হৃদয় ছোঁয়ার দিন

উপন্যাস ৫

সাজ্জাদ হায়দার

প্রকাশিত : ডিসেম্বর ৩১, ২০১৯

কলসকাঠি খুবই সমৃদ্ধ গ্রাম। দক্ষিণ দিকে খরস্রোতা ধানসিঁড়ি নদী। এ নদী নিয়েই জীবনানন্দ দাশ বোধ হয় তার বিখ্যাত কাব্য রচনা করেছিলেন। এ বছর শীত একটু আগেভাগে চলে এসেছে। নদীর পাড়ে শীত বেশ তীব্র। ছটটু গায়ের চাদরটা ভালো করে জড়িয়ে নিল। একটা সোয়েটার থাকলে বেশ হতো। সামনে শীত আরও তীব্র হবে। আপাতত চাদরই ভরসা। নদীর উপর হালকা কুয়াশা ক্রমশ গাঢ় থেকে গাঢ়তর হচ্ছে। ছটটু নদীর পাড় থেকে উঠে দাঁড়ালো। খেঁজুর গাছে হাঁড়ি পেতে গাছিরা গ্রামে ফিরে যাচ্ছে। প্রতিদিন সকলে মিষ্টি খেঁজুর রস গ্রামে সহজ লভ্য। সকালে খেঁজুর রস খাওয়ার পর প্রখর শীত জাঁকিয়ে বসে। সত্যি, সে এক চমৎকার অনুভূতি! খেঁজুর রস নিয়ে বাংলা সাহিত্যে বিখ্যাত কোনও কবিতা আছে কি? ছটটু ঠিক করেছে, কোনও কবি বন্ধুকে বলবে খেঁজুর রস নিয়ে কবিতা লিখতে। হুমায়ূন কবিরকে বলা যায়, এই কবি বন্ধু ওদের দল করে।

এই গ্রামের দূরত্ব বরিশাল শহর থেকে খুব বেশি হলে ত্রিশ মাইল। শহুরে সভ্যতার প্রভাব এ গ্রামে এখনো শিকড় গাড়তে পারেনি। আধুনিকতার ছোঁয়া মুক্ত এ যেন সুপ্রাচীন বাংলার এক চিরায়ত গ্রাম! গঞ্জের দূরত্ব মাইল পাঁচেক। ওখানেই থানা কার্যালয়, পুলিশ ফাঁড়ি, কৃষি অফিস এবং বড় বাজার। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বলতে গঞ্জে আছে একটি জুনিয়র স্কুল, আর গ্রামে প্রাইমারি স্কুল। স্কুল পেরিয়ে কলেজ পর্যন্ত গিয়েছে এমন একজনকে ছটটু খুঁজে পেয়েছে, রহিম। বরিশাল হাতেম আলী কলেজে কিছুদিন আইএ ক্লাসে পড়েছে। এখন গ্রামে এসে চাষাবাদ করে। রহিমকে নিয়ে গ্রামবাসীর অহংকার বেশ। ছটটু নিশ্চিত, ভবিষ্যতে রহিমই এই গ্রামের হর্তাকার্তা হবেন।

প্রাদেশিক রাজধানী ঢাকা তো দূরের কথা, গ্রামের অধিকাংশ মানুষ সারা জীবনে জেলা শহর বরিশালেই যায়নি। গ্রামীণ অর্থনীতি ধান কেন্দ্রিক। টাকার পাশাপাশি ধান বিনিময় যোগ্য। ধানের বিনিময়ে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য ছাড়াও সিগারেট, চিনি, চা-পাতা, এমনকি কাপড়-চোপড় পর্যন্ত পাওয়া যায়। গঞ্জ থেকে পণ্য সম্ভার বোঝাই নৌকা এসে ভেড়ে ধানসিঁড়ি নদীর ঘাটে ঘাটে। উৎসাহভরে গ্রামের ছেলেমেয়ে, গৃহবধূরা সেই নৌকা থেকে দরকারি দ্রব্য সংগ্রহ করে। এক রাতে আফাজউদ্দিন মাতুব্বরের প্রকাণ্ড উঠানে বয়াতি শের আলীর গানের আসর বসেছিল। শের আলীকে নিয়ে গ্রামের মানুষের গর্বের শেষ নেই। দশ-বিশ গ্রামে এমন বয়াতি নেই। দেহতত্ত্ব আর আধ্যাতিকতা তার গানের উপজীব্য। সন্দেহ নেই, রাতের গ্রামীণ পরিবেশ গানগুলো মনে আলাদা মাদকতা সৃষ্টি করে। এহেন শের আলীর পারিশ্রমিক ছিল পাঁচ আগল ধান। পাঁচ সের ধানে এক আগল। শের আলী গান শেষে তৃপ্ত মুখেই বাড়ির পথ ধরেছে।

ঢাকায় বিএন আর অফিসে বোমা হামলার পর দলের ওপর বিপর্যয় নেমে আসে। পুলিশ কয়েকজন কমরেডকে ধরে ফেলে। কোথাও নির্ভরযোগ্য শেল্টার ছিল না। ঠিক তখনই মনে পড়ে এই গ্রামের কথা, মায়া বুবুর কথা। আফজউদ্দিন মাতুব্বরের সাথে ছটটুদের কোনও রক্তের সম্পর্ক নেই সত্য, তবে দীর্ঘদিন ধরে দু’পরিবারের মধ্যে গভীর আত্মিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। আফাজউদ্দিনের স্ত্রী মায়া বুবু ছটটুর বাবাকে বাজান বলে ডাকতেন। বাবাও মায়া বুবুকে কন্যাজ্ঞান করতেন। চিকিৎসা কিংবা ভ্রমণ উপলক্ষে বরিশাল গেলে এই পরিবার ছটটুদের বাসায় আতিথ্য গ্রহণ করে থাকে। কলসকাঠি গ্রামে ছটটু এইবারই প্রথম এলেও, ওদের পরিবারের প্রায় সবাই কখনো না কখনো এই গ্রামে বেড়াতে এসেছে। ছটটু হুলিয়া মাথায় প্রচণ্ড দ্বিধা আর সংকোচ নিয়ে মাস খানেক আগে এই গ্রামে আসে। বিস্ময় আর পরম আনন্দে এই পরিবারের সবাই ছটটুকে গ্রহণ করেছে। মায়া বুবু আর তার স্বামী আফাজউদ্দিন মাতুব্বরের আন্তরিকতায় ছটটুর সকল দ্বিধা কেটে গেছে।

ছটটুকে পেয়ে প্রথম দিন স্মৃতিকাতর মায়া আপা ভীষণ  কেঁদেছিলেন। বাবা, মানে তার বাজানের নিঃসঙ্গ মৃত্যুর কথা বারবার জানতে চেয়েছিলেন। এসব মুহূর্তে ছটটুও নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছিল। সেই থেকে ছটটুকে নিয়ে এলাহি আয়োজন। পুকুরে জাল ফেলে পাঁচ-দশ সেরি মাছ ধরা, গঞ্জে লোক পাঠিয়ে গরুর মাংস আনা, নানা ধরনের পিঠা তৈরি নিয়ে সারাদিনই এ বাড়ির লোকজন ব্যস্ত থাকে। গ্রামে এখন নবান্ন। পাকা ধানের মিষ্টি ঘ্রাণ বাতাসে ভেসে বেড়ায়। গ্রামের মানুষের সীমাহীন ব্যস্ততা। ধান কাটা, সিদ্ধ করা, ধানগুলোকে রোদে শুকানো, ঢেঁকিতে ছাঁটা, পিঠেপুলি তৈরি করা— কাজের ছড়াছড়ি। বিয়ে, মোসলমানি ইত্যাদি সামাজিক উৎসবের ঢল নামে এ সময়। ছটটু হলো আফাজউদ্দিন মাতুব্বরের বড় কুটুম্ব। সুতরাং প্রতিরাতে ছটটুকে কোথাও না কোথাও দাওয়াত খেতে হয়। অপরিসীম মমতা আর অতিথি সেবার নামে যে বাহুল্য, তাতে বোঝারই উপায় নেই যে, এদের অনেকের ঘরেই বছরের ছয় মাসই প্রয়োজনীয় ধান চাল থাকে না। ছয় মাস এরা আধা উপাসি থাকে।

রাতে গ্রামের চেহারা বেশ ভিন্ন। সন্ধ্যার সাথে সাথে সবাই ঘরে ফেরে। তারপরই খাওয়া ও ঘুমানোর পালা। শত বছর কিংবা তারও আগে সম্ভবত জলদস্যু অথবা বর্গিরা এসব অঞ্চলে হানা দিত। গ্রামের প্রাচীন মানুষরা গালগল্পে এসব কথা বলে বেড়ায়। আর রাতে বসে পাহারা। বল্লম যাকে গ্রামের মানুষরা ’ল্যাজা’ বলে, সেই ’ল্যাজা’ হাতে গ্রামের তরুণরা রাত জেগে গ্রাম পাহারা দেয়। উঠানে স্তূপীকৃত ধানের উপর পাটি বিছিয়ে ’ল্যাজা’ হাতে নিয়ে শুয়ে থাকে কেউ কেউ। এরা প্রাণ দেবে তবু ধান দেবে না। রাতে পথচলায়ও এক ধরনের সর্তকতা। দলবদ্ধ হয়ে পথ চলে সবাই। বর্গি অথবা অতিপ্রাকৃতিক শক্তির বিরুদ্ধেই এ প্রস্তুতি। রাতে পথ চলার ছবিটা হলো, মশাল হাতে একজন চলে আগে। তার পেছনে ’ল্যাজা’ উঁচিয়ে পথ চলে দু’একজন। অতিপ্রাকৃতিক ভয় তাড়াতে উচ্চ কণ্ঠে কথা বলে সবাই।

ছটটু নিশ্চিত, এ গ্রামে অন্তত পুলিশের ভয় নেই। আফাজউদ্দিন মাতুব্বর প্রায় নিরক্ষর হলেও সহজাত জ্ঞানের অধিকারী। এক রাতে মাতুব্বর বললেন, শোনও মিয়া, তুমি তোমার বোনের বাড়িতে আছ। তোমার ক্ষতি করবে এমন মরদ এ তল্লাটে নাই। দুই চারটা পুলিশও যদি আহে ’ল্যাজা’ মাইরা ধানসিঁড়িতে ভাসাইয়া দেব। আর গঞ্জ থেকে পুলিশ আইতে এক প্রহর। সব জায়গা আমার লোক লাগানো আছে। তয় তোমার গঞ্জে যাওয়ার দরকার নাই। র মনে কী আছে কে জানে। তুমি যতদিন ইচ্ছা থাকো।

সেই দিন থেকে ছটটু ভারমুক্ত। ছটটু যে গোপন রাজনীতি করে সেই ব্যাপারটা মাতুব্বর ভাসা ভাসা জানে। পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের নির্বাচন ৭ ডিসেম্বর। প্রায় মাসাধিকাল বাকি। গ্রামের সবাই বলাবলি করছে, গঞ্জ নাকি নির্বাচন নিয়ে জমজমাট। ওইখানে গেলে বিনা পয়সায় চা-বিড়ি খাওয়া যায়। একদিন সন্ধ্যায় ছটটু একদল ছেলেপুলে নিয়ে রহিমকে মিছিল করতে দেখেছে। মিছিল থেকে শ্লোগান উঠছে, ভোট দিবেন কিসে, নৌকা মার্কা বাক্সে।

ছটটু জেনেছে, এ গ্রামের ভোটারা কোনও না কোনও ভাবে মাতুব্বরের উপর নির্ভরশীল। সুতরাং মাতুব্বর যে মার্কায় ভোট দিতে বলবে, গ্রামের মানুষেরা সেখানেই ভোট দেবে। মাতুব্বরের প্রচুর জায়গাজমি। হাজার হাজার মণ ধান আসে প্রতি বছর। প্রচুর মানুষের অন্নদাতা তিনি। অধিকাংশই তার আত্মীয়-স্বজন। এরা মাতুব্বরের জমিতে শ্রম দেয়।

পশ্চিমবঙ্গের নকশাল আন্দোলনে এ ধরনের ভূস্বামী-জোতদারকে শ্রেণিশত্রু হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এদেশে আসন্ন বিপ্লবে এই শ্রেণিটিকে হয়তো উৎখাতের আহ্বান জানান হবে। এই ভাবনা থেকে ছটটুর মাথায় নতুন চিন্তা ঘুরপাক খেতে থাকে। মাতুব্বর, ধরা যাক তার মজুরদের শোষণ করছে। এই হিসাবে মাতুব্বর শোষক। কিন্তু হিসাবটা এত সহজ নয়। মাতুব্বর শোষক হলেও ওদের এক ধরনের আশ্রয় বটে। এছাড়া রয়েছে আত্বীয়তার সম্পর্ক। ছটটু নিশ্চিত, যদি কখনো আফাজউদ্দিন মাতুব্বরকে  শ্রেণিশত্রু হিসাবে চিহ্নিত করে উৎখাত করা হয়, তবে আফাজউদ্দিন মাতুব্বরের পক্ষেই যাবে এখানকার সর্বহারা শ্রেণি।

ছটটু ঠিক করল, ভবিষ্যতে পার্টি নেতৃবৃন্দের কাছে এসব বিষয়ে একটি থিসিস্ উপস্থাপন করবে। থিসিস্ লেখা নিয়ে বেশ সময় কেটে যাচ্ছে। চলবে