
চিত্রকর্ম: সফিউদ্দিন আহমেদ
হৃদয় ছোঁয়ার দিন
উপন্যাস ৯
সাজ্জাদ হায়দারপ্রকাশিত : জানুয়ারি ০৫, ২০২০
এমএল জেলি ফিস। কাঠের তৈরি লক্কর মার্কা মেয়াদোত্তীর্ণ একতলা লঞ্চ। লঞ্চডুবি হলে পচাগলা লাশগুলো এরা বহন করে। নৌকার গতির চেয়ে একটু বেশি বেগে চলে আর প্রচণ্ড শব্দ করে। ছটটু ঝড়ের পরের দিনই কলসকাঠি থেকে বরিশাল চলে আসে। ওখানে তিনদিনের অবিরত চেষ্টায় ওরা আশাতীত কাপড় চোপড় সংগ্রহ করতে পেরেছে। বরিশাল লঞ্চঘাট শ্রমিকের মধ্যে এখনো ওদের সংগঠনের অস্তিত্ব বজায় আছে। শিমুল এখন ছটটুর জায়গায় দায়িত্ব পালন করছে। নিজের হাতে গড়া সংগঠন সক্রিয় দেখে ভালো লাগল। ঢাকার ছেলে বায়োকেমিস্ট্রির তুখোর ছাত্র আজম এখন বরিশাল লঞ্চঘাটের কুলি-স্টিমার যাত্রীদের মালমাল রীতিমতো দরদাম করে মাথায় তুলে নেয়। আজমকে পুলিশ খুঁজছে। কুলিগিরি করে আজম যে পয়সা পায়, তা দিয়ে পেট চালিয়ে যা থাকে, পার্টি ফান্ডে দেয়। বরিশালের সংগঠন বিকাশমান। কিন্তু বিপর্যয় নেমে এসেছে চট্টগ্রামে শাখায়। ওখানে মুসলিম লীগের পাণ্ডারা ওদেরকে কাফের আখ্যা দিয়ে নির্যাতন করে। নির্যাতনের হাত থেকে বাঁচতে কর্মীরা আশ্রয় নিয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামের গভীর অরণ্যে। খাদ্যের অভাবে ওরা ঘাসপাতা খেয়েও দিন কাটিয়েছে। পার্টির নেতা সিরাজুল হক কিছুদিন আগে বরিশাল এসেছিলেন। এখন টাকা সংগ্রহের জন্য বিক্রমপুর গিয়েছেন।
ছটটুর পক্ষে বরিশাল শহরে অবাধে চলাফেরা সম্ভব ছিল না। বছর তিনেক আগের আগে এই শহরে ছটটু মৌলবাদীদের সমাবেশে বোমা হামলা চালিয়েছিল। পুলিশ ছাড়াও মৌলবাদীরা কায়দা মতো পেলে ওকে ছেড়ে দেবে না। এছাড়া বিএনআর অফিসে বোমা হামলা ঘটনায় পুলিশের খাতায় ছটটু অন্যতম সন্দেহজনক। সুতরাং মারাত্মক ঝুঁকি নিয়ে ওকে বরিশাল আসতে হয়েছে। তারপরও এই শহরটা বারবার ওকে টানে। এই তিন বছর ওদের পরিবারটা ভেঙেচুরে শেষ। বাবা মারা গেছেন। ভাইরা কেউ ঢাকায়, কেউ খুলনায়। বরিশালের জমজমাট বাড়িটা এখন যেন ছাড়াবাড়ি। নির্ঘুম রাতে এসব ভাবলে কষ্ট বাড়ে। বাবার অন্তিম মুহূর্তে বাবার পাশে থাকতে না পারায় ছটটু এখনো অপরাধ বোধে ভোগে। তখন এ জীবনের সবকিছু অর্থহীন লাগে। সাগরের জোয়ার ঠেলে, নড়বড়ে জেলি ফিস ধুকতে ধুকতে মোহনা ছেড়ে সাগরে পড়ল। আকাশ ঝকঝকে, কিন্তু সাগর এখনো উত্তাল। ভয় হচ্ছে, ওরা আদৌ কোনও গন্তব্যে পৌছাবে কিনা! কিছুক্ষণ পর ওরা দেখল, সাগরের নীলাভ পানিতে ভাসছে অসংখ্য কালো কালো বস্তু। লঞ্চের সারেংও বস্তুগুলো দেখে অবাক। অভিজ্ঞ সারেংয়েল কাছেও এক নুতন অভিজ্ঞতা। লঞ্চ আরেকটু এগিয়ে যেতেই বস্তুগুলো স্পষ্ট হলো, শব। মানুষ আর গবাদি পশুর শব বেঢপ ফুলে এখনো সাগরে ভাসছে। শকুন আর মাছ শবগুলোর বিভিন্ন স্থানের মাংস তুলে নিয়েছে। কিছু কিছু শবে এখনো বসে আছে আহাররত শকুন। সাগরের নির্মল বাতাসে এখন মাংস পচা গন্ধ।
লঞ্চের সারেং যথাসাধ্য চেষ্টা চালাচ্ছে লাশগুলো পাশ কাটিয়ে যেতে, কাজ হচ্ছে না। কারণ সাগরে জোয়ার চলছে। জোয়ারের সাথে লাশগুলো আবার উপকূলে ফিরে যাচ্ছে। এভাবেই সাগর নিয়ে আবার ফেরত দেয়। এসব লাশ নিয়ে সমুদ্র আর কতদিন জোয়ার-ভাটা খেলবে, কে জানে! লাশ দেখতে দেখতে সবার মন খারাপ। কথা বলার উৎসাহ নেই কারও। সারেংয়ের কাছে গিয়ে ছটটু জিজ্ঞাসা করল, ’মায়ার চর আর কত দূর?’ সারেং ইশারায় ডানদিতে দেখালো। ছটটু ওদিকে তাকালো, চোখে পড়ল লঞ্চের কাছেই সাগরে ভাসছে আরেকটি লাশ। ফুলেফেঁপে ঢোল হওয়া বিকট দর্শন যুগল লাশ। লাশ বেঢপ হলেও বেশ চেনা যাচ্ছে। একটি মা, একটি শিশু। শিশুর নিথর দুটি হাত আঁকড়ে ধরেছে মায়ের গলা। আর মা দুহাত দিয়ে বেষ্টন করে ধরেছে শিশুকে। মা নিশ্চয়ই শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত শিশুকে আঁকড়ে ছিলল। সাগর চেষ্টা করেও ওদের আলাদা করতে পারেনি। এই মায়ের কাছে সাগর পরাজিত হয়েছে। বিস্ময়কর হলো, এ যুগল লাশে কোনও শকুন বসেনি। মাছও এই যুগল লাশ দিয়ে উদরপূর্তির চেষ্টা করেনি। প্রকৃতিতে কত অদ্ভুত ঘটনা ঘটে! এ লাশ দেখে ওদের মন আরও খারাপ হয়। আধঘণ্টা পরে দিগন্ত রেখায় সবুজের দেখা মিলল, মায়ার চর। ধীরে ধীরে দ্বীপের অবয়র সৃষ্টি হচ্ছে। এক সময় নিশ্চয়ই সবুজ গাছগাছালিতে পূর্ণ ছিল এ দ্বীপ। এখন দুর থেকে হলুদ আর বিবর্ণ দেখাচ্ছে। নারকেল গাছগুলোর শীর্ষ দুমরে মুচড়ে ছিঁড়ে নিয়েছে যেন কেউ। অবশিষ্ট কাণ্ড কোনোমতে দাঁড়িয়ে আছে! চোখে পড়ল এ ধরনের নারকেল গাছে বসে আছে ন্যাড়া মাথার শকুন। মায়ার চরে চোখে পড়া প্রথম জীবনের লক্ষণ। বেলাভূমি থেকে বেশ কিছুটা দূরে নোঙর করল জেলি ফিস। ওরা হাঁটু পানি ভেঙে তীরে উঠতে লাগল। কষ্টকর পথ। জেলি ফিস থেকে চিড়াগুড় আর কাপড়-চোপড় নামাতে বেশ সময় লাগল। একটা জায়গা বেছে হলদেটে ঘাসের উপর এসব স্তূপ করে রেখে দিল। আসুদ রইল জিনিসগুলোর পাহারায়। বাকিদের নিয়ে ছটটু চরের গভীরে রওনা হলো। এখন দেখতে হবে পুরো চরে জীবিত মানুষ আছে কিনা?
বেলাভূমি থেকে কিছুটা উঁচুতে ফসলের মাঠ, এখন শস্যশূন্য। একপাশে একটা পায়ে চলা পথ। ছটটু সবাইকে নিয়ে ওই পথে হাঁটতে লাগল। আরেকটু এগুতেই ওদের নজরে এলো বসতবাড়ির চিহ্ন। উচু ভিটেবাড়ি, পানির চাপে এবড়ো-খেবড়ো হয়ে আছে। ঘরদোর নিশ্চয়ই পানির তোড়ে ভেসে গেছে। কেবল কয়েকটা বাঁশের খুঁটি এদিক-সেদিক হেলে আছে। চারদিকের সুনসান নীরবতার মধ্যে কেবল ভেসে এলো শকুনের কর্কশ চেঁচামেচি। সেই সাথে পরিচিত গন্ধটা নাকে এসে লাগল। একটা পুকুর ছিল বোধ হয়, সমুদ্রের পানির সাথে ভেসে আসা বালিতে ভরাট হয়ে আছে। ওখানেই পড়ে আছে মানুষের লাশের অংশ বিশেষ। দশ-বারটা শকুন বসে মহানন্দে আহারে ব্যস্ত। পচা লাশের উৎকট গন্ধের জন্য ওরা আর এগুলো না। পচা লাশের গন্ধ আর শকুনের আহারের দৃশ্য দেখে ছটটুর গা গুলিয়ে উঠল। ছটটুর পাশে দাঁড়ানো হবি আর সহ্য করতে পারল না। উপুর হয়ে বসে বমি করে ফেলল।
ছটটু ভাই, চলেন ফিরে যাই। জ্যান্ত মানুষ মনে হয় এই চরে নাই।
চরটা কিন্তু অনেক বড় রে হবি! কোথাও না কোথাও জীবিত মানুষ থাকতে পারে। এসেছি যখন সবটা দেখে যাই।
জীবিত মানুষের খোঁজে ওরা আবার পথ চলতে লাগল। পথচলার আধঘণ্টার মধ্যে শকুন ছাড়া অন্য কোনও জীবিত প্রাণী ওদের চোখে পড়েনি। ওরা যখন কিছুটা হতাশ হয়ে ফিরে যাওয়ার কথা ভাবছে তখনই চোখে পড়ল বসতভিটেটা। এ ভিটেয় ঘরদোর কিছুই নেই। তবে দূর থেকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, ঝড়ে ভেঙে পড়া দুমড়ানো দুটি বেড়া একত্রিত করে ছাউনির মতো আকার দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। ছটটুর কৌতূহল বেড়ে গেল। ওরা ছাউনির কাছে পৌঁছল। ছাউনির পেছনে নলখাগড়ার ঝোপ। পাতাগুলো জলোচ্ছ্বাসের সময় পানিতে ডুবে থাকার জন্য বিবর্ণ আর ঝড়ের সাথে লড়াই করে এখন নুয়ে আছে। ওরা দেখল, নলখাগড়ার ঝোপটা দুলছে। মানুষ কিংবা জন্তু না হয়ে যায় না! নলখাগড়ার ঝোপের ফাঁক দিয়ে মানুষের শরীরের অংশ বিশেষ দেখা যাচ্ছে।
কে ভাই ওখানে! এদিকে আসো, আমরা রিলিফ নিয়ে এসেছি। ছটটু চেঁচিয়ে বলল। কয়েক মূহূর্ত সাড়া নেই। তারপর ঝোপ থেকে মেয়েলি কণ্ঠে উত্তর এলো, আর সামনে আইয়েন না ভাই। ওই হানে খ্যাড়াইয়া মোগো কাছে দুইডা কাপড় ফিক্কা দেন।
ছটটু সবাইকে নিয়ে দু’কদম পিছিয়ে এলো। রিলিফের জন্য নিয়ে আসা কাপড়-চোপড় সাগর তীরে। ছটটু গায়ের চাদরটা খুলে খাগড়ার ঝোপে ছুড়ে দিল। হবিকে পাঠালো সাগর তীর থেকে কাপড় নিয়ে আসতে। ছটটুর চাদরটা কোনোমতে গায়ে জড়িয়ে ওদের সামনে এসে দাঁড়ালো বিশ-বাইশ বছর বয়সের এক কালো মেয়ে। অপুষ্টি আর পানি শূন্যতায় মেয়েটি যেন এক জীবন্ত কংকাল! সে বলল, আরেক জন আছে। আরেকখান কাপড় লাগবো।
হবি খুব দ্রুত ফিরে এলো। ছটটু মেয়েটির হাতে দুটি শাড়ি তুলে দিল। শাড়ি নিয়ে মেয়েটি ঝোপের আড়ালে চলে গেল। ফিরে এলো ত্রিশ পয়ত্রিশ বছর বয়সী আরেক নারীকে নিয়ে। হবি ওদের হাতে চিড়া-গুড় তুলে দিল। মেয়েটি বলল, বানের পর মোরা কলা ছাড়া আর কিছূ খাই নাই। কলাও কাইল শেষ আইছে। আপনারা না আইলে আমরা মরতাম।’
অলৌকিক ভাবে বেঁচে গিয়েছে দুই নারী। ওরা ধানী বউ। ধানের মৌসুমে ধান কাটার জন্য ধানের মালিক চরের জোরদাররা উপকূলবর্তী এলাকা থেকে সংগ্রহ করে দারিদ্রপীড়িত নারীদের। জোরদারের সাথে চার অথবা ছয় মাসের জন্য এরা বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হয়। বিনিময়ে জোটে এ সময়ের খরপোষ, আর মজুরি বাবদ উত্তোলিত ধানের অংশবিশেষ। ধান তোলা শেষে আবার তারা গ্রামে ফিরে যায়। আর স্বয়ংক্রিয় ভাবে বিয়েও ভেঙে যায়।
উপকূলবর্তী জোতদাররা সস্তায় কৃষি শ্রমিক পাওয়ার জন্য যুগ যুগ আগে প্রবর্তিত করেছে শোষণের এই বিশেষ পদ্ধতি। জোরদার ঝড়ের মাসখানেক আগে প্রায় চল্লিশজন শ্রমিক নিয়ে এই চড়ে আসে। এ দুজন ছাড়া বাকিরা নিশ্চয়ই ঝড়ে ভেসে গেছে। ঝড়ের রাতের কথা বলতে গিয়ে দু’মহিলাই কেঁদে ফেলল। ওদের কেবল মনে আছে, পাহাড়ের মতো ঢেউ এসে হঠাৎ ঝাঁপিয়ে পড়ে চরের ওপর। দুজনে একই সাথে ছিল। নোনাপানিতে খাবি খেতে খেতে তারা যখন তালিয়ে যাচ্ছে, ঠিক তখনই নাগালে এলো গাছের গুড়ি। সেই গুড়ি আঁকড়ে ধরে কত সময় কেটেছে, ওরা জানে না। সহজাত বুদ্ধিতে ভেসে থাকার সুবিধার জন্য ওরা পরনের কাপড় খুলে ফেলে। চেতন-অচেতন অবস্থায় এক সময় কাদা মাটির মধ্যে নিজেদের আবিষ্কার করে। চারদিকে মানুষের লাশ আর পশুর শবের মধ্যে খাবার খুঁজতে খুঁজতে পেয়ে যায় এককাদি কলা।
ঝড়ে ভেসে আসা দুটি দুমড়ানো বেড়া একত্রে করে আচ্ছদান তৈরি চেষ্টা করে। ওরা পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে রাতে শীতের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার চেষ্টা করে। অসুস্থ দুই নারীকে নিয়ে ছটটু সৈকতের দিকে চলল। চলবে