
হৃদয় ছোঁয়ার দিন
উপন্যাস ৪
সাজ্জাদ হায়দারপ্রকাশিত : ডিসেম্বর ৩০, ২০১৯
উল্কা এক্সপ্রেস আসছে। পেছনে চট্টগ্রাম মেইল ট্রেন। উল্কার মুখে ভটভট শব্দ। চট্টগ্রাম মেইল স্পীড বাড়ালো। সুতরাং ওর মুখ দিয়ে প্যাপ্যা শব্দে হুইসেল বাজল। কিন্তু উল্কা ওকে জায়গা ছেড়ে দিতে নারাজ। চট্টগ্রাম ধাক্কা দিল উল্কাকে। উল্কা ছিটকে পড়ল বালির ঢিবির ওপর। পরক্ষণে উঠে দাঁড়িয়ে চট্টগ্রাম মেইলের উপর ঝাপিয়ে পড়ল। শুরু হলো ইমু আর টিমু দুভাইয়ের লড়াই। টিমুর গায়ে শক্তি বেশি। আর ইমুর আছে লম্বা লম্বা নখ। লাইন্সম্যানের মনটা খারাপ হয়ে যায়। রেলগাড়ি রেলগাড়ি খেলাটা জমতে না জমতেই শুরু হলো ঝামেলা। দু’ভাইকে ছাড়ানোর জন্য ছুটে গেল। দু’ভাই এখন মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। ইমুর আঁচড় লাগছে বাবুর গায়ে। অন্যদিকে লাগল টিমুর ঘুষি। বাবু সরে দাঁড়ালো। পরমুহূর্তে ইমু রণে ভংগ দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি মুখো হলো। এখন নিশ্চয়ই লাঠি নিয়ে মামা চলে আসবে। টিমু সরে পড়েছে। এখন বাবুর আর কিছু করার নেই। রেলগাড়ি রেলগাড়ি খেলা আর হবে না। এখন বাবুকে নতুন একটা খেলা খুঁজে বের করতে হবে। নতুন খেলা নিয়ে ভাবার জন্য বাবু বালুর ঢিবির ওপর বসলো।
অ্যারোপ্লেন অ্যারোপ্লেন খেলা বেশ মজা। টিমু আর ইমু দুজনেই পাইলট হতে চায়। বড় হলে ওরা নাকি বোয়িং ১৪৭ চালাবে। বাবু ভাবছে অন্য কথা। বোয়িং বিমান চালানো কি এমন কঠিন! স্টিমার চালানো ঢের মজার! বাবু বড় হয়ে স্টিমামের সারেং হবে। স্টিমার চালিয়ে বরিশাল থেকে ঢাকায় আসাটা কতই না মজার! কত কিছু দেখা যায়। নদী, নৌকা, আরও কত কি! বাবু দেখেছে, স্টিমার যখন চলতে শুরু করে তখনই হঠাৎ করে নদীর দুপাড়ের গাছপালা, ঘরবাড়ি, নদীর তীরের ঘাস খেতে থাকা গরু সব কেমন পেছনে চলতে থাকে। স্টিমারের পাখা পানি কেটে যে বিপুল স্রোত তৈরি করে সেই স্রোতের দিকে তাকালে হঠাৎ করেই বোঝা যায়, স্টিমারটাই চলছে। আরও ম্যাজিক আছে স্টিমারের। সোজা সামনের দিকে তাকালে দূরে দেখা যায় সবুজ রেখা। আরও কাছে গেলে মনে হয়, সবুজ যেন দুদিক সরে গিয়ে পথ করে দিয়েছে স্টিমারকে। ব্যাপারটা ধাঁধার মতো মনে হয় বাবুর কাছে। এছাড়া রাতের বেলা স্টিমারের সার্চ লাইট আলো ফেলে পথ খোঁজে। আর স্টিমারকে পথ দেখাতে নদীর পাড়ে ক্ষণে ক্ষণে আলো জ্বলে। বাবু জানে, এ আলোটাকে বলে সিগ্যনাল।
কিন্তু ভেবে পায় না, কে এই আলো জ্বালিয়ে স্টিমারকে পথ দেখায়! কেনই বা দেখায়? আবার স্টিমারে চড়লে সারেংয়ের কাছ থেকে ব্যাপারটা জেনে নিতে হবে। স্টিমারের কথা মনে হলে বাবুর মনে পড়ে বরিশালের কথা। অনেক দিন ধরে ওরা ঢাকায়, এখানে বাবুর খুব ভালো লাগে। নানাবাড়িতে কত লোক আসে। ইমু, টিমু ছাড়াও কত বন্ধু! এখানে রাত হলেও কখনো ভয় করে না। আর বরিশালে সন্ধ্যা হলেই যত ভয় ভর করত। বরিশালে ওদের বাড়িতে আছে বিরাট শিমুল তুলার গাছ। সেই গাছে ভূত থাকে। রাতে বাবু ভুলেও ওই গাছের দিক তাকায় না। বরিশালের কাজের বুয়ার ছেলে জাকির বলেছে, ভূতটা নাকি প্রতি বছর কম হলেও একটা বাচ্চা ছেলের মাথা চিবিয়ে খায়। ভূত ছাড়াও বরিশালে একটা ভয়ংকর রাক্ষস থাকে। রাক্ষসটা একটা মেয়ে মানুষের বেশ ধরে থাকে। বাচ্চাদের ভুলিয়ে-ভালিয়ে দূরে কোথাও ধরে নিয়ে যায়। তারপর ইট দিয়ে বাচ্চাটার মাথা ফাটিয়ে রক্ত বের করে খায়। এ কথাটাও জাকির বলেছে। বাবু ভেবেছিল, রাক্ষসটার কথা বড়দের কাউকে বলবে। কিন্তু বাবুর ধারণা, বড়রা এসব বিশ্বাসই করতে চাইবে না। তবে ছটটু চাচা বিশ্বাস করতে পারে।
ছটটু চাচা বাবুকে খুব আদর করে। জাকির বলেছে, ছটটু চাচা খুব সাহসী। ছটটু চাচা নাকি বোমা ছুঁড়তে পারে। এজন্য চাচাকে পুলিশ খুঁজছে। তবে চাচাকে পাওয়া এত সোজা নয়। চাচা নাকি ভ্যানিস হয়ে যায়। বাবা একদিন গোপনে মাকে বলেছে, ছটটু চাচা নাকি ঢাকা আছে। এ বাড়িতে আসতে পারে। সেই থেকে বাবু ঠিক করেছে, যদি চাচা আসে তবে ব্যপারটা তাকে বলবে। বরিশালে বাবু নেই ঠিকই, কিন্তু জাকির আছে। রাক্ষসটা তো জাকিরকে মেকে ফেলতে পারে! বালির উপর বসে, এসব ভাবতে ভাবতে বাবু দেখল, টিমু এদিকেই আসছে।
বাবু ঠিক করল, এখনই স্টিমার স্টিমার খেলাটা শুরু করবে। বাবু টিমুকে ব্যাপারটা বলতে যাবে ঠিক এ সময় একটা শোরগোল শোনা গেল ঠিক বড় রাস্তা থেকে। টিমু দুহাত মুঠো করে সামনের দিকে হাত বাড়িয়ে দিল। মুষ্টিবদ্ধ হাতের মুঠি ওপরে নিচে ঘুরছে। টিমু মুখ দিয়ে তাকিয়ে ইঙ্গিত করছে। মানে, এখনই বাবুকে মটরসাইকেল হতে হবে।
মটরসাইকেল হয়ে দুজনেই বড় রাস্তায় এলো। ওরা দেখল, অনেকগুলো লোক মিছিল করছে। বাবুর মাথার নতুন আইডিয়া এলো। এখন থেকে মিছিল মিছিল খেলতে হবে। এক সময় মিছিলটা ওদের চোখের সামনে থেকে হারিয়ে গেল। তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা মেঘনা যমুনা, এ শ্লোগান বাবুর মনে গেথে রইল। চলবে