হারাতে হারাতে কুড়াতে কুড়াতে যাই

পর্ব ৫

সরকার আবদুল মান্নান

প্রকাশিত : মে ০৫, ২০২০

আশির দশকের কথা। তখন প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে কলেজে পড়ুয়া ছেলেমেয়েদের খুব একটা দেখা যেত না। বিশেষ করে মেয়েদের সংখ্যাটা ছিল একদম বিরল। প্রাইমারি থেকে হাইস্কুল পর্যন্ত দশ বছর পড়াশোনা করেছি। কত ছেলেমেয়ে সহপাঠী ছিল। তাদের অনেকে প্রাইমারি পর্যন্ত পড়েই পড়াশোনা শেষ করেছে। স্কুলে আর যায়নি। হাই স্কুলে যারা পড়েছে, আমার সেই সহপাঠীদের একজন মেয়েও কলেজে আসেনি। বিচ্ছিন্নভাবে কেউ কোথাও পড়েছে কি না, আমার জানা নেই। এবং ছেলেদের মধ্যে নানা চড়াই-উৎরাই শেষে দু’একজন বিএ পাস করেছে।

কলেজ থেকে প্রায় তিন মাস পরে বাড়িতে গিয়ে বুঝলাম আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব ও পাড়া-প্রতিবেশীদের কাছে আমি আর সেই ছেলেটি নই— এখন আমি কলেজের ছাত্র। কালকুট্টা, কাউল্যা, পোড়া মরিচ— এইসব মধুর সম্ভাষণ তো দূরের কথা, সবাই কি রকম যেন একটা সমীহ করতে শুরু করেছে। আদর-আপ্যায়নও কিঞ্চিত বেড়েছে। আবার কোনো কোনো চাচাতো-জেঠাতো বোন মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকায়, রহস্যময় আচরণ করে। কিন্তু ও সবের কিছুই আমার মাথায় যায় না। এই সময় আমার বিচরণক্ষেত্র ছিল পাঁচ-ছয়টি গ্রাম। জহিরাবাদ, সানকিভাঙ্গা, নাওভঙ্গা, জয়পুর, এখলাসপুর এবং এমনকি ফরাজিকান্দি পর্যন্ত ছিল আমাদেল বিচরণক্ষেত্র। আর আমার চিরকালের সঙ্গী জেঠাতো ভাই হান্নান।

হান্নান আর আমি সমবয়সী। ও আমার পাঁচ দিনের বড়। কিন্তু পড়েছে সবসময় আমার এক ক্লাস নিচে। প্রাইমারিতে একই স্কুলে পড়েছি। সারাটা সময় এক সঙ্গে থেকেছি। আর কী যে ফুল্ল সময় কাটিয়েছি তার কোনো বিবরণ চলে না। তবে শিশু একাডেমী থেকে প্রকাশিত “জলের সঙ্গে শৈশব”, পাঞ্জেরী থেক প্রকাশিত “পালতোলা নৌকা”, “জ্যোৎস্নারাতে ভূত” এইসব গ্রন্থে সেই জীবনের কিছু খণ্ডচিত্র আছে। হাই স্কুলে উঠার পর আমি চলে গেলাম এখলাসপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে। এই স্কুলটি আমাদের ক্লাস্টারে নয়। আমাদের বাড়ি থেকে অনেক দূরে। আর পরের বছর হান্নান চলে গেল নাওভঙ্গা জয়পুর উচ্চ বিদ্যালয়ে। এই স্কুলটি আমাদের ক্লাস্টারে এবং এখনকার শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আমাদের নিত্য দেখা হয়। আমার স্কুলের কোনো বন্ধু হান্নানের বন্ধু হওয়ার সুযোগ ছিল না। কিন্তু ওর স্কুলের সকল বন্ধুই আমারও বন্ধু হয়ে ওঠে। তারা প্রায় প্রত্যেকে আমাকে ‘মান্নান ভাই’ সম্বোধন করে। কিন্তু এতে বন্ধুত্বের সম্পর্কে কোনো সমস্যা হতো না। আড্ডার সময় ভাষা ব্যবহার ও আচরণে সামান্য এই জুনিয়র-সিনিয়রের কোনো প্রভাব পড়ত না। কলেজ থেকে বাড়িতে এসে আমার এই বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা প্রগাঢ় পয়ে ওঠে।

বছরখানেক পরে তারাও কলেজে ভর্তি হবে। সুতরাং কলেজ সম্পর্কে তাদের কৌতূহলের অন্ত নেই। কে কোথায় ভর্তি হবে, কোথায় কার সুবিধা, এইসব নিয়েও অনেক কথা হয়, অথচ তখনো তারা এসএসসি পাস করেনি। কে পাস করবে এবং কে করবেনা, তারও ঠিকঠিকানা নেই। আমাদের সামনে তখন উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো দীপ্তিমান হয়ে আছেন জয়পুরের মুজিব ভাই। তিনি সিলেট মেডিকেল কলেজ থেকে সদ্য এমবিবিএস পাস করেছেন। আছেন এখলাসপুরের মোস্তাফা জামান ভাই। তিনিও এমবিবিএস পড়ছেন। নাওভঙ্গার নূরুল আমিন মামা ৭২ সালে এসএসসিতে ১৪তম এবং ৭৪ সালে এইচএসসিতে দ্বিতীয় স্টেন করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফিজিক্সে পাস করে রাশিয়াতে পিএইচডি করছেন এবং ঘর্ষণের ফলে লোহার ক্ষয়রোধ বিষয়ে গবেষণা করে হৈচৈ ফেলে দিয়েছেন। তাঁর সেই কৃতিত্ব ‘সোভিয়েত ইউনিয়ন’ নামক পত্রিকায় নাকি প্রকাশিত হয়েছে। আমার বড় বোনের দেবর শাহজাহান ভাই ফৌজদারকাট ক্যাডেট কলেজ থেকে পাস করে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন। আমাদের গ্রামের প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক আহসানউল্লাহ কাকার ছেলে নান্নু ভাই, শাখাওয়াত ভাই, কেফায়েত ভাই ও এনায়েত ভাই অসাধারণ মেধার পরিচয় দিয়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন।

আমার বড় ভাই রুহুল আমিন খুব ভালো করতে পারেননি। তিনি এক সাবজেক্ট রেফার্ডে বিএ পাস করেছেন আরও আগে। এবং আমার বড় খালার ছেলে আমিন ভাই বিএ পাস করে এখলাসপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছেন। তিনি আমার শিক্ষক। বন্ধুদের সঙ্গে এইসব মেধাবী আত্মীয়স্বজনদের নিয়ে কথা হয়। কখনো কখনো এদের কারো কারো সঙ্গে দেখাও হয়ে যায়। এরা আমাদের উৎসাহ দেন। বিশেষ করে আমাকে নিয়ে তারা বেশ আস্থাবান। আমি স্কুলে থাকতেই ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজ থেকে শাহজাহান ভাই আমাকে উৎসাহ দিয়ে চিঠি দিয়েছিলেন। ফাউনটেনপেনে গোটা গোটা করে লেখা চিঠি। অসাধারণ সুন্দর হাতের লেখা সেই চিঠি বহুদিন আমি সংরক্ষণ করেছিলাম। পরে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে আমার অত্যন্ত প্রিয় মানুষ শাহজাহান ভাইয়ের সঙ্গে আলবেরুনী হলের ২০৬ নম্বর রুমে কিছুদিন অবস্থানের সৌভাগ্য হয়েছিল। কিন্তু ওই মধুর দিনগুলোর কথা একসময় লিখতে চেষ্টা করব।

ফুল্ল ও প্রাণৈশ্বর্যে ভরপুর কিছু সময় বাড়িতে অতিবাহিত করে আবার আমি নারায়ণগঞ্জ ফিরে আসি এবং মেম্বার সাহেবের বাড়ি থেকে বিদায় নিয়ে নান্নু সর্দারের বাড়িতে গিয়ে উঠি। কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট শীতলক্ষ্যা নদীর একদম তীর ঘেঁষে অবস্থিত। এর পাশ দিয়ে নদীর দিকে নেমে গিয়ে নৌকায় উঠতে হতো। তখন শীতলক্ষ্যা স্বচ্ছতোয়া জলের নদী। নদীকেন্দ্রিক জীবনের ব্যস্ততা তখনো ছিল। যাত্রীবাহী লঞ্চ-স্টিমার এদিকে আসতো না। মুন্সীগঞ্জ, চাঁদপুর, মতলব, টরকী থেকে ছেড়ে আসা লঞ্চগুলো লঞ্চঘাট পর্যন্ত আসতো। কিন্তু বিচিত্র মালবাহী অসংখ্য নৌকা, কার্গো, ট্যাঙ্কার, জাহাছ এই পথে যাতায়াত করত। উত্তরে কোথায় এগুলো যায়, তা আমি জানতাম না। এদের কোনো কোনোটি যাওয়ার পর বিশাল ঢেউ উঠত নদীতে। আর আমাদের পারাপারের ছোট্ট নৌকাটি আকস্মিক ধাক্কায় খেই হারিয়ে ফেলত। বিশেষ করে মেয়ে যাত্রীরা তখন হৈচৈ করে উঠত। কেউ কেউ কেঁদে ফেলত। এবং যখন বুঝত যে, এটা খুব স্বাভাবিক ঘটনা, তখন লজ্জা পেত। কান্না, হাসি আর লজ্জায় মাখামি কিশোরীদের সে মুখ একবার যে দেখেছে, সে আর ভুলতে পারবে না। সাত থেকে দশ মিনিটের মধ্যে আমরা নদী পাড় হয়ে যেতাম। ঘাটে নামার পরে একবার একটি মেয়েকে আমি বলেছিলাম, “জানেন, অপনি যখন কাঁদলেন না, তারপরে লজ্জা পেলেন, তারপরে হাসলেন। আপনার ওই কান্না, হাসি আর লজ্জার মাখামাখিতে লাবণ্যময় মুখটা কি যে সুন্দর হয়ে উঠেছিল ! কি যে সুন্দর...!”

মেয়েটি আমার দিকে রহস্যময় দৃষ্টিতে একবার মাত্র তাকিয়ে হাঁটতে শুরু করে। কয়েক মুহূর্ত ওর ওই ভিন্ন পথের দিকে তাকিয়ে থেকে আমিও আমার পথে চলতে থাকি। ওই মেয়েটিকে কখনোই আর আমি দেখিনি। নবীগঞ্জ এলাকাটি একেবারেই অন্যরকম। মাঝে নদীটি না থাকলে শহরের অবিচ্ছেদ্য অংশই বলা যেত। কিন্তু বাস্তবে শহরের কোনো আভিজাত্য এখানে নেই। মানুষের বৈষয়িক জীবনে বেশ পরিবর্তন এলেও মনোজগতে তেমন কোনো পরিবর্তন আসেনি। এখানেও দেখলাম, ছেলে-মেয়েদের পড়াশোনা নিয়ে তারা মোটেই ভাবিত নয়। অধিকন্তু জাহাজ নির্মাণের কারখানা থেকে শুরু করে পাটকল শ্রমিক ও অন্যান্য কারখানা এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের শ্রমিক অধ্যুষিত এই অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী সম্ভ্রান্ত পরিবারগুলোতেও এক ধরনের অবক্ষয় দেখা দিয়েছে। অধিকাংশ বাড়িতে খোলা জায়গাটুকুতে ঘর তুলে শ্রমিকদের ভাড়া দেওয়ার মতো প্রবণতাও তৈরি হয়েছে। বাড়ির রাস্তা লাগোয়া অংশটুকু দোকানের জন্য ভাড়া দেওয়া হয়েছে। বাড়ির অদূরে নদীর পাড়ে যেখানে শাকসবজির চাষ হতো- গোডাউন তৈরির জন্য ওই খোলা জায়গাটুকোও ভাড়া দেওয়া হয়েছে। ফলে একটি নির্জন ও পরিচ্ছন্ন গ্রাম-শহরের মিলিত জনপদ বস্তিতে রূপ নিয়েছে। অথচ বন্দর ছাড়িয়ে আরও দক্ষিণে গেলে আপনি প্রকৃতির বিপুল নির্জনতার মধ্যে একটি প্রশান্ত জনপদের ঠিকানা তখনো পেয়ে যেতেন।

কিন্তু নান্নু ভাই এই কাজটি করেননি। রাস্তা লাগোয়া তার পূর্বমুখী বসতঘর। তার সঙ্গে একটি ঘরে চাল-গম ভাঙানোর কল। বাড়ির ভিতরে দক্ষিণমুখী একটি দোচালা টিনের ঘরে আমার বসত। আর বিশাল উঠানের পরে দুটি চৌচালা টিনের ঘর। ওখানে তার মা ও ভাইয়েরা থাকেন। তারও পেছনে অব্যবহৃত মজা পুকুর। এই বিশাল বাড়িটিতে তিনি অনেকগুলো ঘর তুলে ভাড়া দিতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করেননি। ফলে বাড়িটির ভেতরে ঢুকলে একটি উন্মুক্ত ও উদার পরিবেশের আস্বাদ পাওয়া যায়। নান্নু সর্দারকে প্রথম দেখে আমি রীতিমতো ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। বিশাল দেহের মানুষ। যেমন তার উচ্চতা, তেমনি মোটা। গায়ের রং শ্যামলা। মুখে বসন্তের দাগ। পৃথিবীর সেরা মাস্তান, গুণ্ডা, সন্ত্রাসী কিংবা খল নায়ক হওয়ার জন্য দৈহিক যত গুণাবলি দরকার সবই ছিল নান্নু সর্দারের। তিনি যখন কথা বলতেন, তখন মনে হতো, পৃথিবীর তাবৎ মানুষ, রাজা, মহারাজা কোন ছার- নস্যি নস্যি। অধিকাংশ সময় গায়ে হাফ শার্ট এবং পরনে দামি লুঙ্গি। খাটের উপরে বা মেঝেতে যখন তিনি বসতেন, তখন হাঁটু ভেঙে পায়ের উপর পা তুলে বসতেন। এবং ওই বসাটার মধ্যে তিনি খুব আয়েশ বোধ করতেন। পরে হায়াৎ মামুদ স্যারকে ওইভাবে আরাম করে বসতে দেখেছি। যখন ঘর থেকে বের হতেন, তখন দীর্ঘ সময় নিয়ে তিনি প্রস্তুতি নিতেন। মাথা ভর্তি বড় চুলে চুবিয়ে তেল মাখতেন এবং ভালো করে লেপটিয়ে আঁচড়াতেন। প্যান্ট পরতেন, তার উপর ফুল হাতা শার্ট। কখনোই শার্ট ইন করতেন না। পায়ে দামি স্যান্ডেল। শরীরের পাউডার মাখতেন। গলার নিচে প্রয়াস পাউডার দেখা যেত।

এমন পরিপাটি হয়ে তিনি যখন রাস্তায় বের হতেন, তখন তার সঙ্গে দু-একজন ছাপোষা লোক থাকতই। লোকজন তাকে সমীহ করে ছালাম দিত এবং সর্দার সহেবের কুশলাদি জানত। এই বিপুল আয়োজন করে তিনি কোথায় যেতেন, তা কখনোই জানা হয়নি। তবে এলাকার কোনো চায়ের দোকানে কিংবা কোনো হোটেল-রেস্তরাঁয় বসে আড্ডা দিতে তাকে কখনোই দেখা যায়নি। এই মানুষটি দেখতে যেমন বিশাল ছিলেন, তার আত্মাটাও ছিল তেমনি বিশাল। তিনি আমাকে ছোট ভাইয়ের মতোই গ্রহণ করেছিলেন। ওখানে যাওয়ার দু-এক দিনের মধ্যেই তিনি আমাকে বললেন, “শোনো মাস্টর, এই বাড়ির কোনো কিছুকেই পর মনে কইর না। নিজের মনে করবা। ছোড ভাইবোন থাকলে পড়াইতা না? ওগও নিজের ছোট ভাইবোন মনে কইরা পড়াইবা। নিজের পড়া নষ্ট কইরা না। আর আমি সাবুরে কইয়া দিতেছি, টেহা-পইসা যা লাগব কল থিকা লইয়া যাইবা।” প্রায় দেড় বছর এই বাড়িতে আমি ছিলাম। নান্নু ভাইয়ের এমন একটি আচরণ বা কথা স্মরণ করতে পারি না যাতে আমি কষ্ট পেয়েছিলাম। ঘরের পাকা মেঝেতে পাটি বিছানো থাকত। ওই পাটির উপর বসে আমরা সবাই এক সঙ্গে খেতাম। খাওয়ার সময় চলত নানা রকম গল্পগুজব, ইয়ার্কি-ফাজলামি, ঠাট্টামস্করা। বিশেষ করে ভাবীর সঙ্গে তার নিত্যদিনের ঠাট্টার সম্পর্ক ছিল। সামান্য সুযোগ পেলেই যৌনগন্ধী ঠাট্টা শুরু হয়ে যেতো। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যকার এই মধুর সম্পর্কটা আমার খুব ভালো লাগত।

বাঙালি গড়পড়তা মেয়েদের চেয়ে ভাবী লম্বা মহিলা। একহারা গড়ন। একদম ফর্সা। অসাধারণ সুন্দরী এই মহিলার মুখে বসন্তের দাগ। খুবই আশ্চর্যের বিষয় এই যে, স্বামী-স্ত্রী দুজনের মুখেই বসন্তের দাগ। সেই বসন্তের ক্ষতচিহ্নগুলোকে অতিক্রম করে ভাবীর মুখের লাবণ্য ও পেলবতা এবং দেহসৌষ্ঠব একবার দেখলে কোনো দিন ভুলে যাবার মতো নয়। স্বামী-স্ত্রী দুইজনই উৎফুল্ল মানুষ। সারাক্ষণ আনন্দে থাকতে পছন্দ করেন। বিশেষ করে ভাবী হৈহৈ রৈরৈ করে বেড়ানো মানুষ। কিন্তু তার জগৎ ওই বাড়িটুকুর মধ্যেই। বাপের বাড়ি নারায়ণগঞ্জের ধারেকাছে কোথাও। কিন্তু ওই বাড়িতে আমি তাকে কখনোই যেতে দেখিনি। আমাকে তিনি ছোট ভাইয়ের মতো স্নেহ করতেন এবং এর মধ্যেই আবার একটা ঠাট্টার সম্পর্কও তিনি তৈরি করে নিয়েছেন। এই দম্পতির দুটি ছেলে। ছোট ছেলেটি ক্লাস টুতে পড়ে। নাম সুমন। বড় ছেলেটির নাম লিটন। লিটন ক্লাস ফোরে পড়ে। সুমন কি যে মায়াবী ছেলে! মাথা ভরা চুল। খুব সুন্দর করে ছেঁটে রাখা। ওই চুল কখনো বাড়েও না, কমেও না। সব সময় একই রকম থাকে। কয়েকদিন পর পরই চুল ছাঁটিয়ে আনা হয়। শৈশবে একটি সময় পর্যন্ত যেমন ছেলে ও মেয়েদের মুখের গড়নটা প্রায় একই রকম থাকে, সুমন যেন সেই সময়টা তখনো পার করতে পারেনি। ওর মুখের গড়নের মধ্যে ছেলে শিশুর লাবণ্যের সঙ্গে মেয়ে শিশুদের একটি অস্পষ্ট লাবণ্যময়তার ছাপ তখনো বিদ্যমান। এইসব মিলে সুমনের মধ্যে অদ্ভুত একটা মায়ার আবহ সর্বদাই বিরাজমান থাকত। কিন্তু বড় ভাই লিটনের সঙ্গে যখন ঝগড়া করত, তখন তার আসল রূপ দেখা যেত। তার জিদের শেষ নেই। লিটনকে হারাতেই হবে। এবং লিটনও হেরে কেঁদেকেটে আনন্দ পেত। ছোট ভাইয়ের প্রতি তার দরদ এমনই ছিল।

লিটন তার মায়ের মতো ফর্সা এবং লম্বা। জন্মসূত্রেই এজমায় আক্রান্ত ছিল বিধায় তার শরীরে একটা খিটমিটে ভাব থাকত। কিন্তু লিটনকে আমার খুব ভালো লাগতে শুরু করে। কারণ ওই বয়সে ও সর্বক্ষণ দায়িত্বশীল মানুষের মতো আচরণ করত। কোনো কিছু নিয়ে ছোট ভাইয়ের সঙ্গে লাগলে, ঝগড়া হলে সে-ই মার খেতো। কখনো কখনো নিজের অংশটুকুও ছোট ভাইকে দিয়ে দিত। ওই বয়সেই লিটন নানা কাজে মাকে সাহায্য করত এবং বাবার ফাই-ফরমাশ শুনত। পড়াশোনায় লিটন তেমন ভালো করত না। কিন্তু তার চেষ্টার কোনো ত্রুটি ছিলনা। ফলে ওর প্রতি সংসারের সবারই ছিল আলাদা যত্ন, আলাদা দরদ। আর পড়াশোনা নিয়ে তাকে যেন চাপ দেওয়া না হয়, এ বিষয়ে নান্নু ভাই খুব সতর্ক ছিলেন। লিটন খুব একটা হাসত না। আবার সারাক্ষণই মুখ ভার করে আছে- তাও নয়। বেশ একটা দায়িত্বশীল মানুষের মতো সে চলাফেরা করত। তবে পড়তে বসলে সে না হেসে পারত না।

খুব ছোটবেলায় আমার ছোট চাচা আমাদের সঙ্গে রাজ্যের সব আজব গল্প ফাঁদতেন। কাকার ওইসব গল্প শুনে আমরা হেসে কুটিকুটি হতাম। কাকাকে আমাদের সবচেয়ে আপন মনে হতো। তখনও আমাদের মধ্যে সত্য-মিথ্যার বোধ তৈরি হয়নি, যৌক্তিক-অযৌক্তিক কিছু আছে বলেও আমরা জানতাম না। পৃথিবীর সবকিছুই আমাদের কাছে অফুরন্ত বিস্ময়। কাকা যেসব গল্প বলতেন, সেগুলো আমাদের খুব অবাক করে দিত। হাতি আকাশে উড়ে বেড়ানোর গল্পও তখন আমাদের কাছে খুবই বাস্তব বলে মনে হতো। বিশাল কানের একটি হাতি কান দুটিকে ডানার মতো ব্যবহার করে একবার ওড়েওছিল। শিশুদের এই আনন্দিত জগতের ব্যপারে আমি সর্বদাই খুব সচেতন ছিলাম। ফলে সুমন ও লিটনকে পড়াতে গিয়ে আমি আশ্রয় নিতাম গল্পের। ফলে লিটনের মতো শিশুও হাসতে হাসতে লুটোপুটি খেত। ওর এই হাসির শব্দ শুনে ভাবী, খালাম্মা, মানে ওদের দাদি এবং আরও অনেকে বেড়ার ফাঁক গলিয়ে দেখতে আসত।

পরে ভাবী আমাকে জিজ্ঞাসা করতেন, “আচ্ছা ভাই, আমনে কী গল্প কন যে আমার গোমড়ামুখো ছেলে পর্যন্ত হাসতে হাসতে লুটোপুটি খায়?” আমি বলতাম, “ভাবী, এখন তো বলতে পারব না। আপনি ওয়ান, টু বা থ্রিতে ভর্তি হয়ে আমার কাছে পড়তে আসেন, তা হলে বুঝতে পারবেন, আমি কী গল্প করি।” ভাবী হতাশ হয়ে বলতেন, “এই বয়সে কে আমার ভর্তি নেবে ভাই? দরকার নাই।”
“কেন, আমি আছি না। আমিই আপনার ভর্তি নেব।” দুষ্টের মতো হেসে বলতাম আমি। দুষ্টুমিটা ভাবী বুঝতে পারতেন। বলতেন, “না রে ভাই। এই বয়সে মাস্টারের প্রেমে পড়ার কোনো ইচ্ছা নাই।” ভাবীর ওই কথা কোথা থেকে নান্নু ভাই শুনে ফেলেছেন। তখন নান্নু ভাইয়ের সংলাপ: “মান্নান, পটাইও না, পটাইও না। এই জিনিস সামলাইতে পারবা না। আমার জীবনই ছেঁড়াবেরা হইয়া গেছে।” শুনে লজ্জায় আমি এক দৌড়ে নদীর পাড়ে।

ভাবীর একজন চাচাতো ভাই ধান-গম ভাঙানোর কলটা চালাত। ছোটখাটো শ্যামলা যুবক। সারাক্ষণ মুখে হাসি লেগে থাকত, আর রাজ্যের গল্প বলত। এর নাম সাহাবুদ্দিন সাবু। সাবু ভাইয়ের সঙ্গে আমার একটি মধুর সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল। নান্নু ভাইও এই শ্যালোকটিকে খুব পছন্দ করতেন। সাবু ভাইয়ের সততা ও নিষ্ঠার কোনো তুলনা চলে না। ধান ও গম ভাঙানোর একটি টাকাও বেহাত করার রুচি তার ছিলনা। পান-সিগারেট খাওয়ার অভ্যাস ছিল। সেটা নান্নু ভাই জানতেন। তার জন্য টাকা বরাদ্দ ছিল। আর আমি যাওয়ায় পর প্রতিদিন আমার জন্যও চার-পাঁচ টাকা বরাদ্দ করা হয়। তবে সাবু ভাইয়ের কাছ থেকে আমি খুব কম দিনই টাকা নিয়েছি।

নবীগঞ্জ গিয়ে কয়েক দিনের মধ্যেই আমি একটি টিউশনি ঠিক করে নিই। কদম রসুল (সা) মাজারে ঢুকতে হাতের ডান দিকের একতলা বাড়িতে। গৃহকর্তা একজন সরকারি কর্মকর্তা। নাম সম্ভবত ফরিদুর রহমান। সত্যিকার অর্থেই একটি শিক্ষিত ও রুচিশীল আধুনিক পরিবার। ছেলেটিকে দেখে আমি মুগ্ধ হই। ওর নাম ফয়সল। এইটে পড়ে। অত্যন্ত সুদর্শন কিশোর। মাথা ভরা অগোছালো চুল। পরনে দামি গেঞ্জি ও জিন্স প্যান্ট। ওই এলাকার আর দশটি ছেলে থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। আমি খুবই আনন্দের সঙ্গে ফয়সলকে পড়াতে শুরু করলাম। অনেক স্নেহ করে, আদর করে এবং ওর ইচ্ছা ও আবেগকে যথেষ্ট মর্যাদা দিয়ে পড়াতে লাগলাম। কিন্তু ফয়সলের মধ্যে পড়াশোনার প্রতি তেমন কোনো আগ্রহ নেই। অধিকন্তু আমি খুব অবাক হয়ে লক্ষ করলাম যে, ওর ব্যবহার, আচার-আচরণ এবং কথাবার্তা আর দশটি ছেলের মতো স্বাভাবিক নয়। কোনো কথা জিজ্ঞাসা করলে সে কোনো উত্তর দেয় না বরং কখনো কখনো খুব অসহায়ের মতো তাকিয়ে থাকে। কখনো বা রাগান্বিত হয়ে অপলক দৃষ্টিতে কোন দিকে চেয়ে থাকে! পড়াশোনাও খুব একটা হচ্ছে না। এর মধ্যে বেশ কয়েক দিন আমি ফয়সলকে বলেছি, “চল ফয়সল, তোমাকে নিয়ে নদীর পাড়ে ঘুরে আসি।”

কিন্তু ও একদিনও যেতে চায়নি। এক সময় আমার মনে হলো, বিষয়টি ওর বাবাকে জানানো দরকার। ওই দিন আমার পড়ানোর কথা ছিল না। আমি শুধু ফয়সলের বাবার সঙ্গে দেখা করার জন্য ওই বাসায় গেলাম। কিন্তু আমি কিছু বলার আগেই ভদ্রলোক বললেন, “কি ভাই, আর পড়াবেন না? অবশ্য আপনাকে আর কষ্ট করতে হবে না। ওকে আবার টঙ্গীতেই নিয়ে যেতে হবে।” আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। বললাম, “ফয়সলকে কি টঙ্গীর কোনো স্কুলে ভর্তি করে দেবেন?” আমাকে খুবই অবাক করে দিয়ে তিনি বললেন, “না ভাই, ওর কপালে পড়াশোনা নেই। সম্ভবও নয়। ওকে পাঠিয়ে দেব টঙ্গীর জাতীয় কিশোর অপরাধ সংশোধন ইনস্টিটিউটে।”

আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। বললাম, “এসব কী বলেন ভাই! ফয়সল কি কিশোর অপরাধী? এটা কিছুতেই হতে পারে না।” ফরিদ ভাই আবেগাক্রান্ত হয়ে পড়লেন। আমাকে বললেন,  “আপনি কিছুই জানেন না। আপনাকে কিছু বলা হয়নি। বলা উচিত ছিল। আপনি ওকে দুই সপ্তাহ ধরে পড়াচ্ছেন। এর মধ্যে ও বিভিন্ন লোকের দোকানে ও বাড়িতে দুই তিনবার চুরি করেছে। এলাকার লোকজন ওর মানসিক এই অসুস্থতার কথা জানে বলে মারপিট করেনি। পুলিশের কাছেও দেয়নি। বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে গেছে। এই যন্ত্রণা কত সহ্য হয়? আপনার ভাবী ছেলের জন্য কাঁদতে কাঁদতে অন্ধ হয়ে যাচ্ছে। ওর এই যন্ত্রণা যখন আর সহ্য করতে পারছিলাম না, তখন গত বছর ওকে ওই রিমান্ড হোমে রেখে এসেছিলাম। কিন্তু চোখের সামনে দেখলাম, কি যে অত্যাচার ওখানে করে! খাওয়া-খাদ্য নেই, কাউন্সিলিং নেই, সংশোধনের বালাই নেই। সারাক্ষণ অত্যাচার। ভাবলাম নিয়ে আসি। ওখান থেকে নিয়ে আসতে গিয়ে দেখলাম, খুনের আসামিকে জেল থেকে ছাড়িয়ে আনা বুঝি এত কঠিন নয়। কত সচিব, এমপি, মন্ত্রীর দরজায় ধর্না দিতে দিতে আমি যখন আর পারছিলাম না, যখন ছেলের আশা বাদ দিয়ে দেওয়ার পর্যায়ে, তখন ছেলে ছাড়া পেল। কত দলিল-দস্তাবেজ, কত কাগজপত্র, কত দাসখত, নাকখত দিয়ে ওকে ছাড়িয়ে আনলাম। এখন আবার যেই লাউ সেই কদু। কী করব, বলেন তো ভাই?”

অসাধারণ সুন্দরী মহিলা ওর মা। পোশাকপরিচ্ছদে আভিজাত্য। কথাবার্তায়ও রুচি ও মননশীল মানুষ। পাশে বসে তিনি স্বামীর আর্তনাদ শুনছিলেন। আমিও তো কিশোর। ফয়সলের চেয়ে কত আর বড়। কী বলতে পারি আমি। শুধু এইটুকু বললাম, “ভাই, ওকে যদি রিমান্ড হোমে পাঠাতেই হয় তা হলে কিছু দিন পরে পাঠান। এই সময়টা আমি ওর সঙ্গে থাকি।” ভাবী আবেগাপ্লুত হয়ে পড়লেন। আমাকে বললেন, “ভাই, ও কোনো দিন কোনো শিক্ষকের কাছে পড়তে পারেনি। দু-একদিন পড়ার পরই বাদ দিয়ে দিয়েছে। কিন্তু আপনাকে ও খুব পছন্দ করে। ভাই, দয়া করে আপনি আসবেন। ওকে ছেড়ে যাবেন না। পড়াতে হবে না ভাই। ওকে শুধু একটু সঙ্গ দেবেন।” এই অবস্থার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। তবুও এই দম্পতিকে কথা দিলাম, আমি থাকব।

এতদিন ফয়সলকে পড়ানোর একটা তাড়া ছিল। বেতন বা সম্মানী যাই বলি না কেন, সেটা জায়েজ করার একটা বিষয় ছিল। এখন ওই বিষয়টা গৌণ। আমি তো কিছুই বুঝি না। আমি মনোবিজ্ঞানী নই। মনস্তত্ত্ব সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা নেই। শিশুমনস্তত্ত্ব সম্পর্কে আমি অজ্ঞ আর অপরাধ বিজ্ঞানের অ-ও জানি না। তা হলে এই ছেলেটিকে নিয়ে আমি কী করি! সুতরাং আমার মুখ্য বিষয় হলো, ফয়সলকে সঙ্গ দেওয়া, অনেক অনেক স্নেহ করা, অনেক অনেক ভালোবাসা। এছাড়া খুব সতর্কতার সঙ্গে ওর ইচ্ছা, আবেগ ও বিশ্বাসকে গুরুত্ব দেওয়া। খুব মনোযোগ দিয়ে, খুব গুরুত্বের সঙ্গে ওর প্রতিটি কথা শোনা। আর পড়ার সময় আমি আসলে তেমন কিছুই করতাম না। কোনো একটি অধ্যায়ের অনুষঙ্গে চলে যেতাম আড্ডায়, গল্পে, হাসিঠাট্টায়, ইয়ার্কিফাজলামিতে।

প্রথম দিকে ও একটু অবাক হয়েছে। আমার সঙ্গে অংশগ্রহণ করতে ওর সমস্যা হতো। কিন্তু আমি ওর আবেগের এতটাই অনুষঙ্গী ছিলাম যে, কিছুতেই যেন ছন্দপতন না হয়। অল্প সময়ের মধ্যেই ও আমার সঙ্গে অংশগ্রহণ করতে লাগল। আস্তে আস্তে ও আমাকে বিশ্বাস করতে শুরু করল এবং আমার সঙ্গে নদীর তীরে বেড়াতে যেতে রাজি হলো। মানুষের ভীড় এড়িয়ে আমি ওকে নদীর পাড়ে নিয়ে যেতে লাগলম। নানা কথা আর গল্পগুজবের ভেতর দিয়ে ওর সঙ্গে আমার একটি নাড়ির বন্ধন তৈরি হতে লাগল।

কিন্তু দুই মাস মাত্র। তার পরেই শুনলাম, ফয়সলকে ঢাকার কোনো একটি আবাসিক স্কুলে ভর্তি করে দেওয়া হয়েছে। স্কুলটিতে খুব যত্ন ও নিরাপত্তার ব্যবস্থা আছে। ফয়সল ঢাকা চলে যাওয়ার পর ওই বাড়িতে আর কখনোই আমার যাওয়া হয়নি। অথচ কদম রসুল (সা) মাজারের পাশ দিয়ে আমি বহুদিন যাতায়াত করেছি। ফয়সলকে পড়াতে যাওয়ার পথে আলতাফ নামে একটি ছেলের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। ফর্সা গোলগাল চেহারার এই ছেলেটির মুখে হালকা দাড়ি। অতি ভদ্র আচরণ। দেখতে একদম ইনোসেন্ট। সে নাকি তোলারাম কলেজে আমার ব্যাচমেট। আর্টসে পড়ে। কিন্তু কোনো দিন আমি তাকে কলেজে দেখিনি। এমনকি আসা-যাওয়ার পথেও ওর সঙ্গে আমার কখনো দেখা হয়নি।

সে সময় আমি প্রচুর পড়াশোনা করি। সুধীজন পাঠাগার থেকে বই নিয়ে আসি। ধুমছে পড়ছি ফ্রিডরিখ নীটসে, সরেন কিয়ের্কের্গো, লুডউইগ ফয়েরবাক, মার্কস, এঙ্গেলস, জ্যাঁ-পল সার্ত্র । আর নিজেকে বিশাল একজন পণ্ডিত মনে করছি। সেই সময় আলতাফ আমাকে বলল, তাদের নাকি একটি লাইব্রেরি আছে। আমি চাইলে সে আমাকে বই ধার দিতে পারে। সত্যি পরদিন সে আমার জন্য তিনটি বই নিয়ে এলো। এবং এই তিনটি বইয়ের লেখকই মাওলানা মওদুদী।

বইগুলো তার হাতে ফিরিয়ে দিয়ে আমি আলতাফকে বললাম, “ধর্ম নিয়ে আমার আগ্রহ আছে। কিন্তু মওদুদীবাদ নিয়ে আমার কোনো আগ্রহ নাই। আশা করি তুমি বুঝতে পেরেছ।” আর কোনো কথা না বলে ওই দিন চলে আসার পর আলতাফের সঙ্গে আর কোনো দিন আমার কথা হয়নি। নবীগঞ্জে আমার একজন ক্লাসমেট ছিল। এখন আর ওর নাম মনে নেই। সম্ভবত শফিক। বড় বোনের বাড়িতে থেকে তোলারাম কলেজে পড়ত। এইচএসসিতে ফিজিক্স প্র্যাকটিকাল পরীক্ষায় আমি ক্যালকুলেটর ব্যবহার করছিলাম। সম্ভবত ইসহাক তালুকদার স্যার এক্সটার্নাল এক্সামিনার হিসেবে ঢাকা কলেজ থেকে এসেছিলেন। তিনি আমার প্র্যাকটিকাল খাতা নিয়ে যান। পরীক্ষা আমার প্রায় শেষ হয়ে গিয়েছিল। সুতরাং সবাই ব্যস্তসমস্ত হয়ে চূড়ান্তভাবে লেখাজোখাগুলো দেখে নিচ্ছে, আমি তখন দাঁড়িয়ে আছি। শফিক আমাকে জিজ্ঞাসা করে, “মান্নান, তুই খাড়ইয়া আছিস কিলিগা? খাতা কই?”

বললাম, “ক্যালকুলেটর ব্যবহার করছিলাম। সেজন্য স্যার খাতা নিয়ে গেছেন। ক্যালকুলেটর নাকি ব্যবহার করা যাবেনা।” হাসতে হাসতে শফিক বলে, “ওহ্, তাইলে তো তোরে এক্সপেল করছে। এখন খাড়ইয়া থাইকা লাভ নাই। যা গা।” কিন্তু আমি বের হয়ে গেলাম না। দাঁড়িয়েই থাকলাম। এর মধ্যে ওই প্র্যাকটিকাল ক্লাসেই স্যার বাইভা নিতে শুরু করলেন। ডান দিক থেকে বাইভা নিতে নিতে আমার দিকে আসছেন। আমার বুক ধড়ফড় করছিল। বাইভাতে কেমন করব তার জন্য নয়, আমাকে বাদ দিয়ে স্যার চলে যান কি না তার জন্য।

এক সময় স্যার আমার সামনে এলেন এবং খুব রাগত স্বরে জিজ্ঞাসা করলেন, “এই ছেলে, তোমার মাথার উপর ওটা কী।” আমি বললাম, “স্যার বাল্ব।”
“কত ওয়াট?”
খুব ভালো করে দেখতে চেষ্টা করলাম বাল্বটি কত ওয়াটের। কিন্তু দেখা যাচ্ছিল না। সুতরাং বললাম, “স্যার, দেখা যাচ্ছে না। তবে ১৫০ ওয়াট হতে পারে।” এর পর স্যার প্রশ্ন করলেন, “ওয়াট কী?” আমি উত্তর দিলাম এবং আরও কয়েকটি প্রশ্ন করে স্যার হাতে রাখা খাতায় কি একটু টুকে নিয়ে আমার পরের টেবিলে চলে গেলেন। আমার মনে হলো, স্যার আমার প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন।

কিন্তু আমার ওই বন্ধুটি নবীগঞ্জ এলাকায় রটিয়েছে যে, আমাকে এক্সপয়েল করা হয়েছে। তবে ক্যালকুলেটর ব্যবহারের বিষয়টি মানুষের কাছে বোধগম্য না হওয়াতে দুর্নামটি ভালো বাজার পায়নি। তবুও ভাবী খুব দ্বিধাদ্বন্দ্বের সঙ্গে আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন যে, ব্যাপারটা কী। আমি খুবই লজ্জিত হয়েছিলাম। এবং ভাবীকে নিশ্চয়তা দিয়েছিলাম যে, বিষয়টি ঠিক নয়। আমাদের সঙ্গে বিজ্ঞান বিভাগে যারা ভর্তি হয়েছি সেই প্রায় তিনশ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে একশ জনের উপরে এসএসসিতে প্রথম বিভাগ ছিল। কিন্তু এইচএসসিতে তাদের মধ্যে মাত্র তিনজন প্রথম বিভাগ পেয়েছিল। আর পাসের হার ছিল মাত্র ২১%। আমি কোনো রকমে দ্বিতীয় বিভাগ পেয়েছিলাম। (কলেজের বিষয়গুলো নিয়ে পরে লিখব)।

সত্তর ও আশির দশকে মতলব উত্তরের ছেলেরা নারায়ণগঞ্জ ও মুন্সীগঞ্জের বিভিন্ন স্কুল-কলেজে পড়তে আসত। নানাজনের বাড়িতে লজিং থেকে তাদের বিদ্যা আহরণ চলত। পাশাপাশি চলত ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় প্রণয়লীলা। লজিং মাস্টারের মেয়ে, চাচাতো বোন, জেঠাতো বোন, ফুফতো বোন, মামাতো বোন, শ্যালিকা ইত্যাকার কাছের-দূরের আত্মীয়াদের সঙ্গে এই প্রণয়লীলা অধিকাংশ সময় শুভ পরিণয়ের ভেতর দিয়ে সুখকর পরিসমাপ্তি ঘটত। এর পরেও কারো পড়াশোনা হয়েছে, এমন সৌভাগ্যবান ব্যক্তির সংখ্যা বেশি নয়।

আমি নারায়ণগঞ্জ আসার সময় আমার বড় বোন পরিষ্কার বলে দিয়েছে, “প্রেম-টেম যা ইচ্ছা করিস কিন্তু খবরদার বিয়ে করবি না। বিয়ে করলে তুই শেষ।” আরেক চাচাতো বোন প্রতিবাদ করে বলেছিল, “আপা চিন্তা কইরেন না। এই কাউল্যারে পছন্দ করার মেয়ে এখনো হয় নাই।”

অমার এইচএসসি পরীক্ষা যখন দোরগোড়ায় তখন নান্নু ভাইয়ের দূর সম্পর্কের অসাধারণ সুন্দরী এক চাচাতো বোন ওই বাড়িতে এসে ওঠে। ওর নাম না বলি। আদ্দিকালের নাম। কিন্তু যৌবনের সেই উত্তাল সময়ে কোনো মেয়ের নাম যদি ‘আরজিনা বেগম’ও হতো তা হলেও আমাদের মনে হতো, “আহাহা, কি মিষ্টি নাম।” কিন্তু মনে করবেন না যেন, আদ্দিকালের নাম বলে এই সময়ে এসে বলছি না। বরং কৌশলগত সমস্যা আছে। তবুও একটি নাম দিয়ে কথা বললে সুবিধা হয়। ধরা যাক ওর নাম কেয়া।

গায়ের রং দুধে-আলতায়। সেই রঙের সঙ্গে মিশে আছে বিস্ময়কর লাবণ্য আর পেলবতা। মাঝারি লম্বা মেয়েটির মাথার চুল বিপুল জলরাশির ঝর্ণার মতো নেমে গেছে হাঁটু অবধি। অধিকাংশ সময় উজ্জ্ব গোলাপি রঙের পোশাক পরে। পোশাকপরিচ্ছদে মার্জিত ও রুচিশীল। কিন্তু মুখে রা নেই। সারাক্ষণ বড় ঘরে থাকে। টুকটাক কাজ করে আর যত কথা বলে সুমন ও লিটনের সঙ্গে। ওরা দুইজন ওর জান। দু-একবার আমি ওকে উঠানে হাঁটতে দেখেছি। আমার মনে হয়েছে, মেয়েটি খুব লাজুক, বিনম্র ও সংকোচপ্রবণ। পৃথিবীর কারো চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলার সাহস ওর নেই।

পরীক্ষা নিয়ে আমার ‘আরজিনা-পাগল’ অবস্থা। না পড়লে ভালোই থাকি। কিন্তু পড়লেই মনে হয় কিছুই পড়িনি। সুতরাং কেয়াকে নিয়ে চিন্তা করার বিন্দুমাত্র ফুরসৎ আমার নেই। সেও কখনোই আমার ঘরের সীমানার মধ্যে আসেনি। এবং অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় এই যে, ওই মেয়েটির সঙ্গে আমার কুশল বিনিময় পর্যন্ত হয়নি। আমি জানি না যে মেয়েটির বাড়ি কোথায়, সে কেনো এখানে থাকছে, তার পড়াশোনার কী অবস্থা। এবং এইসব নিয়ে কারো সঙ্গে আগ্রহ প্রকাশ কারার ইচ্ছাও আমার নেই। আমি আছি পরীক্ষা শেষ করে অন্য কোথাও চলে যাওয়ার চেষ্টায়।

এই সময় ভাবীকে দেখি বেশ বিমর্ষ থাকেন। সারাক্ষণ হাসিখুশি মানুষটি চুপ হয়ে গেলেন। আবার অল্পতেই ছেলেদের সঙ্গে রেগে যান। নান্নু ভাই আগের মতোই হাসিঠাট্টা করেন। কিন্তু ভাবীর পক্ষ থেকে তেমন সাড়া পান না। ফলে তিনি বিব্রত হয়ে থেমে যান। দাম্পত্য জীবনে কত রকম ঝামেলা হতে পারে। ওইসব নিয়ে অন্য পক্ষের চিন্তা করা শোভন নয়। ফলে ভাবীর এই ভিন্নধর্মী অচরণের ব্যাপারে আমি কিছু জানতে চাইনি কখনোই। এভাবেই বেশ কিছুদিন চলে যাওয়ার পর একদিন ভাবী এসে আমার ঘরে বসে আলাপ করার পরিবেশ তৈরি করতে চাইলেন। কিন্তু দুদিন পরেই আমার পরীক্ষা শুরু হবে। সুতরাং দ্রুত বিদায় করার জন্য বললাম, “ভাবী, কিছু বলবেন?”

ভাবী বললেন, “ভাই একটা কথা বলি, অপনি কি কেয়াকে নিয়ে কিছু ভাবছেন?” আমার তো আকাশ থেকে পড়ার যোগার। আমি বললাম, “না তো ভাবী। ওর সঙ্গে আজ পর্যন্ত আমার কুশল বিনিময়টুকুও হয়নি। ওকে নিয়ে আমি কী ভাবব। এছাড়া দুই দিন পরে আমার পরীক্ষা। এই সময় অপনি এ ধরনের কথা কেন বলছেন ভাবী?”
“মাপ করবেন ভাই। এমনিতেই বলছি। কিছু মনে করবেন না। আর আপনার ভাইকে কিছু বলবেন না।” বলে তিনি চলে গেলেন।

ওই ছোট্ট জীবনে কতরকম পরিস্থিতির মধ্যে আমি পড়েছি। চিন্তা করে করে সেই সব প্রতিকূল পরিস্থিতি অতিক্রম করার চেষ্টা করেছি এবং অতিক্রম করেছিও। কিন্তু এই পরিস্থিতিটা আমাকে প্রথম চিন্তার মধ্যে নয়- দুশ্চিন্তার মধ্যে ফেলে দেয়। অল্পক্ষণের মধ্যেই আমি অনুভব করি যে, দুশ্চিন্তা করে কোনো লাভ নেই। নিষ্ঠা ও সততার সঙ্গে পরীক্ষাটা শেষ করতে হবে এবং এই নতুন পরিস্থিতিটাকে কিছুমাত্র পাত্তা দেওয়া চলবে না। প্রত্যেকটি পরীক্ষা শেষ হচ্ছে আর আমি হাঁফ ছেড়ে যেন বাঁচছি। আমার পরীক্ষা যখন একদম শেষ পর্য়ায়ে, ঠিক সেই সময় মেয়েটি আমার ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে আমাকে বলল, “ভাই কেমন আছেন?”

আমি একটু অবাক হলাম এবং কিছুটা বিব্রত। বললাম, “জি, ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?” আমার কথার কোনো উত্তর না দিয়ে সে বলল, “ভাই, আপনার সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে। শুনবেন?” আমি বললাম, “নিশ্চয়ই। তবে আমার আর দুটি পরীক্ষা আছে। শেষ হোক।” কেয়া চলে গেল। ওর সঙ্গে আর কখনোই আমার কথা হয়নি।

তখন আমি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছি। আলবেরুনী হলের ২০৬ নম্বর রুমে থাকি। সেই সময় কেয়ার একটি চিঠি পেলাম। নান্নু ভাইয়ের বাড়ি থেকে বিদায় নেওয়ার প্রায় ছয় মাস পরে। ওই চিঠিতে কেয়া আমার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়েছে এবং তার ওই ছোট্ট জীবনে কত বড় যন্ত্রণার মধ্যে পড়েছিল, তার বিবরণ তুলে ধরেছে। চিঠিটি পড়ে কেয়ার প্রতি গভীর স্নেহ ও মমতায় আমার চোখে জল এসে পড়ে।

ওই চিঠিতে উত্তর লেখার কোনো ঠিকানা ছিল না। ঠিকানা থাকলেও হয়তো কোনো দিনই উত্তর লেখা হতো না। দূর থেকে দেখে দেখে আমাকে কেয়া যতটুকু চিনেছে, তাতে ঠিকানা দিয়ে চিঠি না পাওয়ার কষ্টটুকু নিতে চায়নি। ওই বুদ্ধিটুকুর জন্য আজও ওকে আমি স্মরণে রেখেছি। কেননা, উত্তর লেখার দায় থেকে ও আমাকে মুক্তি দিয়েছিল। চলবে

লেখক: শিক্ষাবিদ