত্র শিশুকন্যা। না ভাবি না চাচি— এমন একটা আজব বয়সের মহিলাকে আমি কী বলে সম্বোধন করব, বুঝতে পারছিলাম না। ভাবি-চাচি বাদ দিয়ে শেষ পর্যন্ত সাহস করে আপা সম্বোধন করে বসলাম। দেখলাম উনি বেশ খুশি হয়েছেন। না হেংলা না মোটা— এমন মাঝারি গড়নের উজ্জ্বল শ্যামলা এবং লম্বাচূড়া মহিলাকে প্রথম দেখাতেই সমীহ করার মতো মনে হয়েছিল। এখন খুব কাছে থেকে দেখে মনে হচ্ছে, আমার ধারণা বেঠিক নয়। তিনি শান্ত-সৌম্য প্রকৃতির মানুষ। মাথা ভরা বিপুল কেশরাশি পিঠ অতিক্রম করে আরও নিচে চলে গেছে। ফলবতি বিনম্র বৃক্ষের মতো তার আজানুলম্বিত চুলগুলো তাকে অনেক নম্র, ভদ্র ও বিনয়ী করে তুলেছে।

তিনি টেবিলের উপর দুপুরের খাবার রাখতে রাখতে বললেন, ভাই, আমারা বড়লোক না। বলতে পারেন, গরিব মানুষ। রিজিকে যা আছে, খাইবেন। আর কিছু দরকার হইলে কইবেন। মেয়ের কাছে কইলেই অইব।
আমি বললাম, আপনি একদম চিন্তা করবেন না আপা। আমার কোনো সমস্যা হবে না।

মেয়েটির নাম তুরফা। খুবই অপরিচিত নাম। আমি কখনো এমন নাম শুনিনি। সে হাজিগঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ক্লাস টুতে পড়ে। মায়ের মতো সেও কেশবতী। শরীরের অর্ধেকের চেয়ে বেশি অংশ কেশময়। প্রায় হাঁটু সমান চুল সে কী করে যে সমলায় তা দেখার মতো। একটু ঝুঁকে বসলে চুলের জন্য তার মুখ দেখা যায় না। চুল সামলাবে নাকি পড়বে, চুল সামলাবে নাকি লিখবে— এই নিয়ে তার সমস্যার শেষ নেই। সেই বিপুল কেশপাশ সরিয়ে তার মুখের পুরো গড়নটুকু দেখলে মনে হয়, যে পৃথিবীতে এত সুন্দর মেয়ে আছে— এমন চোখ, এমন নাক, এমন মুখ আর সর্বত্র মায়া মাখা! এমন একটি মেয়ে সংসারে থাকলে সেই সংসার তো আনন্দে ভরপুর থাকার কথা। আমার মনে হলো, সত্যিকার অর্থে আমি একটি মায়ার জগতে এসে পড়েছি।

ওই বিকেলেই তুরফার সঙ্গে আমার খাতির হয়ে গেল। খাতির না হয়ে উপায় নেই। আমার কাছে পৃথিবীর শিশুদের চেয়ে প্রিয় আর কিছু নেই। ফুল নয়, পাখি নয়, নদী নয়, সমুদ্র নয়, পাহাড় নয়— শিশু। শিশুদের চেয়ে সুন্দর আর কিছু হতে পারে না। আমার কাছে শিশুরা থাকলে আর কিছু দরকার হয় না। আমার মনে হয়, শিশুদের নিজস্ব একটি জগৎ আছে। সেই জগৎ বড়দের মতো নয়। সেই জগৎ মায়ার জগৎ, কল্পনার জগৎ, বাস্তব-অবাস্তব-অতিবাস্তব মিলিয়ে অদ্ভুত এক জগৎ। যারা শিশুদের এই জগৎকে চিনতে পারে, সম্মান করতে পারে— শিশুদের সঙ্গে ভাব হতে তাদের সময় লাগে না।

তুরফাকে আমি পড়াতে চাই না। পড়ার প্রতি একটি মায়া তৈরি করে দিতে চাই। ওকে আমি বুঝিয়ে দিতে চাই যে, পড়াটা ভয়ের ব্যাপার নয়— মজার ব্যাপার। যা কিছু ওকে পড়াই তাই নিয়ে একটি গল্প করি। আর গল্পের ফাঁদটা এমনভাবে পাতি যাতে ওই বিষয়টা নিয়ে ওর মধ্যে অনেক কৌতূহল তৈরি হয় এবং এক জীবনে সে যেন ভুলে না যায়। আর একটি বিষয় আমি ওকে বুঝিয়ে দিতে চাই যে, তুমি আমার কাছে অসম্ভব মূল্যবান। তোমার প্রতিটি কথা, প্রতিটি কাজ, প্রতিটি গল্প, প্রতিটি আচরণ আমার কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এইভাবে তুরফার সঙ্গে আমার একটা সম্পর্ক তৈরি হলো। ওই সম্পর্কটা খুবই দুর্লভ। তুরফা সেটা বোঝে। ফলে আমাকে খুশি করার জন্য সে সারাক্ষণ চেষ্টা করে। সেই চেষ্টার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ লেখাপড়া।

প্রথম রাতে ওই ঘরটিতে ঘুমোতে গিয়ে আমি বিস্ময়কর অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হলাম। রাত এগারোটার দিকে মনে হলো রূপকথার দৈত্যরা এসে আমাকেসহ আমার ছোট ঘরটি আছড়িয়ে, দাবড়িয়ে যেন কোথায় ফেলে দিচ্ছে। পরে বুঝলাম, আমি যে বলেছি রেল গাড়ির তলে এসে আশ্রয় নিয়েছি, এই হলো তার পরিচয়। রাতের বাকি অংশ আমি জেগেই কাটিয়ে দিলাম। কয়েকটি দিন এভাবেই কাটিয়ে দিলাম। নির্ঘুম। কিন্তু কবে থেকে যেন ঘুমিয়ে যাচ্ছিলাম, বুঝতে পারছিলাম না। প্রতিকূল পরিবেশের সঙ্গে মানুষের দেহমন কীভাবে যে খাপখাইয়ে নেয়, তার কোনো ব্যাকরণ আছে কি না জানি না।

আমি কলেজ থেকে আসার পথে ওর জন্য কিছু না কিছু নিয়ে আসি— একটি চকলেট, এক টাকার বাদাম, বুট, তালমিছরি, গজা, কদমা, বাতাসা এইসব। তুরফা আমার জন্য অপেক্ষা করে। বিশেষ করে সপ্তাহের যে দিনগুলোতে প্রাক্টিক্যাল থাকে, সে দিন কলেজ থেকে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। সে দিন তুরফার অস্থিরতার সীমা থাকে না। ওর মাকেও অস্থির করে তোলে। একদিন কোনো কারণে আমি বিরক্ত ছিলাম। তুরফা ইঁদুর লিখতে গিয়ে লিখেছে ইদুর। অন্য সময় হলে আমি হয়ত বলতাম, তুরফা সোনা, তোমার চাঁদ উঠেনি কেন? রাগ করেছে? তুরফা প্রথমে হয়তো বুঝতেই পারত না। ভাবত, ঘরের ভেতরে চাঁদ উঠবে কোত্থেকে। পরে আকার-ইঙ্গিতে বলে দিলে খিল খিল করে হাসত আর ই-এর উপর একটি চন্দ্রবিন্দু বসিয়ে দিত। কিন্তু ওই দিন এইসব ভণিতা না করে সোজা ধমক দিয়ে বসলাম, এই মেয়ে, ইদুর লিখেছ, চন্দ্রবিন্দু কোথায়?

তুরফা অবাক হয়ে গেল। কিছুক্ষণ গাল ফুলিয়ে থেকে তারপর বলল, স্যার, চন্দ্রবিন্দু না দিলে ইঁদুরের কি কোনো সমস্যা হয়? তুরফাদের এই ঘরে এবং ওদের বাড়িতে অনেক ইঁদুর। দিনের বেলায়ও দেখা যায় বিদ্যুৎ গতিতে ইঁদুর দৌড়ে বেড়াচ্ছে। এই ইঁদুরদের নিয়ে ওর কৌতূহলের সীমা নেই। প্রতিনিয়ত ওর সামনে দিয়ে ইঁদুরেরা দ্রুত গতিতে পালিয়ে বেড়ায়, কুট কুট করে এটা সেটা কাটে আর তুরফা মুগ্ধ হয়ে দেখে। ধরা ছোঁয়ার বাইরে ইঁদুরদের সঙ্গে ওর একটা মায়ার সম্পর্ক তৈরি হয়ে যায়। কল পেতে কিংবা বিষ প্রয়োগ করে ইঁদুর নিধনের চেষ্টা করেছিলেন ওর বাবা। কিন্তু একমাত্র মেয়ে এতই প্রতিবাদ করে যে, নাওয়া-খাওয়া পর্যন্ত ছেড়ে দেয়। ফলে ইঁদুর নিধনের পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। অগত্যা একটি বিড়াল পোষার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এখন ইঁদুর যেমন ওর খুব প্রিয়, বিড়ালটিও প্রিয়। বিড়ালটি বেশি প্রিয়। কেননা, এটি ওর ধারেকাছে থাকে, ধরতে পারে, কথা বলতে পারে, আদর করতে পারে। সুতরাং এই দুই চির শত্রুকে নিয়ে ও বন্ধুর আসনে বেশ আনন্দে বসে আছে। কে কার কী ক্ষতি করছে সেইসব বোঝার বুদ্ধি এখনো ওর হয়নি। তবুও বিড়ালটিকে সাবধান করে দিয়ে বলেছে, খবরদার, ইঁদুর ধরে খেতে যাবি না কিন্তু। তা হলে তোকে আর আমি খাবার দেব না। মনে থাকে যেন।

সুতরাং কোনো কারণে ইঁদুরদের ক্ষতি হোক, তুরফা কিছুতেই তা চায় না। বিষয়ের গুরুত্ব অনুধাবন করে আমি হেসে দিলাম। বললাম, না, তুরফা সোনা, ইঁদুরদের কোনো সমস্যা নেই। ওদের নাম কীভাবে লেখা হচ্ছে, সেটা ওরা জানে না। ‘ই’ লিখছ নাকি ‘ঈ’ লিখছ, চন্দ্রবিন্দু দিচ্ছ কি দিচ্ছ না, ‘দ’ লিখছ নাকি ‘ধ’ লিখছ, উ-কার দিচ্ছ নাকি ঊ-কার দিচ্ছ, ‘র’ লিখছ নাকি ‘ড়’ বা ‘ঢ়’ লিখছ তার কিছুই ইঁদুরেরা জানে না। তুমি চন্দ্রবিন্দু দিতেও পার নাও দিতে পার। দিলে ঠিক হবে, আর না দিলে ভুল হবে। তোমার যেটা ইচ্ছা সেটাই লিখতে পার। কোনো সমস্যা নেই। যেভাবেই লেখা হোক না কেন ইঁদুরদের কোনো সমস্যা নেই, শুনে তুরফা খুশি হয়ে উঠল। এবং ইঁদুর বানানটি সে ঠিকঠাকভাবেই লিখে দিল।

তুরফার পড়াশোনা ভালোই হচ্ছে। কোনো সমস্যা নেই। আমার খাওয়া-দাওয়াতেও কোনো সমস্যা নেই। বিশাল সজনে গাছ দিয়েই মিটে ওই পরিবারের নিত্যদিনের তরিতরকারির প্রয়োজন। সজনেফুল ভাজি, সজনে ফুলের ভর্তা, সজনের পাতা ভাজি, সজনে পাতার শবজি, সজনে পাতার ভর্তা, ডালের সঙ্গে সজনে, ভাতের মারের ঝোলের সঙ্গে সজনে। সর্বত্র সজনে সজনে সজনে। বক্তাবলির কসাই বাড়িতে গোস্ত পর্বের শেষে প্রথম দিকে সজনে পর্ব খারাপ লাগেনি। কিন্তু কাহাতক? ত্যক্তবিরক্ত হয়ে একদিন তুরফাকে বললাম, তুরফা সোনা, সজনে তোমাদের অনেক প্রিয়, তাই না? আমাকে অবাক করে দিয়ে তুরফা বলল, একদম না স্যার। সজনে আমার ভালোই লাগে না। কিন্তু বাবা তো বাজারই করে না। সারাক্ষণ থাকে গোরু নিয়ে। মা আর কী করবে? আমি বললাম, না না। ঠিক আছে সব। কোনো অসুবিধা নেই। তুমি কিছু মনে করো না। কিন্তু তুমি কি জানো, সজনে পাতার শাকের মতো পুষ্টিকর খাবার পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি নেই। সজনের শিকড় ছাড়া আর সবকিছুই খাওয় যায় এবং খুবই পুষ্টিকর।

এসব কথায় তুরফার কিন্তু তেমন কোনো পরিবর্তন হলো না। সে খুব মন খারাপ করে কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে আমাকে বলল, স্যার, আপনি কি আমাদের এখানে থাকবেন না? আমি বললাম, অবশ্যই থাকব। তোমাকে ছেড়ে কোথ্থাও যাব না আমি।

কলেজে পড়াশোনার চাপ বেড়ে গেছে। কলেজ থেকে এসে একটি বাসায় প্রাইভেট পড়াতে হয়। তারপর রাতে বেশ কিছুটা সময় তুরফাকে পড়িয়ে আমার নিজের পড়াশোনা নিয়ে বসতে হয়। রাত বারোটা থেকে একটা পর্যন্ত পড়ে তারপর ঘুমোতে যাই। এর মধ্যে একদিন দেখি, তুরফা চলে যাওয়ার পর কারেন্ট নেই। নিশ্চয়ই কোথাও সমস্যা হয়েছে। ভাবলাম, কী আর করার আছে! শুয়ে পড়ি। তাই করলাম। পরের দিনও একই ঘটনা। তুরফা পড়াশোনা করে চলে যাওয়ার পর বিদ্যুৎ চলে গেছে। ঘর থেকে বের হয়ে দেখি, সবখানেই কারেন্ট আছে। কী সমস্যা? আমার জীবনে বক্তাবলিতে প্রথম বিদ্যুতের আলোয় পড়াশোনা করার সুযোগ পাই। বাড়িতে পড়তাম কুপি কিংবা হ্যারিকেনের আলোয়। কী সমস্যার জন্য বিদ্যুৎ নেই তা তো আমি বুঝব না। তাই ভাবলাম কালকে তুরফাকে বলব ও যেন ওর বাবাকে বলে সব ঠিক করে দেয়।

পরদিন তুরফাকে বললাম, তুরফা সোনা, তুমি পড়াশোনা করে চলে যাওয়ার পর ঘরে তো বিদ্যুৎ থাকে না। তোমার বাবাকে বলো তো, কোথায় সমস্যা ঠিক করে দিতে। উত্তরে তুরফা যেটা বলল সেটা প্রায় অবিশ্বাস্য। তুরফা বলল, স্যার, আমি চলে যাওয়ার পর বাবা আপনার ঘরের লাইন অফ করে দেয়। আপনি নাকি অনেক রাত পর্যন্ত পড়েন। বেশি বেশি বিদ্যুৎ খরচ হয়। তুরফার কথা শুনে আমি হতভম্ব। বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। বললাম, তোমার মাকে একটু আসতে বলো তো। তুরফা দ্রুত ওর মাকে নিয়ে আসে। আমি বললাম, আপা রাতে তো এই ঘরে কারেন্ট থাকে না। কী সমস্যা হয়েছে, একটু দেখবেন? ওর মা বলল, ভাই, এই কাজ ওর বাপের। এই ঘরের কারেন্ট অফ কইরা দেয়। আমি বলছি ভাই। আপনের পড়াশোনার ক্ষতি হয়। লোকটা তো শোনে না। সারাটা জীবন এই রহম। আমি বললাম, ঠিক আছে আপা, আপনি চিন্তা করবেন না। কী ব্যবস্থা করা যায় দেখি।

পরদিন কলেজে গিয়ে রুহুল ভাইকে খুঁজে বের করলাম এবং বিস্তারিতভাবে কাহিনি বললা। কিন্তু অবাক কাণ্ড। রুহুল ভাই তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালেন না। বললেন, তোমার জন্য একটা হ্যারিকেন ঠিক করব। কয়টা দিন থাক। তারপর দেখছি কী করা যায়। আমার মনে হলো, জেনেশুনেই রুহুল ভাই আমাকে ওই বাড়িতে লজিং দিয়েছেন। লোকটি সম্পর্কে তিনি জানেন। কলেজ থেকে ফেরার পথে আমি কয়েকটি মোমবাতি নিয়ে এলাম। এই প্রথম আমি মোমবাতির আলোতে পড়তে যাচ্ছি। কিন্তু মোমবাতির আলোয় পড়া যে কী দিগদারি! সারাক্ষণ আলো নড়াচড়া করে। আর তার সঙ্গে সঙ্গে ঘরের নানা জিনিসের ছায়াগুলো কত রকম যে হয়ে ওঠে! কখনো বড়, কখনো ছোট, কখনো দৈত্য, কখনো দাও। আবার কখনো মুলির বাঁশের বেড়ার ফাঁক দিয়ে ফুরফুর করে বাতাস ঢোকে ঘরে। আর মোমের আলো নিভু নিভু করতে করতে জ্বলে ওঠে। যখন বাতি নিভতে থাকে, তখন রাজ্যের অন্ধকার মহা উৎসবে আমার চার দিকে নাচতে থাকে। আর যখন আলোটা সেই মুমূর্ষু অবস্থা থেকে আস্তে আস্তে জেগে ওঠে, তখন অন্ধকার যেন ভীষণ অনিচ্ছায় একটু সরে দাঁড়ায়। আলোর এমন দুরবস্থায় কার পড়তে ইচ্ছা হয়! সুতরাং সব দোষ মোমবাতির আলোর উপর বর্তিয়ে আমি নির্দোষ ঘুমিয়ে পড়ি।

পরদিন কলেজে গিয়ে দেখি, রুহুল ভাই আমার জন্য একটি হ্যারিকেন জোগাড় করে রেখেছেন। আমাকে বললেন, কটা দিন এই হ্যারিকেন দিয়ে চালাও। ওই বাড়িতে তোমার থাকা হবে না। আমি অন্য ব্যবস্থা করছি। এই বলে তিনি একটি ব্যাগ আমার হাতে দিয়ে কোথায় চলে গেলেন। আমি মুগ্ধ ও অভিভূত হয়ে গেলাম। কিছুক্ষণ তার পথের দিকে ঠাঁয় তাকিয়ে থেকে ভাবলাম, আমার ভাই নয়, বন্ধু নয়, পাড়া প্রতিবেশী নয়; কিন্তু এই মানুষটি কেন আমার জন্য এত কিছু করছেন! বিন্দুমাত্র স্বার্থ কি তার আছে? নেই। তবুও তিনি করছেন। আমার চোখে জল এসে গেল। দূর থেকে রুহুল ভাইয়ের প্রতি আমার সমস্ত ভালোবাসা, অফুরন্ত শ্রদ্ধা ও শুভকামনা জানিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম। হাঁটছি আর ভাবছি, জীবন কতভাবে যে মধুর হয়ে উঠতে পারে তার কোনো ইয়ত্তা নেই। রাতে হ্যারিকেন জ্বালিয়ে পড়তে শুরু করলাম। হ্যারিকেন ভরা কেরোসিন তেল। সুতরাং কয়েক দিন পড়তে পারব। কিন্তু পড়তে গিয়ে দেখি, চারদিকে বিদ্যুতের বিপুল আলোর জ্বলজ্বলে অবস্থার মধ্যে রেল লাইন লাগোয়া এই মুলির বাঁশের বেড়া দেয়া হত দরিদ্র দোচালা ঘরটি আন্ধারে নিমজ্জিত হয়ে আছে। আর এই হ্যারিকেনটির আলো হলদে আভার এমন একটি জন্ডিস রোগের লক্ষণ নিয়ে কোনো রকমে টিকে আছে যাতে পড়াশোনা করার কোনো আগ্রহ তৈরি হয় না। অধিকন্তু দেহে ও মনে একটি নির্জীবতার অভিব্যক্তি তৈরি করে। হ্যারিকেনের গোড়ার অন্ধকারটা গোল হয়ে অনেকটা জায়গা দখল করে আছে। আমি বই নিয়ে অন্ধকার বাঁচিয়ে হলদে আভার আলোর মধ্যে যেতে চেষ্টা করি। এর মধ্যেই দেখি, ওই গোল অন্ধকারের পরিধিটা অন্যদিকে ছোট হয়ে আমার বইয়ের দিকে বিস্তৃত হয়েছে। পড়তে ভালো লাগছে না। মোদ্দা কথা, বিদ্যুতের অনেক আলোর আহ্বান আমার মাথার মধ্যে উজ্জীবিত হয়ে আছে। আর যা কিছু বললাম, সব না-পড়ার ছুতানাতা।

কয়েকদিন পরে ওই রেল লাইন ধরেই কলেজের আরও কাছের দিকে এক মেম্বারের বাড়িতে আমার তৃতীয় লজিংয়ের ব্যবস্থা হলো। তুরফাকে আমি সব বললাম। ওকে যে আমি অনেক স্নেহ করি, তাও বললাম। কিন্তু আমার তো পড়াশোনা করতে হবে এবং তার জন্যই তো অন্যের বাড়িতে থাকা। সুতরাং আমাকে যেতে হবে। তবে যখনই আমি এই এলাকায় আসব তখনই ওকে দেখে যাব, ওর সঙ্গে গল্প করে যাব। কিন্তু ও কোনো কথাই শুনছিল না। খুবই কান্নাকাটি করছিল। আমারও কষ্ট হচ্ছিল। কিন্তু আমি মজার মজার গল্প করতে চেষ্টা করছিলাম। তুরফার তাতে কোনো ভাবান্তর হচ্ছিল না। ওর মা এসে কিছুক্ষণ ঠায় দাঁড়িয়ে থাকল। কিছুই বলতে পারছিল না। অগত্যা আমার বিদায় নিতে হলো। কতবার ওই এলাকায় গিয়েছি। কিন্তু তুরফার সঙ্গে এই জীবনে আর কখনোই দেখা হয়নি। চলবে

লেখক: শিক্ষাবিদ