
হৃদয় ছোঁয়ার দিন
উপন্যাস ১৩
সাজ্জাদ হায়দারপ্রকাশিত : জানুয়ারি ১০, ২০২০
পঁচিশে মার্চ রাত। পারুল ঘুমাতে পারেনি। পারুল কেন, এই আজিমপুর কলোনির কেউ-ই ঘুমাতে পারেনি। গুলিগোলার অশ্রুতপূর্ব শব্দে আর আতংকে ওরা মৃত্যুর কাছাকাছি চলে গিয়েছে। মধ্যরাতের আগেই পাকিস্তানিরা এখানকার ইপিআর ক্যাম্পে হামলা চালিয়েছে। ভয়াবহ ব্যাপার হলো, কালরাতে শফিক বাড়ি আসেনি। পারুল জানালার একটা পাট খুলে রাস্তার দিকে তাকিয়ে ছিল, যদি শফিক আসে! জানালা দিয়ে রাস্তায় একটা মানুষও দেখা যায়নি। চোখে এসেছে দূরাগত আগুনের আভা, আর গোলাগুলির শব্দ ছাপিয়ে দৈত্যের মতো রাস্তা কাঁপিয়ে ছুটে গিয়েছে পাকিস্তানিদের সামরিক যান। অন্যদিকে বাবা সারারাত জায়নামাজে কাটিয়েছেন। মাঝে মাঝে পারুলের মাথায় হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দিয়েছেন।
আশা-নিরাশা আর আতংকের রাতে কত কথাই না মনে পড়ে! শফিক স্বামী হিসাবে অসাধারণ হলেও পারুল ওকে ভালবাসতে পারেনি। পারুলের ভালোবাসা পাওয়ার জন্য লোকটা কোনও চেষ্টাই করত না। অফিস আর বাড়ি, এই ছিল লোকটির পৃথিবী। প্রায়শ অফিসের ফাইল নিয়ে বাড়ি চলে আসত। প্রতিমাসে ব্যাংকের ডিপোজিট স্লিপ পারুলকে গর্ব ভরে দেখাত। করাচিতে একটা বাড়ি বানানোই শফিকের একমাত্র স্বপ্ন। মার্চের প্রথম দিকেই পারুলকে নিয়ে করাচি থেকে শফিক ঢাকা আসে। বিয়ের পর এই প্রথম দেশে ফেরা। শফিক ঢাকা এসেও পারুলকে সময় দিতে পারেনি। প্রতিদিনই হাবিব ব্যাংকের মতিঝিল অফিসে ধর্ণা দিচ্ছে। শফিককে আবার ঢাকায় পোস্টিং দেয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এই ব্যাপারটা ঠেকানোর জন্যই শফিক সারাদিন অফিস পাড়ায় পড়ে থাকে।
ট্রান্সফার ঠেকানোর জন্য বসের কাছে তদ্বিরের জন্য অবাঙালি কলিকদের তোয়াজ করে। অসহযোগ আন্দোলন শুরু হলে শফিকের বিরক্তি চরমে ওঠে। কোনও কারণে পাকিস্তান ভেঙে যাক, এটা শফিক চায় না। পাকিস্তান ভেঙে গেলে করাচিতে বাড়ি হবে কীভাবে!
বাড়ির সামনে দিয়ে প্রতিদিনই মিছিল-মিটিং যায়। এই কলোনির সবাই সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, অথচ সবাই এক আধদিন মিছিল-মিটিংয়ে যায়। একদিন মিছিলে নিয়ে যাওয়ার কথা বলতেই শফিক অবাক হয়ে পারুলের দিকে তাকিয়ে থাকে। শফিকের তাকানোর ভঙ্গিতে এমন কিছু ছিল, যাতে এ ব্যাপারে ফের অনুরোধ করতে পারুলের রুচিতে বাধে। সারাদিনই এ রাস্তা দিয়ে বিভিন্ন ধরনের মিছিল যায়। শফিক বাড়িতে না থাকলে মিছিলের শ্লোগানের শব্দ কানে এলেই পারুল বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। মিছিলের লোকগুলোকে খুটিয়ে দেখতে থাকে। একটা চেনামুখ খুঁজে বেড়ায়। নিরাশ হয়ে ঘরে আসে। মিছিল হবে অথচ ছটটু থাকবে না, এটা হতেই পারে না। বিয়ের পর থেকে ছটটুর কোনও খবর পারুল জানে না। লজ্জার কারণে কারও কাছে জানতেও চায় না।
করাচি থেকে ফিরে ঢাকার উত্তাল অবস্থা দেখে ছটটুর কথাই আগে মনে আসে। এ ধরনের কাজের জন্য ছটটু অবহেলায় পারুলকে উপেক্ষা করে। ছটটুর কাছে পারুলের কানাকড়ি মূল্যও নেই। জীবনে একবার হলেও ছটটুর মুখোমুখি হতে ইচ্ছে হয়। একদিন শফিক বাইরে চলে যাওয়ার পর পারুল সামান্য সাজে বাড়ির বাইরে আসে। ঢাকা শহরের রাস্তা ঘাট তেমন চেনে না পারুল। একা চলাচলের তেমন অভ্যাসও নেই। তবে বাড়ির কাছে হওয়ায় নিউ মার্কেট ভালই চেনে। শফিক যদি জানতে পারে তবে নিউ মার্কেটের কথা বললেই হবে। ঢাকা শহরে এই রোজ মিছিল হচ্ছে, এসব মিছিল কোথায় শুরু হয়, কোথায় শেষ হয়, আজ পারুল দেখতে চায়।
পারুল রাস্তায় দাঁড়াতেই একটা রিকশাঅলা এগিয়ে আসে। কই যাইবেন আফা?
পারুল এই প্রশ্নে একটু থতমত খায়। মিছিল কোথায় শুরু হয় পারুল জানে না, আন্দাজে কোথায় যাবে? পারুল চিন্তায় পড়ে। অনেক ভেবে রিকশাঅলাকেই জিজ্ঞাসা করল, এখানে মিছিল হয় কোথায়?
ও মিছিলে যাইবেন? ওঠেন আফা, এই তো সামনে শহিদ মিনার। ওইখানেই মিছিল হয়।
ভাড়া কত?
আফা আপনে ওঠেন তো। যারা মিছিলে যায় আমি তাগো কাছে ভাড়া চাই না। ওঠেন আফা।
পারুলের দ্বিধা কেটে যায়। সে রিকশায় উঠে বসে।
আফা, আমাগো আর চিন্তা নাই। দ্যাশ স্বাধীন হইয়া যাইবো। স্বাধীন হইলে কি আমরা রিকশা চালামু। এই যে আপনে দ্যাশের কামে যাইতাছেন, আপনারে নিয়া যাইতে আমার কত ভালই না লাগতাছে। এইড্যাও দ্যাশের কাম। কি কন আফা!
রিকশাঅলার কথা শুনে পারুল লজ্জা পায়। জীবনে এই প্রথম পারুল মিছিলে যাওয়ার জন্য রিকশায় উঠেছে। আর রিকশাঅলা পারুলকে ছটটুদের মতো মিছিলের লোক মনে করেছে। রিকশাঅলা বিড়বিড় করে আরো অনেক কিছু বলতে থাকে। পারুল শুধু হু হা করে সায় দেয়। খুব দ্রুতই শহিদ মিনার এসে যায়। পারুল রিকশাঅলার হাতে জোর করেই একটা টাকা গুজে দেয়। শহিদ মিনারের দিকে তাকাতেই পারুলের গায়ে শিহরন বয়ে যায়। গায়ের লোম খাড়া হয়ে ওঠে। এত কাছ থেকে এই প্রথম শহিদ মিনারকে দেখা। শহিদ মিনারের আশপাশে অনেক লোক। নারী-পুরুষ-শিশু। কেউ বসে, কেউ দাঁড়িয়ে। বেদির উপরে বসে একদল শিল্পী গান গাইছে। গান শেষ হতেই একজন ঘোষক গানের সমাপ্তি টেনে বলল, এখনই আমাদের মিছিল শুরু হবে। মিছিল নিয়ে আমরা ধানমন্ডি বত্রিশ নম্বরে যাব।
মিছিলের প্রস্তুতি চলছে। পারুল আবার দ্বিধায় পড়ে। ইচ্ছে হলে এখান থেকে বাড়ি ফিরে যাওয়া যায়। শফিক কেন, কেউ কিছু জানতে পারবে না। মিছিলের দিকে তাকিয়ে পারুল আবার দ্বিধায় পড়ে। মিছিলের সামনে সারিবদ্ধভাবে মেয়েরা ধীরে ধীরে দাঁড়াচ্ছে। একটি মেয়ে অতি পরিচিতার মতো পারুলকে হাতের ইশারায় ডাকছে। এগিয়ে যেতেই মেয়েটি একটু সরে গিয়ে পারুলকে দাঁড়ানোর জায়গা করে দেয়।
মিছিলের সামনে কয়েকজন হারমনিয়াম নিয়ে গান গাইতে গাইতে পথ চলছে। ভয় আর সাহস দুই মিলে এক অদ্ভুত অনুভূতি নিয়ে পারুল পথ চলছে। চেনা অচেনা নানা পথ ধরে মিছিলটি পথ চলতে থাকে। ধানমন্ডি লেকের পারের সরু রাস্তায় গিজগিজ করছে মানুষ। এই লেকের ধারেই শেখ মুজিবের বাড়ি। পারুলদের মিছিলটা গলির গলি মুখে ঢুকতেই মানুষের চাপে ওদের মিছিলটা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। পারুল হতভম্ব হয়ে রাস্তার একপাশে সরে আসে। এখন কি করবে ভেবে পাচ্ছে না। মিছিলের চেনামুখগুলো জনস্রোতে হারিয়ে গেছে। এতদূর হেঁটে আসায় ক্লান্তি লাগছে। বাড়ি ফিরে যাওয়ার কথা ভাবছে, কিন্তু শেখ মুজিব? শেখ মুজিবকে দেখা যাবে কি? আর দুটি বাড়ির পরই যে শেখ মুজিবের বাড়ি! মানুষের দঙ্গল দেখে পারুল হতাশ হলো। এই দঙ্গল ঠেলে ওর পক্ষে একচুলও এগুনো সম্ভব না।
ইশ্, শফিক যদি সাথে থাকত! পারুল জানে, সারা জীবন চেষ্টা করলেও শফিক এধরনের কাজে আসবে না। একটি হাত এসে পারুলের পিঠে পড়ল। পারুল চমকে তাকালো, ওর কাঁধ ঘেঁষে দাঁড়িয়েছে সেই মেয়েটি। এই মেয়েটি ওকে মিছিলে ডেকেছিল। মিছিলে মেয়েটি ওর পেছনেই ছিল। মেয়েটির নাম শিখা। চলো ওইদিকে যাই। পরিচিত জনের মতো মেয়েটি বলল।
ওদেরকে এগিয়ে আসতে দেখে কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবক ওদের পথ করে দিল। রাস্তার এপাশে মেয়েদের সারি। দুটি বাড়ি পার হতেই পারুল বত্রিশ নম্বর বাড়ির দক্ষিণের ফুটপাতে এসে দাঁড়াল। নিচু দেয়ালের এ পাশ থেকে পুরো বাড়িটাই পারুলের চোখে পড়ল। আঙ্গিনার ভেতর মানুষ আর মানুষ। এ ভিড় ঠেলে পারুল কেন, কোনও মেয়ের পক্ষেই ভেতরে যাওয়া সম্ভব নয়। সবাই বলাবলি করছে, শেখ মুজিব এখন বাড়ির ভেতর আছেন। অন্য নেতাদের সাথে মিটিং করছেন। পারুল একটু হতাশ হলো, ওর পক্ষে আর দেরি করা সম্ভব নয়। শফিক চলে এলে মারাত্বক কেলেংকারি হয়ে যাবে। আফসোস্, এত দূর এসেও শেখ মুজিবকে দেখা হলো না। পারুল ওর পাশের মেয়েটিকে বাড়ি ফেরার কথা বলতে যাবে, ঠিক তক্ষণই নুতন একটা গুঞ্জন, ওই ওই যে মুজিব। অবাক বিস্ময়ে পারুল দেখল, দোতলার বারান্দা এসে দাঁড়িয়েছেন দীর্ঘদেহী শেখ মুজিব। সাদা পাঞ্জাবি-পাজামা, হাতাকাটা কালো কোট। হাতে একটা সিগার খাওয়ার পাইপ। মুজিব একটু ঝুঁকে সমাবেত মানুষগুলোকে দেখলেন। ততক্ষণে শ্লোগানে শ্লোগানে কেঁপে উঠছে গোটা এলাকা।
শেখ মুজিব বোধ হয় কিছূ বলবেন। না, তিনি কিছুই বললেন না, সবদিকে তাকিয়ে হাত নাড়লেন। পরমুর্হূতে হেসে আবার বাড়ির ভেতর চলে গেলেন। এক-দু’মিনিট মাত্র! মিছিলের লোকজন নানা ধরনের উত্তেজক শ্লোগান দিচ্ছিল এতক্ষণ। কিন্তু মনে হলো, মুজিব যেন এই মানুষজনের মনের কথা ঘরের ভেতর বসেই টের পেয়েছিল। শ্লোগান বন্ধ করে এখন সবাই পরম তৃপ্তিতে একজন আরেকজনের দিকে তাকাচ্ছে। পারুল ওই মেয়েটিকে সাথে নিয়ে বাড়ি ফেরার জন্য ভিড়ের বাইরে এলো। পারুল শেষবারের মতো মিছিলের মানুষগুলোকে দেখতে লাগল। এ ধরনের জায়গায় ছটটুর থাকার কথা। যদি পাওয়া যায়! যাত্রীর অপেক্ষায় একঝাঁক রিকশা দাঁড়িয়ে আছে। ওখানে রিকশাযাত্রীদের জটলা। শিখা নামের মেয়েটির সাথে নানা কথা বলতে বলতে পারুল ওখানে আসে। একটা লোকের দিকে পারুলের চোখ যায়। লোকটির সাথে সালোয়ার কামিজ পরা অপূর্ব এক মেয়ে। ঘনিষ্ঠভাবে কথা বলছে দুজন। বারবার পারুল ওদের দিকে তাকাচ্ছে। লোকটিও হঠাৎ করে পারুলের দিকে তাকালো। চোখাচোখি হয়ে গেল। পারুল লজ্জা পেয়ে চোখ ঘুরিয়ে নিল। আর লোকটি দুকদম এগিয়ে এসে একেবারে পারুলের প্রায় গা ঘেঁষে দাঁড়ালো।
আরে তুমি পারুল না! অনেক বছর পর তোমাকে দেখলাম!
আপনাকে তো ঠিক চিনতে পারছি না। তবে কোথায় যেন দেখেছি!
ছটটুদের বাসায়, অবশ্য তুমি তখন অনেক ছোট ছিলে, আমি ছটটুর বন্ধু আমান।
ছটটুর নামটা শোনার সাথে সাথে পারুলে সাড়া দেহে একটা শিরশির অনুভূতি বয়ে যায়। সিনেমার ফ্লাশব্যাকের মতো নানা টুকরা দৃশ্য ভেসে উঠে। ছটটুর বড় ভাইয়ের বিয়েতে কিশোরী বয়সের পারুল তিনদিন থেকেছিল ছটটুদের বাড়িতে। তখনই ছটটুকে ভালো লেগেছিল। আমান আর ছটটু দুজনে ছিল মানিক জোড়। কী রোমাঞ্চকর দিনই না গিয়েছে!
আপনি ভালো আছেন আমান ভাই? আসলে অনেক বছর পর তো, তাই আপনাকে চিনতে পারিনি। অবশ্য ঠিকই চেনা চেনা লেগেছিল।
আর পারুল, এ হলো আমার কাজিন পারভিন। পাশের মেয়েটিকে দেখিয়ে আমান বলল। মেয়েটি পারুলকে সালাম দিল। ওদের সাথে অনেক কথার পর সংকোচ ঝেড়ে ফেলে পারুল বলল, ছটটু ভাইয়ের খবর কি?
ওর আর খবর! ডিসেম্বর থেকে জেলে আছে। এখন কুষ্টিয়া জেলে।
জেলে কেন? বোকার মতো প্রশ্ন করল পারুল।
আর কেন, দেশকে স্বাধীন করতে হবে, সেই জন্য। কিছুটা আবেগ ঝরে পড়ে আমানের কণ্ঠে। জানো, ওরা অত্যাচার করে ওর শরীরটা একেবারে শেষ করে দিয়েছে।
অনেক কষ্টেও কান্না চাপাতে না পেরে পারুল হাত নেড়ে আমান আর সাথের মেয়েটিকে বিদায় জানিয়ে একটা রিকশা উঠে বসে। রিকশা যখন অনেকদূর এগিয়ে এসেছে তখনই পারুলের মনে হলো, আমানের কোনও ঠিকানা নেয়া হয়নি। পারুলও কোনও ঠিকানা রেখে আসেনি।
অন্যসব দিনের মতো পঁচিশে মার্চ রাতও শেষ হয়। সারা রাতের আগুন কিংবা গোলাগুলির শব্দ কিছুই পরের দিনের ভোর হওয়া ঠেকাতে পারেনি। আব্বা বলেছেন ভোর হলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। শফিক ফিরে আসবে। এখন ভোর হচ্ছে। পারুল এই ভোরের জন্যই সারারাত অপেক্ষা করেছে। চলবে