
ফাইল ছবি
হৃদয় ছোঁয়ার দিন
উপন্যাস ১৩
সাজ্জাদ হায়দারপ্রকাশিত : জানুয়ারি ০৯, ২০২০
বিভীষিকাময় দুটি রাতের পর ২৭ মার্চ ঢাকায় এক অন্যভোর। সকাল থেকে সন্ধ্যা পযর্ন্ত কার্ফ্যু তুলে নেয়ার ঘোষণা দিয়েছে রেডিও পাকিস্তান। যত দ্রুত সম্ভব এই প্রিয় নগরী ছেড়ে দূরে কোথাও চলে যাওয়াই হতবিহ্বল মানুষের প্রথম কাজ। নগরীর রাস্তায়, ড্রেনের পাশে এখনো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে মানুষের মৃতদেহ। ঢাকার আকাশে আগে সচারাচর শকুন দেখা যেত না। আজ সূর্যোদয়ের সাথে সাথে আকাশে শুরু হয়েছে শকুন ঝাঁকের ওড়াওড়ি। হতবিহ্বল মানুষ যতটা সম্ভব জিনিসপত্র নিয়ে ঢাকা ছাড়ছে। অলিগলি থেকে মানুষ এসে মিশে যাচ্ছে মহাসড়কের জনস্রোতে। এই জনস্রোতে শিশু-বালক-বালিকা থেকে শুরু করে বৃদ্ধবৃদ্ধা সবাই আছে। এই মহাসড়কে গরিব-ধনি সবাই মিলেমিশে একাকার হয়ে পথ হাঁটছে। সবার মধ্যে একই ভীতি, একই আশা, বেঁচে থাকার একই রকম নেশা।
কার্ফ্যু উঠে গেলেও রাস্তায় চলছে সেনা টহল। পলায়নপর মানুষ শহর না ছাড়া পর্যন্ত বেঁচে থাকার কোনও গ্যারান্টি পাচ্ছে না। পাক সেনাদের টহল যান বাঘের উপস্থিতিতে কম্পমান মেষপালের মতোই ভীত-সন্ত্রস্ত্র করে তুলছে পলায়নপর মানুষকে। মানুষের স্রোতে হাঁটতে হাঁটতে নানা চিন্তায় ডুবে আছে আমান। মেসবাড়ির সবাই ঢাকা ছেড়ে যাচ্ছে। আমানকেও বাধ্য হয়ে ঢাকা ছাড়তে হচ্ছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ওপর নির্মিত গুটি কয়েক বিখ্যাত চলচ্চিত্র আমান দেখেছে। জার্মান সৈন্যদের ভয়ে পলায়নপর ইহুদি উদ্বাস্তুদের মতো মনে হচ্ছে নিজেদের। এখন আমানের প্রয়োজন একটা ক্যামেরা। একটা রাইফেলের চেয়ে একটা ক্যামেরা এই মুর্হূতে অনেক মূল্যবান। আমান একটু থামল। সাপের মতো প্যাঁচানো রাস্তায় শুধু মানুষের মাথা আর মাথা। লং শটে এধরনের সিকয়েন্স কী চমৎকার ভাবেই না ফুটিয়ে তোলা যায়!
আমান ওর ক্যামেরার চোখে চারদিক দেখতে দেখতে তোপখানা পেরিয়ে হাইকোর্টের সামনের রাস্তায় এলো। রাস্তার একপাশে কাত হয়ে পড়ে আছে শতাব্দী প্রাচীন মহাবৃক্ষ রেইনট্রি। পাকসৈন্যদের বাধা দিতে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররা জনতার সাথে মিলে ২৫ মার্চ রাতে এই গাছ কেটে পাক সৈন্যদের বাধা দিতে চেয়েছিল। এসব বাধা সামরিক বাহিনীর কাছে কোনও বাধাই না। খুব সহজেই পাকসৈন্যরা বুলডজার দিয়ে গাছটিকে একপাশে সরিয়ে পথ করে নিয়েছে। তারপর বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে হামলা করেছে। ওখানে কজন মরেছে কে জানে!
রেইনট্রি গাছের পাশেই গুলি খেয়ে লুটিয়ে পরে মরে আছে কেউ। পিঠের ওপর জমাট হয়ে আছে চাপ চাপ রক্ত। লোকটি হয়তো পালাতে চেয়েছিল। লোকটির কোমরে জড়িয়ে আছে আধ ময়লা লুঙি। হয়তো পাকিস্তানি সৈন্যদের দেখে পালাতে চেয়েছিল অথবা হঠাৎ গুলির শিকার। আরেকটু কাছাকাছি হতেই লাশ পচা গন্ধে আমানের গা গুলিয়ে উঠল। ঠিক তখনই দূর থেকে ভেসে এলো সৈন্যবাহী ট্র্যাকের শব্দ। এদিকে আসছে। পলায়নপর মানুষের মধ্যে ভীতি ছড়িয়ে পড়েছে। বিড়বিড় করে সবাই আল্লাহকে ডাকছে। রাস্তা ছেড়ে সবাই ফুটপাতের ওপর দিয়ে পথ চলতে লাগল। সবার বুকে কাঁপন ধরিয়ে তীব্র বেগে ছুটে গেল পাক সৈন্যদের তিনটি ট্র্যাক। সম্ভবত কলা ভবন এলাকায়। বিস্ময়ের ব্যাপার, পাকিস্তানি সৈন্য লোকজনকে পালিয়ে যেতে তেমন বাধা দিচ্ছে না। ওরা হয়তো ঢাকা শহর বাঙালিমুক্ত করতে চায়। এমনো হতে পারে, এ জীবনে শুধু আমানই নয়, এই পলায়নরত মানুষের কেউ আর কখনো এই প্রিয় শহরে ফিরে আসতে পারবে না।
ক্রোধে আর দুঃখে আমানের চোখের পাতা ভিজে উঠল। মানুষের মিছিল কার্জন হলের পূবের রাস্তা ধরে বুড়িগঙ্গামুখি হয়। আমান দেখল, ওদিকের রাস্তা থেকে দুজন লোক একটা ঠেলাগাড়ি এদিকে টেনে নিয়ে আসছে। ঠেলাগাড়িতে চাদরে ঢাকা একটা লাশ। ঠেলাঅলা জানালো, ২৫ মার্চরাতে নিহত লোকটি কার্জন হলের পশ্চিমপাশের মোড়ে রাস্তার ধারে ঠেলাগাড়ি রেখে রোজকার মতো গাড়ির উপর শুয়েছিল। আজ সকালে র্কাফ্যু উঠে যাওয়া পর ঠেলাগাড়ির খোঁজে এসে ওরা দেখতে পায়, লোকটি ঠেলাগাড়ির পাশেই মরে পরে আছে। নিহত লোকটি ওদের অগ্রজ। এ লাশ থেকেও গন্ধ বেরুচ্ছে। আমান আবার ফুটপাতে উঠে এলো।
বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ছেড়ে ইংলিশ রোডে এসে আমান দেখল এক নতুন দৃশ্য। এ এলাকা টিন, কাঠ, লোহা লক্করের বাজার। এখন কিছু চেনার উপায় নেই। পুরো এলাকা আগুনে পুড়েছে, অবশিষ্ট আছে ছাই আর পোড়াটিন। বাতাসে এখনো পোড়া গন্ধ। ধোঁয়া উঠছে কোথাও কোথাও। কিছু লোক পোড়াটিন সারানোর জন্য এদিক ওদিক ছোটাছুটি করছে। কাঠ টিনের সাথে মানুষও নিশ্চয়ই ছাই হয়েছে। পঁচিশ মার্চের মধ্যরাতের পর কামানের গোলা এসে এই মার্কেটে আঘাত করে। হতবিহ্বল মানুষ ধ্বংস যজ্ঞের দিকে তাকিয়ে আছে। কেউ কেউ বিলাপ করে কাঁদছে। সান্ত্বনা দেয়ার ভাষা নেই কারও। অনাহত ভবিষ্যতের চিন্তা নিয়েই বিভোর সবাই।
ঠিক এগারটায় বুড়িগঙ্গার পাড়ে বাদামতলী ঘাটে পৌঁছাল আমান। নদীতে আজ নুতন দৃশ্য, ডজন ডজন নৌকা মানুষজনকে এপার থেকে ওপারে নিচ্ছে। খেয়াপারের জন্য অপেক্ষমান মানুষদের মধ্যে এক ধরনের স্বস্তি। বেঁচে থাকার আনন্দ। পানি খাচ্ছে। হাতপা ছড়িয়ে জিরিয়ে নিচ্ছে কেউ কেউ। তারপর লাইন ধরে খেয়া নৌকায় উঠে যাচ্ছে। এক সময় আমানও খেয়ায় উঠল। নৌকায় সব বয়সি মানুষ। এক হিন্দু দম্পতি। গেরুয়া পোষাকের এক বৌদ্ধ ভিক্ষু। এই ছোট্ট খেয়া নৌকায় জাতপাত মিলিয়ে সবাই বাঙালি হয়ে উঠেছে।
নৌকা জিঞ্জিরা ঘাটে ভিড়ল। মাটি পা রাখতে বৌদ্ধ ভিক্ষু মাটির খণ্ড হাতে তুলে নিয়ে কপালে ঠেকালো। আমানের শিরদাঁড়া কেঁপে উঠল, সে ভূমি স্পর্শ করে তুলে নিল মাটির একটি টুকরা। জিঞ্জিরায় এখনো পাকিস্তানি সৈন্য নেই। এভূমি মুক্তভূমি। মুক্তভূমির স্পর্শ আজ সব বাঙালিকে নিতে হবে। মাটির খণ্ড কপালে ছোঁয়াতে আমানের দু’চোখের পাতা ভারি হয়ে উঠল। চলবে