
পল্টন ময়দানে ভাষণ দিচ্ছেন মাওলানা ভাসানী
হৃদয় ছোঁয়ার দিন
উপন্যাস ১০
সাজ্জাদ হায়দারপ্রকাশিত : জানুয়ারি ০৬, ২০২০
দুপুর থেকেই ঢাকা মিছিল নগরী। মিছিলে যোগ দিতে লঞ্চ বাস ট্রাক রেলগাড়িতে চড়ে ঢাকার চারদিক থেকে স্বতঃস্ফূর্ত মানুষ পল্টন ময়দান অভিমুখ চলছে।
মাওলানা ভাসানী উপকূল ঘুরে এসেছেন। জনসভায় সেই অভিজ্ঞতা তুলে ধরবেন। মাত্র দশদিন আগে বিধ্বস্ত উপকূলে এখনো যোগাযোগ ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা হয়নি। ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও রাজধানী ঢাকা শহর ও আশপাশের জনপদের লোকজন উপকূলে যেতে পারেনি। অন্যদিকে রেডিও কিংবা সরকারি ভাষ্যে এখন আর মানুষের আস্থা নেই। রাজনীতি বিমুখ মানুষও চলছে জনসভায়। মাওলানার মুখ থেকেই ঝড়ের প্রকৃত অবস্থা জানতে চায়।
এফডিসিতে মাওলানা ভাসানীর আসন্ন জনসভার ঢেউ লেগেছে। সকাল থেকেই বিভিন্ন আড্ডায় জনসভা প্রসঙ্গ। মাওলানা আজ কি বলবেন, এটাই সবার জিজ্ঞাস্য। মাওলানার ন্যাপ তো আগেই বলেছে নির্বাচন করবে না। তবে কি আজ তিনি নির্বাচন প্রতিরোধের ডাক দেবেন? এ ধরনের আহ্বানে তো সারা দেশে রক্তগঙ্গা বইবে! নির্বাচন বানচাল করে তিনি কি চাচ্ছেন, ইয়াহিয়ার শাসন আরও দীর্ঘ করতে? মাওলানা কি তাহলে ইয়াহিয়ার হয়ে কাজ করছেন?
এসব আড্ডায় আমান জানল, সিনেমা জগতের অনেকেই আজ মাওলানার জনসভায় যাবে। ফতেহ লোহনী, খান আতা, জহির রায়হান, বেবি ইসলামসহ অনেকে মিছিল নিয়ে পল্টন যাবেন। এ খবর শুনে আমানের খুব ভালো লাগল। চলচ্চিত্রের মানুষগুলোকে এই ঝড় সমাজের মূল অংশের সাথে মিশিয়ে দিয়েছে। এরাও প্রয়োজনে গোটা জাতির সাথে একাত্ম।
অনেক কসরত করে আমান যখন পল্টনে পৌঁছাল তখন ডিআইটি ঘড়িতে আড়াইটা বাজে। শীতের দুপুর, দেখতে দেখতে লোকজনে প্রায় পূর্ণ হলো পল্টন ময়দানে। মানুষের জটলা জিন্নাহ এভ্যুনিউর রাস্তা পর্যন্ত এসেছে। এ রাস্তায় গাড়ি চলাচল অনেক আগেই বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। জিপিওর সামনে ইপি আর সৈনিক বোঝাই দুটি ট্রাক। পুলিশ জীপ ক্ষণে ক্ষণে টহলে দিচ্ছে। মাওলার জনসভা বলে কথা!
প্রায় দুই বছর আগে এখান থেকেই মাওলানা গর্ভনর হাউস ঘেরাওয়ের জন্য যাত্রা করেছিলেন। মাওলানার জ্বালানো সেই আগুন স্বৈরশাসক আইয়ুর খানের পতনের পরই কেবল নিভেছিল। সেদিন বিদেশি সাংবাদিকরা মাওলানাকে অগ্নিভূক মাওলানা উপাধি দিয়েছিল। কে জানে, আজ আবার মাওলানা কী আগুন জ্বালান! আমান দেখল, টঙ্গি থেকে আসা শ্রমিকদের মিছিল। আরেক পাশ থেকে আসছে ছাত্রদের একটা মিছিল। চোখে পড়ার মতো প্লাকার্ড। যাতে লেখা, ’স্বাধীন পূর্বপাকিস্তান কায়েম করো।’ কয়েকজন আলোকচিত্র সাংবাদিক দৌড়ে গিয়ে প্লাকার্ডের ছবি তুলছে। দুটি মিছিল একহয়ে মিলেমিশে পল্টনে ঢুকল।
এরই মধ্যে সভা শুরু হয়ে গেছে। একের পর এক ন্যাপ নেতারা গৎবাঁধা বক্তৃতা দিচ্ছেন। এসব শুনে অনেকটা সময় কাটলো। হঠাৎ করে জনতার মধ্যে একটা চাঞ্চল্য দেখা গেল। যারা এতক্ষণ ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসেছিল তারা মঞ্চের কাছাকাছি যাওয়ার চেষ্টা করছে। মাইকে ঘোষিত হচ্ছে, ’এখন বক্তৃতা করবেন আফ্রো-এশিয়ার মুক্তিদাতা মজলুম জননেতা মাওলানা ভাসনী’ ইত্যাদি। এরপর শ্লোগানে মুখর হলো পল্টন ময়দান।
মাওলানা বক্ততা দিতে উঠে দাঁড়ালেন। মাথায় সুপরিচিত তালের টুপি, গায়ে চেক লুঙি আর সাদা পাঞ্জাবি। মাওলানার মুখ অসম্ভব গম্ভীর। ক্লান্ত চোখে তিনি জনতার দিকে তাকালেন। মাওলানার বাঁদিক থেকে শ্লোগান উঠল, ’কৃষক শ্রমিক অস্ত্র ধরো, স্বাধীন পূর্বপাকিস্তান কায়েম করো।’ ক্রোধাগ্নি চোখে তিনি সেদিকে তাকালেন। তারপর বললেন, ’খামোশ।’ সাথে সাথে জনসভায় নেমে এলো পিনপতন নীরবতা। মাওলানা শুরু করলেন বক্তৃতা।
কিছুটা কৈফিয়তের ভঙ্গিতে বললেন, আমরা নাকি নির্বাচন চাই না। আমাদের কাছে নির্বাচনের চাইতে মানুষ বড়। নির্ধারিত সময়ে নির্বাচন হতে কে বাধা দিচ্ছে? ক্ষমতায় গিয়ে যারা লাইসেন্স পারমিট শিকার করতে চায় তারা নির্বাচন করুক। আমরা অনেক নির্বাচন দেখেছি। ভিয়েতনামে যখন গণহত্যা চলেছে তখন সায়গনে নির্বাচন হয়েছে।’ মাওলানা একটু দম নিলেন, এরপর আবেগ মথিত গলায় শুরু করলেন, ’হযরত নূহের জামানার পর এতবড় প্রলয় কাণ্ড মানুষের ইতিহাসে ঘটেনি। উপকূলে দশ থেকে বার লাখ নর-নারী ও শিশু এই দুর্যোগে প্রাণ হারিয়েছে। কিন্তু মহা ধ্বংসযজ্ঞের দশদিন পরও প্রায় চার লাখ লাশ পড়ে আছে। এদের দাফনের ব্যবস্থা নেই। বিধ্বস্ত বিরান উন্মুক্ত আকাশের নিচে আমাদের অগণিত মা-বোন উলঙ্গ হয়ে পড়ে আছে। বিরান জনপদ কোথাও কাপড় নাই, এই শীতের দিনে ধনী গরিব কারও মাথা গোঁজার ঘর নাই।
মাওলানার বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠ কিছু সময়ের জন্য থামলো। আমান দেখল, ওর পাশে দাঁড়ানো বয়স্ক এক ব্যাক্তি নিঃশব্দে কাঁদছে। হয়তো ঝড়ে এই লোকটি উপকূলে প্রিয়জন হারিয়েছে। আমান দেখল, অনেকের চোখেই পানি। বাকিরা ব্যথাতুর, বিমর্ষ। মাওলানা যেন এদেশের বিধ্বস্ত উপকূল থেকে দুঃখ বহন কবে এনে এই জনসমুদ্রে ছড়িয়ে দিচ্ছেন। মাওলানা এবার অনল উদ্গীরণের মতো বললেন, ’পূর্ব বাংলার এই মহাদুর্দিনে ওরা, পশ্চিম পাকিস্তানিরা কেউ আসে নাই। ১৯৫৪ বলেছিলাম, লা-কুম-দ্বিন-কুম ওলিয়া দ্বিন। আজ আবার বলছি, আস্লামালাইকুম।
এক সময় মাওলানা বক্ততা শেষ হলো। মাওলানার জনসভাগুলো সাধারণত শেষ হয় উত্তেজনার মধ্যে দিয়ে। আজ যেন উত্তেজনা বদলে স্থবিরতা। ভাষণ শুনতে আসা লোকগুলোর মধ্যে কোনও তাড়া নেই। কাজ নেই। যেন ঘরবাড়ি নেই! উপকূলে ছড়িয়ে থাকা দশদিনের পচা-গলা লাশের মধ্যে শুয়ে থাকা প্রিয়জনের ছবি যেন ভাসছে সবার চোখে। মাওলানা তো অগ্নিভূক আগুন জ্বালিয়ে নাকি লণ্ডভণ্ড করতে চান সবকিছু। কিছুদিন আগে ইয়াহিয়া খান পূর্ব-পাকিস্তান সফরে এসে এক নৌবাহিনী কর্মকর্তাকে বলেছিলেন, ’মাওলানাকে জাহাজে করে মাঝসমুদ্রে ডুবিয়ে মারা যায় কিনা।’ ইয়াহিয়ার এই ফরমায়েস অবশ্য ওই কর্মকর্তা পালন করেনি। কারণ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া তখন মদের নেশায় ছিলেন।
মাওলানা কোনও শাসককেই শান্তি দেন না। আজ তিনি কি করলেন? তিনি কি চাচ্ছেন উপকূল থেকে বয়ে আনা শোকের চাদর দিয়ে গোটা দেশকে মুড়ে দিতে? জাতিগত দ্বন্দ্ব প্রকট করে তিনি কি পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে সর্ম্পকের সুতোটা কেটে দিতে? শ্রেণি দ্বন্দ্বকে পেছনে ফেলে জাতিদ্বন্দ্ব কি প্রবল হলো? নাকি সব রাজনৈতিক ভেল্কিবাজি? প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে খুঁজতে আমন গুলিস্তানের দিকে হাঁটা দিল। চলবে