হায় জীবন! হায় মৃত্যু!
অমিত কুমার কুণ্ডুপ্রকাশিত : জুলাই ০৯, ২০২০
আলম তালুকদার। একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা, শিশুসাহিত্যিক ও অবসরপ্রাপ্ত উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা। সদা হাস্যোজ্জ্বল, দিলখোলা, কৌতুকপ্রিয় এই মানুষটি আর আমরা দেখব না। বুধবার বিকেলে তিনি চলে গেছেন না-ফেরার দেশে। বন্ধুবৎসল মজার এই মানুষটিকে আমরা কখনো ভুলব না।
মানুষ জীবনে অনেক কিছু চায়। কেউ গাড়ি চায়, কেউ বাড়ি চায়, কেউ নারী চায় । কেউ আবার সুরা পান করে হাতি ঘোড়া মারতে চায়। আলম তালুকদার এসব কিছুই চাননি। তিনি চেয়েছেন সাহিত্যিক হতে। কতটা হতে পেরেছেন বা কতটা হতে পারবেন সেটা সময় বলে দেবে।
আমরা তার বিচার করার কে? আমরা শুধু বলতে পারি, যত বেশি সংখ্যক লোক বাংলা সাহিত্য চর্চার সঙ্গে যুক্ত হবে, বাংলা সাহিত্যের তত বেশি উন্নতি হবে। আলম তালুকদারের মতো যত বেশি সংখ্যক মানুষকে আমরা সাহিত্য অঙ্গনে পাব, তত বেশি সংখ্যক মানুষ সুসাহিত্যিকদের মূল্যায়ন করতে শিখবে।
সাহিত্য অন্তপ্রাণ এই মানুষটির লেখা `মজার পড়া ১০০ ছড়া` বইটি আজ পড়লাম। তিনি সাবলীলভাবে লিখেছেন:
যখন তুমি দেখবে কালো
তখন তুমি চাইবে আলো
কিন্তু আলো কই?
অন্ধকারে দেখতে পাবে
সব কালোকে গিলে খাবে
একটি ভালো বই।
তোমার ভেতর স্বপ্ন হবে
যোগ্যতম হবে তবে
থাকলে ভালো বই,
যদি থাকো বইয়ের পাড়ায়
বাধার পাহাড় সরে দাঁড়ায়
বই মানে তো মই।।
`বই মানে তো মই`। বই নিয়ে কী অসাধারণ একটা লেখা। এই আলম তালুকদারই লিখেছিলেন:
পড়িলে বই আলোকিত হই,
না পড়িলে বই অন্ধকারে রই।
এই পদদুটি এখন জাতীয় স্লোগানে রূপান্তরিত হয়েছে।
এছাড়া তিনি লিখেছেন:
রাশি রাশি কিনছি হাসি
আমরা হাসির আড়ৎদার
আমার হাসি হাসার জন্য
বলছি ব্রিটিশ ভারত ছাড়।
স্বাধীনতা যুদ্ধ অংশ নেয়া একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার নিকট থেকে এরকম স্বদেশি কবিতা বের হবে, এটাই তো স্বাভাবিক। আবার শব্দের কুপ্রভাব স্মরণে আনতে তিনি লিখেছেন:
বনের পশু এক হয়েছে
করছে প্রতিবাদ
অমানবিক শব্দগুলো
দিতে হবে বাদ।
তিনি `উপদেশ` নামে একটি চমৎকার ছড়ায় বুঝিয়ে দিয়েছেন, আমরা নিজেদের অসংখ্য ছিদ্র থাকা সত্ত্বেও অপরের ছিদ্র অন্বেষণে কত ব্যতিব্যস্ত। তিনি লিখেছেন:
এটা ধরি ওটা ধরি
অপরের দোষ ধরি
নিজেরটা ধরি না।
এটা করি ওটা করি
মাঝে মাঝে ফোঁস করি
ভালো কাজ করি না।
এটা পড়ো সেটা পড়ো
বেশি করে বই পড়ো
তবে নিজে পড়ি না।
এটা গড়ো ওটা গড়ো
ভালো করে দেশ গড়ো
নিজে কভু গড়ি না।
তিনি `আপদ-বিপদ` নিয়েও ছড়া কেটেছেন। ছড়ার এই বহুমাত্রিক ব্যবহার ছড়াকে অনন্য করেছে। অতিথি বাড়ির উপর আসলে বাড়ির বাচ্চারা কত যে খুশি হয় সেটা বোঝাতে তিনি লিখেছেন:
মিষ্টি নিয়ে ইষ্টি কুটুম
বাড়ি যখন আসে
চার বছরের ঊর্মি সোনা
ফুলের মতো হাসে।
একুশ নিয়ে তিনি রচনা করেছেন অনন্য একটি ছড়া।
একুশ আমার মায়ের ভাষা
একুশ আমার গর্ব
একুশ আমার জীবন-মরণ
যুদ্ধ শুরুর পর্ব।
তিনি জাদুঘরের প্রতি বাচ্চাদের আকর্ষণ সৃষ্টির লক্ষ্যে লিখেছেন:
জাদুঘরে আইসা দাদু
জাদুঘরটা দেখো
আজব আজব জিনিস দেইখা
নতুন কিছু শেখো।
তিনি এ বইএর সর্বশেষ ছড়াটি লিখেছেন পরিবেশ নিয়ে।
আমাদের পৃথিবী আমাদের ঘরে
পশু-পাখি, খাল-বিল নয় কেহ পর।
আমাদের মা মাটি
সবচেয়ে বেশি খাঁটি
রাখি যদি পরিপাটি
তারপর যদি হাঁটি
সব ভালো থাকবে।
দূষণীয় পরিবেশ
যদি সব করি শেষ
ফুলে ফলে ভরি দেশ
সবে মিলে গড়ি দেশ
পাখি সব ডাকবে।
তার চাওয়া আমাদেরও চাওয়া। আমরাও চাই একটি দূষণমুক্ত শান্তিময় পৃথিবী। এই প্রিয়মুখ আমরা আর দেখতে পাব না! আহারে! বীর মুক্তিযোদ্ধা, শিশু সাহিত্যিক, সাবেক অতিরিক্ত সচিব, সকলের ভালোবাসার মানুষ, শহরের সবচেয়ে হাসিখুশি মানুষ আলম তালুকদার চলে গেলেন পরপারে। কষ্টে হৃদয় ভেঙে পড়ছে। মানুষ জীবন এমন পদ্মপাতার জলের মতো কেন? জীবন এমন টলমল করে টুপ করে ঝড়ে পড়ে কেন? কেনইবা জীবন আসে, আর কেনইবা জীবন মৃত্যুতে রূপান্তরিত হয়ে বিশ্বপ্রকৃতির সাথে মিলে যায়! হায় জীবন! হায় মৃত্যু!
























