হৃদয় ছোঁয়ার দিন

উপন্যাস ১৪

সাজ্জাদ হায়দার

প্রকাশিত : জানুয়ারি ১১, ২০২০

আকস্মিকভাবে জেলমুক্তি! তাও আবার জনগণ জেল ভেঙে সব রাজবন্দিতে মুক্ত করবে, এটা ছ্টটু স্বপ্নেও ভাবেনি। ডিসেম্বর থেকে মার্চ ছটটু কারাগারে। আর বাইরে অচিন্ত্যনীয় সব ঘটনা ঘটে চলেছে। বিপ্লব তো এভাবেই শুরু হয়। জেলের বাইরে এসে প্রাথমিক বিস্ময় কাটিয়ে ছটটুর চিন্তা এলো, এখন কি করবে? কোথায় যাবে? কুষ্টিয়ায় পরিচিত তেমন কেউ নেই। শুধু এক সহবন্দি ওকে জোর করে একশো টাকা দিয়েছে। পাকিস্তানি বাহিনী এখনো এ শহর দখলে নিতে পারেনি। তবে আশপাশে যুদ্ধ চলছে। ছটটুর কোনও পিছুটান নেই। বাবা মারা যাওয়ার পর ভাইবোন সবাই ছড়িয়ে ছিটিয়ে, যে যার মতো আছে। ইচ্ছে হলে এ শহরে থেকে যেতে পারে। অংশ নিতে পারে প্রতিরোধ যুদ্ধে। তবে সবচেয়ে আগে দরকার ওদের দলের সাথে যোগাযোগ। কুমিল্লায় বেউথা নামের একটা গ্রামে গেলেই দলের সাথে যোগাযোগ হতে পারে। ঢাকাকে পাশ কাটিয়ে গ্রামের হাঁটাপথে কুমিল্লা যেতে হবে।

দুদিন ধরে ছটটু পথ চলছে। মার্চের ক্রাক ডাউনের পর বড় শহর বিশেষ করে ঢাকা শহর থেকে বিপুল মানুষ এখন গ্রামমুখি। মানুষের ভিড়ে এখন গ্রামগুলো উৎসব মুখর। খাবার আর আশ্রয় দিতে গ্রামের মানুষের কোনও কার্পন্য নেই। তবে ছটটুর উল্টো যাত্রাকে সন্দেহের চোখে দেখছে কেউ কেউ। গ্রামে গঞ্জে এখনো পাকিস্তানি বাহিনী আসেনি ঠিকই, তবে সব জেলা শহরগুলো এখন ওদের দখলে। শীঘ্রই ওরা এসে যাবে মহকুমা শহরে। তারপর বোধহয় গ্রামে এসে যাবে। এ নিয়ে মানুষের মাঝে আছে চাপা ভীতি। পথ চলতে চলতে গ্রামের তরুণদের সাথে কথা চলছে। সবাই যুদ্ধে যাওয়ার উপায় নিয়ে ভাবছে। আবেগ আর উৎকণ্ঠা নিয়ে ভবিষ্যৎ বোঝার চেষ্টা করে সবাই। এখন বসন্ত যাব যাব সময়। দ্রুত শুকিয়ে যাচ্ছে খালবিল। প্রতিদিনের তাপমাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। গুমট দুপুরে গরম যখন চরমে, ঠিক তখনই হঠাৎ আসা বসন্তের বাতাস স্বস্তির পরশ বুলিয়ে দেয়। অলস দুপুরে কোকিলরা অবিরাম ডেকে যায়। প্রায় শুকিয়ে যাওয়া পুকুর ডোবায় মৎস্য শিকারোৎসবে নামে বক, সারস, মাছরাঙা, চিল আর ফিঙ্গের ঝাঁক। অন্য বসন্তের চেয়ে এই বসন্তের প্রকৃতিগত কোনও পার্থক্য না থাকলেও পাল্টে যাচ্ছে মানুষ। আর এই বসন্তে নিজের চেয়েও বেশি চেনার চেষ্টা করছে দেশকে।

চারদিন ধরে পাল্টে যাওয়া গ্রাম আর লোকালয় পেরিয়ে ঢাকাকে পাশ কাটিয়ে এক সন্ধ্যায় ছটটু কুমিল্লার প্রান্তিক গ্রাম বেউথা পৌঁছায়। মেঘনা নদীর দুটো শাখা দুদিক থেকে এসে বেউথাসহ কয়েকটি গ্রামকে মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে। গ্রামে এসে খায়রুলকে খুঁজে পেতে কোনও অসুবিধা হয়নি। এ গ্রাম তো বটেই, আশপাশের গ্রামের মধ্যে খায়রুলই একমাত্র ’শিখিত’ লোক। সুতারাং এ এলাকায় আমজনতার মধ্যে খায়রুলে বিশেষ গ্রহণযোগ্যতা আছে। খায়রুল গ্রামের জনাদশেক তরুণকে নিয়ে মুক্তিবাহিনী গঠন করেছে। ২৫ মার্চের আগেই বাজারের কামারশালা থেকে বিশেষ ফরমাস দিয়ে তৈরি করা হয়েছে ’সড়কির ফালি’। সেগুলিকে শক্ত বাঁশের আগায় লাগিয়ে বর্শা বানানো হয়েছে। প্রথমদিকে রাত জেগে গ্রাম পাহারা দেয়া ছিল এই মুক্তিযোদ্ধাদের বড় কাজ। কিন্তু এখন ঢাকা থেকে পালিয়ে আসা মানুষগুলো নিরাপদে সীমান্ত পার করতে ওরা কাজ করে। তবে এ এলাকা এক কোণায় হওয়ায় খুব কমলোকই এ এলাকা দিয়ে সীমান্ত পার হয়।

ছটটুকে পেয়ে খায়রুল ভীষণ উত্তেজিত। গ্রামের তরুণ-কিশোররা উৎসাহ আর উদ্দিপনায় উদ্বেলিত। বছর দুয়েক আগে ছটটু কয়েকদিনের জন্য এ গ্রামে এসেছিল। কয়েকটা চেনা মুখও আছে। সবচেয়ে গুরত্বপূর্ণ খবরটা হলো, পাশের গ্রামে ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলর্স এর কয়েকজন পলাতক জোয়ান আশ্রয় নিয়ে সীমান্ত অতিক্রমের অপেক্ষায় আছে। এদের সাথে অস্ত্রও আছে। খুব দ্রুত সিদ্ধান্ত নিল ছটটু, নষ্ট করার মতো সময় নেই। গভীর রাতে খায়রুলকে নিয়ে রওনা হলো পাশের গ্রামে। পঁচিশ মার্চ রাতে এই ইপিআর সৈন্যরা ঢাকার পিলখানায় ছিল। এরা হঠাৎ আক্রমণের শিকার হলেও প্রাথমিক প্রতিরোধ গড়ে তোলে। কিন্তু পাকিস্তানি পদাতিক আর সাজোঁয়াবাহিনীর সম্মিলিত আক্রমণে এই প্রতিরোধ ভেঙে যায়। বিপুল প্রাণহানি ঘটে ওখানে। কোনোক্রমে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে এসেছে ওরা।

রাত শেষে যখন ওদের আলোচনা শেষ, তখন নিজেকে বিজয়ী বীরের মতো মনে হচ্ছে ছটটুর। পাঁচ ইপিআর সৈনিকের মধ্যে একজন ছটটুদের সাথে থেকে যাবে। বাকিরা হাতের অস্ত্র আর গুলিও রেখে যাবে। যে সৈনিক এখানে থেকে যেতে চাচ্ছে তার নাম রমিজ। ওর একভাই ’লেখাপড়া’ জানা মানুষ, ছটটুর মতোই বয়স। সুতরাং ছটটুর মতো আরেক লেখাপড়া জানা লোককে সাহায্য না করার কোনও কারণই নেই। পরদিন সূর্য ওঠার আগেই ওরা কাজে নেমে পড়ল। এক জায়গায় মাটি উচুঁ হয়ে টিলার আকার নিয়েছে। এই জায়গার নাম নিশ্চিতপুর। ইপিআর সদস্যদের সাথে কাজে নেমে পড়ল ছটটু। ক্যাম্প করার জন্য চমৎকার জায়গা পেল। শুরু হলো ঝোপঝাড় কেটে থাকার উপযোগী একটা ঘর আর চারদিকে চারটা আউটপোস্ট তৈরির কাজ। আনন্দ আর উদ্দীপনায় গোটা এলাকা উৎসব মুখর হয়ে উঠল। সূর্য যখন মধ্যগগনে, বয়লারের মতো জ্বলছে চৈত্রের খর দুপুর। ঘেমে একাকার সবাই। তখনও সমান তালে কোঁদাল আর দা চলছে।

এমন সময় দূরাগত সমবেত কণ্ঠের শব্দ ভেসে এলো। কাজ রেখে ভয় আর উৎকণ্ঠায় থমকে দাঁড়াল সবাই। কিছুক্ষণের মধ্যে স্পষ্ট হলো সমাবেত কণ্ঠধ্বনি, ’বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো বাংলাদেশ স্বাধীন করো’... ’জয় বাংলা’ ইত্যাদি। মিছিল নিয়ে সব বয়সি কয়েকশো গ্রামবাসী এদিকেই আসছে। মিছিল কাছাকাছি হতেই ছটটুদের সবাই এগিয়ে গিয়ে মিছিলকারীদের সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল। শ্লোগানে শ্লোগানে মুখর হলো এলাকাটা। শ্লোগানের রেশ একটু থামতেই একজন এসে কাগজের তৈরি একটি মালা ছটটুর গলায় পরিয়ে দিল। সাথে সাথে উল্লাস ধ্বনি উঠল। এ সময় একজন এসে ছটটুকে কাঁধে তুলে নেয়ার চেষ্টা করল। শ্লোগান উঠল, ছটটু ভাই এগিয়ে চলো, আমরা আছি তোমার সাথে। ’ছটটু তোমার ভয় নাই, আমরা আছি লক্ষ ভাই’ ইত্যাদি। সবার অনুরোধে একটা মাটির ঢিবিতে দাঁড়িয়ে বিপুল করতালি আর শ্লোগানের মধ্যে ছটটুকে দুয়েকটা কথা বলতে হলো। তারপর শুরু হলো আহার পর্ব। নাস্তার জন্য গ্রামবাসী কেউ এনেছে সিদ্ধ মিষ্টি আলু, গুড়-মুড়ি, কেউ কলার কাঁদি কেউ বা ডাব। খুব ভোর ওরা অভুক্ত অবস্থায় কাজে এসেছে। খাবারের চিন্তা ওদের মাথায় ছিলও না। হাড়ভাঙা পরিশ্রমের পর ওরা খাবারগুলো পেয়ে গোগ্রাসে গিলতে লাগলো। একজন জানালো, দুপুরের জন্য তার বাড়িতে খিচুড়ি আর খাসির মাংস রান্না হচ্ছে। এজন্য বারো সেরি পালিত খাসি জবেহ করা হয়েছে। সিরাজূলের কথা মনে পড়ল ছটটুর। সিরাজুল বলেছিল, জনগণ সাথে থাকলেই গণযুদ্ধ হয়। আর প্রয়োজনে জনগণই তাদের নেতা তৈরি করে।  

এক সপ্তাহের ভেতর গোটা এলাকার চেহারা পাল্টে গেল। প্রত্যন্ত গ্রাম নিশ্চিতপুর এখন আশপাশের মানুষের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। মুক্তিযোদ্ধা আর তাদের ঘাঁটি দেখতে প্রতিদিন শত শত মানুষ আসে। অনেকেই চাল-ডাল অন্যান্য খাবার-দাবার নিয়ে আসে। প্রায় তরুণ, কিশোরদের দাবি সবচেয়ে বেশি। তারা মুক্তিযোদ্ধা হতে চায়। অনেক বাছাই বাদ দেয়ার পরও নুতন রিক্রুটের সংখ্যা দাঁড়াল পঞ্চান্ন জনে। সময় নষ্ট না করে ইপিআরের রমিজ প্রশিক্ষণ শুরু করল। গ্রামবাসী রসদ যুগিয়ে যাচ্ছে, তবে এখন দরকার অস্ত্র আর গুলি। পাকিস্তানিরা এখান থেকে ষাট মাইল দূরে কুমিল্লা জেলা সদরে। হানাদারদের যাতায়াতের পথে কোথাও একটা অচমকা হামলা চালিয়ে অস্ত্র ছিনিয়ে আনতে হবে। এছাড়া অস্ত্র পাওয়ার কোনও সহজ পথ আপাতত নেই। রমিজকে নিয়ে ছটটু একটা অচমকা হামলা পরিকল্পনা করতে থাকে। চলবে