
হৃদয় ছোঁয়ার দিন
উপন্যাস ৮
সাজ্জাদ হায়দারপ্রকাশিত : জানুয়ারি ০৪, ২০২০
এ বাড়ির রান্নাঘর দোতলায়। পারভিনও নিশ্চয়ই সেখানে। আমানের তাড়া নেই। চুপচাপ বসে রইল। কেউ না কেউ আসবে তখন দোতলায় গেলেই চলবে।
আমান ভাই যে“ কখন এলে? আশ্চার্য মানুষ তুমি। উপরে না গিয়ে এখানে চুপচাপ বসে আছ? আমানের সামনে পারভিন দাঁড়িয়ে। ওকে খুব সজীব দেখাচ্ছে। স্নান করে এসেছে বোধ হয়। খোলা চুলে ওকে আরও ভালো দেখাচ্ছে। মেয়েটা দিন দিন আরও সুন্দরী হচ্ছে। ভীষণ ফটোজনিক চেহারা।
তুমি কেমন আছ আমান ভাই? ছাদের দিকে তাকিয়ে কি ভাবছো? পারভিন মজা পাওয়া কণ্ঠে বলল।ৎ
না, তেমন কিছু না। তোমার ক্লাস কেমন চলছে? পারভিনের দিকে তাকিয়ে আমান বলল।
তুমি দেখি সব গুলিয়ে ফেলছ? এত বড় একটা ঝড়ের পর কিসের ক্লাশ!
বোকার মতো প্রশ্ন করায় আমান লজ্জা পেয়ে কী বলবে ভেবে পেল না।
ভালো কথা, তুমি একটু বমো। আমি তৈরি হয়ে আসি। আমার সাথে তোমাকে একটু যেতে হবে। অনুনয় করে পারভিন বলল। তারপর আমানে সম্মতির অপেক্ষা না কারে সোজা দোতালায় উঠে গেল।
পরমুর্হূতে খালার আর্বিভাব। মুখে কসমেটিক মেখেছেন। বিপুল গহনা সারা গায়ে। বিয়ের প্রথম বছরগুলোতে দৈন্য অবস্থায় দিন কাটাতে হয়েছিল তাকে। এখন সেই কষ্ট পুষিয়ে নিতে চেষ্টা করছেন। আমানকে পেলে খালা রাজ্জাক-কবরী, সুচন্দাদের সব খবর জানতে চান। কবে কোন ছবি মুক্তি পাবে, সেটাও আমানের কাছ থেকে জেনে নেন।
একা একা নিচে বসে আছিস কেন? চেহারা তো রোদে পুড়ে তামা করে ফেলেছিস। ডাইনিংয়ে চল, আর পারভিনকে একটু নিউ মার্কেটে নিয়ে যাস্ তো। ও ভালো কথা, খালা একটু থামলেন। তারপর সোফায় বসে বললেন, তোকে পেয়ে ভালোই হলো। নীল আকাশের নিচে ছবিতে কবরী যে হারটা গলায় দিয়েছিল সেই হার তোর খালুর পছন্দ হয়েছে। তুই একটু কবরীকে জিজ্ঞেস করে দেখিস তো হারটা কোন দোকান থেকে কিনেছে। ভুলে যাস না কিন্তু!
নিউ মার্কেট নয়, পারভিন আমানকে নিয়ে এলো গুলিস্তান সিনেমা হলের সামনে। মিটার দেখে স্কুটার ভাড়া মিটিয়ে দেয়ার উদ্যোগ নিতেই পারভিন বাধা দিল। আমান ভাই, তুমি ভুলেও ও কাজ করবে না। আজ সব খরচ আমার।
পারভিন নাজ হলে উর্দু সিনেমা ’চান্দা’ দেখবে। স্পেশাল শোর দুটো টিকেট কাটার টাকা পারভিন আমানের পকেটে গুঁজে দিল। টিকেট কাটার পর পারভিন বলল, নাজ হলের ক্যান্টিনে কফি খাবে। নাজ হলের কফি হাউসটা বেশ ছিমছাম। ছবি শুরু হওয়ার আগে সময় কাটানোর জন্য মহার্ঘ্য স্থান। কফি নিয়ে টুকটাক কথা বলে ওদের কিছুটা সময় কাটল। এক সময় শো শুরু হওয়ার এলার্ম বাজলো। ফাঁকা হয়ে গেল কফি হাউস।
চল পারভিন ওঠা যাক। শো শুরু হয়ে গেল বোধ হয়। আমান পারভিনকে তাড়া দেয়।
আরে ধাৎ, সিনেমা দেখবে কে?
সিনেমা দেখবে না তো টিকেট কাটলে কেন?
এই কফি হাউসে বসে তোমার সাথে কথা বলার জন্য।
আমান একটু অবাক হলো। পারভিন মেয়েটা খেয়ালি। হয়তো কোনো খেয়ালি ভূত মাথায় চেপেছে। কিন্তু ওর সাথে কি এমন কথা থাকতে পারে যা বলার জন্য এত বাহানা করতে হবে। আমান ভেবে পেল না। এ মুর্হূতে কফি হাউস ফাঁকা কেবল ছোকড়া মতো ম্যানেজারটা ক্যাশে বসে টাকার হিসাব করেছে।
আচ্ছা আমান ভাই, তুমি গত চার বছর ধরে আমার পেছনে কেন ঘুরঘুর করো?
আমান হতবাক হয়ে গেল। ভাবছে বেশ কঠিন দু’কথা শুনিয়ে দেবে। কিন্তু বলার সময় দেখল পারভিনকে কঠিন কথা বলা খুবই কঠিন কাজ।
আমি তোমার পেছনে ঘুরঘুর কেন করবো? আমান কোনোমতে বলল।
আমান ভাইয়া, তুমি কিন্তু রেগে যাচ্ছ! রাগ করো না। আমি তোমায় সব বুঝিয়ে বলছি। তুমি কারণে অকারণে আমাদের বাড়িতে আসো ঠিক, কি আসো না?
আমান হাঁ বাচক মাথা নাড়ে।
অথচ বাবা টাকা ছাড়া কিছু বোঝেন না। আর মায়ের সাথে আড্ডা দেয়া নিশ্চয়ই বোরিং। আসলে তুমি আমাকে দেখার জন্যই আমাদের বাসায় আসো। কি ঠিক বলছি?
বিস্ময়ে আমান লা জবাব। কী উত্তর দেবে ভেবে পেল না। আমান শুধু পারভিনের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল, সব প্রশ্নের উত্তর হয় না।
আসলে তুমি বেশ বোকা। সত্যি কথা মুখ ফুটে বলতে চাও না। এখন আমান ভাইয়া আমার কিছু সমস্যার কথা শোনও। পুরোটা মন দিয়ে শুনে তারপর তোমার কথা বলবে। আমাকে বিয়ে করার জন্য এখন বাঙালি অবাঙালি হালি হালি পাত্রের লাইন। মায়ের এখন একটাই কাজ, বসে বসে এই সব পাত্রের যাচাই বাছাই করা। কিন্তু কিছু দিন আগে বাবা মত পাল্টিয়েছেন। অন্তত এক বছরের জন্য বিয়ে মুলতবি। বাবার ধারণা, আগামী নির্বাচনে বাঙালি ক্ষমতা পাচ্ছে। আওয়ামী লীগ যদি ক্ষমতায় আসে তবে বাবার ব্যবসা আর ক্ষমতা দুই বেড়ে যাবে। বাবার ধারণা, স্টাটাস বেড়ে যাবে। সুতরাং তখন আরও নামি দামি পাত্র পাওয়া যাবে। কি এখন খুশি তো? পারভিন হাসিমুখে আমানের দিকে তাকালো।
আসলে আমার মাথায় কিছু ঢুকছে না। আমানের কণ্ঠটা হাহাকারের মতো শোনালো।
আমি তোমাকে বুঝিয়ে বলছি। তুমি কম পক্ষে এক বছর সময় পাচ্ছ। পারভিন একটু থামল। ওর দু’গালে লাল আভা ফুটে উঠল। আর একটা ভালো লাগার অনুভূতি আমানের শিরদাঁড়া দিয়ে নেমে গেল যেন! একটু লজ্জা পেয়ে যেন পারভিন অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে নিল। তারপর বলল, এক বছর অনেক সময়। আমি বাবাকে রাজি করাবো। আর বাবা রাজি না হলে, যাই হোক একটা কিছু করবো। এখন তুমি মন দিয়ে কাজ করো। আমি চাই তুমি ’জীবন থেকে নেয়া’র মতো একটা সিনেমা তৈরি করো। তাহলে দেখবে তোমাকে আর কেউ হেলাফেলা করতে পারবে না। জহির রায়হান পারে, তুমিও পারবে। কথা শেষ করে পারভিন একটা হাত আমানের হাতের উপর রাখল।
আর আমার? বুকের গভীর লুকিয়ে থাকা চাপাচাপ দুঃখ এখন কান্না হয়ে যেন চোখ দিয়ে বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে। অনেক কষ্টে আমান আবেগ চাপা দিল। মধ্যবিত্তের অসহ্য জীবন ওর বর্তমান জীবনকে কোনও আশা দেখাতে পারেনি। অভিনেতা হলে এক কথা ছিল, ফিল্মের এক সামান্য এসিস্টেন্ট ডিরেক্টর, আত্মীয়-স্বজন কারও কাছেই ধতর্ব্য নয়। এই প্রথম কোনও মেয়ে আমানকে স্বপ্নের কথা বলল। আমান নিশ্চয়ই জীবন থেকে নেয়ার মতো সিনেমা বানবে। চাই একটা প্লট, সুন্দর চিত্রনাট্য। অনেক দূরে হারিয়ে গেল মনটা। আমানের চোখের সামনে ভেসে উঠল ঝড় বিধ্বস্ত উপকূল। ঝড়ের সাথে বেঁচে থাকার জন্য একদল মানুষের লড়াই। টিকে থাকার প্রতিযোগিতা। এরই মধ্যে শুরু হয়েছে ক্লাস স্ট্রাগল। একের পর এক চমৎকার সব সিকোয়েন্স।
কী ব্যাপার আমান ভাই, একেবারে চুপ যে? পারভিনের কথায় আমানের সম্বিত ফিরল।
তুমি আমার জন্য অনেক করলে পারভিন। তুমি খুবই ভালো। তোমায় আমি চাই। তুমি ধারণা করতে পারবে না কতটা। ভীষণ ভালো লাগছে, আরেক কাপ কফি খেতে ইচ্ছে হচ্ছে। চলবে