
হৃদয় ছোঁয়ার দিন
উপন্যাস ১৪
সাজ্জাদ হায়দারপ্রকাশিত : জানুয়ারি ১২, ২০২০
ঢাকার জনসংখ্যা ছিল ১২ লাখ। পঁচিশ মার্চের পর এখন চার লাখে নেমে এসেছে। এ শহর ছেড়ে যাদের পক্ষে গ্রামে কিংবা অন্য শহরে থাকা সম্ভব, তারা সবাই চলে গেছে। এ শহর এখন শিশু ও নারী শূন্য প্রায়। শিশু ও নারী এখন এ শহরে নিরাপদ নয়। নিরাপদ নয় সদ্য যুবা-তরুণরা। এখনকার ঢাকা যেন জরাগ্রস্ত বৃদ্ধের মতো মৃত্যুও প্রহর গুণছে। বাড়িঘরের মাথায়, অলি-গলিতে উড়ছে চাঁদ-তারা মার্কা পাকিস্তানি পতাকা। দেয়ালেরও কান আছে, এ কথাটা মেনে এ শহরের লোকেরা এখন কথা বলে। তারপরও রটে স্বাধীনতার পক্ষে-বিপক্ষে নানা গুজব। পাকিস্তানিরা গুজবে কান না দেবার জন্য নাগরিকদের সর্তক করে দেয়। এসব সর্তক বাণীতে গুজব আরও বাড়ে।
পঁচিশে মার্চ হামলার পর পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে যে প্রতিরোধ লড়াই শুরু হয়েছিল, তা এখন স্তিমিত। শুধু সীমান্ত এলাকায় এখন ছিটেফোটা লড়াই চলছে। পাকিস্তানিরা এসব লড়াই ভারতীয় অনুপ্রবেশকারীদের সাথে সংর্ঘষ হিসাবে অবিহিত করে থাকে। শহরের অধিকাংশ লোক দিনের বেলা হাই ভ্যলুমে রেডিও পাকিস্তান শুনলেও সন্ধ্যায় অতি সর্তকতায় ভ্যলুম কমিয়ে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র শোনে। তারপর নানা স্বপ্নে বিভোর হয়ে ঘুমাতে যায়। সরকারি অফিসগুলোতে উপস্থিতি প্রায় স্বাভাবিক হলেও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো স্বাভাবিক করতে পাকিস্তানিরা প্রতিনিয়ত চাপ দিয়ে আসছে।
মে মাসের তপ্ত দুপুরের প্যাচ প্যাচে গরমে ছটটু ঘেমে গেছে। ছটটুর পরিধানে চমৎকার পোশাক-আষাক। টেট্রনের সাদা শার্ট, কালো প্যান্ট আর চোখে সান-গ্লাস। ওকে এখন ঠিক ফিল্ম স্টারের মতো লাগছে। সিরাজুল হক এ ধরনের পোশাক-আষাক পরে ওকে ঢাকা শহরে চলাফেরা করতে বলেছেন। গত এক মাসে সারাদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ওদের দলের মধ্যে একটা যোগাযোগ গড়ে তোলা সম্ভব হয়েছে। পার্টির নেতৃত্বে পেয়ারা বাগান, সাভার, আর বিক্রমপুরে গেরিলা ঘাঁটি গড়ে উঠেছে। এখন দরকার অস্ত্র আর গুলি। সিরাজুল হক ভবিষ্যতের কথা মনে রেখে ঢাকায় একটি গেরিলা ঘাঁটি গড়ে তুলতে চায়। এছাড়া ঢাকায় ওদের কয়েকজন সহযোগী কমরেড রয়েছে। এদের সাথে যোগাযোগ রাখাটাও জরুরি। এ কারণে নিশ্চিতপুরের ঘাঁটি ছেড়ে ছটটুকে ঢাকায় আসতে হয়েছে।
মতিঝিলের স্টেট ব্যাংকের প্রবেশমুখে বালির বস্তার ঘেরের মধ্যে মেশিনগান ফিট করে পাকিস্তানি সৈন্যরা বসে আছে। রাস্তার ওপর সৈন্য ট্রাক আর জীপ, পুরো মতিঝিলকে একটা নিরাপত্তা ছাতায় নিয়ে আসা হয়েছে। রাস্তার লোকজন ভীরুপদে চলাফেরা করছে। পোশাক-আষাক আর টুপি দাড়িতে সবাই নিজেকে সাচ্চা মুসলমান হিসাবে প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করছে। স্মার্ট ভঙ্গিতে ছটটু ’সাফায়েত এসোসিয়েশন’এর প্রবেশ করে হাফ ছেড়ে বাঁচলো। সাফায়েত এসোসিয়েশনের মালিক জামাল ভাই। অফিস পিয়ন জানালো, তিনি এখনও আসেননি। তবে সময় হয়েছে। এখনই এসে যাবেন। জামাল ভাই নানা ধরনের ব্যবসা করেন। দেশের বিভিন্ন জায়গায় তার কনশস্ট্রাকশনের কাজ চলছে। ঢাকা শহরে গেরিলাদের নিশ্চিন্তে চলাফেরার জন্য জামাল ভাইয়ের সাহায্য দরকার।
প্রায় দু’ঘণ্টা বসে থাকার পর জামালভাই এলেন। তিনি অসম্ভব ঘামছেন। ছটটুর উপস্থিতি উপেক্ষা করেই জামাল ভাই তার চেয়ারে ধপ করে বসে পড়লেন। তারপর দুচোখ বন্ধ করলেন। মনের চাপ কমানো চেষ্টা করছেন বোধহয়! কিছু পরে তিনি চোখ খুলে ছটটুর দিকে তাকালেন, ’বুঝলে ছটটু, এ সবের দরকার ছিল না। যখন পারবে না, তখন খোঁচাতে গেলে কেন?’
থতমত খেয়ে ছটটু জিজ্ঞাসু চোখে জামাল ভাইর দিকে তাকালো।
আর বলো না। কাল সাভারে গিয়েছিলাম। সকালেই ঢাকার বাসে চড়েছি। বাসে প্রায় পঞ্চাশ ষাটজন যাত্রী। বাস মিরপুর ছাড়িয়ে মোহাম্মদপুর আসতেই বিপত্তি। পশ্চিমা পুলিশ কয়েকজন বিহারি ছোকরা নিয়ে বাস থামালো। বাস থেকে তল্লাশির নামে সবাইকে লাইন ধরে দাঁড়া করিয়ে ’ডান্ডি কিধ্যার’ ’ডান্ডি কিধ্যার’ বলতে থাকল। দেহ তল্লাশির ছলে বিহারী ছোকরারা মানিব্যাগ ঘড়ি যা যা পাওয়া যায় নিয়ে গেল। এই দেখো, আমার দামি সিটিজেন ঘড়িটা গেছে।
জামাল ভাই তার ঘড়িবিহীন কব্জিটা উঁচিয়ে দেখালেন। ঘড়ি টাকা গিয়েছে যাক, দুঃখ ওই লোকগুলোর জন্য, পাঁচ সাতজন লোক, নিতান্ত গ্রামের লোক। ওদের কাছে আইডেন্টিটি কার্ড ছিল না। কি ভয়ানক মারটাই মারল! তারপর দড়ি দিয়ে বেঁধে রাস্তায় ফেলে রেখে দিল। তারপর আমাদের বাসে তুলে দিল। জালাল ভাই একটু থামলেন।
আমাদের নেতারা কি জানত না, তারা আমাদের কি বিপদেই ঠেলে দিচ্ছেন! এখন প্রতিদিনই আমাদের সবার জীবন হাতে করে এ শহরে বাস করতে হয়। বেঁচে থাকাটাই এখন কঠিন। বাঘের মুখে আমাদের ফেলে নেতারা লাপাত্তা। বুঝলে, কিছুই হবে না। ঢাল নাই তলোয়ার নাই একেকজন নিধিরাম সর্দ্দার! একটা যুদ্ধে বিজয়ী হতে গেলে কামান বন্দুক, বিমান কত কিছুই না লাগে। এসব কোথায়? আর ইন্ডিয়া! নিজেরাই খেতে পায় না, আমাদের জন্য যুদ্ধ করবে! কিছু হবে না বুঝলে। যাক ও সব, এখন কাজের কথায় আসো। সিরাজ আমাকে সব কিছু বলেছে। আমি আইডেন্টিটি কার্ড রেডি করে রেখেছি। কিন্তু মনে রাখবে, সবগুলোই ভূয়া। মাথামোটা পশ্চিমা শুয়োরগুলোকে ফাঁকি দেয়ার জন্য যথেষ্ট। মাথামোটা শুয়োরগুলো ’ডান্ডি কিধ্যার’ ’ডান্ডি কিধ্যার’ করেই খালাস। আশাকরি সামলাতে পারবে। আর আমি কয়েকটি কনশট্রাকশন কোম্পানির ঠিকানা যোগাড় করে রেখেছি। সব বিহরী হারামজাদাদের। এসব জায়গায় চেষ্টা করে দেখো এক দুজনতে ঢোকাতে পারো কিনা।
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। আপনি আমাদের জন্য অনেক করলেন।
তোমাদের জন্য কেইবা করে! তোমাদের জন্য করে লাভই বা কি? তোমরা ক্ষমতায় গেলে কি আমাকে লাইসেন্স পারমিট দেবে? সিরাজ বন্ধু মানুষ। এজন্য যা একটু করার চেষ্টা করছি। কিন্তু তোমরা তো কেউ বাঁচবে না। ইন্দিরা গান্ধী তোমাদের মতো বামপন্থিদের নিয়ে নিজেই ঝামেলায় আছেন। এখন পাকিস্তানিরা তোমাদের মারবে, ভারতীয়রাও তোমাদের মারবে। তোমরা দেখি আগুনে ঝাঁপ দিয়ে বসে আছ! বিকেলের আগেই আমার বাসায় চলে আসবে। আমি অফিসের সাইক্লোস্টাইল মেশিন বাসায় রেখে দিয়েছি।
ছটটু একটু বিস্মিত। জালাল ভাই কিছুই ভুলেন না। বিক্রমপুরের গ্রামের ছেলে সাইফুল। ঢাকায় এসে কত কি দেখল। তোয়াহা গ্রুপের সাথে মেশার পর নিজেকে মার্ক্সসবাদী ভাবতেই ভালো লাগে। এ কারণে সচিবালয়ের নিম্ন পদস্থ কর্মচারীর চাকুরটাও খারাপ লাগে না। তাছাড়া ওদের মতো কৃষক পরিবারের পক্ষে চাকরির নগদ টাকাটা নেহায়েত মন্দ না। বাবার অসুখের পেছনে যদি স্রোতের মতো টাকা ব্যয় করতে না হতো তবে সাইফুলকে অন্তত টাকার চিন্তা করতে হতো না। জীবনটা নিজের মতো করে খরচ করা যেত। পঁচিশে মার্চের ক্রার্ক ডাউনের পর সাইফুল প্রতিদিনই মনোকষ্টে ভোগে। ওর অনেক বন্ধু বান্ধব এ শহরে ছেড়ে পালিয়ে মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছে। কিশোর বয়স থেকে এ ধরনের একটা যুদ্ধের কত স্বপ্নই না সাইফুল দেখেছে! তিনটি কারণে সাইফুল মুক্তিযুদ্ধে যেতে পারছে না। সাইফুল কোথাও চলে গেলে বাবার চিকিৎসা হবে না। ওর চাকরিটা খুবই স্পর্শকাতর। সাইফুল পালিয়ে গেলে পাকিস্তানিরা ওর গ্রামের বাড়িও তোলপাড় করে ফেলবে। আর ওর রাজনৈতিক দলটি কি ভূমিকা রাখবে!
পাকিস্তানিদের সাথে থাকবে না মুক্তিযুদ্ধে যাবে, তা এখনো ঠিক করতে পারেনি। প্রতি সন্ধ্যা সাইফুলের খুব খারাপ কাটে। রেডিও থাকলেও প্রতিদিন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র শোনার উপায় নেই। ওর দুজন রুমমেটই জামায়াত ইসলামির লোক। প্রতি শনি রবিবার ওরা গ্রামের বাড়ি কাপাশিয়ায় চলে যায়। এ দুদিনই সাইফুল নিজের মতো করে থাকতে পারে। শনিবার সকালবেলা মেসবাড়ির বাইরে টিউবওয়েলের পাশে বসে সাইফুল কাপড় পরিষ্কার করছে। ঠিক এ সময় একটি রিকশা এসে থামল। সাইফুল দেখল, ধোপদুরস্ত এক ব্যক্তি রিকশা থেকে নামছে। কাপড় কাচা রেখে সাইফুল উঠে দাঁড়াল। কাছাকাছি হতেই লোকটি চোখের সান-গ্লাস খুলে হাতে নিল।
চিনতে পেরেছিস?
চিনতে পারবো না মানে! সাইফুল উচ্ছ্বাসে বলল। কতদিন পর তোকে দেখলাম ছটটু! সাইফুল ছটটুকে জড়িয়ে ধরতে গেল।
আরে করিস কি পাগলা! তোর গায়ে পানি। ছটটু সম্ভাব্য অলিঙ্গন ঠেকাতে দুপা পিছিয়ে গেল।
তারপর দু বন্ধুর তুমুল আড্ডা জমে উঠল। দুতিন ঘণ্টা সময় দ্রুত কেটে গেল। দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর ছটটু আসল কথা বলল, পরিকল্পনাটা নিয়ে দুজনের মধ্যে চুলচেলা বিশ্লেষণ চলল।
তুই আমাকে বাঁচালি ছটটু। আমি এ ধরনের একটি কাজ চাইছিলাম আর ঝুঁকি তো থাকবেই। ঝুঁকি ছাড়া কি স্বাধীনতা আসে! সাইফুল বলল।
পাকিস্তানিরা সচিবালয়ে প্রায় স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে এনেছে। পাক প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়ে এখন একটা অপারেশন করা দরকার। যাতে করে প্রশাসনে একটা ভীতি সৃষ্টি হয়। এজন্য সচিবালয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের একটা নেটওর্য়াক গড়ে তোলা প্রয়োজন। ভবিষ্যতে বিস্ফোরক দিয়ে সচিবালয় উড়িয়ে দিতে হবে। তবে এজন্য সময় ও প্রস্তুতি প্রয়োজন। তার আগে সচিবালয়ের ভেতর স্বাধীনতার পক্ষে প্রচারণা চলানো যেতে পারে। জালাল ভাইয়ের বাসায় বসে সাইক্লোস্টাইল মেশিনে ’স্বাধীনতা ডাক’ শিরোনামে লিফলেট ছাপানো হয়েছে। এ লিফলেট সচিবালয়ে বিতরণের ভার নিয়েছে সাইফুল। চলবে