হুমায়ূন আহমেদ এবং হুমায়ূন আহমেদ

ইমদাদুল হক মিলন

প্রকাশিত : জুলাই ১৯, ২০১৯

হুমায়ুন আহমেদকে নিয়ে ইমদাদুল হক মিলনের একটি লেখা আছে, নাম– হুমায়ূন আহমেদ এবং হুমায়ূন আহমেদ। লেখাটিতে হুমায়ুন আহমেদের সাক্ষাৎকারের সাথে সাথে বেশ কিছু মজাদার হাসি তামাশাও চলে এসেছে যাতে হুমায়ুন আহমেদের চির হাস্যমুখর প্রাণবন্ত অনুভূতি ফুটে উঠেছে।

এই লেখাটুকু হুমায়ূন আহমেদের

কিছুদিন হলো আমার জীবনচর্যায় নতুন সমস্যা যুক্ত হয়েছে। সন্ধ্যা মিলাবার আগেই সিরিয়াস মুখভঙ্গি করে তিন-চারজন আমার বাসায় উপস্থিত হচ্ছে। আমার মায়ের শোবার ঘরটিতে ঢুকে যাচ্ছে। নিজেরাই উদ্যোগী হয়ে এসি ছেড়ে দিচ্ছে। গলা উঁচিয়ে চা-নাশতার কথা বলছে। এই ফাঁকে একজন ক্যাসেট রেকর্ডার রেডি করছে। অন্য একজন ক্যামেরায় ফিল্ম ভরছে। তৃতীয়জন কাগজ-কলম নিয়ে প্রস্তুত। চতুর্থজন ব্যস্ত হয়ে মোবাইলে টেলিফোন করছে ইমদাদুল হক মিলনকে। ঔপন্যাসিক চলে এলেই কর্মকাণ্ড শুরু হবে। ঔপন্যাসিক আমার ইন্টারভিউ নেবেন।

ইমদাদুল হক মিলনের সমস্যা কী, আমি জানি না। ইদানীং সে সবার ইন্টারভিউ নিয়ে বেড়াচ্ছে। টিভি খুললেই দেখা যায় সে কারোর না কারো ইন্টারভিউ নিচ্ছে। পত্রিকার পাতাতেও দেখছি অনেকেই তার প্রশ্নবাণে জর্জরিত। কিছুদিন আগে পশ্চিমবঙ্গ থেকে ঔপন্যাসিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সস্ত্রীক বেড়াতে এসেছিলেন। তাঁরাও রক্ষা পাননি। তিন দিন ধরে ক্রমাগত তাঁদের ইন্টারভিউ হলো। আমার দখিন হাওয়ার বাসাতেই হলো।

মিলন জানেও না ইন্টারভিউ নিতে নিতে তার গলার স্বরেও কিছু পরিবর্তন হয়েছে। চোখের দৃষ্টিও অন্য রকম। এখন তার চোখে শুধু প্রশ্ন খেলা করে।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আমি কেন এই ফাঁদে পা দিলাম? সন্ধ্যাটা আগে বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে ভালোই কাটত। এখন ক্যাসেট প্লেয়ার মুখের সামনে ধরে মিলন বসে থাকে। সামান্য ঝুঁকে এসে প্রশ্ন করে,

ইমদাদুল হক মিলন: আপনার সাম্প্রতিক উপন্যাস ‘লীলাবতী’ দিয়েই শুরু করছি। এটা পড়ে মনে হয়েছে, প্রধান চরিত্র হচ্ছে সিদ্দিকুর রহমান। এই উপন্যাসটির নাম ‘সিদ্দিকুর রহমান’ বা ‘সিদ্দিকুর রহমানের জীবন’ এ রকম হতে পারত। ‘অনিল বাগচীর একদিন’ নামে আপনার একটা বই আছে। উপন্যাসের প্রধান চরিত্রের নামেই যদি নামকরণ করেন, তাহলে উপন্যাসটির নাম ‘লীলাবতী’ কেন?

হুমায়ূন আহমেদ : আমি তো মনে করি যে, ‘লীলাবতী’ উপন্যাসে যে কটি চরিত্র এসেছে, প্রতিটিই প্রধান চরিত্র।

[ভুল উত্তর। উপন্যাসের সব চরিত্রই প্রধান হতে পারে না। ঔপন্যাসিক মিলন অবশ্যই এটা জানে। কিন্তু সে এমন ভাব করল যেন সে আমার উত্তর গ্রহণ করেছে। সে দ্বিতীয় প্রশ্ন করল_]

ইমদাদুল হক মিলন : তাহলে ‘লীলাবতী’ নামটি কেন রাখলেন?

[প্রবল ইচ্ছা হলো বলি_আমার ইচ্ছা। তোমার কী?

এই জাতীয় উত্তর দেওয়া যায় না। অনেক পাঠক পড়বে। জ্ঞানগর্ভ কিছু বলা দরকার। জ্ঞানগর্ভ কিছু মাথায় আসছে না। কী করি? উপন্যাসের নাম নিয়ে মিলনের মাথাব্যথার কারণটাও ধরতে পারছি না। আমি বললাম_]

হুমায়ূন আহমেদ : উপন্যাসের নাম হিসেবে ‘লীলাবতী’ নামে যে মাধুর্য আছে ‘সিদ্দিকুর রহমান’ নামে কি সে মাধুর্য আছে?

ইমদাদুল হক মিলন : অবশ্যই এটা একটা সুন্দর নাম।

[মিলন মুখে বলল, এটা একটা সুন্দর নাম; কিন্তু তার চেহারা দেখে মনে হলো সে আমার কথাবার্তায় পুরোপুরি সন্তুষ্ট না। তার চেহারায় প্রশ্নবোধক চিহ্ন পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। তখন আমার মনে হলো_আচ্ছা, মিলন কি ভাবছে আমি ‘লীলাবতী’ নামটি বাণিজ্যিক কারণে রেখেছি? তাই যদি হয় তাহলে তো নামকরণের ব্যাপারটি ভালোমতো ব্যাখ্যা করা দরকার। বইয়ের ফ্ল্যাপে এই ব্যাখ্যা আছে। আমি পরিষ্কার বলেছি_ভারতীয় গণিতজ্ঞ ভাস্করাচার্যের কন্যার নাম ‘লীলাবতী’। এই নামটির প্রতি আমার অস্বাভাবিক দুর্বলতা আছে। তবে আমি এত ব্যাখ্যায় গেলাম না, সরাসরি মূল বিষয়ে চলে গেলাম_]

হুমায়ূন আহমেদ : মিলন, তুমি যদি মনে করো আমি ‘লীলাবতী’ নামটি দিয়েছি বাণিজ্যিক চিন্তাভাবনায়, তাহলে ভুল করবে। আমার ভালো লেগেছে, তাই এই নাম দিয়েছি। বইয়ের নামের কারণে কিছু বই বেশি বিক্রি হবে_এটা নিয়ে আমার প্রকাশক মাথা ঘামাতে পারে। আমি ঘামাই না।

[আমার কঠিন কথায় মিলন একটু থমকে গেল এবং অতি দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়ে বলল_]

ইমদাদুল হক মিলন : আপনার উপন্যাসের ক্ষেত্রে নাম কোনো ফ্যাক্টর না। আপনি ‘মন্দ্রসপ্তক’ নামে একটি বই লিখেছিলেন। এই শব্দটির অর্থও অনেকে জানেন না। আপনি বাংলাদেশ টেলিভিশনে একটি নাটক লিখেছিলেন_’অয়োময়’। এই শব্দের সঙ্গে বেশির ভাগ বাঙালি পরিচিত নন। আপনার লেখার ক্ষেত্রে নাম কোনো ফ্যাক্টর না। ওইভাবে আমি ভাবিনি।

হুমায়ূন আহমেদ : তার পরও কিন্তু ফ্যাক্টর থাকে, মিলন। আমি দেখেছি। অন্যপ্রকাশ আমার দুটি বই ‘বাসর’ ও ‘সৌরভ’ প্রকাশ করেছে। তুমি দেখবে, ‘বাসর’-এর বিক্রি হয়েছে অনেক বেশি। ‘বাসর’ নামটি হয়তো মানুষকে আকর্ষণ করেছে অনেক বেশি, দেখি তো কী আছে বইটিতে। ‘সৌরভ’ কিন্তু ততটা আকর্ষণ করেনি। ‘সৌরভ’ উপন্যাসটির নাম যদি ‘বাসর’ দিতাম এবং ‘বাসর’ উপন্যাসটির নাম ‘সৌরভ’ দিতাম তাহলেও একই ঘটনা ঘটত।

ইমদাদুল হক মিলন : (বিজয়ীর ভঙ্গিতে) তাহলে তো আপনি স্বীকারই করলেন যে, নামের একটি বাণিজ্যিক ব্যাপার আছে।

হুমায়ূন আহমেদ : হ্যাঁ স্বীকার করলাম। তবে বইয়ের নাম দেওয়ার সময় বাণিজ্যিক ব্যাপারটা আমার মাথায় কখনো থাকে না। যদি থাকত তাহলে ‘সৌরভ’ উপন্যাসটির নাম দিতাম ‘গোপন বাসর’। হা হা হা।

[বুদ্ধিমান পাঠক সম্প্রদায়, আপনারা কি লক্ষ করছেন_মিলন আমাকে দিয়ে স্বীকার করিয়ে নিল যে নামের একটা বাণিজ্যিক ব্যাপার আছে। এখন আমার কি উচিত না আরো সাবধানে তার প্রশ্নের জবাব দেওয়া? কে জানে সে হয়তো এমন অনেক কিছু আমার মুখ দিয়ে বলিয়ে নেবে, যা আমার মনের কথা না। কাজেই Attention, সাবধান। প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার ব্যাপারে সাবধান। মিলন গভীর জলের পাঙ্গাশ মাছ। আমার মতো অল্প পানির ‘তেলাপিয়া’ না।]

ইমদাদুল হক মিলন : আপনি প্রচুর ভূতের গল্প লিখেছেন। অবিস্মরণীয় কিছু ভূতের গল্প-উপন্যাস লিখেছেন। বৃহন্নলা, দেবী, নিশিথিনী, অন্যভুবন_এই যে লেখাগুলো, এগুলোর মধ্যে আপনি আধিভৌতিক এবং রহস্যময়তার ব্যাপারগুলো সব সময়ই এনেছেন। পাশাপাশি আপনি আবার বললেন যে, বিজ্ঞানের ছাত্রদের এই বিষয়ে বিশ্বাস থাকা ঠিক না। আপনি যখন এই লেখাগুলো লেখেন, তখন কি বিজ্ঞানের ব্যাপারটি মাথায় রেখে লিখেছিলেন?

[মিলন কোন দিকে যাবে বুঝতে পারছি। সে আবারও আমাকে দিয়ে স্বীকার করাবে যে আমি নিজেকে ‘কনট্রাডিক্ট’ করছি। একই সঙ্গে বিজ্ঞানের কথা বলছি আবার ভূত-প্রেতের কথা বলছি। অতি সাবধানে এখন উত্তর দিতে হবে। সবচেয়ে ভালো হয় প্রশ্নগুলো পাশ কাটিয়ে যাওয়া।]

হুমায়ূন আহমেদ : বিজ্ঞান তো থাকবেই। কিন্তু সব ব্যাখ্যা কি বিজ্ঞান দিতে পারছে? মহাবিশ্বের শুরু হলো বিগ ব্যাং (Big Bang) থেকে। তার আগে কী ছিল?

[মিলন ভুলবার মানুষ না। সে এই বিষয়ে দ্বিতীয় প্রশ্ন করল। আমাকে ঠেলা ধাক্কা দিয়ে খাদে ফেলতে চাচ্ছে…]

ইমদাদুল হক মিলন : বিভিন্ন সময়ে অনেক আড্ডায় আপনি প্রচুর ভৌতিক গল্প বলেন। আপনাকে আমরা যত দূর জানি, আপনি একজন যুক্তিবাদী মানুষ, অযৌক্তিক কোনো কিছুকে আপনার প্রশ্রয় দেওয়ার কথা না। তাহলে…?

হুমায়ূন আহমেদ : আমার চরিত্রের একটি অংশ হিমু, আরেক অংশ মিসির আলী। হিমু তো যুক্তিহীন জগতের মানুষ।

ইমদাদুল হক মিলন : আপনার কথা শুনে মনে হয়, আপনার মধ্যে একসঙ্গে অনেকগুলো মানুষ বসবাস করে।

হুমায়ূন আহমেদ : শুধু আমার মধ্যে কেন, সবার মধ্যেই বাস করে। মিলন! তোমার মধ্যে কি বাস করে না? ‘A man has many faces’. শুধু জন্তুর একটাই ‘Face’ থাকে। মানুষ জন্তু না।

[মোটামুটি ‘জ্ঞানগর্ভ’ উত্তর দেওয়া হলো। আমি খুশি। মিলনকে তেমন খুশি মনে হচ্ছে না।]

ইমদাদুল হক মিলন : তাহলে আপনাকে একটি প্রশ্ন করি, মানুষ হিসেবে আপনি নিজেকে কিভাবে মূল্যায়ন করবেন এবং নিজেকে কোন স্তরের মনে করেন?

হুমায়ূন আহমেদ : মাঝে মাঝে আমার মনে হয়, আমি খুবই উঁচু স্তরের। মাঝে মাঝে মনে হয়, আমি খুবই নিম্নস্তরের একজন মানুষ।

ইমদাদুল হক মিলন : কী কী কারণে এমন মনে হয়?

হুমায়ূন আহমেদ : কখনো কখনো আমি এমন সব কাজ করি যে মনটা খুবই খারাপ হয়, তখন মনে হয় এই কাজটা কিভাবে করলাম? কেন করলাম?

ইমদাদুল হক মিলন : এটা কি রিসেন্ট কোনো ঘটনায় আপনার মনে হয়েছে! আপনার দ্বিতীয় বিয়ের ঘটনায় বা…

[ইন্টারভিউ নেওয়ার সময় যদি ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকের ব্যবস্থা থাকত তাহলে এ পর্যায়ে ব্যং করে একটা শব্দ হতো এবং টেনশন মিউজিক শুরু হতো।]

ইমদাদুল হক মিলন : প্রশ্নের জবাব দিতে না চাইলে দিতে হবে না।

হুমায়ূন আহমেদ : আমি যখন ইন্টারভিউ দিতে রাজি হয়েছি, তখন তোমার সব প্রশ্নেরই উত্তর দেব। মানুষ হিসেবে আমি কখনো নিজেকে অতি উচ্চস্তরের ভাবি আবার কখনো নিম্নস্তরের ভাবি অনেক আগে থেকেই। দ্বিতীয় বিয়ের সঙ্গে এর সম্পর্ক নেই।

ইমদাদুল হক মিলন : আপনি বহু দিন ধরে টিভিতে, পত্র-পত্রিকায়, এমনকি কোনো অনুষ্ঠানেও যান না, এর কারণ কী? আপনি কি এগুলো অ্যাভয়েড করতে চান? আপনি বলছেন সব কিছু পরিষ্কার বলতে চান, কিন্তু আপনি তো বলেন না।

হুমায়ূন আহমেদ : শোনো, এ ধরনের প্রোগ্রামে যাওয়া বাদ দিয়েছি অনেক দিন হলো। একটা সময় ছিল, লেখালেখি জীবনের শুরুর কথা বলছি, যখন আগ্রহ নিয়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যাওয়া-আসা করতাম। পত্রিকার অফিসে বসে থাকতাম। বাংলাবাজারের প্রকাশকদের শোরুমে সময় কাটাতাম। ওই সময়টা পার হয়ে এসেছি। আমার বয়সও হয়েছে। এসব ভালো লাগে না। ঘরে বসে থাকতে ভালো লাগে বেশির ভাগ সময়। তা ছাড়া হয়েছে কী, মানুষ তো গাছের মতো। গাছ কী করে? শিকড় বসায়। প্রতিটি মানুষেরই শিকড় আছে। আমার দীর্ঘদিনের ব্যক্তিগত যে শিকড় আছে, সেগুলো ছিঁড়ে গেছে। আমি ফর ফাইভ ইয়ারস বাইরে বাইরে ঘুরেছি। কখনো মায়ের কাছে থেকেছি, কখনো হোটেলে থেকেছি, কখনো উত্তরায় একটি বাসা ভাড়া করে থেকেছি, কখনো বন্ধুর বাসায় থেকেছি, দখিন হাওয়ায় থেকেছি। যখন দখিন হাওয়ায় থাকতে শুরু করলাম তখনো সমস্যা। সপ্তাহের তিন দিন থাকি দখিন হাওয়ায়, চার দিন থাকি গাজীপুরে। প্রায়ই রাতে আমার ঘুমটা ভেঙে যায়। ঘুম ভেঙে গেলে মনে হয়, আমি এখন কোথায়? ঢাকায় না গাজীপুরে? একজন মানুষের শিকড় যখন ছিঁড়ে যায়, তখন তাকে অস্থিরতা পেয়ে বসে। এই অস্থিরতার জন্যই বাইরে কোথাও যেতে ইচ্ছে করে না। মনে হয়, নিজের মতো থাকি। ঘরে বসে থাকি, ছবি দেখি, গান শুনি। আমি এই বয়সে এসে এ রকম একটা সময় পার করছি। গর্তজীবী হওয়ার পেছনে এটাও হয়তো কারণ।

এখন নতুন শিকড় গজাচ্ছে। অস্থিরতা কমে আসছে। গর্ত থেকে বেরোতে শুরু করেছি। তোমাকে দীর্ঘ ইন্টারভিউ দিতে যে রাজি হলাম এটা কি তা প্রমাণ করে না?

ইমদাদুল হক মিলন : আপনাকে অনেকে রুক্ষ মানুষ মনে করে, ভয় পায়। কিন্তু আপনার লেখা যারা পড়েছে তারা জানে যে, আপনি অসম্ভব মমতাবান একজন মানুষ। মানুষকে আপনি পছন্দ করেন।

হুমায়ূন আহমেদ : লেখা পড়ে তো একজন মানুষকে বিচার করা যায় না।

ইমদাদুল হক মিলন : অবশ্যই করা যায়। কেন যাবে না? একজনের লেখা পড়ে আমরা কি বুঝতে পারব না, সে কোন ধরনের মানুষ এবং এটা আপনার তো বিশ্বাস করার কথা। একজন লেখক জীবনের নানা রকম কথা তাঁর লেখার বিভিন্ন চরিত্রের মধ্য দিয়ে বলেন।

হুমায়ূন আহমেদ : হেমিংওয়ের লেখা পড়ে আমরা কখনোই বুঝতে পারি না যে, হেমিংওয়ে নিজেকে গুলি করে মেরে ফেলতে পারেন। তিনি অসম্ভব জীবনবাদী একজন লেখক। তাঁর লেখা পড়ে যদি তাঁকে আমরা বিচার করতে যাই, তাহলে কিন্তু আমরা একটা ধাক্কা খাব। মায়কোভস্কি পড়ে কখনোই বুঝতে পারব না যে, মায়কোভস্কি আত্মহত্যা করার মানুষ। আমরা কাওয়াবাতা পড়ে কখনো বুঝতে পারব না যে, কাওয়াবাতা হারিকিরি করে নিজেকে মেরে ফেলবেন। এঁরা প্রত্যেকেই জীবনবাদী লেখক। জীবনবাদী লেখকদের পরিণতি দেখা গেল ভয়ংকর। তার মানে কী? তার মানে কী দাঁড়ায়? লেখকরা কি সত্যি সত্যি তাঁদের লেখায় নিজেকে প্রতিফলিত করেন? নাকি তাঁদের শুদ্ধ কল্পনাকে প্রতিফলিত করেন?

ইমদাদুল হক মিলন : ঘুরে ফিরে ‘লীলাবতী’র প্রসঙ্গটায় আবার আসি। আপনার এ লেখাটা এমন আচ্ছন্ন করেছে আমাকে, এর আগে ‘জোছনা ও জননীর গল্প’ পড়ে এমন আচ্ছন্ন হয়েছিলাম। লীলাবতীতে মাসুদ নামের একটি ছেলে গোপনে এক সুন্দরী মেয়েকে বিয়ে করে ফেলেছে, পরীবানু যার নাম, আপনার মনে আছে নিশ্চয়ই। সে চরিত্রটা আবার আত্মহত্যা করল। আপনি মানুষকে এত নির্মমভাবে মেরে ফেলেন কেন আপনার লেখায়?

হুমায়ূন আহমেদ : আমাদের জগৎটা কিন্তু খুব নির্মম। এ জগতে মানুষ যখন মরে যায়, খুব স্বাভাবিকভাবেই সে মরে যায়। সৃষ্টিকর্তাও কিন্তু নির্মম। এই যে সুনামিতে দেড় লক্ষ দুই লক্ষ লোক মারা গেল, তিনি নির্মম বলেই তো এত লোক মারা গেল। এই নির্মমতাটা কিন্তু আমাদের মধ্যেও আছে। কথা নেই বার্তা নেই একজন গলায় দড়ি দিচ্ছে, হঠাৎ করে একজন ঘুমের বড়ি খেয়ে নিচ্ছে। যে ঘুমের বড়িটা খাচ্ছে, সে কিন্তু খুব আয়োজন করে খাচ্ছে তা না। মনে হলো খেয়ে নিল। জীবনানন্দের সেই বিখ্যাত কবিতা, ‘শোনা গেল লাশকাটা ঘরে নিয়ে গেছে তারে/ কাল রাতে_ফাল্গুনের রাতের আঁধারে/ যখন গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ/ মরিবার হলো তার সাধ/…বধূ শুয়ে ছিল পাশে_শিশুটিও ছিল/প্রেম ছিল, আশা ছিল/ জ্যোৎস্নায়,_তবু সে দেখিল কোন ভূত/ ঘুম ভেঙে গেল তার? অথবা হয়নি তো ঘুম বহুকাল/ লাশকাটা ঘরে শুয়ে ঘুমায় এবার/ এই ঘুম চেয়েছিল বুঝি/ রক্তফেনা-মাখা মুখে/ মড়কের ইঁদুরের মতো ঘাড় গুঁজি/ আঁধার গুজির বুকে ঘুমায় এবার;/ কোনোদিন জাগিবে না আর/ কোনোদিন জাগিবে না আর/ জাগিবার গাঢ় বেদনার/ অবিরাম_অবিরাম ভার/ সহিবে না আর।’ [এই পর্যায়ে আমি জীবনানন্দ দাশের দীর্ঘ কবিতার প্রায় সবটাই চোখ বন্ধ করে আবৃত্তি করলাম। কারণ? আশপাশে সবাইকে জানান দেওয়া যে, আমি ঘণ্টার পর ঘণ্টা কবিতা মুখস্থ বলতে পারি। মিলনকে সামান্য ভড়কে দেওয়ার ইচ্ছাও যে ছিল না, তা না।]

ইমদাদুল হক মিলন : এই ‘লীলাবতী’ উপন্যাসটা আপনি জীবনানন্দকে উৎসর্গ করেছেন। উৎসর্গের ভাষাটা হচ্ছে এ রকম_তিনি জীবিত, আপনি কবির উদ্দেশে বলছেন_কবি, আমি কখনো গদ্যকার হতে চাইনি। আমি আপনার মতো একজন হতে চেয়েছি। হায়, এত প্রতিভা আমাকে দেওয়া হয়নি।

হুমায়ূন আহমেদ : জীবনানন্দ দাশের কবিতা যখন পড়ি, তখন মনে হয় কবি যেন পাশেই আছেন। আমি যখন গভীর আগ্রহ নিয়ে তাঁর কবিতাটি পাঠ করছি তিনি সেটা শুনতে পাচ্ছেন। রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রেও আমার এই ব্যাপারটি ঘটে। যখন রবীন্দ্রসাহিত্য পড়ি, তখন মনে হয়, তিনি বুঝি আশপাশেই আছেন। অল্প কিছুদিন আগে বিভূতিভূষণের ‘কিন্নরদল’ গল্পটি পড়ছিলাম…

ইমদাদুল হক মিলন : হ্যাঁ, এটা আপনার খুব প্রিয় একটা গল্প…

হুমায়ূন আহমেদ : আমি যখন গল্পটি পড়ছি, তখন আমার মনে হলো, তিনি আমার পাশেই আছেন। গল্পটি পড়ে আমি আনন্দ পাচ্ছি এবং সেই আনন্দটা তিনি বুঝতে পারছেন। এটা আমার ছেলেমানুষি হতে পারে। কিন্তু এই অনুভূতিটা আমার প্রায়ই হয়। যেকোনো ভালো লেখা পড়ার সময়ই আমার মনে হয় লেখক আমার পাশে আছেন।

ইমদাদুল হক মিলন : আপনার লেখা পড়তে পড়তে আমার মনে হয়, ধরেন আপনি লিখছেন, কিন্তু এর পরে কোন লাইনটা লিখবেন আপনি জানেন না?

হুমায়ূন আহমেদ : কিছু কিছু লেখক আছেন, যাঁরা প্রতিটি লাইন খুবই চিন্তাভাবনা করে লেখেন। আবার একধরনের লেখক আছেন, স্বতঃস্ফূর্ত লেখক। মাথায় যেটা আসবে সেটা লিখবে। আমার লেখার ওপর খুব একটা কন্ট্রোল আছে_তা না, কন্ট্রোল আছে হালকা, আমার মনে হয় যে আমার মধ্যে স্বতঃস্ফূর্তভাবে লেখাটা বেশি কাজ করে। কিন্তু আমি যখন ‘জোছনা ও জননীর গল্প’ লিখেছি তখন কোন লাইনের পর কোন লাইন লিখব আমি জানি। আমি যখন মিসির আলী লিখি তখন কিন্তু আমি জানি এই লাইনটার পরে আমি কোন লাইন লিখব। সায়েন্স ফিকশন লেখার সময় আমি জানি কোন লাইনটা লিখব। ওই বাকি লেখাগুলোর সময় আমার আর কন্ট্রোল থাকে না।

ইমদাদুল হক মিলন : ‘লীলাবতী’ লেখার সময় জানতেন?

হুমায়ূন আহমেদ : না।

ইমদাদুল হক মিলন : ‘লীলাবতী’র একটা ছোট চরিত্রের কথা বলি, চঞ্চলী, সে রমিলার বোন। রমিলা মাঝে মাঝে বলে আমি পানিতে ডুবে গেলাম। আমার বোন আমার জন্য ঝাঁপ দিল, আমি উঠে গেলাম কিন্তু সে আর উঠল না। সে এখন সব সময় আমার সঙ্গে থাকে। মাগো, এই জন্য আমি তোমার সঙ্গে ঢাকায় যাব না। এই যে চরিত্রটা, আপনি জেনেই লিখেছেন নাকি হঠাৎ?

হুমায়ূন আহমেদ : হ্যাঁ হঠাৎ…হঠাৎ করেই মাথায় এসেছে, আবার হঠাৎ করেই চলে গেছে। চলে গেছে যখন এটা নিয়ে পরে আর মাথা ঘামাইনি। যেমন দীঘির জলে একটা মাছের লেজ ভেসে উঠল। জলে ঘাই দিয়ে তলিয়ে গেল।

ইমদাদুল হক মিলন : এটি ১৩৫৭ সালের পটভূমিতে লেখা উপন্যাস, এখানে আনিস চরিত্রটা কতটুকু যৌক্তিক বলে মনে হয়েছে?

[বুঝতে পারছি মিলন এখন প্রমাণ করার চেষ্টা করবে যে, আনিস চরিত্রটি যৌক্তিক না। আমাকে এই মুহূর্তে কঠিন অবস্থানে যেতে হবে। দেরি করা যাবে না।]

হুমায়ূন আহমেদ : (কঠিন গলা) মিলন যথেষ্ট হয়েছে। রেকর্ডার বন্ধ কর। চা খাও। আজকের মতো এখানেই ইতি।

[মিলন রেকর্ডার বন্ধ করল। আমার দিকে তাকিয়ে হাসল। হাত বাড়িয়ে আমার ডান হাত শক্ত করে চেপে ধরল। অনেক দিন আগের একটি স্মৃতি আমার মনে পড়ল। তখন শ্যামলীর এক ভাড়া বাড়িতে থাকি। আমার হয়েছে ভয়াবহ জন্ডিস। মিলন প্রচুর ফলমূল নিয়ে আমাকে দেখতে এসেছে। তার মাথাটা পরিষ্কার করে কামানো। তাকে অদ্ভুত দেখাচ্ছে। সে আমার বিছানার পাশে বসল। শক্ত করে আমার হাত চেপে ধরল। মুখে কিছুই বলল না। এভাবে সে বসে থাকল দীর্ঘ সময়। ভাব প্রকাশের ব্যাপারটা লেখকদের চেয়ে ভালো কেউ জানেন না। কিন্তু গভীর আবেগের সময় যে তারা কিছুই বলেন না_এই তথ্য কি সবাই জানে?

অনেক বছর আগে আমার হাত চেপে ধরে মিলন যে আবেগ প্রকাশ করেছিল, আজও সে তাই করল। হাত সে ধরে আছে ধরেই আছে, কিছুতেই ছাড়ছে না। আমি এত ভাগ্যবান কেন? মানুষের এত ভালোবাসা কেন আমার জন্য? আমার ঘরভর্তি চাঁদের আলো। এই আলো আমি কোথায় রাখব?]

 

হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে

হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে যেদিন পরিচয় হলো সেদিন আমার মাথা ন্যাড়া। জীবনে দুবার ন্যাড়া হওয়ার কথা আমার মনে আছে। একবার একাত্তরের মাঝামাঝি, আরেকবার তিরাশির শুরুর দিকে। দুবারই মন ভালো ছিল না। একাত্তরে আমি এসএসসি ক্যান্ডিডেট। আমাদের বয়সী ছেলেরাও মুক্তিযুদ্ধে যাচ্ছে। এ কারণে বাবা আমাকে বাড়ি থেকে বেরোতে নিষেধ করে দিলেন। দুঃখে আমি ন্যাড়া হয়ে গেলাম। ন্যাড়া মাথা নিয়ে রাস্তায় বেরোতে লজ্জা করবে, ফলে বাড়ি থেকে বেরোনো হবে না।

সত্যি তা-ই হয়েছিল। ন্যাড়া মাথার কারণে একাত্তরের সময় অনেক দিন আমি বাড়ি থেকেই বেরোইনি। তিরাশি সালে সেই স্মৃতি মনে করেই ন্যাড়া হয়েছিলাম। আমার তখন রুজি-রোজগার নেই। একাশির অক্টোবরে জার্মানি থেকে ফিরে ‘রোববার’ পত্রিকায় জয়েন করেছি। ইত্তেফাকের সামনে দিন-দুপুরে ট্রাকের তলায় এক পথচারীকে থেঁতলে যেতে দেখে রোববারে একটা রিপোর্ট লিখলাম, সেই রিপোর্টে বিশেষ একটি মন্তব্য করায় চাকরি চলে গেল। তারপর বন্ধুদের সঙ্গে ‘দোয়েল’ নামে একটা অ্যাডফার্ম করলাম। এক-দেড় বছরের মাথায় সেটাও বন্ধ হয়ে গেল। তত দিনে বিয়ে করে ফেলেছি। কিন্তু পকেটে দশটি টাকাও নেই। এ অবস্থায় সিদ্ধান্ত নিলাম, সমরেশ বসু হয়ে যাব। লিখে জীবন ধারণ করব। কিন্তু বাংলাদেশের মতো দেশে সে যে কী কঠিন কাজ, আজকের কোনো তরুণ লেখক ভাবতেই পারবেন না। তখন একটা গল্প লিখে পঞ্চাশ-এক শ টাকা পাই। ঈদ সংখ্যার উপন্যাসের জন্য পাঁচ শ-এক হাজার। তাও পেতে সময় লাগে তিন-চার মাস। লেখার জায়গায়ও কম। এত পত্রপত্রিকা তখন ছিল না। দৈনিক পত্রিকায় উপন্যাস ছাপার নিয়ম ছিল না। কঠিন সময়। দু-চারটা বই তত দিনে বেরিয়েছে, সেগুলোর অবস্থাও ভালো না। পাবলিশাররা টাকাই দিতে চায় না। একটা বিখ্যাত প্রকাশন সংস্থা তো অভাবী লেখক দেখে ষোলো শ টাকায় আমার দুটি বইয়ের গ্রন্থস্বত্বই কিনে নিয়েছিল। প্রথম প্রকাশিত বইয়ের জন্য আমি কোনো টাকাই পাইনি। এ অবস্থায় লিখে জীবন ধারণ! সত্যি, সাহস ছিল আমার! সেই সব দিনের কথা ভাবলে এখনো বুক কাঁপে।

যা হোক, লিখে জীবন ধারণ মানে প্রতিদিন দিস্তা দিস্তা লেখা। লেখার জন্য সময় দেওয়া এবং ঘরে থাকা। কিন্তু সারা দিন ঘরে আমার মন বসবে কেমন করে! যখন-তখন বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা না দিলে আমার পেটের ভাত হজম হয় না। তখনই একাত্তরের ন্যাড়া হওয়ার স্মৃতি মনে এসেছিল। ন্যাড়া হয়ে গেলাম। ন্যাড়া মাথা নিয়ে সারা দিন ঘরে বসে উন্মাদের মতো লিখি। লেখার কষ্ট দেখে জ্যোৎস্না একদিন আমার ন্যাড়া মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলেছিল, সাধ্য থাকলে তোমার লেখাগুলো আমি লিখে দিতাম।

সেবারের বাংলা একাডেমী বইমেলায় তিন-চারটা বই বেরোল। ‘কালোঘোড়া’, ‘তাহারা’ ইত্যাদি। বইয়ের বিক্রি বাড়াবার জন্য লজ্জা-শরমের মাথা খেয়ে ন্যাড়া মাথা নিয়েই মেলায় যাই। আমার অবস্থা যে বেশ ভালো তা বোঝাবার জন্য জার্মানি থেকে আনা জিনস-কেডস আর একেক দিন একেকটা শার্ট পরি। জ্যোৎস্নার মোটা ধরনের একটা সোনার চেইন পরে রাখি গলায়। কিন্তু ভেতরে ভেতরে আমার অবস্থা তখন ‘উপরে ফিটফাট, ভিতরে সদরঘাট’। পকেটে সিগ্রেট খাওয়ার পয়সা পর্যন্ত থাকে না।

বইমেলায় এক বিকেলে নওরোজ কিতাবিস্তানে বসে আছি, প্রতিষ্ঠানটি তখনো ভাগ হয়নি, আমার ‘তাহারা’ বইটি হাতে নিয়ে চশমা পরা, রোগা, দেখলেই মেধাবী এবং তীক্ষ্ন বুদ্ধিসম্পন্ন মনে হয়, এমন একজন মানুষ সামনে এসে দাঁড়ালেন। অটোগ্রাফ। মুখের দিকে তাকিয়ে দিশেহারা হয়ে গেলাম। নিজের অজান্তে উঠে দাঁড়ালাম। মুখটি আমার চেনা। ছবি দেখেছি। হুমায়ূন আহমেদ। তখন পর্যন্ত খান ব্রাদার্স থেকে তাঁর তিনটি বই বেরিয়েছে। ‘নন্দিত নরকে’, ‘শঙ্খনীল কারাগার’ আর বাংলাদেশের প্রথম সায়েন্স ফিকশন ‘তোমাদের জন্য ভালবাসা’। তিনটি বইয়ের কোনো একটির ব্যাক কাভারে পাসপোর্ট সাইজের ছবিও আছে। আর কে না জানে, স্বাধীনতার পর পর ‘নন্দিত নরকে’ বাংলাদেশের সবচেয়ে আলোচিত উপন্যাস। আহমদ শরীফ, শওকত আলী, আহমদ ছফা_এই সব শ্রদ্ধেয় মানুষ উপন্যাসটির প্রশংসায় পঞ্চমুখ। সনাতন পাঠক ছদ্মনামের আড়ালে বসে তখনই বিখ্যাত সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ‘দেশ’ পত্রিকায় ‘নন্দিত নরকে’র উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করলেন।

তিয়াত্তর-চুয়াত্তর সালের কথা। আমি জগন্নাথ কলেজে ইন্টারমিডিয়েট পড়ি। লেখার পোকা মাত্র মাথায় ঢুকেছে। আমার বন্ধু কামালের বন্ধু হচ্ছে খান ব্রাদার্সের মালিকের ছেলে ফেরদৌস। তার কাছ থেকে ‘নন্দিত নরকে’ এবং ‘শঙ্খনীল কারাগার’ জোগাড় করে আনল কামাল। মন্ত্রমুগ্ধের মতো সেই বই পড়লাম আমরা। পড়ে মুগ্ধ এবং বিস্মিত! এমন লেখাও হয়! এত সহজ-সরল ভাষায়, এমন ভঙ্গিমায়, মধ্যবিত্ত জীবনের সামান্য ঘটনাকে এমন অসামান্য করে তোলা যায়! সেই প্রথম হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে একটা ঘোর তৈরি হলো আমার। সদ্য স্বাধীন হওয়া দেশ, কত নতুন নতুন লেখক লিখতে শুরু করেছেন, এমনকি আমাদের প্রবীণ লেখকরাও নতুন লেখকদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে লিখছেন কিন্তু বেশির ভাগ লেখকেরই লেখা আমি বুঝতে পারি না। ভাষার কারুকার্যে অযথাই জটিল। গল্পে গল্প খুঁজে পাওয়া যায় না। কায়দা-সর্বস্ব। এ অবস্থায় দু-তিন বছরের মধ্যে বিচ্ছিন্নভাবে আরো দু-তিনটি লেখা পড়লাম হুমায়ূন আহমেদের। ‘জনান্তিক’ কিংবা এ ধরনের কোনো একটি লিটল ম্যাগাজিনে পড়লাম ‘নিশিকাব্য’ নামে এক আশ্চর্য সুন্দর গল্প। বাংলাবাজার থেকে ‘জোনাকী’ নামে উল্টোরথ টাইপের একটি সিনেমা পত্রিকা বেরোত, সেই পত্রিকার কোনো এক বিশেষ সংখ্যায় পড়লাম ‘সূর্যের দিন’। এই ‘সূর্যের দিন’ই পড়ে ‘শ্যামল ছায়া’ নামে বই হয়। যদিও ‘সূর্যের দিন’ নামে পরে অন্য আরেকটি মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস লিখেছেন হুমায়ূন আহমেদ। যা হোক, ‘বিচিত্রা’র ঈদ সংখ্যায় সে সময় উপন্যাস লিখলেন হুমায়ূন আহমেদ। ‘নির্বাসন’। বুক হু হু করা এক প্রেমের উপন্যাস। তারও পর লিখলেন ‘অন্যদিন’। এই সব লেখা পড়ে আমি বুঝে গেলাম, লেখা এমনই হওয়া উচিত। সাদামাটা নিজস্ব ভাষায়, নিজের মতো করে জীবনের কথা বলে যাওয়া, যা প্রত্যেক মানুষকে আলোড়িত করবে, দ্রুত পেঁৗছাবে পাঠকের কাছে। বলতে দ্বিধা নেই, লেখায় সরলতার মন্ত্র আমি হুমায়ূন আহমেদের কাছ থেকেই পেয়েছিলাম। কিন্তু বইমেলার সেই বিকেলের আগে তাঁকে কখনো চোখে দেখিনি। শুনেছি তিনি ছয় বছর ধরে আমেরিকায়, পলিমার কেমিস্ট্রিতে পিএইচডি করছেন। এদিকে বাজারে সম্ভবত চারটি মাত্র বই_’নন্দিত নরকে’, ‘শঙ্খনীল কারাগার’, ‘তোমাদের জন্য ভালবাসা’ আর ‘নির্বাসন’। সেই চারটি বইয়ের কল্যাণেই বিরাশি সালে বাংলা একাডেমী পুরস্কার পেয়ে গেছেন। পরে শুনেছি, আমেরিকায় বসে তিনি যখন বাংলা একাডেমী পুরস্কার পাওয়ার কথা শুনলেন, শুনে তাঁর শিক্ষককে দিলেন খবরটা, আমেরিকান শিক্ষক হতভম্ব। তুমি কেমিস্ট্রির লোক, লিটারেচারে একাডেমী অ্যাওয়ার্ড পাও কী করে?

সেই শিক্ষক কি জানতেন, কালক্রমে বাংলা সাহিত্যের রসায়ন সম্পূর্ণ চলে আসবে হুমায়ূন আহমেদের হাতে! সাহিত্যের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক পদ তিনি অবলীলায় ছেড়ে আসবেন!

মনে আছে, তিরাশির বইমেলায় খান ব্রাদার্স থেকে বেরিয়েছে তাঁর ‘অন্যদিন’ উপন্যাসটি। মাঝখানে ছয় বছর লেখালেখি করেননি, তবু ‘অন্যদিন’ খুব ভালো বিক্রি হচ্ছে। এ অবস্থায় তিনি এসেছেন আমার অটোগ্রাফ নিতে। একজন স্বপ্নের মানুষ এসে দাঁড়িয়ে আছেন সামনে। কিসের অটোগ্রাফ, আমি তাঁর পা ধরে সালাম করব কি না ভাবছি। কোনো রকমে শুধু বলেছি, হুমায়ূন ভাই, আপনাকে আমি চিনি। তিনি বললেন, আমি আমেরিকায় বসে খবর পেয়েছি বাংলাদেশে ইমদাদুল হক মিলন নামে একটি ছেলে গল্প-উপন্যাস লিখে জনপ্রিয় হয়েছে। তুমি কী লেখ আমার একটু বোঝা দরকার।

আমাদের পরিচয় হয়েছিল এইভাবে।

সেদিনই সন্ধ্যার পর আমাকে তিনি তাঁর বাসায় নিয়ে গেলেন। শ্যামলীতে এখন যেখানে শামসুর রাহমানের বাড়ি তার পেছন দিকে খোলা মতো মাঠ পেরিয়ে একটা বাড়ি। সেই বাড়ির দোতলা কিংবা তিনতলায় হুমায়ূন ভাইয়ের ফ্ল্যাট। খালাম্মা, শাহিন, মানে আজকের বিখ্যাত সম্পাদক কার্টুনিস্ট এবং লেখক আহসান হাবিব, ছোটবোন, ভাবি, ফুটফুটে নোভা, শিলা, বিপাশা। বিপাশা তখন ভাবির কোলে। আর রফিকের মা নামে একজন বুয়া ছিল। পরবর্তী সময়ে এই বুয়াটির বহু মজার মজার আচরণ হুমায়ূন ভাইয়ের বিভিন্ন নাটকে হাসির উপাদান হয়ে এসেছে।

সেদিন আমার সঙ্গে আরো দুজন মানুষ গিয়েছিলেন হুমায়ূন ভাইয়ের বাসায়। দৈনিক বাংলার সালেহ চৌধুরী আর বাংলাদেশের প্রথম গ্র্যান্ডমাস্টার নিয়াজ মোরশেদ। সালেহ চৌধুরীকে হুমায়ূন ভাই ডাকতেন ‘নানাজি’, আর নিয়াজ মোরশেদের দাবার তিনি ভক্ত। নিয়াজের জন্য ভালো রান্নাবান্না হয়েছিল বাসায়। গুলতেকিন ভাবি বেশ বড় সাইজের আস্ত একখানা ইলিশ মাছ ভেজে খুবই লোভনীয় ভঙ্গিতে সাজিয়ে রেখেছেন ট্রেতে। ইলিশটির ওপর ভাজা পেঁয়াজ ছড়ানো, চারপাশে চাক চাক করে কাটা টমেটো, শসা। ভাত-পোলাও দুটোই আছে, মাছ, মুরগি, সবজি, মিষ্টি_সব মিলিয়ে টেবিল ভর্তি খাবার। নানাজি এবং নিয়াজ মোরশেদকে ভাবি চিনতেন। হুমায়ূন ভাই ভাবির সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিলেন। ভাবি তাঁর স্বভাবসুলভ হাসিমুখে আমার দিকে তাকালেন, একটু বুঝি অবাকও হলেন। ন্যাড়া মাথা, গলায় সোনার চেইন, পরনে জিনস-কেডস, এ কেমন লেখক!

সেই সন্ধ্যায় সেই যে হুমায়ূন আহমেদ পরিবারের সঙ্গে আমি মিলে গেলাম, আজও সে রকম মিলেমিশেই আছি। আমাদের কোথাও কোনো গ্যাপ হয়নি।

হুমায়ূন ভাই তখন ঢাকা ইউনিভার্সিটির কেমিস্ট্রির অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর। ইউনিভার্সিটির কাজ সেরে শ্যামলীর বাসায় ফিরে যান, বিকেলবেলা আসেন ইউনিভার্সিটি টিচার্স ক্লাবে। সালেহ চৌধুরী আসেন, হুমায়ুন আজাদ আসেন, আমিও যাই। চা, সিগ্রেট, শিঙাড়া আর গল্পগুজব চলে। সালেহ চৌধুরী গল্প শুরু করলে সহজে থামেন না। শুরুর আগেই হুমায়ুন আজাদ বলেন, কাহিনীটা কি খুব দীর্ঘ? দুজনের ছোটখাটো খুনসুটিও লাগে কোনো কোনো দিন। হুমায়ূন ভাই আর আমি চুপচাপ বসে থাকি। হুমায়ূন ভাই চেয়ারে বসেন দুপা তুলে, আসনপিঁড়ি করে। সেই ভঙ্গিতে বসে মাথা নিচু করে চুপচাপ সিগ্রেট টানেন। তখন কথা বলতেন খুব কম। শুনতেন বেশি। আর আমি শুধু তাঁকে খেয়াল করি। পরিচয়ের দিন থেকে ব্যক্তি-মানুষটাকেও তাঁর লেখার মতোই নেশা ধরানো মনে হচ্ছিল আমার। আস্তে-ধীরে হুমায়ূন-নেশায় আচ্ছন্ন হচ্ছিলাম আমি।

এ সময় হুমায়ূন ভাইয়ের একবার জন্ডিস হলো। পেঁপে নিয়ে আমি তাঁকে দেখতে গেছি। জন্ডিসভরা শরীর নিয়েও এমন মজাদার আড্ডা দিলেন তিনি, আমি হতভম্ব। সেদিন প্রথম টের পেলাম, হুমায়ূন আহমেদ পুরনো হতে জানেন না, তিনি প্রতিদিন নতুন। এমন ঠাট্টাপ্রিয় মানুষ আমি আর দেখিনি। অবলীলাক্রমে নিজেকে নিয়েও ভয়ানক ঠাট্টা করতে পারেন। আর অসম্ভব মেধাবী, তীক্ষ্ন বুদ্ধিসম্পন্ন, আগাগোড়া যুক্তিবাদী, সম্পূর্ণ স্মার্ট এবং ভয়াবহ শিক্ষিত। জানেন না এমন বিষয় পৃথিবীতে কম আছে। অদ্ভুত সব বিষয়ে আসক্তি। হিপনোটিজম শেখার জন্য আমেরিকা থেকে দুবার নোবেল প্রাইজ পাওয়া প্রফেসর ফাইন ম্যানের বই আনলেন। ‘অন্যদিন’ সম্পাদক মাজহারুল ইসলামকে হিপনোটাইজ করে ঘুম পাড়িয়ে দিলেন। ভূত, বিজ্ঞান, ধর্ম, ম্যাজিক, মানুষ আর মানুষের মনোজগৎ, সাহিত্য, গান, নাটক, সিনেমা, দাবা আর শিশু_এসব একত্রে ককটেল করলে যে জিনিসটা দাঁড়ায়, সেই জিনিসের নাম হুমায়ূন আহমেদ।

তীব্র শীতে নুহাশপল্লীতে শুটিং করতে এসেছে একটি গ্রাম্য মেয়ে। মা গেছে মেয়েটির জন্য শীতবস্ত্র জোগাড় করতে। পাতলা জামা পরা মেয়েটি ঠকঠক শীতে কাঁপছে। আগুন জ্বেলে তার চারপাশে লোকজন নিয়ে বসে আছেন হুমায়ূন ভাই। মেয়েটিকে খেয়াল করছেন। আগুনের পাশে আসতে মেয়েটি একটু লজ্জা পাচ্ছে, কারণ এখানকার কাউকে সে চেনে না। এর পরও শীত সহ্য করতে না পেরে আস্তে-ধীরে আগুনের পাশে এসে দাঁড়ায়। সেই তাপেও তার শীত মানে না। হুমায়ূন ভাই উঠে গিয়ে নিজের কম্বল এনে দেন মেয়েটিকে। তারপর জিজ্ঞেস করেন, তুমি চেন আমাকে? মেয়েটি তাঁর মুখের দিকে খানিক তাকিয়ে থেকে বলে, মনে হয় আপনে হুমায়ূন আহমেদ। আপনেরে আমি চিনছি।

 

অদ্ভুত একটা স্বপ্ন দেখলাম একরাতে।

কোথাও বেশ একটা জনকোলাহল। অনেক সুন্দরী নারী। সম্ভবত কোথাও কোনো সাহিত্য সম্মেলন হচ্ছে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে দেখতে পেলাম আসরের মধ্যমণি হয়ে বসে আছেন। গান-গল্পে মুখর হয়ে আছে অনুষ্ঠান।

একসময় সুনীল উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘আমাকে এক্ষুনি ছুটতে হবে। প্লেন ধরতে হবে।’

তিনি কিছুক্ষণের জন্য উধাও হয়ে গেলেন। তারপর পোশাক বদলে একটা ব্যাগ হাতে বেরিয়ে এলেন। ব্যাগটা আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন, ‘আমার পেছন পেছন এসো।’

আমি সুনীলের পেছন পেছন হাঁটতে শুরু করলাম।

একটা সময় দেখি কিছুতেই আমি আর তাঁর নাগাল পাচ্ছি না। তিনি আমাকে অনেকটা পেছনে ফেলে এগিয়ে গেছেন। হাঁটা বাদ দিয়ে তাঁকে ধরার জন্য আমি ছুটছি। সামনে একটা জলাশয়। সুনীলকে দেখি জলাশয়ের ওপারে। একবারও পেছন ফিরে তাকাচ্ছেন না, মাঝারি মানের মোটা শরীর নিয়ে হনহন করে হেঁটে যাচ্ছেন। আমি জলাশয় পেরিয়ে তাঁকে ধরার চেষ্টা করছি, পারছিই না।

এটুকুই স্বপ্ন। কী অর্থ ওই স্বপ্নের কে জানে। তবে সুনীলদা আমাকে ফেলে নিউ ইয়র্কের লাগোর্ডিয়া বিমানবন্দর থেকে লস অ্যাঞ্জেলেসে চলে গিয়েছিলেন। সেবার হুমায়ূন ভাইও ছিলেন। নিউ ইয়র্কের জ্যাকসন হাইটসের ‘মুক্তধারা’ বিখ্যাত প্রতিষ্ঠান। মুক্তধারার কর্ণধার বিশ্বজিৎ সাহা বইমেলার আয়োজন করেছিলেন। বাংলাদেশ থেকে অতিথি হিসেবে গিয়েছিলাম হুমায়ূন আহমেদ আর আমি। কলকাতা থেকে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আর সমরেশ মজুমদার। হুমায়ূন ভাই দল ছাড়া চলতে পারেন না। অন্যদিন গ্রুপের প্রধান নির্বাহী মাজহারুল ইসলাম আছেন আমাদের সঙ্গে, হুমায়ূন ভাইয়ের অতিপ্রিয় বন্ধু আর্কিটেক্ট আবু করিম আছেন। অন্যদিন গ্রুপের কমলও ছিলেন।

এই ঘটনা বলার আগে একটু পেছন ফিরি। হুমায়ূন আহমেদ সম্পর্কে বলি।

হুমায়ূন আহমেদ কোনো কিছু লুকাতে জানেন না, আড়াল করতে জানেন না। তিনি তাস খেলেন মাটিতে ফেলে। সবাই দেখতে পায় তাঁর হাতের তাস। সম্পূর্ণ নিজের মতো একটি জীবন তিনি যাপন করেন। যা ভালো লাগে, বিশ্বাস করেন, তা-ই করেন। কোনো কাজ করার আগে বন্ধুদের সঙ্গে খোলামেলা আলাপ-আলোচনা করেন, প্রত্যেকের মতামত নেন; কিন্তু করেন সেটাই, নিজে যেটা ভালো মনে করেন। সেন্ট মার্টিনস দ্বীপে বেড়াতে গিয়ে ভাবলেন, এ রকম দ্বীপে একটা বাংলোবাড়ি করলে কেমন হয়? জায়গা কিনে বাড়ি করে ফেললেন। তাঁর সেই বাড়ি ইতিহাস হয়ে গেল। দেশের সব মানুষ জানে। বাবা ফয়েজুর রহমান আহমেদ একাত্তরের বীর শহীদ, বাংলাদেশ সরকার তাঁর নামে স্মারক ডাকটিকিট প্রকাশ করেছে আর হুমায়ূন আহমেদ তাঁর পিতার স্মরণে ৭০ লাখ টাকা ব্যয় করে নিজ গ্রামে একটা স্কুল করেছেন। সেই স্কুলের ডিজাইন ও পরিবেশ স্কটল্যান্ডের মতো। তাঁর নুহাশপল্লী এখন আপন মহিমায় বিখ্যাত। বহু লোক দেখতে যায়। ঢাকা-ময়মনসিংহ রোডে হোতাপাড়ার পশ্চিমে ঢুকে গেছে যে সড়ক, সেই সড়কের নাম ‘নুহাশপল্লী সড়ক’। মোটকথা, হুমায়ূন আহমেদ যা করেছেন, তা-ই ইতিহাস হয়ে গেছে। জীবনে যা চেয়েছেন তিনি, পেয়েছেন তার চেয়ে বহুগুণ বেশি।

শাহাদৎ চৌধুরী সম্পাদিত একসময়কার বিখ্যাত সাপ্তাহিক ‘বিচিত্রা’ই তাঁকে নিয়ে পাঁচ-ছয়বার কাভার স্টোরি করেছে, ‘রোববার’, ‘পূর্ণিমা’, ‘অন্যদিন’ তো করেছেই, আরো কত পত্রিকা যে করেছে! তাঁর একক বইমেলা হয়েছে বাংলাদেশের বহু জায়গায়, নিউ ইয়র্কে, ফ্রাংকফুর্টে। নিজের তৈরি ছবির ফেস্টিভ্যাল হয়েছে জাপানে। জাপানের বিখ্যাত টেলিভিশন এনএসকে তাঁকে নিয়ে ১৭ মিনিটের ডকুমেন্টারি করেছে_’হু ইজ হু ইন এশিয়া’। শাহরিয়ার কবির, অভিনেতা মাহফুজ আহমেদ তাঁকে নিয়ে বই লিখেছেন। ‘কোথাও কেউ নেই’ নাটকে বাকের ভাইয়ের যাতে ফাঁসি না হয়, সে জন্য মিছিল বেরিয়েছে ঢাকার রাস্তায়, পোস্টারিং হয়েছে। আসাদুজ্জামান নূরের মতো জনপ্রিয় অভিনেতা, এখন আওয়ামী লীগের বিখ্যাত নেতা এবং সংসদ সদস্য চাপা পড়ে গেছেন বাকের ভাইয়ের আড়ালে। এখনো লোকে তাঁকে বাকের ভাই বলেই চেনে। নাটকটির শেষ পর্ব যেদিন প্রচারিত হয়, সেদিন হুমায়ূন ভাই বাড়িতে থাকতে পারেননি। বাকেরের যাতে ফাঁসি না হয়, সে জন্য হাজার হাজার লোক এসে দাঁড়িয়েছিল তাঁর বাড়ির সামনে।

যেখানে হাত দিয়েছেন হুমায়ূন ভাই, সোনা ফলেছে। ব্যর্থতা বলে কোনো জিনিস হুমায়ূন আহমেদের ধারেকাছেও ভিড়তে পারেনি কখনো। টিভি নাটক লিখতে এসে সম্পূর্ণ নতুন এবং নিজস্ব একটি ধারা তৈরি করে দিলেন তিনি। হুমায়ূন আহমেদের নাটক শুধুই হুমায়ূন আহমেদের নাটক, অন্য কারো সঙ্গে মেলে না, অন্য কেউ তাঁর মতো লিখতেও পারেন না। ‘এইসব দিনরাত্রি’ থেকে শুরু হলো। ‘বহুব্রীহি’, ‘অয়োময়’, ‘কোথাও কেউ নেই’_আরো কত তুঙ্গস্পর্শী জনপ্রিয় নাটক!

সিনেমা করলেন, মধ্যবিত্ত শ্রেণী আবার হলে ফিরল। প্রথম ছবিতেই আট-দশটি ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড। অসাধারণ কিছু গান লিখলেন, যেমন_’এক যে ছিল সোনার কন্যা মেঘবরণ কেশ, ভাটি অঞ্চলে ছিল সেই কন্যার দেশ’। দুর্দান্ত কয়েকটি বিজ্ঞাপনচিত্র তৈরি করলেন, যেমন_হ্যামিলনের বংশীবাদকের মতো কুদ্দুস বয়াতির পেছনে ৪০-৫০টি শিশু ছুটছে। প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রমের বিজ্ঞাপন। তাঁর প্রায় প্রতিটি ধারাবাহিকের জনপ্রিয় চরিত্রদের নিয়ে বিজ্ঞাপন হয়েছে। একটি নাটকে রাধারমণের গান ব্যবহার করলেন, ‘আইজ পাশা খেলব রে শ্যাম’। গানটি জনপ্রিয়তায় রেকর্ড করল। সিনেমা-নাটকে ব্যবহার করে হাছন রাজার গানকে নতুন করে জনপ্রিয় করালেন তিনি। তাঁর গল্প পড়ে রমাপদ চৌধুরী বলেন, বিশ্বের যেকোনো ভাষার ভালো গল্পগুলোর সঙ্গে হুমায়ূন আহমেদের গল্প তুলনীয়। তিনিই একমাত্র বাঙালি লেখক, যিনি সাত বছর ধরে ‘দেশ’ পত্রিকার শারদীয় সংখ্যায় উপন্যাস লিখেছেন। এই সৌভাগ্য আর কোনো বাঙালি লেখকের হয়নি।

আর তাঁর বইয়ের বিক্রি?

অনেক বছর ধরে বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ মিলিয়ে হুমায়ূন আহমেদ সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখক। তাঁর কোনো কোনো বই ৮০-৯০ হাজার কপিও বিক্রি হয়েছে। টাকার বস্তা নিয়ে প্রকাশকরা তাঁর বাড়ির দরজায় গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। একসঙ্গে ৫০ লাখ টাকা অগ্রিম দেন কোনো প্রকাশক। তাঁর বই না পেয়ে হতাশায় ডায়াবেটিস হয়ে যায় প্রকাশকের। গাড়ি, ফ্ল্যাট হয়ে যায় পর পর কয়েক বছর বইমেলায় তাঁর একটি করে বই পাওয়া ভাগ্যবান প্রকাশকের। বইমেলায় যে স্টলে বসেন তিনি, ভিড় ঠেকাতে সেখানে আট-দশজন পুলিশ লাগে। আড়াই ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে তাঁর অটোগ্রাফ নিতেও ক্লান্ত হয় না পাঠক। তাঁর সঙ্গে এক দিনের জন্য আড্ডা দিতে নুহাশপল্লীতে কলকাতা থেকে ছুটে আসেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, বাড়িতে দেখা করতে আসেন শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, নুহাশ পদক দিতে তিনি ডাকেন সমরেশ মজুমদারকে। কিশোর-তরুণ-তরুণী তো আছেই, অনেক শ্রদ্ধেয় ও বয়স্ক ভদ্রলোকও তাঁর ভক্ত, পেছন পেছন ঘুরছেন আর স্যার স্যার করছেন। অভিনেতা-অভিনেত্রী, পাঠক-প্রকাশক এবং সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের কাছে তিনি স্যার। নিজ গ্রামে তিনি পীর সাহেব। লোকে তাঁকে তেমন করে মানে। ভাবতে বিস্ময় লাগে, পাঁচ ফুট সাত ইঞ্চি মাপের রোগা-পটকা একজন মানুষ কোন মন্ত্রবলে এমন আকাশছোঁয়া হয়ে ওঠেন, কী করে হয়ে ওঠেন কিংবদন্তি!

তাঁকে নিয়ে ভাবতে শুরু করলে ঘোর লেগে যায়। আমি আমার ঘোর কাটাতে আবার পেছন ফিরে তাকাই। হুমায়ূন ভাইয়ের আরো পেছনে ফেলে আসা জীবনটা দেখি।

শ্যামলীর বাসা ছেড়ে হুমায়ূন ভাই এরপর আজিমপুরে চলে এলেন। নিউ মার্কেটের দক্ষিণ পাশ দিয়ে সোজা পশ্চিমে বিডিআর গেট, সেই গেটের বাঁ দিকের রাস্তা দিয়ে খানিক এগিয়ে হাতের ডান দিকে একটা রাস্তা ঢুকে গেছে, রাস্তার একপাশে একটা ডোবা আর কয়েকটা কবর, তার উল্টো পাশের বাড়িটির তিনতলার ফ্ল্যাট। তত দিনে জয়যাত্রা শুরু হয়ে গেছে তাঁর। ঈদ সংখ্যাগুলোতে একটার পর একটা উপন্যাস লিখছেন, বইয়ের পর বই বেরোচ্ছে, প্রতিদিনই বিস্ময়করভাবে বাড়ছে বইয়ের বিক্রি। প্রকাশকদের আসা-যাওয়া শুরু হয়ে গেছে। হুমায়ূন ভাইও প্রায়ই যাচ্ছেন বাংলাবাজারে। নওরোজ কিতাবিস্তানে ইফতেখার রসুল জর্জের ওখানে আড্ডা হয়। প্রায় নিয়মিত আসেন হেদায়েত হোসাইন মোরশেদ।

কখনো বিউটি বুক হাউস, কখনো স্টুডেন্ট ওয়েজ। আমি যাই। দু-চার দিন পর পরই হুমায়ূন ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হয়। কোনো কোনো দিন দুপুরবেলা আমাকে তিনি সঙ্গে করে বাড়ি নিয়ে যান। দুপুরে তাঁর ওখানে খেয়ে বিকেলবেলা ইউনিভার্সিটি ক্লাবে আড্ডা দিতে যাই। এ সময় টেলিভিশনে শুরু হলো তাঁর দেশমাতানো ধারাবাহিক ‘এইসব দিনরাত্রি’। নাটকটির পরিচালক মুস্তাফিজুর রহমান। মুস্তাফিজ ভাই তখন আজিমপুর স্টাফ কোয়ার্টারে থাকেন। আমাকে নিয়ে হুমায়ূন ভাই প্রায়ই তাঁর ওখানে যান, স্ক্রিপ্ট নিয়ে কথা হয়। কোনো কোনো দিন টিভি ভবনে রেকর্ডর্িংয়েও যাই আমি। সেই সময় নিজেদের গ্রামে বাবার নামে একটা পাঠাগার করলেন হুমায়ূন ভাই। নির্মলেন্দু গুণ, হুমায়ুন আজাদ এবং আমাকে নিয়ে গেলেন উদ্বোধন করাতে। ফেরার দিন রাতে ময়মনসিংহ শহরে নির্মলেন্দু গুণের বাসায় থাকলাম। উহ্, সারাটা রাত নির্মলেন্দু গুণ আর হুমায়ুন আজাদ যে কী ঝগড়া করলেন! ঝগড়ার শ্রোতা আমি আর হুমায়ূন আহমেদ।

 

হুমায়ূন আহমেদের সাক্ষাৎকার

এই সব বিষয় আপাতত থাক। ধীরে ধীরে আরো অনেক ঘটনা লিখব। এখন তাঁর সাক্ষাৎকারের দিকে যাই। ২০০৬ সালে অসাধারণ একটি উপন্যাস লিখলেন হুমায়ূন ভাই_’লীলাবতী’। সেই উপন্যাস ধরে শুরু করলাম তাঁর সাক্ষাৎকার। ২০০৬ সালের এক সন্ধ্যায়। স্থান দখিন হাওয়া, ধানমণ্ডি।

ইমদাদুল হক মিলন : আপনার মনে হয়নি যে ‘লীলাবতী’ উপন্যাসের শেষটা আপনি খুব দ্রুত করেছেন? শেষটা আরেকটু বিস্তৃত হতে পারত?

হুমায়ূন আহমেদ : আমার বেশির ভাগ উপন্যাসে আমি শেষের দিকে এসে তাড়াহুড়া করি। কেন করি তোমাকে ব্যাখ্যা করি_তুমি তো লেখক মানুষ, তুমি বুঝবে। লেখক যখন লেখালেখি করেন, লেখার আগে থেকে পুরো উপন্যাসটা তাঁর মাথার ভেতর ঢোকে। আমি একটা ৫০০ পৃষ্ঠার উপন্যাস লিখলাম, ৫০০টা পৃষ্ঠা কিন্তু আমি তখন মাথার ভেতর নিয়ে বাস করছি। তখন একটা চেষ্টা থাকে, কত তাড়াতাড়ি আমি জিনিসটাকে মাথা থেকে নামিয়ে দেব। আমি প্রবল চাপ নিয়ে হাঁটাহাঁটি করি, একই সঙ্গে আমার মাথার ভেতর ৫০০ পৃষ্ঠার উপন্যাস হাঁটাহাঁটি করে। উপন্যাসের চরিত্রগুলো কুটুরকুটুর করে নিজেদের মধ্যে কথা বলে, ব্যাপারটা একই সঙ্গে আনন্দের ও প্রচণ্ড চাপের। আমার মনে হয়, একজন গর্ভবতী মা ৯ মাস গর্ভধারণের পর সন্তানের জন্ম দিয়ে যে আনন্দ-তৃপ্তি-স্বস্তিটা পান, একজন লেখক ঠিক সেই স্বস্তিটা পান। সেই স্বস্তিটার জন্য আমার তাড়াহুড়া। আল্লাহপাক হয়তো এ কারণেই কোরআন শরিফে বলেছেন_’হে মানবসন্তান, তোমাদের বড়ই তাড়াহুড়া।’

ইমদাদুল হক মিলন : আবার ‘লীলাবতী’ প্রসঙ্গে আসি। মাসুদের স্ত্রীর যখন বাচ্চা হবে, সে বাড়িতে থাকল, তার বাচ্চা হচ্ছে না। তার শাশুড়ি আগেই বলেছিল, তার যমজ বাচ্চা হবে। একটা ছেলে, একটা মেয়ে। তারপর নৌকা করে সে যাচ্ছে, ঝড়বৃষ্টি হচ্ছে, সেখানে তার যমজ বাচ্চা হলো। এই যে এটুকু রহস্য, তাকে আপনি ঝড়-জলের মধ্যে কেন নিয়ে এলেন? রহস্যটা কী? এই কষ্টটা সে তো বাড়িতেও পেতে পারত?

হুমায়ূন আহমেদ : নৌকায় পরীবানুকে নিয়ে, তাকে ঝড়বৃষ্টির হাতে ছেড়ে দিয়ে যে টেনশন তৈরি হয়েছে, পরীবানুকে বাড়িতে রেখে দিলে তা হতো না।

ইমদাদুল হক মিলন : আমি সাহিত্যের যেটুকু বুঝি, তাতে জানি যে আপনি খুব বড় একজন লেখক। অন্য ভাষায় অন্য দেশে জন্মালে হয়তো আপনি আরো ভাগ্যবান হতেন। দুর্ভাগ্য আপনার, আপনি এই ভাষার, এই দেশে জন্মে গেছেন। আপনার কী মনে হয়, বাংলা ভাষার প্রেক্ষাপটে ঔপন্যাসিক হিসেবে আপনার অবস্থানটা কোথায়?

হুমায়ূন আহমেদ : আমার অবস্থান আমাকেই ঠিক করতে হবে? মিলন, শোনো, আমি সাহিত্যের ছাত্র না। আমি কেমিস্ট্রির ছাত্র। সাহিত্যের বিষয়ে আমার যে জ্ঞান, সেটা হচ্ছে বই পড়ে। এক জীবনে প্রচুর বই পড়েছি। আমাদের সময় তো রেডিও, টিভি_এসব ছিল না; আমাদের একমাত্র জিনিস ছিল গল্পের বই। বিশাল বিশাল উপন্যাস, যেটা আমাদের অল্পবয়সীদের পড়তে দেওয়া হতো না। যেমন ধরো, ‘কড়ি দিয়ে কিনলাম’, খাটের নিচে ঢুকে অন্ধকারে পড়ে শেষ করেছি। আমার সাহিত্য সম্পর্কে যা জ্ঞান আছে, ওই খাটের নিচে ঢুকে বই পড়ে। এমন একজনকে কি সাহিত্যে তার অবস্থান বিষয়ে কিছু জিজ্ঞেস করা ঠিক?

ইমদাদুল হক মিলন : হুমায়ূন ভাই, আমি জানতে চাইছিলাম যে আপনি এত বড় একজন লেখক, বাংলা সাহিত্যের প্রেক্ষাপটে আপনার নিজের অবস্থানটা কোথায়?

হুমায়ূন আহমেদ : প্রশ্নের উত্তর নিয়েই ছাড়বে? আমার অবস্থান ঠিক হবে আমার মৃত্যুর পর। তোমরা সবাই মিলেই ঠিক করবে। এই সময়ে আমি বর্তমানের একজন জনপ্রিয় লেখক। এর বেশি কিছু না।

ইমদাদুল হক মিলন : এখানে একটা কথা বলি, যে অবস্থায় হেমিংওয়ে তাঁর জীবদ্দশায় পপুলার, জীবদ্দশায় মার্কেজ পপুলার, জন স্টাইনবেক পপুলার, তাঁদের মতো লেখক সারা পৃথিবীতে বিরল আর আমাদের সাহিত্যে শরৎচন্দ্র জনপ্রিয়, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, বনফুল_এঁরা জনপ্রিয়। এখন এসব লেখকের জনপ্রিয়তার পার্থক্য আছে। আমি বাংলা ভাষায় জনপ্রিয়তার কথা বললে তারাশঙ্করকে বলব। তাঁর সময়ে তাঁর মতো জনপ্রিয় আর কেউ নেই। জনপ্রিয়তার কথা বললে আপনাকে তো কেউ রোমেনা আফাজের সঙ্গে তুলনা করে না, আপনাকে তুলনা করলে তারাশঙ্করের সঙ্গে তুলনা করে, শরৎচন্দ্রের জনপ্রিয়তার সঙ্গে করে।

হুমায়ূন আহমেদ : মিলন, শোনো, বাংলাদেশে সাহিত্যের থার্মোমিটার হলেন সাহিত্যের অধ্যাপকরা। এ দেশে পাঠকদের ভালোলাগা-মন্দলাগা গ্রাহ্য হয় না। সাহিত্যের অধ্যাপকদের থার্মোমিটারে কী উঠছে, সেটাই গ্রাহ্য। সাহিত্যের থার্মোমিটার বলছে, আমি একজন জনপ্রিয় লেখক। এর বেশি কিছু না। কাজেই এটাই সত্য। আমার মৃত্যুর পর নতুন সত্য আসতে পারে, আবার নাও পারে। না এলে নাই। সাহিত্যের অধ্যাপকরা সাহিত্য মাপার নানা যন্ত্রপাতি_থার্মোমিটার, ল্যাকটোমিটার নিয়ে বসে থাকুক। আমি বসে থাকব বলপয়েন্ট নিয়ে। মিলন, ল্যাকটোমিটার কী জানো তো? ল্যাকটোমিটার দিয়ে দুধের ঘনত্ব মাপা হয়। সাহিত্যের সমালোচকদের হাতেও কিন্তু সাহিত্যের ঘনত্ব মাপার ল্যাকটোমিটার আছে। হা হা হা।

বাংলাদেশের একজন সাহিত্যবোদ্ধা আমার উপন্যাসগুলোর জন্য একটা নাম বের করেছিলেন, সেটা তোমার মনে আছে? ‘অপন্যাস’।

ভাগ্যিস তার পরই কলকাতার ‘দেশ’ পত্রিকা আমার ‘অপন্যাস’ ছাপতে শুরু করল। আমাদের দেশের সাহিত্যবোদ্ধাদের কাছে ওই পত্রিকাটি হিসাবের পত্রিকা।

ইমদাদুল হক মিলন : হ্যাঁ, এটা বাংলা ভাষার কোনো লেখকের ক্ষেত্রে ঘটেনি। প্রতিবছর শারদীয় সংখ্যায় বাংলা ভাষার কোনো লেখকের উপন্যাস ছাপা হওয়া ‘দেশ’-এর ইতিহাসে নেই।

হুমায়ূন আহমেদ : থাকুক ওই প্রসঙ্গ। শারদীয় ‘দেশ’ আমার উপন্যাস ছেপেছে বলে আমি জাতে উঠে গেছি, এটা আমি মনে করি না। আমি লেখালেখি আমার আনন্দের জন্য করি, জাতে ওঠার জন্য করি না। জাতিচ্যুত হওয়ার জন্যও করি না।

ইমদাদুল হক মিলন : আপনি তো প্রচণ্ড আত্ম-অহংকারী লোক!

হুমায়ূন আহমেদ : আমি চোখমুখ শক্ত করে থাকি বলে আমাকে অহংকারী মনে হয়। তবে কিছু অহংকার আছে। সেই অহংকার নিজেকে ভালো মানুষ ভাবার অহংকার। এর বেশি না।

ইমদাদুল হক মিলন : আপনার প্রথম উপন্যাস ‘নন্দিত নরকে’ প্রকাশিত হওয়ার পর বাংলা ভাষার খুব বড় ঔপন্যাসিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বইটি নিয়ে ‘দেশ’ পত্রিকায় লিখলেন। ওটা একটা অসাধারণ রচনা। আমার এখনো মনে আছে। আপনার বইয়ের ভূমিকা লিখলেন আহমদ শরীফ এবং বাংলাদেশের যত বুদ্ধিজীবী আছেন, সবাই আপনার প্রশংসা করেছিলেন এই লেখার জন্য। এরপর ড. আনিসুজ্জামান আপনার বইয়ের ভূমিকা লিখে দিলেন। শামসুর রাহমান আপনার লেখার ব্যাপক প্রশংসা করে লিখেছেন এবং বাংলা ভাষার খুব বড় লেখক আমি মনে করি তাঁকে, জানি না আপনি আমার সঙ্গে একমত হবেন কি না_তাঁর নাম রমাপদ চৌধুরী, তিনি আপনার লেখা সম্পর্কে উচ্ছ্বসিত চিঠিপত্র লিখেছিলেন এবং তাঁর সঙ্গে আমার একবার কথাও হয়েছিল কলকাতায়। সব কিছু মিলিয়ে আপনার এ ধারণাটা কেন হলো যে এ দেশের দু-একজন কী বললেন না বললেন তার ওপর আপনাকে নির্ভর করতে হবে বা আপনি খুব আশান্বিত হবেন তাঁদের কথায়?

হুমায়ূন আহমেদ : মিলন, আমি যে সময়ের কথা বলেছি, সে সময়…।

ইমদাদুল হক মিলন : না, তার আগে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বা আহমদ শরীফের মতো লেখকরা আপনাকে নিয়ে লিখেছেন। শওকত আলী আপনাকে নিয়ে লিখেছেন।

হুমায়ূন আহমেদ : মানুষের মন খারাপ হয় না? কত আগ্রহ, কত আনন্দ নিয়ে লিখি! কত না বিনিদ্র রজনীর লেখাকে অপন্যাস বলা হচ্ছে, একথা মনে লাগবে না? লেখকরা তো আবেগের সমুদ্রেই লালিত-পালিত।

ইমদাদুল হক মিলন : জনপ্রিয় লেখকের কনসেপ্টটা আসলে কী আপনার কাছে? আপনি আমাকে একটু পরিষ্কার করে বলেন তো…।

হুমায়ূন আহমেদ : তুমি দেখি এক ‘জনপ্রিয়’ নিয়ে ঘটঘট করেই যাচ্ছ? ব্যাপারটা কী? জনপ্রিয় লেখকের কনসেপ্ট একটাই_বহু লোক তাঁর বই পড়ছে।

ইমদাদুল হক মিলন : এখন বহু লোক তো মার্কেজের বইও পড়ছে, তারাশঙ্করের বইও পড়ছে, হুমায়ূন আহমেদের বইও পড়ছে, আবার এদিকে রোমেনা আফাজ বা এজাতীয় লেখকের বইও পড়ছে। সে ক্ষেত্রে ব্যাপারটা কী রকম দাঁড়ায়?

হুমায়ূন আহমেদ : শোনো মিলন, এত প্যাঁচালের মধ্যে যেতে চাইছি না। এখন আমার কাছে জনপ্রিয় শব্দটা খুব প্রিয়।

ইমদাদুল হক মিলন : প্রিয় শব্দ?

হুমায়ূন আহমেদ : কারণ জনপ্রিয় শব্দটার প্রথম শব্দ হলো ‘জন’, যেখানে জনতা আছে, সেখানে সেই শব্দটাকে আমি ক্ষুদ্র করে দেখব, আমি ওই রকম লোকই না। আমাদের হেমন্তের গান শুনতে ভালো লাগে না?

ইমদাদুল হক মিলন : হ্যাঁ, অবশ্যই।

হুমায়ূন আহমেদ : কত দরদি একজন গায়ক হেমন্ত মুখোপাধ্যায়! এখন বহু লোক তাঁর গান শোনে বলে কি তিনি ছোট হয়ে গেছেন?

ইমদাদুল হক মিলন : না, এখানে কি হুমায়ূন ভাই আপনার মনে হয় জনপ্রিয়তার দুটি ভাগ আছে? ধরেন যে অর্থে মার্কেজ বা তারাশঙ্কর জনপ্রিয়, যে অর্থে আপনি জনপ্রিয়, সেই অর্থে ফুটপাতের চটিবই লেখা একজন জনপ্রিয় লেখক, এ বিষয়ে আপনার ব্যাখ্যাটা কী?

হুমায়ূন আহমেদ : আসলে ব্যাপার হলো, জনতার কোন অংশ বইটি পড়ছে।

ইমদাদুল হক মিলন : আমি সেটাই জানতে চাইছি। আমি বিষয়টা একটু ক্লিয়ার করে দিই আপনাকে। ধরেন হেমিংওয়ে বা মার্কেজের জনপ্রিয়তা, তারাশঙ্কর বা বিভূতিভূষণের যে জনপ্রিয়তা আর ওদিকে নীহারঞ্জন গুপ্ত। আপনার জায়গাটা কোথায় আসলে?

হুমায়ূন আহমেদ : ভালো যন্ত্রণায় পড়লাম তো। মিলন, শোনো, একটা সময় ছিল, যখন এই সব তুচ্ছ বিষয় নিয়ে আমি মাথা ঘামাতাম। এখন মাথা ঘামাই না। এখন মনে হয়, তোমাদের যা ইচ্ছা তোমরা বলো, আমার উপন্যাসকে ‘অপন্যাস’ বলো, আমার কিছু যায়-আসে না। আমার প্রধান কাজ হচ্ছে লেখালেখি করে যাওয়া, এ কাজটি আমি যদি আমার মৃত্যুর আগের মুহূর্ত পর্যন্ত করে যেতে পারি, আমি মনে করব, এটা আমার জন্য যথেষ্ট। এবং আমি খুবই ভাগ্যবান লেখক যে আমি আমার বইগুলো অনেককেই পড়াতে পারছি। একটা প্রত্যন্ত গ্রামের কোনো বাড়িতে ঢুকে যখন দেখি ওই বাড়িতে চার-পাঁচটা বই আছে, এর মধ্যে একটা নিয়ামুল কোরআন আছে, একটা ‘বিষাদসিন্ধু’ আছে আর একটা হুমায়ূন আহমেদের বই_আমার যে কী আনন্দ হয়! চোখে পানি এসে যাওয়ার মতো আনন্দ।

 

এবার অন্য রকম একটি প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলি। তারপর আবার হুমায়ূন আহমেদের পেছনের জীবনের দিকে ফিরব।

হুমায়ূন ভাইয়ের যেকোনো লেখাই গভীর আগ্রহ ও আনন্দ নিয়ে পড়ি। আমার ধারণা, তাঁর এমন কোনো লেখা নেই, যা আমি পড়িনি। বছর তিনেক আগের কথা, তখন অপেক্ষা করে থাকতাম তাঁর ‘বলপয়েন্ট’ লেখাটির জন্য। ‘সাপ্তাহিক ২০০০’-এ প্রতিসপ্তাহে বেরোচ্ছে ‘বলপয়েন্ট’। এত স্বাদু রচনা, পড়তে শুরু করলে কখন শেষ হয়ে যায় টেরই পাই না। শেষ হওয়ার পর বিরক্ত লাগে। কেন মাত্র দেড়-দুই পৃষ্ঠা করে লিখছেন তিনি? কেন এই লেখা আরো বড় করে লিখছেন না?

এর মধ্যে একটি পর্বে দেখলাম আমাকে নিয়ে দু-তিনটি প্যারা লিখেছেন। পড়ে সন্ধ্যাবেলা তাঁকে ফোন করলাম। তিনি বিক্রমপুর থেকে ফোন ধরলেন। বিক্রমপুরের দীঘিরপার এলাকায় নাটকের শুটিং করতে গেছেন। গ্রামটির নাম কামাড়খাড়া। এই গ্রামের পাশের গ্রাম বাণীখাড়ায় ছিল শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়দের বাড়ি। এলাকাটি আমার বিশেষ পরিচিত। ওই গ্রামে আমার এক দাদার বাড়ি। অর্থাৎ বাবার ফুফাতো চাচার বাড়ি। কিশোর বয়সে বহুবার সেই বাড়িতে গেছি। গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীটির নাম রজতরেখা। হুমায়ূন ভাই ওই এলাকায় শুটিং করছেন আর সেদিনই অনেক দিন পর তাঁর সঙ্গে আমার কথা হচ্ছে ভেবে ভালো লাগল। আমাকে নিয়ে তিনি লিখেছেন সেই কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্য ফোন করেছিলাম। কথায় কথায় বললাম, ‘বলপয়েন্ট’ লেখাটিকে মনে হচ্ছে ‘কলম ছেড়ে দেওয়া লেখা’। কোনো পরিকল্পনা নেই, মাথায় এলোমেলোভাবে আছে স্মৃতিগুলো। কোন স্মৃতি আগের, কোনটি পরের_কোনো হিসাব নেই, কলম যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে, লেখাও এগোচ্ছে সেইভাবে। বলপয়েন্টের মূল আকর্ষণ এই জায়গায়।

কিন্তু যে কথা বলার জন্য হুমায়ূন ভাইকে ফোন করেছিলাম সেই কথাটাই বলা হলো না। এখন বলি। হুমায়ূন ভাই, আপনি লিখেছেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আর সমরেশ মজুমদার ঢাকায় এসেছেন। সন্ধ্যাবেলা পার্টি হচ্ছে কোথাও। ঢাকার লেখক-শিল্পীরা অনেকেই আছেন সেখানে। পানাহার হইহল্লা আড্ডা চলছে। সেই আড্ডায় আমি সুনীল-সমরেশকে সমানে তুমি তুমি করে যাচ্ছি।

এখানটায় একটুখানি গণ্ডগোল আছে।

আমি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে কখনো তুমি বলি না। তাঁকে আপনি করেই বলি। সুনীলদা আপনি, বলি।

সমরেশ মজুমদারকে তুমি করে বলি। পেছনে একটা ঘটনা আছে। সতেরো-আঠারো বছর আগে সমরেশ মজুমদার প্রথম ঢাকায় এলেন। ফেব্রুয়ারির বইমেলা চলছে বাংলা একাডেমীতে। সমরেশকে ঢাকায় এনেছেন পার্ল পাবলিকেশন্সের আলতাফ হোসেন। আপনার-আমার দুজনের প্রিয় মিনু ভাই। মিনু ভাই অকালে চলে গেছেন। এই মুহূর্তে তাঁর কথা খুব মনে পড়ছে। মিনু ভাই ঠোঁটকাটা লোক ছিলেন, হঠাৎ রেগে যেতেন; কিন্তু মনটা খুব ভালো ছিল! একবার তাঁর বিদেশে থাকা এক আত্মীয় খুবই সুন্দর পিংক কালারের বেশ দামি একটা টি-শার্ট গিফট করেছেন মিনু ভাইকে। মিনু ভাই সেটা নিয়ে আমার গেণ্ডারিয়ার বাসায় গিয়ে হাজির। ওই টি-শার্টে নাকি আমাকে খুব মানাবে। বহুদিন মিনু ভাইয়ের দেওয়া সেই টি-শার্ট পরে আমি ঘুরে বেরিয়েছি। ফেব্রুয়ারি বইমেলায় মিনু ভাইকে একটা বই দেব বলে অনেক দিন ঘুরিয়েছিলাম, সে কথা মনে করে আজ অনুতপ্ত হচ্ছি।

তো, সমরেশ ঢাকায় এসে মিনু ভাইয়ের সঙ্গেই আছেন। বাংলা একাডেমীতে মিনু ভাইয়ের স্টলের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। তখনো বাংলাদেশের পাঠক সমরেশকে সেভাবে চেনে না। আমি হাঁটতে হাঁটতে গেছি মিনু ভাইয়ের স্টলের সামনে। মিনু ভাই সমরেশের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। সমরেশের লেখা সম্পর্কে আমার কিছু ধারণা ছিল। তাঁর বহু লেখা আমি পড়েছি। বিশেষ করে ‘উত্তরাধিকার’ উপন্যাসটি আমাকে মুগ্ধ করেছিল। পরিচয়ের মুহূর্তেই সমরেশ যেটা করলেন, আমার কাঁধে একটা হাত দিলেন, দিয়ে বেশ একটা দাদাসুলভ ভঙ্গিতে কলকাতার ভাষায় বললেন, ‘তা, কী লিখছ আজগাল?’ আচরণ এবং প্রশ্নে আন্তরিকতার অভাব ছিল না। কিন্তু আমার মনের ভেতর খুট করে একটা শব্দ হলো। বয়সে ছোট ইত্যাদি ভেবে কি তিনি আমাকে তুমি করে বলছেন? নাকি লেখকসুলভ কোনো ভাব! লেখকদের তো নানা ধরনের ভাবচক্কর থাকে।

আমার মাথায় দুষ্টু একটা পোকা কামড় দিল। তাহলে আমিও সমরেশের সঙ্গে একটু ভাব নিই। আমি ঘাড় বাঁকা করে সমরেশের মুখের দিকে তাকিয়ে অতিশয় নির্বিকার গলায় বললাম, ‘তা, তুমি কী লিখছ?’

সমরেশ কিন্তু ব্যাপারটা সহজভাবেই নিলেন। ওই বিকেলেই আমাদের বন্ধুত্ব হয়ে গেল। আমি সমরেশকে তুমি করেই বলতে লাগলাম। সঙ্গে ‘দা’টা লাগিয়ে দিলাম। কিন্তু হুমায়ূন ভাই, আপনি এই তুমি তুমিটা একদমই পছন্দ করছিলেন না। একদিন খুবই বিরক্ত হয়ে কথাটা আমাকে বলেছিলেন। যখন আমি ঘটনাটা বললাম, শুনে আপনি খুব মজা পেয়েছিলেন। তবে তারপর দু-একবার সমরেশদাকে আমি আপনি করে বলার চেষ্টা করেছি, ব্যাপারটা তিনি স্বাভাবিকভাবে নেননি। মাইন্ড করেছেন।

২০০৯-এর এপ্রিলে কলকাতায় গেছি। সমরেশের সঙ্গে দেখা। বললাম, কেমন আছেন, সমরেশদা? সমরেশদা গম্ভীর গলায় বললেন, ‘তুমি কিন্তু আমাকে তুমি করে বলতে?’

 

এবার অন্য প্রসঙ্গে। মনে আছে, হুমায়ূন ভাইয়ের আজিমপুরের বাসায়ই মুহম্মদ জাফর ইকবালের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল। তখন তিনি আমেরিকায় থাকেন। ছুটিতে দেশে এসেছেন। আমি মুহম্মদ জাফর ইকবালেরও ভক্ত পাঠক। যত দূর জানি, তখন পর্যন্ত তাঁর দুটি মাত্র বই বেরিয়েছে। মুক্তধারা থেকে ‘কপোট্রনিক সুখ দুঃখ’, শিশু একাডেমী থেকে ‘দিপু নাম্বার টু’। ‘কপোট্রনিক সুখ দুঃখ’ গল্পটি বিচিত্রায় ছাপা হয়েছিল এবং আজকের অনেক পাঠকই জানেন না, হুমায়ূন ভাইয়ের ‘নন্দিত নরকে’র প্রথম সংস্করণের প্রচ্ছদ এঁকেছিলেন দুজন শিল্পী_মুহম্মদ জাফর ইকবাল ও শামিম সিকদার।

হুমায়ূন আহমেদরা তিন ভাইই বিখ্যাত, তিন ভাইই লেখক। জনপ্রিয়তায় হুমায়ূন ভাইয়ের পরই জাফর ভাই। স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীদের কাছে মুহম্মদ জাফর ইকবালের মতো প্রিয় লেখক আর কেউ নেই। শিক্ষক হিসেবে দারুণ জনপ্রিয় তিনি। স্কুল-কলেজের মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের আদর্শ, অসম্ভব সাহসী এবং সৎমানুষ। যে কজন মানুষের আলোয় আলোকিত হয়ে আছে আমাদের সময়, মুহম্মদ জাফর ইকবাল তাঁদের একজন।

আর আহসান হাবিব ‘উন্মাদ’ পত্রিকার সম্পাদক, দুর্দান্ত কার্টুন আঁকেন, রম্য লেখায় তাঁর তুলনা তিনি নিজেই। তাঁর জোকসের বইয়ের যে বিক্রি বইমেলায় আমি দেখেছি, বিস্ময়কর! এই পরিবারের আরেকজন মানুষের আমি খুব ভক্ত, হুমায়ূন ভাইয়ের মা। সারা দিন বই পড়েন, সাহিত্য নিয়ে ভাবেন। ‘নূরজাহান’ প্রথম পর্ব পড়ে আমাকে বললেন, দ্বিতীয় পর্ব বেরোলে আমাকে দিয়ো। দ্বিতীয় পর্ব বেরোতে সাত বছর লাগল। এই সাত বছরে যতবার দেখা হয়েছে, ততবারই তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করেছেন, বেরোয়নি?

বই বেরোনোর পর প্রথম কপিটি আমি তাঁকে পেঁৗছে দিয়ে এসেছি। শেষ পর্ব হুমায়ূন ভাই মাকে কিনে দিয়েছিলেন, বইটা পেঁৗছে দিতে আমার কয়েকটা দিন দেরি হয়েছিল বলে।

আজিমপুরের সেই বাসা ছেড়ে হুমায়ূন ভাই তারপর এসে উঠলেন শহীদুল্লাহ্ হলের হাউস টিউটরের কোয়ার্টারে। তত দিনে অনিন্দ্য পাবলিশার্স নামের একটি প্রকাশন সংস্থা বেশ জাঁকজমক করে এসেছে প্রকাশনায়। হুমায়ূন ভাইয়ের ‘অমানুষ’, আমার ‘কালাকাল’_এই সব বই নিয়ে শুরু করল। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই অনিন্দ্যর স্বত্বাধিকারী নাজমুল হক একদিন একটা মিষ্টির প্যাকেট আর একটা নতুন সাদা ডাইহাটসু গাড়ি নিয়ে হুমায়ূন ভাইয়ের বাড়িতে এসে হাজির। গাড়িটা আপনার জন্য। রয়ালটি থেকে অ্যাডজাস্ট হবে।

ঘটনাটি অবিশ্বাস্য। বাংলাদেশের কোনো লেখকের ক্ষেত্রে এ ধরনের ঘটনা আগে বা পরে আজ পর্যন্ত আর ঘটেনি।

সেই সময় ‘দৈনিক বাংলা’র সাহিত্য পাতায় ‘মৌনব্রত’ নামে একটি ধারাবাহিক উপন্যাস লিখেছিলেন হুমায়ূন ভাই। ধারাবাহিকভাবে লেখা তাঁর বেশির ভাগ উপন্যাসই শেষ পর্যন্ত শেষ হয় না। ‘মৌনব্রত’ও শেষ হলো না। পরে এই লেখাটি নাম বদলে বই করলেন তিনি। ‘জনম জনম’। উপন্যাসটি যাঁরা পড়েছেন তাঁরা স্বীকার করবেন, ‘জনম জনম’ এক অসাধারণ উপন্যাস। পরে ‘নিরন্তর’ নামে আবু সায়িদ ছবি করেছেন। নায়িকা শাবনূর।

আমি হুমায়ূন আহমেদের প্রায় সব উপন্যাস পড়েছি। বহু ভালো উপন্যাস লিখেছেন তিনি। কতগুলোর নাম বলব! ‘নন্দিত নরকে’ ও ‘শঙ্খনীল কারাগার’_এ দুটো উপন্যাস তো ইতিহাস! তারপর ‘নির্বাসন’, ‘সূর্যের দিন’, ‘অন্ধকারের গান’, ‘চাঁদের আলোয় কয়েকজন যুবক’, ‘গৌরিপুর জংসন’, ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’, ‘কবি’, ‘উনিশ শো একাত্তর’, ‘ফেরা’, ‘জীবনকৃষ্ণ মেমোরিয়াল হাই স্কুল’, ‘আগুনের পরশমণি’, ‘কোথাও কেউ নেই’, ‘রুমালি’, ‘শুভ্র’, ‘লীলাবতী’, ‘মধ্যাহ্ন’, ‘জোছনা ও জননীর গল্প’, ‘বাদশানামদার’_আরো কত উপন্যাস! তাঁর লেখার একনিষ্ঠ পাঠক ও ভক্ত ছিলেন বাংলাদেশের খুব বড় একজন শিক্ষিত মানুষ, অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক। বেশ কয়েকবার হুমায়ূন ভাই আমাকে রাজ্জাক স্যারের ইউনিভার্সিটি কোয়ার্টারে নিয়ে গেছেন। মনে আছে, রাজ্জাক স্যার নিজ হাতে পাঙাস মাছের ডিম রান্না করে আমাদের দুজনকে একদিন খাইয়েছিলেন। তাঁর মুখে কী যে প্রশংসা শুনেছি হুমায়ুন ভাইয়ের একেকটি লেখার!

একবার বইমেলায় আবু হেনা মুস্তাফা কামাল বললেন, হুমায়ূন মধ্যবিত্তের নাড়ি স্পর্শ করেছে। তাঁর ‘চোখ’ গল্পটি পড়ে ‘সংবাদ’-এ দুর্দান্ত একটি লেখা লিখলেন সৈয়দ শামসুল হক। ‘চাঁদের আলোয় কয়েকজন যুবক’ উপন্যাসটি পড়ে আহমদ ছফা আমাকে বলেছিলেন, অসাধারণ লেখা! মাত্র কময়কটি আঁচড়ে বাংলাদেশের চেহারা ফুটিয়ে তুলেছে হুমায়ূন। ফরহাদ মযহার বলেছিলেন, হুমায়ূনের গল্পগুলোর কোনো তুলনা হয় না। নির্মলেন্দু গুণ মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন, তাঁর ‘জলিল সাহেবের পিটিসন’ গল্পটি পড়ে। কলকাতার ‘জিজ্ঞাসা’ পত্রিকায় হুমায়ূন ভাইয়ের ‘১৯৭১’ গল্পটি ছাপা হলো। আমার সামনে সেই গল্পের এমন প্রশংসা করলেন আল মাহমুদ, হুমায়ূন ভাই লজ্জা পেয়ে গেলেন।

এ রকম কত ঘটনার কথা লিখব!

একই হাতে কত রকমের লেখা যে লিখেছেন হুমায়ূন ভাই। বাংলা ভাষায় সায়েন্স ফিকশনের জনক তিনি। প্রথম সার্থক সায়েন্স ফিকশন লিখেছেন, সায়েন্স ফিকশনকে জনপ্রিয় করেছেন। এখন তাঁর অনুজ মুহম্মদ জাফর ইকবালের সায়েন্স ফিকশনও ভীষণ জনপ্রিয়। ভূতের গল্পে হুমায়ূন আহমেদের কোনো জুড়ি নেই। তাঁর মতো এত ভালো ভূতের গল্প বাংলা ভাষার আর কোনো লেখক লেখেননি। এই মুহূর্তে মনে পড়ছে ‘ছায়াসঙ্গী’ গল্পটির কথা। রহস্য, ফ্যান্টাসি, থ্রিলার আর অদ্ভুত অদ্ভুত বিষয়ের লেখা। ‘দেবী’, ‘নিশীথিনী’ লিখে আরেকটা জগৎ তৈরি করলেন। ‘অন্য ভুবন’ লিখে আরেকটি জগৎ তৈরি করলেন। ‘আয়নাঘর’, ‘পোকা’, ‘ভয়’_কত লেখার কথা বলব! আর তাঁর সেই অবিস্মরণীয় চরিত্র মিসির আলী, তুমুল জনপ্রিয় চরিত্র হিমু! সিলেটের একটি মেয়ে হিমুর সঙ্গেও আমার একবার দেখা হয়েছিল। সব মিলিয়ে হুমায়ূন আহমেদ একটি নেশার নাম, হুমায়ূন আহমেদ একটি প্রতিষ্ঠান। শিশু-কিশোরদের লেখা, রূপকথা_কোথায় তাঁর হাতের পরশ পড়েনি? আর যেখানে পড়েছে, সেখানেই সোনা ফলেছে। বাংলা ভাষায় তাঁর প্রিয় লেখক রবীন্দ্রনাথ। ঘণ্টার পর ঘণ্টা রবীন্দ্রনাথের কবিতা মুখস্থ বলে যেতে পারেন। বিভূতিভূষণ, তারাশঙ্কর, মানিক, সতীনাথ ভাদুড়ীর উপন্যাস-গল্প তাঁর প্রিয়। জন স্টাইনবেক, স্টিফান কিং তাঁর প্রিয়। সারাক্ষণ লেখা নিয়ে ভাবছেন। লেখার ব্যাপারে অসম্ভব খুঁতখুঁতে। মনমতো না হলে সেই লেখা কিছুতেই লিখবেন না। মাথা ভর্তি নতুন নতুন আইডিয়া। সবার মধ্যে থেকেও, তুমুল আড্ডার মধ্যে থেকেও কোন ফাঁকে যেন একা হয়ে যান, লেখার জগতে চলে যান। যখন-তখন লিখতে পারেন। লেখেন মেঝেতে বসে, লেখার জন্য চেয়ার-টেবিল দরকার হয় না। লেখার মতোই অসম্ভব আকর্ষণীয় ভঙ্গিতে গল্প বলতে পারেন, বাস্তবের সঙ্গে কোথায় যে মিশেল দেবেন কল্পনা, তিনি নিজে ছাড়া কেউ তা বুঝতে পারবে না। কখনো তিনি নিজেই মিসির আলী, কখনো হিমু। সব মিলিয়ে এক বিস্ময়কর মানুষ। কাউকে মা-বাবা ডাকতে পারেন না। নিজের শ্বশুর-শাশুড়িকেও কখনো মা কিংবা বাবা বলে ডাকেন না। কাউকে দুঃখ দিতে চাইলে বেশ ভালোভাবেই তা দিতে পারেন। নিজের নাটকে একবার এক বিশাল নাট্যব্যক্তিত্বের অভিনয় দেখে এত বিরক্ত হলেন, বললেন, ‘এটা কি অভিনয়? আরে, আপনি তো অভিনয়ই জানেন না।’ একবার তাঁর নুহাশপল্লীতে নাটকের রেকর্ডিংয়ে এসে সন্ধ্যার পর কয়েকজন অভিনেতা-অভিনেত্রী অন্য একটি ঘরে বসে হুমায়ূন আহমেদের তুমুল নিন্দামন্দ করছেন। তিনি তো আর তা জানেন না, খুবই উৎফুল্ল ভঙ্গিতে সেই ঘরের দিকে যাচ্ছেন। ঘরের কাছে গিয়েই শোনেন, এই অবস্থা। বাইরে দাঁড়িয়ে খানিক ওসব শুনে মন খারাপ করে ফিরে এলেন। সেই সব অভিনেতা-অভিনেত্রীকে বুঝতে দিলেন না কিছু। আবার পেটে কথাও রাখতে পারেন না। যদি বন্ধুদের কেউ কোনো গোপন কথা বলে বলল, কাউকে বলবেন না, সেটাই সবার আগে বলে ফেলবেন। পাগলের সাঁকো নাড়ানোর মতো।

 

ইমদাদুল হক মিলন : বাংলা ভাষার খুব জনপ্রিয় লেখক হচ্ছেন শরৎচন্দ্র, তারপর তারাশঙ্কর। কিন্তু যে অর্থে জনপ্রিয়তাকে আমাদের দেশে বিবেচনা করা হয়, এঁরা সেই স্তরের লেখক না এবং আমরা সেই সারিতে আপনাকে অনেক আগেই যুক্ত করেছি। আপনার কি মনে হয়?

হুমায়ূন আহমেদ : আমার কিছু মনে হয় না, মিলন। আমি এটা আগেও বলেছি। তবে শোনো, আমাদের দেশের লেখকদের ভাগ্য খুবই খারাপ। শুধু লেখালেখি করে আমাদের লেখকরা জীবিকা নির্বাহ করতে পারেন না। সেখানে আমার যে অবস্থানটা হয়েছে, মাঝেমধ্যে আমার কাছে খুবই বিস্ময়কর মনে হয়। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন অধ্যাপনা করি, মাসে ছয় হাজার-সাড়ে ছয় হাজার টাকা পাই, থাকি শহীদুল্লাহ হলে। হঠাৎ করে দেখলাম, লোকজন আমার বই পড়া শুরু করেছে। আমি কী করলাম? মাথা খারাপ থাকলে যা হয় আর কি! সব কিছু বাদ দিয়ে একটা গাড়ি কিনে ফেললাম।

ইমদাদুল হক মিলন : কিনলেন কি, ওটা তো ছিল একটা গিফট। ওটা আপনাকে উপহার দিয়ে গেল এক প্রকাশক। এ ধরনের ঘটনা বাংলা সাহিত্যে কোনো লেখকের ক্ষেত্রে কখনো ঘটেনি।

হুমায়ূন আহমেদ : এটা ইন্টারেস্টিং ঘটনা ছিল। কিন্তু ইন্টারেস্টিং ঘটনার এখানেই শেষ না। আট মাসের মাথায় আরো বেশি টাকা হয়ে গেল। আমি কিনে ফেললাম মাইক্রোবাস। আমার মাইক্রোবাসের তো তখন দরকার নেই। কেন কিনলাম? এটার কোনো লজিক্যাল কারণ থাকতে পারে? কোনো কারণ নেই, কিন্তু আমার গাড়ি রাখার জায়গা নেই। হলের ভেতরও তো জায়গা নেই। একটা ছোট গাড়ি, আবার একটা মাইক্রোবাস বাসার সামনে পড়ে থাকে। আমার দেখতে খুবই ভালো লাগে। মাঝেমধ্যে মাইক্রোবাসের দরজা খুলে রাতে মাইক্রোবাসে চুপচাপ গিয়ে বসা। এর চেয়ে হাস্যকর কিছু হতে পারে? একজন লেখকের পক্ষেই এ রকম হাস্যকর জিনিস করা সম্ভব। একজন লেখকের চারটি গাড়ি। একটা পর্যায়ে আমার গাড়ি ছিল চারটি। চারটি গাড়ির দরকার নেই আমার। কিন্তু ড্রাইভার আমার একটি। একটি লোক যে চারটি গাড়ি কিনবে তাঁর চারটি ড্রাইভার থাকবে বা তিনটি ড্রাইভার থাকবে। চারটি গাড়ি নিয়ে আমি বসে আছি, আমার ড্রাইভার কিন্তু একজন। চারটি গাড়ি কেন কিনলাম? এগুলো করার সুযোগ করে দিয়েছে আমার বইগুলো। আমার নানা ধরনের পাগলামি পূরণ করতে পারছি কী জন্য? মানুষজন আমার বই পড়ছে বলে। এই যে আমি সেন্ট মার্টিনে একটি বাড়ি কিনে রেখেছি, কেন? নুহাশপল্লী বানিয়ে রেখেছি, কেন?

ইমদাদুল হক মিলন : তার মানে, আপনার মনে হয় আপনার মধ্যে পাগলামি আছে?

হুমায়ূন আহমেদ : আমার মধ্যে পাগলামি আছে।

ইমদাদুল হক মিলন : এটা কি আপনার বাবার মধ্যেও ছিল? আমি যত দূর জানি, আপনার বাবা, আপনি ‘আমার ছেলেবেলা’ বইয়ে লিখেছিলেন যে তিনি এক মাসের বেতন পেয়ে একটি ঘোড়া কিনে নিয়ে এসেছিলেন।

হুমায়ূন আহমেদ : ঘোড়া কিনে এনেছিলেন, বেহালা কিনে এনেছিলেন।

ইমদাদুল হক মিলন : আপনার বাবার ঘোড়া কেনার সঙ্গে আপনার মাইক্রো কেনার কোনো যোগসূত্র আছে?

হুমায়ূন আহমেদ : ভালোই তো মিলিয়েছ। শুধু ঘোড়া না, বাবা তাঁর বেতনের টাকায় বেহালাও কিনেছিলেন। সেই সময় উনি বেতন পেতেন আশি টাকা। বেহালাটা কিনেছিলেন পঁচিশ টাকা দিয়ে। ওটা কেনা মানে ওই সময় বেতনের অনেকটাই চলে যাওয়া। খুবই দামি একটি বেহালা। এই বেহালাটা তিনি ওপরে উঠিয়ে রেখে দিলেন। আমাদের নাগালের বাইরে রেখে দিলেন। কী জন্য বেহালাটা কিনলেন? কোনো একসময় তিনি একজন ওস্তাদ পাবেন বেহালার, তখন তিনি শিখবেন। তাই আগে থেকে কিনে বসে আছেন। সেই ওস্তাদও পাওয়া গেল না। হয়তো বা পাওয়া গেল, শেখার পয়সাটা জোগাড় করতে পারলেন না। তাঁর বেহালা শেখা হলো না। একটা পর্যায়ে বেহালাটা তাকের ওপর থেকে নামিয়ে আমরা ভাইবোনরা কিছুক্ষণ পোঁ পোঁ করে বাজাতাম, তারপর উঠিয়ে রাখতাম, বাবা যাতে টের না পান।

ইমদাদুল হক মিলন : আপনার লেখালেখির মধ্যে পাঠকরা একধরনের পাগলামির প্রকাশ দেখতে পায়, এর কারণটা কী?

হুমায়ূন আহমেদ : মিলন, তুমি এখন আমাকে দিয়ে বলানোর চেষ্টা করছ যে আমি পাগল। পাগল বলেই লেখায় পাগলামি উঠে আসে। আচ্ছা, যাও আমি পাগল। কি, তুমি খুশি তো? আর বকবক করবে না। স্টপ।

ইমদাদুল হক মিলন : আপনি বললে স্টপ।

(ইন্টারভিউ বন্ধ হলো। হুমায়ূন আহমেদ তাঁর তোলা ফটোগ্রাফের স্তূপ নিয়ে বসলেন। একেকটা ছবি হাতে নিচ্ছেন এবং ব্যাখ্যা করছেন। আমি বললাম, আপনার ছবির চেয়ে ব্যাখ্যা সুন্দর। হুমায়ূন আহমেদ বললেন, যাও, তোমাকে আর ছবি দেখাব না।)

ইমদাদুল হক মিলন : লেখাপড়ার প্রসঙ্গে আসি। আপনি একবার বলেছিলেন আপনি লেখাপড়ায় মনোযোগী ছিলেন না।

হুমায়ূন আহমেদ : না, ছিলাম না। ছোটবেলায় একেবারেই ছিলাম না। পড়াশোনায় আমার মন বসে অনেক পরে। স্কুলের সব পরীক্ষায় টেনেটুনে পাস করতাম। ক্লাস সিঙ্ ে(চিটাগাং কলেজিয়েট স্কুল) ফেল করি। আমাদের ক্লাস টিচার বড়ুয়া স্যার আমার কান্নায় দ্রবীভূত হয়ে বিশেষ বিবেচনায় পাস করিয়ে দেন।

ইমদাদুল হক মিলন : পড়াশোনায় আপনার মন বসল কখন?

হুমায়ূন আহমেদ : তখন ক্লাস এইটে পড়ি। বৃত্তি পরীক্ষা হবে। ভালো ছাত্ররা বৃত্তি পরীক্ষার জন্য সিলেক্ট হয়েছে। তাদের বিশেষ যত্ন। ডাবল টিফিন পায়। যেহেতু বৃত্তি দিচ্ছে, তাদের ফাইনাল পরীক্ষাও দিতে হবে না। আমার খুব… [এখানে মজার একটা ঘটনা আছে, হুমায়ূন ভাইয়ের জবানিতে না, আমার মতো করে আমি ঘটনাটা লিখব]

ইমদাদুল হক মিলন : আপনার চাকরিজীবনের কথা বলুন। প্রথমেই কি ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে জয়েন করলেন?

হুমায়ূন আহমেদ : না। প্রথমে জয়েন করলাম ময়মনসিংহের অ্যাগ্রিকালচারাল ইউনিভার্সিটিতে। সেখানে মাস চার-পাঁচ মাস্টারি করার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিই।

ইমদাদুল হক মিলন : ময়মনসিংহের সময়টা আপনার কেমন কেটেছে?

হুমায়ূন আহমেদ : খুব খারাপ। যদিও ময়মনসিংহ আমার নিজের জেলা। ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে একটি বাসা ভাড়া করে থাকতাম। মনে হতো নির্বাসনে এসেছি। সহকর্মীদের কারো সঙ্গই পছন্দ হতো না। তাঁদের চিন্তাভাবনা স্থূল মনে হতো। তাঁদের দেখে মনে হতো তাঁদের জীবন ক্লাস নেওয়া এবং ক্লাস থেকে ফিরে দুপুরে খেয়ে ঘুমানোর মধ্যেই আটকে গেছে।

ইমদাদুল হক মিলন : আপনার সময় কাটত কিভাবে?

হুমায়ূন আহমেদ : ব্রহ্মপুত্র নদের পাড়ে হাঁটাহাঁটি করে। রাতে লিখতাম। ‘অচিনপুর’ নামের উপন্যাসটি ময়মনসিংহে লেখা শুরু করি।

ইমদাদুল হক মিলন : তার আগেই তো আপনার ‘নন্দিত নরকে’ ও ‘শঙ্খনীল কারাগার’ প্রকাশিত হয়ে গেছে।

হুমায়ূন আহমেদ : হ্যাঁ।

ইমদাদুল হক মিলন : আচ্ছা, এই যে ‘নন্দিত নরকে’ লেখা হলো একেবারে হঠাৎ করে। তার আগে ‘নন্দিত নরকে’তে একটা ভূমিকা ছিল, সোমেন চন্দরের একটা গল্প ‘ইঁদুর’ আপনাকে প্রভাবিত করেছিল_কিন্তু কথা সেটা না, কথা হলো ছেলেবেলায় পাঠ্যপুস্তকের বাইরে বই পড়ার অভ্যাসটা আপনার কিভাবে হলো?

হুমায়ূন আহমেদ : ভূমিকাটা ছিল ‘শঙ্খনীল কারাগারে’। আর বই পড়ার অভ্যাসের কথা বলছ? এই অভ্যাস পেয়েছি বাবার কাছ থেকে। তাঁর খুব পড়ার শখ ছিল। বাড়ি ভর্তি ছিল বইয়ে। তিনি লেখালেখিও করতেন। তাঁর একটি গল্পগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল। নাম ‘দীপ নেভা যার ঘরে’। তাঁর লেখা কলকাতার কিছু পত্রিকা, এ দেশের ‘দৈনিক আজাদ’-এ ছাপা হতো। লেখালেখি করে কলকাতার কোনো এক প্রতিষ্ঠান থেকে তিনি ‘সাহিত্য সুধাকর’ উপাধিও পেয়েছেন। সেই সময়ের লেখকরা নানা উপাধি পেতেন।

ইমদাদুল হক মিলন : আপনার ‘নন্দিত নরকে’ লেখা কি একেবারেই আচমকা? এর আগে আপনি কি কিছু লিখেছেন কখনো?

হুমায়ূন আহমেদ : কবিতা লিখেছি। ‘দৈনিক পাকিস্তান’ পত্রিকায় ছাপাও হয়েছে। তবে নিজের নামে লিখিনি। কবিতাগুলো আমার ছোট বোন মমতাজ আহমেদ শিখুর নামে পাঠাতাম। তার নামেই ছাপা হতো।

ইমদাদুল হক মিলন : ছোট বোনের নামে পাঠাতেন কেন? নিজের নামে নয় কেন?

হুমায়ূন আহমেদ : কবিতাগুলো তেমন সুবিধার ছিল না। পুরুষ কবির কবিতা হিসেবে চলে না। মহিলা কবির কবিতা হিসেবে চলতে পারে।

ইমদাদুল হক মিলন : মহিলাদের সৃষ্টিশীলতাকে আপনি কি ছোট করে দেখছেন না?

হুমায়ূন আহমেদ : মিলন, তুমি বাংলা ভাষার দশজন মহিলা কবির নাম বলো, যাঁরা পুরুষদের পাশে দাঁড়াতে পারেন।

ইমদাদুল হক মিলন : আপনার ছোট বোনের নামে প্রথম যে কবিতাটি ছাপা হয় তার নাম কী?

হুমায়ূন আহমেদ : দিতে পার একশ ফানুস এনে/আজন্ম সলজ্জ সাধ, একদিন আকাশে কিছু ফানুস উড়াই।

ইমদাদুল হক মিলন : এটা তো মুক্তিযুদ্ধের আগে?

হুমায়ূন আহমেদ : হ্যাঁ, মুক্তিযুদ্ধের আগে।

ইমদাদুল হক মিলন : তার পরে এভাবে ক’টা কবিতা পত্রিকায় ছাপানো হয়েছিল, আপনার মনে আছে?

হুমায়ূন আহমেদ : পাঁচটি কবিতা।

ইমদাদুল হক মিলন : তারপর আপনি উপন্যাস লিখলেন?

হুমায়ূন আহমেদ : নাহ্, উপন্যাসটা অনেক পরে…।

ইমদাদুল হক মিলন : উপন্যাসে আসার ঘটনাগুলো বলেন_এই ধরেন_কিভাবে শুরু, কিভাবে আইডিয়াটা এল মাথায়…

হুমায়ূন আহমেদ : প্রথমে তো আমি লিখলাম ‘শঙ্খনীল কারাগার’। যদিও প্রথমে এটা ছাপা হয়নি, কিন্তু উপন্যাস প্রথমে লেখা হয়েছিল ‘শৃঙ্খনীল কারাগার’। কিছুই করার ছিল না সেই সময়। আমার ঠিকমতো মনেও নেই। তবে এই উপন্যাসটা আমার বাবা পড়েছেন_এটা আমার জন্য খুবই আনন্দের একটা ঘটনা।

 

হুমায়ূন আহমেদের ভালো ছাত্র হয়ে ওঠার গল্পটা বলি।

গল্প না, ঘটনা। গল্পে কল্পনা থাকে, ঘটনায় থাকে সত্যতা। ছেলেবেলায় পড়াশোনায় খুবই খারাপ ছিলেন তিনি। আসলে পড়াশোনায় তাঁর মন বসত না। একেবারেই মনোযোগী ছিলেন না লেখাপড়ায়। স্কুলের পরীক্ষাগুলোয় টেনেটুনে, কায়ক্লেশে পাসটা করতেন। বাবার বদলির চাকরি। একেকবার একেক জেলায়। চিটাগাং কলেজিয়েট স্কুলে ক্লাস সিক্সে পড়ছেন। সে বছর পাসই করতে পারলেন না। ডাহা ফেল। ফেল করা মুখ নিয়ে বাড়ি ফিরবেন কী করে! ক্লাস টিচার বড়ুয়া স্যার। তাঁর কাছে গিয়ে কান্নাকাটি শুরু করলেন। ছাত্রের কান্না দেখে বড়ুয়া স্যারের হৃদয় দ্রবীভূত হলো। তিনি বিশেষ বিবেচনায় ক্লাস সেভেনে তুলে দিলেন। ওপরের ক্লাসে উঠে যেই কে সেই! অবস্থা আগের মতোই। পড়ায় মন বসে না।

মন বসল ক্লাস এইটে ওঠার পর।

স্কুল থেকে তখন খুবই সুস্বাদু, ভালো টিফিন দেওয়া হতো। সেই টিফিনের জন্য ব্যাপক লোভ ছিল বালক হুমায়ূন আহমেদের। এখানে ব্র্যাকেটে আরেকটা কথা বলে রাখি। হুমায়ূন আহমেদের ডাকনাম ‘বাচ্চু’। কবি শামসুর রাহমানেরও ডাকনাম ছিল ‘বাচ্চু’। পরে দুজনের কেউ এই নাম কখনো ব্যবহার করেননি। কাউকে বলতেনও না।

যা হোক, ক্লাস এইটে বৃত্তি পরীক্ষা হবে। ক্লাসের ভালো ছাত্রদের সিলেক্ট করা হয়েছে বৃত্তি পরীক্ষার জন্য। যারা সিলেক্ট হয়েছে, স্কুলে তাদের মহাসমাদর। স্যাররা খাতির করছেন, ছাত্ররা খাতির করছে। তাদের যত্ন-আত্তির অভাব নেই। যেহেতু বৃত্তি পরীক্ষা দিতে হবে, সেহেতু ফাইনাল পরীক্ষাও তাদের দিতে হবে না। আর যেটা সবচেয়ে আকর্ষণীয় ঘটনা সেটা হলো, ভালো ছাত্রদের টিফিন দেওয়া হবে ডাবল। সাধারণ ছাত্ররা যে টিফিন পাবে, ওরা পাবে তার দ্বিগুণ।

এই টিফিনের লোভটা ঢুকল হুমায়ূন আহমেদের মাথায়। যেমন করে হোক বৃত্তি পরীক্ষা তাঁকে দিতেই হবে। বৃত্তি পরীক্ষায় সিলেক্ট হলেই ডাবল টিফিন। তিনি ক্লাস টিচারের কাছে গিয়ে, হুমায়ূন আহমেদের ভাষায়, ‘ঘ্যানরঘ্যানর শুরু করলাম। রোজই স্যারকে ধরি আর করুণ মুখ করে কাঁদো কাঁদো গলায় বলি, স্যার, আমি বৃত্তি পরীক্ষা দেব।’

প্রথম দিন ক্লাসের খারাপ ছাত্রগুলোর একটি বৃত্তি পরীক্ষা দিতে চাইছে শুনে স্যার আকাশ থেকে পড়লেন। ‘বলিস কী, তুই দিবি বৃত্তি পরীক্ষা!’

_জি স্যার।

_আরে তুই তো ক্লাস সিক্সে ফেল করেছিলি। সেভেন থেকে এইটে উঠেছিস তাও দুটো না তিনটে সাবজেক্টে ফেল।

_তাও আমি স্যার বৃত্তি পরীক্ষা দেব।

_যা যা ভাগ।

স্যার ধমক দিয়ে বিদায় করলেন।

পরদিন আবার সেই ঘ্যানঘ্যানানি, ‘স্যার, আমি বৃত্তি পরীক্ষা দেব।’

আজ স্যার বিরক্ত হলেন আরো বেশি। পারলে মেরে ক্লাস থেকে বের করে দেন। হুমায়ূন আহমেদের করুণ কাঁদো কাঁদো মুখ দেখে মারলেন না। আগের দিনের মতোই ধমক দিয়ে থামালেন।

কিন্তু হুমায়ূন আহমেদ থামার জিনিস না। চান্স পেলেই স্যারকে ধরছেন, ‘আমি বৃত্তি পরীক্ষা দেব, স্যার। আপনি ব্যবস্থা করে দিন।’

একই ঘ্যানঘ্যানানি রোজ শুনতে শুনতে স্যার একদিন মহা বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘আয় আমার সঙ্গে।’

নিয়ে গেলেন হেডস্যারের রুমে, ‘স্যার, এই ছেলেটা বৃত্তি পরীক্ষা দিতে চায়।’

হেডস্যার অবাক, ‘বলেন কী!’

_জি স্যার।

_আরে ও তো সব সাবজেক্টে পাসই করতে পারে না, ও কী বৃত্তি পরীক্ষা দেবে? স্কুলের মান-ইজ্জত থাকবে না।

সারা জীবনই হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে বিচিত্র সব মানুষের দেখা হয়েছে। ওই স্যারটিও কিঞ্চিৎ বিচিত্র চরিত্রেরই ছিলেন। হেডস্যারকে বললেন, ‘তার পরও আপনি স্যার ওকে কনসিডার করেন। দেখা যাক কী হয়।’

সেই শিক্ষকের নাম আমার মনে পড়ছে না। হুমায়ূন ভাই বলেছিলেন, ‘ভুলে গেছি। স্মৃতি আজকাল কিছুটা প্রতারণাও করছে।’

তো, ক্লাস টিচারের কথা শুনে হেডস্যার হতভম্ব, ‘এসব আপনি কী বলছেন? এটা কী করে সম্ভব? স্কুলের মান-ইজ্জত সব যাবে।’

শেষ পর্যন্ত ওই স্যারের কারণেই হেডস্যার কনসিডার করলেন। ক্লাস এইটের একটি খারাপ ছাত্রও বৃত্তি পরীক্ষা দেবে_এমন ঘটনা চিটাগাং কলেজিয়েট স্কুলে কখনো ঘটেনি।

হুমায়ূন আহমেদ দারুণ খুশি। আরে, কিসের বৃত্তি পরীক্ষা, টিফিন ডাবল পাওয়া যাবে_এটাই হচ্ছে আসল ঘটনা।

পরদিন থেকে ভালো ছাত্রদের মতো ডাবল টিফিন পেতে লাগলেন। কিন্তু কপাল খারাপ, চার-পাঁচ দিনের মাথায় জলবসন্ত হয়ে গেল। জলবসন্ত নিয়ে স্কুলে যাওয়া যায় না, বাড়িতে শুয়ে থাকতে হয়। রাতের বেলা তো বটেই, দিনের বেলাও মশারি টানিয়ে রাখতে হয়। মাথার কাছে নিমের একটা ডাল রাখা হয়েছে। ডাল ভর্তি পাতা। নিমপাতা জলবসন্তের মহৌষধ। শরীর অবিরাম চুলকায়। তখন নিমপাতা শরীরে বুলিয়ে দিলে আরাম হয়।

কিন্তু মশারির তলার জীবন লেখকের ভালো লাগে না। ভাইবোনরা কেউ তাঁর সামনে আসেই না। জলবসন্ত ছোঁয়াচে রোগ। কাছে এলেই বা ছুঁলেই হবে। বাবা চাকরি নিয়ে ব্যস্ত, মা সংসার নিয়ে। বালক হুমায়ূন আহমেদ মশারির তলায় একা একা ছটফট করেন। সময় আর কাটে না। ওদিকে বৃত্তি পরীক্ষার মাস দেড়-দুয়েক বাকি।

একদিন মনে হলো, আচ্ছা, ক্লাসের বইগুলো একটু পড়ে দেখি তো! কিছু হোক আর না হোক, সময়টা তো কাটবে।

জলবসন্ত ভরা শরীরে মশারির তলায় সময় কাটানোর জন্য ক্লাসের বইগুলো পড়তে শুরু করলেন, অঙ্কগুলো একা একাই করতে লাগলেন। লেখাপড়ার আশ্চর্য এক নেশা ধরে গেল। ধীরে ধীরে জলবসন্ত সারল। বৃত্তি পরীক্ষার দিন এসে গেল। পরীক্ষা দিলেন। ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেলেন। স্কুলের ভালো ছাত্র যারা তাঁর সঙ্গে পরীক্ষা দিয়েছিল, তারা কেউ তাঁর ধারেকাছেও নেই। সবাইকে পেছনে ফেলে হুমায়ূন আহমেদ নাম্বার ওয়ান!

শুরু হলো হুমায়ূন আহমেদের ভালো ছাত্রের জীবন। এসএসসিতে স্ট্যান্ড করলেন, এইচএসসিতে স্ট্যান্ড করলেন। ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে কেমিস্ট্রিতে ভর্তি হলেন, তুখোড় রেজাল্ট। ডক্টরেট করতে গেলেন আমেরিকার নর্থ ডাকোটা ইউনিভার্সিটিতে। অলথ্রু এ ক্যাটাগরির স্টুডেন্ট। শিক্ষকতার জীবন শুরু করলেন ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে। তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচারার। অধ্যাপক হয়ে ডক্টর হুমায়ূন আহমেদ শিক্ষকতা ছেড়ে দিলেন। তত দিনে সাহিত্যজগতে তিনি কিংবদন্তি হয়ে গেছেন।

কিন্তু ক্লাসের খারাপ ছাত্রটি বৃত্তি পরীক্ষায় সবচেয়ে ভালো করেছে, স্কুলে হৈচৈ পড়ে গেছে। সেই টিচার পারলে হুমায়ূন আহমেদকে কোলে নিয়ে হেডস্যারের রুমে চলে যান। ছাত্রের ভালো রেজাল্টের গৌরবে স্কুলে তাঁর পজিশনও হাই হয়ে গেছে।

ক্লাস নাইনে ঘটল আরেক ঘটনা।

জেনারেল ম্যাথের টিচার হুমায়ূন আহমেদের খাতা দেখতে দেখতে এতটাই মুগ্ধ হয়ে গেছেন, ১০০ নম্বরের জায়গায় ১১০ নম্বর দিয়ে দিয়েছেন।

আজব ব্যাপার!

হেডস্যার অঙ্কের টিচারকে ডেকে পাঠালেন। এটা আপনি কী করেছেন? ১০০ নম্বরের জায়গায় ১১০? অঙ্কের টিচার খেপে গেলেন। ছেলেটা অঙ্কে এত ভালো, আমার ইচ্ছা আমি তাকে ১০০-র মধ্যে ১১০ দিয়েছি। আপনার কোনো অসুবিধা আছে?

হেডস্যার হতভম্ব। এ দেখি অদ্ভুত চরিত্র!

নিশ্চয় জীবনের এসব অভিজ্ঞতা থেকেই হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস-গল্প-নাটকে অদ্ভুত সব চরিত্রের সমাবেশ ঘটান। তাঁর অভিজ্ঞতা এবং দেখার ভঙ্গি অন্য কারো সঙ্গে মেলে না।

এসব ঘটনা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন আড্ডায় হুমায়ূন ভাই মজা করে বলেছেন। আমি আমার স্মৃতি থেকে লিখছি।

হুমায়ূন ভাইয়ের ভয় পাওয়া নিয়ে এবার নিজের একটা অভিজ্ঞতার কথা বলি।

১৯৮৫-৮৬ সালের কথা। বিটিভিতে চলছে হুমায়ূন আহমেদের দেশ-কাঁপানো ধারাবাহিক ‘এইসব দিনরাত্রি’। প্রযোজক মুস্তাফিজুর রহমান। সেই নাটক নিয়ে চারদিকে চলছে তুমুল আলোচনা। নাটকের ছোট্ট মেয়ে টুনি, তার ব্লাড ক্যান্সার। দর্শক আতঙ্কে আছে টুনির মৃত্যু নিয়ে। ওই প্রথম বাংলাদেশ টেলিভিশনের কোনো ধারাবাহিক নিয়ে দৈনিক পত্রিকায় পোস্ট এডিটরিয়াল পর্যন্ত লেখা হলো। টুনিকে যেন মেরে ফেলা না হয়। কোনো কোনো সাপ্তাহিক পত্রিকা কাভার স্টোরি করেছে।

নাটক যখন তুঙ্গে, তখন এক সন্ধ্যায় আমাকে নিয়ে হুমায়ূন ভাই গেছেন মুস্তাফিজ ভাইয়ের ফ্ল্যাটে। তিনি তখন নিউ মার্কেটের দক্ষিণ দিককার সরকারি কোয়ার্টারে থাকেন। প্রায়ই আমাকে নিয়ে হুমায়ূন ভাই তাঁর ফ্ল্যাটে যান। খাওয়াদাওয়া, গল্প-আড্ডা আর নাটক নিয়ে নানা ধরনের আলাপ-আলোচনা। আড্ডা শেষ করে হুমায়ূন ভাই ফিরে যান তাঁর আজিমপুরের বাসায়, আমি চলে যাই গেণ্ডারিয়ায়।

ও রকম এক সন্ধ্যার ঘটনা।

সিঁড়ি ভেঙে আমরা দুজন মুস্তাফিজ ভাইয়ের ফ্ল্যাটের দরজায় এসে দাঁড়িয়েছি। সরকারি পুরনো আমলের ফ্ল্যাট। দরজাগুলো পুরনো। দরজার মাথার ওপর পুরনো আমলের কলিংবেলের সুইচ। সিঁড়িতে টিমটিম করে জ্বলছে অল্প পাওয়ারের একটা বাল্ব। হুমায়ূন ভাই আনমনা ভঙ্গিতে কলিংবেলের সুইচে হাত দিতে গিয়েই ‘উরে বাবা রে’ বলে একলাফে সরে এলেন।

আমি কিছুই বুঝতে পারিনি। ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলাম। প্রথমে মনে হলো পুরনো কলিংবেল, তারফারে লিকটিক হয়ে আছে কি না! হুমায়ূন ভাই কি ইলেকট্রিক শক খেলেন!

আমি খুবই নার্ভাস ভঙ্গিতে তাঁর হাত ধরলাম। কী হলো, হুমায়ূন ভাই?

তিনি কোনো রকমে বললেন, ‘মাকড়সা।’

_মাকড়সা?

_হ্যাঁ।

তিনি রীতিমতো কাঁপছেন। তাকিয়ে দেখি, কলিংবেলের সুইচের ওখানে মাঝারি সাইজের একটা মাকড়সা।

মাকড়সাকে এ রকম ভয়?

সত্যি তা-ই। হুমায়ূন ভাই সবচেয়ে ভয় পান মাকড়সা। তাঁর ভাইবোনরাও কেউ কেউ মাকড়সাকে খুবই ভয় পান।

সেদিন মাকড়সার ভয়ে মুস্তাফিজ ভাইয়ের ফ্ল্যাটে তিনি আর স্বাভাবিকই হতে পারলেন না। দ্রুত আড্ডা শেষ করে আমরা ফিরে এলাম। আমরা তখন প্রায়ই বাংলাবাজারে পাবলিশারদের ওখানে গিয়ে চা-বিস্কুট খাই আর আড্ডা দিই। রয়ালটির টাকা-পয়সার জন্যও যাই কোনো কোনো দিন। আমার অবস্থা তখন খুবই খারাপ। হুমায়ূন ভাই ইউনিভার্সিটির টিচার। তাঁর একটা বাঁধা রোজগার আছে। আমার নেই কিছুই। হুমায়ূন ভাইয়ের কাছ থেকে পঞ্চাশ-এক শ টাকা ধারও নিই। সেই ধার কোনোদিন শোধ করি না। একদিন দুপুরের দিকে বাংলাবাজার থেকে রিকশায় করে যাচ্ছি তাঁর শহীদুল্লাহ হলের কোয়ার্টারে। বাহাদুর শাহ্ পার্কের ওখানে দেখি এক পাখিওয়ালা খাঁচায় করে মুনিয়া পাখি বিক্রি করছে। আমরা রয়ালটির কিছু টাকা পেয়েছি। খাঁচাসহ হুমায়ূন ভাই তিন জোড়া মুনিয়া পাখি কিনে ফেললেন।

ঢাকায় তখন ট্রাফিক জ্যাম বলতে কিচ্ছু নেই। আমরা রিকশায় করে ইউনিভার্সিটি এলাকার দিকে যাচ্ছি। যেতে যেতে দুজনে মিলে একটা বিজনেসের প্ল্যান করে ফেললাম। আমাদের সেই ব্যবসার প্ল্যান ইত্যাদির কথা পরে বলব। এবার আসুন আমাদের দুজনার কথোপকথন বা আমার নেওয়া হুমায়ূন আহমেদের সাক্ষাৎকারের পরের অংশে নিয়ে যাই আপনাদের।

 

হুমায়ূন আহমেদের সাক্ষাৎকার

ইমদাদুল হক মিলন : মানে, আপনার হাতে লেখা কপিটাই পড়েছেন?

হুমায়ূন আহমেদ : হ্যাঁ।

ইমদাদুল হক মিলন : পড়ে কী বললেন?

হুমায়ূন আহমেদ : আমাকে কিছু বললেন না। বাবার সঙ্গে আমাদের ভাইবোনদের দূরত্ব ছিল। বাবা সরাসরি আমাদের কিছু বলতেন না। ভায়া মিডিয়া কথা বলতেন। তাঁর যা বলার তিনি মাকে বলতেন, মা আমাদের বলতেন।

ইমদাদুল হক মিলন : তিনি আপনার মাকে কী বললেন?

হুমায়ূন আহমেদ : পৃথিবীর সব বাবাই সন্তানদের সামান্য প্রতিভায়ই মুগ্ধ হন। তিনিও হয়েছিলেন। তাঁর মুগ্ধতা যে উঁচু পর্যায়ে ছিল, তার প্রমাণ পেলাম কিছুদিন পর। তিনি তখন একটা রেডিও নাটক লিখে শেষ করেছেন। নাম ‘কত তারা আকাশে’। হঠাৎ সেই নাটকের পাণ্ডুলিপি আমার হাতে দিয়ে বললেন, তুই তোর মতো করে ঠিকঠাক করে দে।

আমি আমার একজীবনে অনেক সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছি_ওই দিনের সাহিত্য পুরস্কার সব পুরস্কারের ওপরে।

মিলন, আজ আর না। অনেক বকবক করেছি।

ইমদাদুল হক মিলন : ঠিক আছে, আজ এ পর্যন্তই।

সেদিনের মতো আমরা থেমে গেলাম। তারপর একে একে বন্ধুরা এলেন, আলমগির রহমান, আর্কিটেক্ট করিম, অন্যদিন গ্রুপের প্রধান মাজহারুল ইসলাম, মাসুম রহমান, কমল_শুরু হয়ে গেল আমাদের আড্ডা। প্রিয় পাঠক, ঘটনা ২০০৬ সালের, অন্যদিন পত্রিকার জন্য হুমায়ূন ভাইয়ের সাক্ষাৎকার নিচ্ছিলাম আমি। এই সেই সাক্ষাৎকার, যা কয়েক পর্বে ছাপা হয়েছিল অন্যদিনে। এবার আমার নিজের স্মৃতিচারণাসহ সেই সাক্ষাৎকার নতুন আঙ্গিকে শিলালিপিতে ছাপা হচ্ছে। কয়েক দিন পর আরেক সন্ধ্যায় আমি তাঁর সাক্ষাৎকার নিতে বসলাম।

ইমদাদুল হক মিলন : আমরা কথা বলছিলাম আপনার আমেরিকা যাওয়া প্রসঙ্গে। আপনার চারটি বই বের হলো, আপনি আমেরিকায় চলে গেলেন। আমেরিকায় তো আপনি ছয় বছর ছিলেন একটানা। নোভা, শীলা_দুজনেরই কি জন্ম হয়েছে ওখানে?

হুমায়ূন আহমেদ : নোভা দেশেই হয়েছে। শিলার জন্ম হয়েছে ওখানে।

ইমদাদুল হক মিলন : ছয় বছর আপনি কিছু লেখেননি?

হুমায়ূন আহমেদ : না। ওখানে পড়াশোনার চাপ এত বেশি ছিল, লেখালেখির বিষয়টা মাথায়ই ছিল না। তা ছাড়া তখন বিদেশে আমাদের প্রথম সংসার, জানি না কিছু, নোভার মাও তো খুবই বাচ্চা মেয়ে, সেও তো কিছু জানে না। সংসার চালানো এবং পড়াশোনার বাইরে কিছু করার সুযোগ ছিল না। অবসর কাটত টিভি দেখে।

ইমদাদুল হক মিলন : আর এমনিতে সাহিত্যের পড়াশোনা?

হুমায়ূন আহমেদ : সাহিত্যের পড়াশোনা মানে কি গল্প-উপন্যাস? গল্প-উপন্যাস একটা বয়স পর্যন্ত পাগলের মতো পড়েছি। তারপর সেই পাঠকের মৃত্যু হয়েছে। অন্য সব বিষয় পড়ার আগ্রহ তৈরি হয়েছে। বিষয় কী তোমাকে বলব না। তুমি আমাকে বুদ্ধিজীবী ভেবে বসতে পারো।

আমার পছন্দের বইপত্র পড়ার সুযোগ আমেরিকায় ছিল। ইউনিভার্সিটির বিশাল লাইব্রেরি। লাইব্রেরি ভর্তি বই। তবে আমার সময় ছিল না। গাদা গাদা বই লাইব্রেরি থেকে নিয়ে আসতাম, এক সপ্তাহ পর না পড়েই ফেরত দিতাম। পড়াশোনাটা করতাম, মাঝেমধ্যে, যখন সামারে ছুটি হতো। এত পয়সা-কড়ি তো ছিল না যে পুরো সামার বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে ঘুরব। পছন্দের পড়াশোনা বা গল্পের বই যা পড়ার ওই সময়ই পড়তাম। ওই সময় পাঠ্যবই খুলে দেখেছি বলে মনে পড়ে না।

ইমদাদুল হক মিলন : আচ্ছা, আপনি যে আমেরিকায় পড়লেন ‘পলিমার কেমিস্ট্রি’, ওই বিষয়ে কি আপনি লেখালেখি করেননি? বা থিসিসটা কি বের হয়নি বই হয়ে?

হুমায়ূন আহমেদ : বিজ্ঞানের ওপর বিদেশে যে কাজগুলো হয় ওগুলোর থিসিস পাবলিশড হয় না, থিসিস থেকে পেপার পাবলিশড হয় বিদেশি জার্নালগুলোতে। আমার ২৫টির মতো পেপার ইন্টারন্যাশনাল জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। থিসিসের কাজ এবং পরে পোস্ট ডক করার সময়ের কাজ নিয়ে।

ইমদাদুল হক মিলন : আমেরিকা থেকে আপনি ফিরে এলেন ‘৮৪-র দিকে বোধ হয়? তার আগে, মাত্র চারটি বই লিখে বাংলা একাডেমী পুরস্কার পেয়েছেন। এটা একটা অবিস্মরণীয় ঘটনা আমার কাছে। আপনি ফিরে এসে আবার লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত হওয়ার কথা ভাবলেন কী করে? তখন তো আপনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেছেন, আপনার সংসারটা বড় হয়েছে।

হুমায়ূন আহমেদ : হয়তো লেখালেখির বিষয়টা ভেতরে ছিল সব সময়। যদি ভেতরে থাকে তাহলে লেখালেখি বিষয়টা মাথার গভীরে এক ধরনের চাপ দিতেই থাকে। এই চাপটা একটা কারণ হতে পারে। দেশে ফিরে এসেছি, বিশ্ববিদ্যালয়ে জয়েন করেছি। আবার আমি যে একজন লেখকও, ওটাও তো মাথায় ছিল।

ইমদাদুল হক মিলন : লেখালেখির ক্ষেত্রে বড় গ্যাপ পড়লে একটা অস্বস্তি তৈরি হয়। আপনার সে অস্বস্তিটা কি তৈরি হয়েছিল যে এত দিন পর আমি আবার শুরু করলাম!

হুমায়ূন আহমেদ : এটা আসলে মনে করতে পারছি না। মনে হয় না ছিল। কারণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে যাঁরা লেখালেখি করেন, তাঁরা এগুলো নিয়ে মাথা ঘামান না। অনেক দিন লিখিনি তাতে কী হয়েছে? আবার লিখব। ইচ্ছা না করলে আবার বন্ধ করে দেব।

ইমদাদুল হক মিলন : কিন্তু এই স্বতঃস্ফূর্ততা কি আপনার প্রথম থেকে ছিল, নাকি আস্তে আস্তে…?

হুমায়ূন আহমেদ : না। আমার মনে হয় এটা শুরু থেকেই ছিল। মাঝেমধ্যে এটা একটু কেটে গেছে, এটা বলতে পারো। কিছু কিছু লেখার ক্ষেত্রে খুবই চিন্তাভাবনা করে লাইনগুলো লিখতে হয়েছে। একটা লাইন লিখে দ্বিতীয় লাইনটির জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে। দ্বিতীয় লাইন আসি আসি করছে, আসছে না_এই অবস্থা।

ইমদাদুল হক মিলন : নাটকের দিকটায় আপনি যে গেলেন, সেই প্রসঙ্গটায় আমি একটু পরে আসছি। এই যে দেশের বাইরে থেকে ফিরেই একটার পর একটা বই আপনি লিখতে থাকলেন, নাটক তো আরো পরে ‘৮৫-র দিকে। ‘৮৫-তে আপনি ‘এইসব দিনরাত্রি’ শুরু করেছিলেন। আমার মনে আছে। কিন্তু এই যে একটার পর একটা লেখা, পাঠককে মন্ত্রমুগ্ধ করা, এই যে এই অবস্থাটা তৈরি হলো, আপনার কী মনে হয়, এর পেছনে রহস্যটা কী?

হুমায়ূন আহমেদ : এই অবস্থা যে তৈরি হয়েছিল, এই বিষয়টার একটা নরমাল আর একটা আদিভৌতিক ব্যাখ্যা আছে।

ইমদাদুল হক মিলন : আপনি বলেন, আমরা দুটোই শুনি।

হুমায়ূন আহমেদ : নরমাল ব্যাখ্যা হলো, আমি নাটক লেখা শুরু করলাম। আমাদের দেশে নাটকের দর্শক তো অনেক বেশি। ‘এইসব দিনরাত্রি’ বহু লোক দেখা শুরু করল এবং এরা মনে করল এই যে লোকটি নাটক লিখছে, তার একটা বই পড়ে দেখি না কেন! তারা বই কিনতে শুরু করল। পাঠকদের আমার বইয়ের প্রতি আগ্রহী হওয়ার পেছনে ‘এইসব দিনরাত্রি’ নাটকটা কাজ করেছে বলে আমার নিজের ধারণা। একজন নতুন লেখক লিখবে আর সঙ্গে সঙ্গেই তার বই বিক্রি হবে_এটা তো হওয়ার কথা না। আমার ধারণা, আমার নাটক দেখে লোকজন আগ্রহী হয়েছে, একটা বই পড়ে হয়তো সেকেন্ড বই পড়তে চেয়েছে_এটা হতে পারে।

আর আদিভৌতিক ব্যাখ্যা যেটা হলো_শহীদুল্লাহ হলে যখন থাকি, তখন একসঙ্গে প্রকাশকদের কাছ থেকে আমি হঠাৎ কিছু বড় অঙ্কের টাকা পেয়ে গেলাম। ২৫-৩০ হাজার টাকা। সেই সময় ২৫-৩০ হাজার টাকা অনেক টাকা। বই বিক্রির টাকা। তখনো বই লেখা বাবদ অ্যাডভান্স দেওয়া শুরু হয়নি। যেহেতু টাকা পেয়েছি, আমার হাত খুব উশখুশ করছিল টাকাটা খরচ করার জন্য। কাজেই করলাম কি, স্ত্রী এবং বাচ্চাদের নিয়ে গেলাম ইন্ডিয়ায়। এই টাকা শেষ না হওয়া পর্যন্ত দেশভ্রমণ হবে_এই হলো পরিকল্পনা। প্রথমে গেলাম নেপালে, নেপাল থেকে দিলি্ল। ভাবলাম, এত কাছে যখন এলাম, মরুভূমি দেখে যাই। জয়সলমীরের উদ্দেশে রওনা দিলাম। জয়সলমীরের পথে পড়ল আজমীর শরিফ। এত নাম শুনেছি_পথে যখন পড়লই, তখন ভাবলাম যে আজমীর শরিফ দেখে যাই। আজমীর শরিফ গেলাম। আমার সবচেয়ে ছোট মেয়েটি, বিপাশা, সে খুবই বিরক্ত হয়ে গেল; বলল_কোথায় নিয়ে এলে? চারদিকে ফকির। ফকিরে ভর্তি জায়গাটি। বিপাশার বয়স তখন তিন-সাড়ে তিন; আমি তাকে বোঝালাম যে এখানে একজন অতি বড় সাধু মানুষের কবর আছে। এখানে এলে আল্লাহর কাছে যা চাওয়া যায়, তা পাওয়া যায়। দেখা গেল যে এই কথা শুনে মানসিকভাবে সে স্বস্তি বোধ করল। তখন তাকে নিয়ে গেলাম কবর জিয়ারত করতে, জিয়ারত শেষ করে চলে আসব, দেখি বিপাশা দাঁড়িয়ে। ব্যাপার কী? বিপাশা বলল, ‘আমি যেটা চেয়েছি, সেটা তো পাইনি। না পেলে যাব না।’ আমি বললাম, মা, তুমি কী চেয়েছ? বিপাশা বলল, ‘আল্লাহর কাছে আমি এক হাজার বস্তা টাকা চেয়েছি। এই টাকা না পাওয়া পর্যন্ত এখান থেকে আমি যাব না।’ কবরস্থানের পাশে রেলিংটা ধরে সে ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। আমি ও তার মা তাকে নিয়ে টানাটানি করতে লাগলাম। না, সে এ জায়গা ছেড়ে নড়বে না। এদিকে বাংলাভাষী কিছু লোক ছিল, তারা খুবই মজা পেয়ে গেল। একটি মেয়ে এক হাজার বস্তা টাকা আল্লাহর কাছে চাইছে, না পাওয়া পর্যন্ত সে যাবে না_এটা তো মজার বিষয়ই। তখন বিপাশাকে বোঝালাম যে এখন টাকাটা পেলে বরং সমস্যা হবে। এত টাকা দেশে নিয়ে যেতে হবে। কান্নাকাটি না করে চলো দেশে যাই। দেশে গেলে টাকাটা পেয়ে যাবে। অবশ্যই পাবে। আমরা দেশে ফিরে এলাম। আসার পরপরই জলের মতো হু হু করে টাকা আসতে লাগল। কেউ যখন আমাকে জিজ্ঞেস করে, লেখালেখি করে বিপুল অর্থ উপার্জন আপনি কিভাবে করলেন? আমি বলি, আমার ছোট মেয়ে বিপাশার কারণে করেছি_এখানে আমার কোনো হাত নেই।

ইমদাদুল হক মিলন : আপনি যে ঘটনা বললেন, এটি সত্যি মনে রাখার মতোই ঘটনা। আপনি কি অলৌকিক শক্তিতে বিশ্বাসী?

হুমায়ূন আহমেদ : না। পৃথিবী লজিকে চলে। মিরাকল পৃথিবীর চালিকাশক্তি নয়।

ইমদাদুল হক মিলন : কিন্তু আপনি তো প্রায়ই মাজারে যান। সিলেটে গেলেই শাহজালাল সাহেবের মাজার জিয়ারত করেন।

হুমায়ূন আহমেদ : মহাপুরুষদের মাজার জিয়ারত করা মানেই কিন্তু অলৌকিকে বিশ্বাস স্থাপন না। শাহজালাল, শাহ মখদুম, শাহ পরান_এঁরা সবাই উঁচু শ্রেণীর সুফি মানুষ। সব কিছু ছেড়েছুড়ে মানুষের কল্যাণের জন্য এ দেশে এসেছেন। ধর্মীয় কাজকর্মের পরও তাঁরা পুরো জীবন ব্যয় করেছেন সাধারণ মানুষের কল্যাণের জন্য। তাঁরা তো মহাপুরুষ পর্যায়ের মানুষ। আমরা যদি অন্য কোনো বিখ্যাত ব্যক্তির কবরস্থানে যাই তাঁকে সম্মান দেখানোর জন্য_আমরা এঁদের কাছে যাব না কেন? একটু চিন্তা করে দেখো, কোথায় কোন দেশ থেকে কত জায়গা ঘুরে তাঁরা বাংলাদেশে এসেছেন। তাঁদের ত্যাগটা দেখো না! তাঁদের কষ্টটা দেখো না। তা ছাড়া মুসলমান পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছি, ইসলামী ভাবধারায় বড় হয়েছি, ছোটবেলা থেকে মা-বাবাকে দেখেছি_তাঁরা নামাজ পড়ছেন, সকালবেলা ঘুম ভেঙেছে আমার মায়ের কোরআন তিলাওয়াত শুনে। এটা তো ব্রেনের মধ্যে ঢুকে যায়।