
হৃদয় ছোঁয়ার দিন
উপন্যাস ৬
সাজ্জাদ হায়দারপ্রকাশিত : জানুয়ারি ০২, ২০২০
নভেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকেই শীতের মাত্রা কমে গেল। গ্রামে মুরুব্বি গোছের লোকেদের মধ্যে এক ধরনের উত্তেজনা। শীত কমে যাওয়াটাকে তারা যেন মেনে নিতে পারছে না। এসব খুব হালকা বিষয় বাদ দিয়ে, ছটটু সব ভুলে থিসিস নিয়ে লেগে গেল। নভেম্বরের দশ তারিখ ছটটু দেখল, ধানসিঁড়ি নদীতে অস্বাভাবিক পানি। গ্রামের মানুষ নদীর তীরে জটলা করছে। এসময় নদীতে ভাটা শুরু হওয়ার কথা। অথচ আজ সময়ের সাথে সাথে নদীতে পানি বাড়ছে। বয়স্ক লোকদের চোখমুখে আতংকের ছাপ। এই আবহাওয়া ঝড়-বৃষ্টির লক্ষণ। তারা ঝড়ের স্মৃতি রোমান্থন করছে। কম বয়স্করা মনোযোগ দিয়ে শুনছে।
পরদিন থেকে শুরু হালে গুড়িগুড়ি বৃষ্টি। বাড়ল শীতের প্রকোপ। নদীর পানি দুকূল ছাপিয়ে প্লাবিত করছে ফসলের মাঠ, অপেক্ষাকৃত নিচু এলাকায়। ছটটু দেখল, ঘরের টিনের বেড়ার গায়ে অসংখ্য পিঁপড়ার সারি। মাটির নিচের আশ্রয় ছেড়ে পিঁপড়ারা নতুন আশ্রয় খোঁজে চলছে। গোয়ালঘর থেকে গরুগুলো বের করা হয়নি। গরুদের হাম্বা ধ্বনিতে কেমন আতংকের ছাপ। সারা প্রকৃতির মধ্যে ভয় মেশানো অস্থিরতা। বিকেল থেকেই পানি আর কাদা ভেঙে একজন-দুজন করে গ্রামবাসী এসে আসন গাড়তে লাগল মাতুব্বরের বৈঠকখানায়। এ সময়টা মাতুব্বর ভেতরের ঘরে থাকেন। ছটটুকে এখানে পেয়ে এরা আশ্বস্ত হয়। ছটটুর সাথে কথা বলতে সবার আগ্রহ। এদের সাথে আড্ডা দিয়ে বেশ সময় কাটল। আসলে ঝড়ঝঞ্জা নিয়ে ওদের তেমন মাথাব্যথা নেই। তবে অনেক ক্ষেতেই শস্য তোলা বাকি। দু’একদিনের মধ্যে বৃষ্টি না থামলে সমূহ ক্ষতির সম্ভাবনা।
মাগরিবের নামাজ শেষে মাতুব্বর বৈঠকখানা ঘরে এলেন। হেরিকেনের আলোয় তার মুখটা অসম্ভব গম্ভীর দেখাচ্ছে। তার হাতে এক ব্যান্ডের ট্র্যানজিস্টার। চাদরের তলা থেকে ব্যাটারি বের করে তিনি ওটাতে ভরতে লাগলেন। গুঞ্জন থামিয়ে সবাই আগ্রহ ভরে মাতুব্বরের কার্যকলাপ দেখতে লাগল। ব্যাটারি লাগিয়ে তিনি গভীর আগ্রহে টিউনিং করতে লাগলেন। অনেকে কসরতের পর রেডিও পাকিস্তান ঢাকা কেন্দ্র পাওয়া গেল। ঘোষক জানালেন, এখন শুরু হবে অনুরোধের আসর। বাজতে লাগল একের পর চলচিত্রের জনপ্রিয় গান আর গানের ফাঁকে ফাঁকে প্রচার হতে থাকল অনুরোধকারীর নাম। এক সময় বিরক্ত হয়ে মাতুব্বর নব ঘুরিয়ে ট্র্যানজিস্টার বন্ধ করে দিলেন।
হালার পো হালারা, আসল খবর কইবো না। যতসব প্যানপ্যানানি... মাতুব্বর বলতে লাগলেন, শোনও মিয়ারা, ঝড় আইবো। রাইতেই আইতে পারে। এক কাম করো, সবাই যার যার বাড়ি যাও। যাগো ঘর ল্যারাব্যারা তাগো এই বাড়িতে আইতে কও। পুরুষেরা থাকবো এই বৈঠকখানায় আর বউ বাচ্চাগুলারে ভেতরের ঘরে পাঠাও। যাও যাও দেরি কইরো না। সামনে বসে থাকা লোকগুলোকে মাতুব্বর তাড়া লাগালো। ঝিরঝির বৃষ্টি আর দমকা হাওয়ার মধ্যে গ্রামের বউ বাচ্চাদের নিয়ে গ্রামবাসীরা সবাই এ বাড়ি আসছে। ছটটু আফাজউদ্দিন মাতুব্বরের বৈঠকখান ঘরটা খুটিয়ে খুটিয়ে দেখতে লাগল। বিশাল চৌচালা টিনের ঘর। লোহা কাঠের থাম। দেখলেই বোঝা যায়, প্রচণ্ড ঝড়ঝাপটা সহ্য করার ক্ষমতা এ ঘরের আছে।
মায়া বুবুর ঘরটাও একই ধরনের। সন্দেহ নেই, অতীতেও এ ঘরগুলো ঝড়ঝঞ্জার সাথে লড়াই করেছে এবং প্রতিবারই হয়েছে গ্রামবাসীদের নিরাপদ আশ্রয়। দেখতে দেখতে লোকজনে বৈঠকখনা ভরে উঠল। বৈঠকখানা পেরিয়ে মহিলারা বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে আশ্রয় নিচ্ছে মায়া বুবুর ঘরে। কিছুক্ষণ পর মায়াবুবু ছটটুকে ভেতরের ঘরে ডেকে পাঠালেন। এই দুর্যোগ সত্ত্বেও মায়াবুবু প্রচুর রান্না করেছেন। নিজেদের জন্য, আশ্রিতদের জন্যও। মহিলা আর বাচ্চারা যার যার মতো খিচুরি খেয়ে নিচ্ছে। খাওয়া শেষে ছটটু বৈঠকখানা ঘরে এলো। এটুকু পথ আসতেই ভিজে একাকার। বৃষ্টি আর ঝড় হাওয়ার মাত্রা বেড়েই চলেছে। বৈঠকখানার একপাশে একটা চৌকি। ছটটুর বিছানা। এরই মধ্যে ধবধবে চাদর বিছানো হয়েছে। মায়াবুবুর নজর সবদিকে। মাতুব্বরও কম যান না। আশ্রিতদের একজন বিছানার প্রান্তে বসতে এসেছিল, মাতুব্বর তাকে প্রচণ্ড ধমক দিলেন। বেচারা থতমত খেয়ে জিভ কেটে মেঝেতে বসে পড়ল। আজ রাতে ঘুম আসবে না। আর এত লোকের সামনে ঘুমানোর প্রশ্নই আসে না।
অনুচ্চ গলায় কথা বলছে সবাই। একজন বৃদ্ধ উচ্চ স্বরে কোরান তেলোয়াত শুরু করছেন। মাঝে মাঝে তার কণ্ঠ বাতাসের শব্দে চাপা পড়ে যাচ্ছে। মাতুব্বর চেয়ারে বসে একমনে তবজি গুনছেন। সবাই যেন কিছু একটার অপেক্ষা করছে। মধ্যরাতের পর অপেক্ষার পালা শেষ হয়। প্রথমে কয়েক মুহূর্তের জন্য বৃষ্টি আর দমকা হাওয়া মিলিয়ে গেল। তারপর অতি দূর থেকে ক্ষীণ শব্দ খুব দ্রুত লয়ে এগিয়ে আসল। চিন্তার চেয়ে দ্রুত গতির শব্দটা এসে প্রচণ্ড আক্রোশে যেন বৈঠকখানা ঘরের ওপর ঝাপিয়ে পড়ল। ঝ্নঝ্ন করে কেঁপে উঠল ঘরের কাঠামো। সেই সাথে পানির তীব্র ঝাপটার শব্দ। নিচের মেঝে আর টিনের বেড়ার ফাঁক দিয়ে ঢোকা তীব্র বাতাসে হেরিকেনের শিখা নিভু নিভু হয়ে যাচ্ছে। বাতাস আর পানির শব্দ ছাপিয়ে শোনা যাচ্ছে মহিলা আর বাচ্চাদের ভীত চিৎকার।
মায়া বুবুর ঘরটা দাঁড়িয়ে আছে কিনা দেখার জন্য কেউ একজন জানালা খোলার চেষ্টা করতেই পানি আর বাতাসের সম্মিলিত শক্তি আগের চেয়ে তীব্র হয়ে আঘাত হানল ঘরে। ঘরের সবার মুখ দিয়ে ভয় পাওয়া আর্ত চিৎকার বেরিয়ে এলো। বেড়ার ফাঁক-ফোঁকড় দিয়ে আসা পানির ঝাপটায় ঘরের সবাই ভিজে একাকার। শীতের কাঁপুনিতে ছটটুর হাড়মাংস একত্রে মিশে যেতে চাচ্ছে। সবার মুখে আল্লাহ রাসূলের নাম। একজন আজান দেয়া শুরু করলেন। লোকটি কয়েক হাত দূরে থাকলেও বাতাস আর পানির শব্দে ছটটুর কাছে কোনও দূরাগত আজান ধ্বনির মতো মনে হলো। দূরেও কেউ বোধ হয় আজান দিচ্ছে। এ সময় ঝড়ের শব্দ ছাপিয়ে প্রচণ্ড কিছু একটা টিনের চালের উপর আছড়ে পড়ল। মর্মর করে নড়ে উঠল লোহা কাঠের ভারি খুঁটি। ঝনঝন করে উঠল টিনের চাল আর পার্টিশন। ভয়ে একজন আরেক জনকে জড়িয়ে ধরল। ঘরচাপা পড়ে মরার আতংকে একজন দরজা খুলতে গেল। সশব্দে খুলে গেল দরজার পাল্লা। বাতাসের ধাক্কায় লোকটি ছিটকে পড়ল মেঝেতে। ভেতরে শুরু হলো বরফ শীতল পানি আর ঘূর্ণি হাওয়ার নাচন।
দপ করে নিভে গেল হারিকেনের শিখা। ‘নূহ নবির তুফান আইলো বুঝি’, কেউ একজন বলল। সহজাত বুদ্ধিতে ছটটু চলে এলো খোলা দরজার কাছে। অনেক কসরত করে দুপাল্লা একত্র করে সর্বশক্তি দিয়ে অবশেষে দরজাটা বন্ধ করতে পারল। দরজা বন্ধ করার সময় ছটটু দেখল, উঠানের প্রকাণ্ড আমগাছটা কাত হয়ে বৈঠকখানার চালের ওপর পড়েছে। শুরুটা যেমনি হয়েছিল তেমনি হঠাৎ করে ভোরের সাথে সাথে ঝড় কমতে থাকল। ঝড়ের পর ছটটু গ্রাম দেখতে বের হলো। ঝড়ে এ গ্রামের অনেক কাঁচাবাড়ি আর গাছ উপড়ে ফেলেছে। তবে মানুষ আর গবাদি পশুর তেমন ক্ষতি হয়নি। দুজন বৃদ্ধ সামান্য আহত হয়েছে। রাতের আতংকের তুলনায় এই ক্ষতি খুবই সামান্য।
দুপুরের পর মাতুব্বর গঞ্জে গেলেন ধানচালের আড়ত দেখতে। ওইসব স্থাপনা ঝড়ে আস্ত আছে কিনা দেখা দরকার। গভীর রাতে মাতুব্বর ফিরলেন। তার মুখটা অসম্ভব গম্ভীর। হাউমাউ করে কাঁদছেন। কান্না থামিয়ে বিবৃত করলেন ভয়ংকর সংবাদটি। একজন লোক বানের পানিতে ভাসতে ভাসতে কিভাবে যেন গঞ্জে এসেছে। নিশ্চয়ই দক্ষিণের চর থেকে। ওই চরে একজন মানুষও বেঁচে নেই। মাতুব্বরের কথা শেষ হতেই সারা বাড়িতে শোকের মাতম উঠল। দক্ষিণের চর ছাড়িয়ে দূরবর্তী গলাচিপা দ্বীপে এ পরিবারের একাংশের বসবাস। দক্ষিণের চরে কেউ বেঁচে থাকলেও গলাচিপা দ্বীপে কাকপক্ষিরও বেঁচে থাকার সম্ভাবনা নেই। মুহূর্তের মধ্যে বাড়িটি শোকের বাড়িতে রূপান্তরিত হলো। ছটটু ঠিক করল, যেভাবেই হোক বরিশাল যাবে। চলবে