হৃদয় ছোঁয়ার দিন

উপন্যাস ১২

সাজ্জাদ হায়দার

প্রকাশিত : জানুয়ারি ০৮, ২০২০

স্বপ্নটা ভেঙে গেল। কে যেন ধাক্কা দিচ্ছে ওকে!  ঘুম জড়ানো চোখ খুলতে কষ্ট হচ্ছে। আবার ঘুমাতে চেষ্টা করল। পারল না। প্রচণ্ড শব্দ ওর কান ঝালাপালা করে দিচ্ছে। শব্দটা কি স্বপ্নে এসেছে!

শব্দটা ছাপিয়ে কেউ যেন ওকে ডাকছে, ’বাবু বাবু উঠ।’ মায়ের গলা। ঠিক তখন দূর থেকে একটা শব্দ এলো। শব্দটা যেন এগিয়ে আসছে এদিক পানে। ঝ্নঝ্ন করে কাঁপছে যেন টিনের চাল। এবার বুম করে প্রচণ্ড শব্দ উঠল। ঘুমচোখে বাবু দুহাত দিয়ে দু’কান চেপে ধরল। আবার ’চুই’ একটা শব্দ উঠল। এবার একটা আলোর ঝলকানি। টিনের বেড়ার ফাঁক গলে আলো এসে দিনের মতো হলো ঘরটা। ’কর কর’ আরেকটা শব্দ যেন ফের এগিয়ে আসছে। বাবু বিছানা থেকে নিচে নামল। দক্ষিণে জানালার একপাট খোলা। ওখানে সবই উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। বাবু একনজর দেখল, ওদিকের আকাশে কমলা কিংবা লাল রংয়ে ছড়াছড়ি। মাকে দেখল দোয়া-দরুদ পড়ছে। টিমু ওর মাক ধরে কাঁপছে। ’চুইং’ শব্দটা ফের আসছে। আবার ঝলমল করে উঠল আকাশটা।

রাজারবাগ বোধ হয় শেষ! বললেন বড়মামা।
ওরা তাহলে যুদ্ধ শুরু করে দিল। এখন আমাদের কি করতে হবে? মরতে হবে অথবা লড়াই করতে হবে। আপন মনে যেন বললেন জসিম ভাই। আরও কীসব যেন বলছেন তিনি। গুলির শব্দে শোনা যাচ্ছে না। প্রচণ্ড শব্দ আবার আসছে। বাবু দু’কানে হাত চাপা দিল।

জানালা থেকে সরে এসো সবাই। গুলি এসে লাগতে পারে। জানলা বন্ধ করে দাও। অন্ধকার থেকে বড় মামার গলা ভেসে এলো। তাহলে সত্যি গুলি হচ্ছে! বাবুর ভয়টা যেন বেড়ে গেল। গুলি এসে লাগলে কি হবে? ওরা মরে যাবে!

পতাকা! পতাকা কি নামানো হইছে! বাবার গলা শুনতে পেল বাবু।
সর্বনাশ! এখন কি হবে! ওরা তো গলিতে চলে আসবে? ভয় পাওয়া গলায় বললেন বড় মামা।
বাবুর মনে পড়ল, বেশ কয়েকদিন ধরে ঘরের চালে লাল-সবুজ পতাকা টানানো হয়েছে। সবুজের মধ্যে লাল সূর্য, স্বাধীনতার পতাকা।
আমি যাই, পতাকা নামিয়ে আনি। বললেন জসিম ভাই।
গুলির মধ্যে কিভাবে যাবে? সবাই একসাথে বলল।
পতাকা নামাতে হবে। মিলিটারি আসলে কাউকে বাঁচতে হবে না। কথা বলতে বলতে দরজা খুলে ফেলল জসিম ভাই। দূরের আগুনের আভায় ঝলমল করে উঠল পুরো ঘর।

আমি আসি তোর সাথে? বললেন ছোট মামা।
দরকার নাই্। আমি মাথা নিচু করে যাচ্ছি।
বাবু দেখল, মাটির উপর ঝুঁকে অন্ধকারে হারিয়ে গেলেন জসিম ভাই। দরজাটা চাপিয়ে দিল একজন। ঘরের ভেতর কেউ আর কথা বলছে না। বাবুর মনে হলো, জসিম ভাইয়ের জন্য সবাই অপেক্ষা করছে।

বাবুর মনটা খারাপ হয়। কিছু দিন ধরে অদ্ভুত সব কাণ্ড-কারখানা শুরু হয়েছে। প্রতিদিন হরতাল আর মিছিল চলছে। ওরা প্রতিদিনই বড়দের মতো করে মিছিল মিছিল খেলেছে। ওদের স্কুল নেই। বড়রা পড়ার জন্য ওদেরকে তেমন চাপ দিচ্ছে না। শুধু খেলা আর খেলা। আর বড়রাও কেমন বাচ্চাদের মতো হয়ে গেছে। বাবা, মামা, জসিম ভাই, অন্য ভাড়াটে সবাই দুপুর হলেই একসাথে মিছিলে যায়। সবার হাতে থাকে বাঁশের লাঠি। কারও কারও লাঠিতে ছোট্ট লাল-সবুজ পতাকা। সন্ধ্যার সময় ফিরে বাংলো ঘরে শুরু হয় আড্ডা। অনেক রাত অবধি জমজমাট থাকে বাড়িটা। এসব ভাবতে ভাবতে বাবুর চোখের পাতা ভারি হয়ে যায়।

রাত তো শেষ হলো। আজানের শব্দ শোনা যাচ্ছে না! নানুর কথায় বাবু চোখ মেলে তাকায়। গোলাগুলির শব্দ এখন কিছু কমে এসেছে। এ সময় বড় গেট ধাক্কার শব্দ এলো। পাওয়া গেল ভারি বুটের শব্দ। কারা যেন গেটে চিৎকার করছে। বাবু দেখল, বড়রা সবাই সবার দিকে তাকাচ্ছে। সবাই যেন ভয় পাচ্ছে। বাবুর ভীষণ ভয় লাগছে।

দরজা খুলুন ভাই! আমরা বাঙালি। গেট থেকে চিৎকার করে বলল কেউ। কথাটা আরেক বার শুনল সবাই। তারপর জসিম ভাই গেল গেট খুলতে। পরমুর্হূতে ভারি বুটের আওয়াজ পাওয়া গেল। বাবু উঠে গেল। দরজার ফাঁক দিয়ে বাইরে এলো। বড়রা কেউ কিছু বলল না। হয়তো ভেবেছে, বাবুর হিসি পেয়েছে। বাবু দেখল, জসিম ভাইয়েল সাথে আটজন লোক। সবার গায়ে হাতা কাটা গেঞ্জি। জসিম ভাইয়ের সাথে সবাই খাবার ঘরে ঢুকল। বাবু দেখল, সবার হাতে একটা করে রাইফেল। গায়ের শার্ট দিয়ে জড়ানো। জসিম ভাই ইশারায় বাবুকে ডাকল। বাবু তার পেছন পেছন খাবার ঘরে এলো। লোকগুলো ঘরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসল। জসিম ভাই বললেন, যা তো বাবু, তোর নানুর মুড়ি টিন আর গুড়ের ডিব্বাটা নিয়ে আয়।

বাবু এক দৌড়ে নানুর ঘরে এলো। সামনে পড়ল মা, কোথায় ছিলি তুই? এই গোলাগুলির মধ্যে? বাবু দু’পা পিছিয়ে গেল। মা নিশ্চয়ই বাবুর কান টেনে দিতে চেয়েছিলেন। বাবু তাড়াতাড়ি বলল, জসিম ভাই ও ঘরে মুড়ি আর গুড় নিয়ে যেতে বলেছেন।

বাবুর কথা শুনে বাবা আর দুই মামা খাবার ঘরে ছুটলেন। মুড়ি আর গুড় দিতে গিয়ে বাবু অনেক কথা শুনল। ওই লোকগুলো রাজারবাগের পুলিশ। সারা রাত এরা পাকিস্তানি সৈন্যদের সাথে যুদ্ধ করেছে। এখন ওদের গুলি শেষ হওয়ায় পালিয়ে এসেছে। এখন ওদের পোষাক পাল্টানো দরকার। ওরা এখন ঢাকা ছেড়ে পালাবে। জসিম ভাই সবার জন্য লুঙি নিয়ে এলেন। পুলিশরা লুঙি পরে সবার সাথে কোলাকুলি করে চলে গেল। ভোর হচ্ছে। গোলাগুলি থামার লক্ষণ নেই। তবে গোলাগুলির শব্দে বাবুর আর আগের মতো ভয় লাগছে না। ঘুম চলে গেছে।

বড় মামা রেডিও খুললেন। আজ নাকি সারাদিন কেউ ঘরের বাইরে যেতে পারবে না। কার্ফ্যু জারি হয়েছে। বাবু দেখল, বড়রা ভয় পেয়েছে।
না, এই শহরে আর থাকা যাবে না। ওরা এ শহরে বাঙালিদের থাকতে দেবে না। বিড়বিড় করলেন বড়মামা। চলবে