হৃদয় ছোঁয়ার দিন

উপন্যাস ৭

সাজ্জাদ হায়দার

প্রকাশিত : জানুয়ারি ০৩, ২০২০

দুখিনী বাংলায় আবার বিপর্যয়। উপকূলে ঘুর্ণিঝড়ে লাখ লাখ মানুষের প্রাণহানী। দৈনিক পত্রিকার কালো কালো লেখা আর ফুলে ওঠা লাশের ছবি আমানের চোখে জ্বালা ধরায়। গত কয়েকদিন ধরে ঢাকা শহর প্রকৃত শোকের শহর, এদেশ এখন শোকের দেশ। পাল্টে গেছে সময়। ছন্ধপতন ঘটেছে নির্বাচনী আবহাওয়ায়। উপকূলে যাদের আত্মীয় স্বজনের বসবাস, সেসব ঢাকাবাসী প্রতিদিনই উপকূলে যাওয়ার চেষ্টা করে। নৌযানের তীব্র সংকট। দখিনাঞ্চলের সব লঞ্চ এখন ত্রাণ আর উদ্ধারের জন্য উপকূলে ছুটে গেছে। সুতরাং  ঢাকা থেকে বরিশাল যাওয়া খুবই কষ্টকর।

পরপর দুদিন আমান সদর ঘাট থেকে ফিরে এসেছে। চোখ বন্ধ করলেই ভেসে ওঠে উপকূলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অসংখ্য চেনামুখ। এফডিসির কাজকর্মে ভাটা পড়েছে। প্রতিটি বাঙালিই এখন আমানের মতো দুঃখভরাক্রান্ত, বিক্ষুদ্ধ। দায়িত্বহীন পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠি ঘুর্নিঝড় সম্পর্কে জনগণকে যেমন সামান্যতম সচেতন করেনি, তেমনি এখন ত্রাণ ও উদ্ধারকাজেও সীমাহীন ঔদাসিন্য দেখাছে। মাওলানা ভাসানী ঝড়ের আগে নার্সিংহোমে ভর্তি ছিলেন। লাখ লাখ বাঙালির মৃত্যুর খরব পেয়ে অগ্নিভুক মাওলানা উপকূল পানে ছুটলেন। তিনি চট্টগ্রাম থেকে হাতিয়া যাওয়ার জন্য পূর্ব পাকিস্তান শিপিং কর্পোরেশনের ’ভোলা’ জাহাজে চড়ে বসেন। শুরু হলো কর্তৃপক্ষের সাথে মাওলানার দ্বন্দ্ব। নাটক বেশ জমে উঠল। শাসক গোষ্ঠি চায় না তিনি উপকূলে যান এবং ফিরে এসে বিদ্রোহের আগুন জ্বালান।

তিন ফরাসি টিভি ক্রু ও জাপানি সাংবাদিক মাওলানার সফরসঙ্গী। জাহাজটি চট্টগ্রাম ছেড়ে চৌদ্দ মাইল দূরত্ব অতিক্রম করে আবার ফিরে আসে। এ নিয়ে সারা দেশে প্রতিবাদের ঝড় বয়ে যায়। বেগতিক দেখে কর্তৃপক্ষ মাওলানাকে হাতিয়া পাঠানোর ব্যবস্থা করে। বাঙালিদের আরেক নেতা, যিনি আসন্ন নির্বাচনে প্রায় নিশ্চিত বিজয়ী হয়ে ক্ষমতা পেতে যাচ্ছেন, সেই শেখ মুজিবুর রহমানও এখন উপকূলে। আসেননি প্রেসিডেন্ট ও সামারিক শাসক ইয়াহিয়া খান এবং তার সঙ্গপাঙ্গরা। পকিস্তানি শাসকের এই তাচ্ছিল্য গোটা বাঙালি জাতিকে এক অবিচ্ছেদ্য ঐক্যের বন্ধনে আবদ্ধ করেছে।

প্রতিটি বাঙালিই এখন শারীরিক ও মানসিকভাবে ঘূর্ণিঝড় দুর্গতদের দূঃখকষ্টের ভাগিদার। প্রতিটি রাজনৈতিক দল, সাংস্কৃতিক সংগঠন, ক্রীড়া সংগঠন মায় পাড়ার সামান্য ক্লাবের কর্মীরা দ্বারে দ্বারে ঘুরে দুর্গত মানুষের জন্য চাঁদা সংগ্রহ করছে। ছাত্র, কেরানি, চাকুরে, ব্যবসায়ী, গৃহবধূ সবাই অকাতরে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। এফডিসিতেও শিল্পী-কলাকুশলীরা চাঁদা সংগ্রহে ব্যস্ত। দু’তিন দিন পর এরা সাহায্য নিয়ে উপকূলে যাবে। একারণে আমানকে কিছুটা সময় দিতে হয়। পত্রিকার আগাগোড়া পড়ে আমানের মন খারাপ হয়ে যায়। কোথাও ঘুরে এলে হয়তো মনটা ভালো হবে। আমান ঠিক করল, ধানমন্ডি যাবে ওর কাজিন পারভিনের বাড়ি।

পারভিনের বাবা মফিজখাল একজন সেলফমেইড মানুষ। ছিলেন সামান্য কেরানি, পাটের ব্যবসায় নেমে এখন লাখপতি। গাড়িবাড়ি সবই করেছেন। পশ্চিম পাকিস্তানি ধনকুবেররা এখন তার প্রতিদ্বন্দ্বি। এ কারণে তিনি পশ্চিমা শাসকদের অপছন্দ করেন। প্রশাসনিক আনুকূল্যের কারণে ওদের সাথে কম্পিটিশনে পেড়ে ওঠা দায়। আমান দেখল, মফিজ খালু সোফায় বসে আছেন। চেহারায় চিন্তার ছাপ। আমান উনাকে সালাম দিল। মফিজ খালু আমানের দিকে সরাসরি তাকালেন। তারপর বললেন, কি মিয়া, নির্বাচন কি হবে?

এ সময় প্রতিটি মানুষের প্রিয় বিষয় রাজনীতি। এখন রাজনীতির বিষয় ছাড়া কোনও আড্ডা জমে না। শহর মায় পাড়াগাঁয়ের চায়ের দোকান এখন রাজনৈতিক ঘটনাবলির বিশ্লেষণ কেন্দ্র। কিছুদিন আগে ইয়াহিয়ার ক্ষমতা দখলের প্রথম কয়েক মাস রাজনীতি নিষিদ্ধ ছিল। এজন্য চায়ের দোকানে ’এখানে রাজনৈতিক আলোচনা নিষেধ’ এ ধরনের ফলক টাঙ্গানো থাকত। এখন পাল্টে যাওয়া সময়। দেখা যায় রেস্তরাঁর মালিক কিংবা ম্যানেজার মায় ওয়েটারকে পর্যন্ত কাস্টমারের সাথে জমজমাট রাজনৈতিক আড্ডায় যোগ দিতে। এধারা এখন ড্রইং রুম থেকে হেঁসেল অবধি বহমান।

আমানের ধারণা, মফিজখালু এই কেজো মানুষটি আজ আড্ডার মেজাজে রয়েছেন। ঘূর্ণিঝড়ের পর সব রাজনৈতিক দলই নির্বাচন পিছিয়ে দেয়ার দাবি করেছে। ব্যতিক্রম শুধু আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগ হয়তো ক্ষমতায় যাবে, সরকার গঠন করবে, এ কারণে আর দেরি করতে চায় না। কোটি টাকার প্রশ্ন পশ্চিমার কি এত সহজে সব কিছু ছেড়ে দেবে, এত সহজে কি বাঙালির হাতে ক্ষমতা এসে যাবে? সারা শহর জুড়ে এ সব আলোচনা। উনার প্রশ্নের উত্তরে আমান বলল, এখনো ঠিক বোঝা যাচ্ছে না খালু।

আরে মিয়া, আমার কাছে আসল কথা শোনও। মফিজ খালুর মুখটা হাসিতে ভরে গেল। আসল খবরটা বলার জন্যই যেন এতক্ষণ বসে ছিলেন! আমাদের চেম্বারের গুলজার ভাই, জানও তো মুজির ভাইয়ের সাথে তার কি গভীর সর্ম্পক! সেই গুলজার ভাইকে মুজিব ভাই নিজে বলেছেন, যেভাবেই হোক আওয়ামী লীগ নির্বাচন করবে। নির্বাচন পেছানোর কোনও সম্ভাবনা নেই। আরে মিয়া, ইলেকশন না হলে ক্ষমতায় থাকবে কারা? এই ইয়াহিয়া খান। বাঙালির তাতে লাভ কি!

কিন্তু খালু, এই ঘুর্ণিঝড়, এত মানুষের মৃত্যু... আমান আম্তা আম্তা করে।  
আরে মিয়া ঝড় হয়েছে তো কি হয়েছে? ইলেকশন না হলে কি মানুষগুলো প্রাণ ফিরে পাবে! অনেক দিন পর বাঙালির ক্ষমতায় যাওয়ার সুযোগ এসেছে। কাজে লাগাতে হবে। আওয়ামী লীগ দেড়শো সিট নিতে পারলেই কেল্লা ফতে। আর দেড়শো সিট তো তৈরি আছে। সুতরাং ইলেকশন পিছিয়ে কি হবে! মফিজ খালু একটু থেমে ঘড়ি দেখলেন তারপর উঠে দাঁড়ালেন। তা তুমি বসো, তোমার খালা রান্না ঘরে। আমি যাই। খালু একটা ব্রীফকেস তুলে নিয়ে চলে গেলেন। চলবে