
হৃদয় ছোঁয়ার দিন
উপন্যাস ১৫
সাজ্জাদ হায়দারপ্রকাশিত : জানুয়ারি ১৩, ২০২০
মে মাসের গুমোট দুপুরে হঠাৎ কালো মেঘের আনাগোনা। স্বস্তির বৃষ্টি আসবো আসবো করছে। মগবাজার মোড়ে ’লাহোর হোটেল এন্ড রেস্টুরেন্টে’ বসে ছটটু অপেক্ষা করছে। উল্কা এক্সপ্রেসের গতিতে ওর মনে উত্তেজনার ঝড় বইছে। কালই সাইফুল সচিবালয়ে লিফলেট নিয়ে গিয়েছে। আজ এখানে এসে ছটটুর জন্য কোথাও অপেক্ষা করার কথা।
ছটটু রেস্টুরেন্টের চারদিকে চোখ বুলালো। এক জায়গা বড় বড় অক্ষরে লেখা, ‘এখানে রাজনৈতিক আলোচনা নিষেধ। আরেক জায়গায় কাঁচা হাতে কাবা শরিফের ছবি আঁকা। এছাড়া আছে কায়েদে আজম জিন্নাহর ছবি। ক্যাশের লোকটি এই গরমের মধ্যেও জিন্নাহ স্টাইলে একটা পশমি টুপি পড়ে দরদর করে ঘামছে। ছটটু ঘড়ির দিকে তাকালো।
কোনও বড় ঝামেলা না হলে সাইফুলের এতক্ষণে এখানে চলে আসার কথা। তখন কাজটা সহজ মনে হলেও এখন মনে হচ্ছে, বড় কাঁচা কাজ হয়েছে। অযথাই সাইফুলকে বিপদের মধ্যে ঠেলে দেয়া হয়েছে। এসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতেই আকাশ ভেঙে ঝপঝপিয়ে বৃষ্টি নামল। মৌসুমের প্রথম বৃষ্টি। বৃষ্টির সাথে বইছে ঝড়ো হাওয়া।
কিছুক্ষণ পর তীব্র ঝড় বৃষ্টি ভেঙে একটা রিকশা এসে দাঁড়ালো রেস্টুরেন্টের সামনে। আর ছটটু স্বস্তির সাথে দেখল, সাইফুল রিকশা থেকে নামছে। গতকালই সাইফুল লিফলেটগুলো সচিবালয়ের টয়লেটসহ বিভিন্ন নির্জন জায়গায় রেখে আসে। আজ এ নিয়ে সচিবালয়ে তোলপাড়। শুরু হয়েছে নানা গোয়েন্দা তৎপরতা। তবে সাইফুলকে কেউ সন্দেহ করেনি। অবাঙালিদের মধ্যে কিছু আতংক থাকলেও অধিকাংশ বাঙালি চাপা উল্লাসিত। তবে দুপুরে খাবার দিতে দিতে ওর অবাঙালি পাঠান পিয়ন বলে যে, সে ঠিকই জানে সচিবালয়ে এই লিফলেট কে বিলিয়েছে। কিন্ত জীবন গেলেও এই পাঠান সেই ’সাচ্ছা আদমি’র নাম কাউকে বলবে না।
পাঠান সাইফুলকেই ইংগিত করেছে। কারণ সাইফুল কাল বারবার রুম থেকে বাইরে গিয়েছে। পাঠান নিশ্চয়ই খেয়াল করেছে। হয়তো ওকে অনুসরণও করেছে। সাইফুল নিশ্চিত, এই পাঠান মরে গেলেও ওর ক্ষতি করবে না। কারণ সাইফুল সব সময়ই এই পাঠান পিয়নকে নানাভাবে সাহায্য করে। মজার ব্যাপার করেছে সাইফুলের বস। ছুটির পর সাইফুলকে ধরেছে তাকে বাড়ি পযর্ন্ত পৌছে দিতে। কারণ পথে মুক্তিযোদ্ধারা অফিসগামীদের মারার জন্য ওৎ পেতে বসে থাকতে পারে।
প্রচণ্ড বৃষ্টির কারণে ফাঁকা রেস্টুরেন্টে ওরা কথা সেরে নিল। ঢাকার কাজ আপাতত শেষ। বৃষ্টি শেষে সাইফুলকে বিদায় দিয়ে ছটটু গুলিস্তান বাস ডিপোতে চলে এলো। ছটটু কুমিল্লাগামী বাসের জন্য অপেক্ষা করছে। ঠিক এ সময় ওর পেছন থেকে কেউ ডাকল, এই যে বাবাজি!’ ছটটু ঘুরে তাকালো। লোকটি বলল, ’আজিমপুরের বাস কোথায়?’ বলেই লোকটি ছটটুর দিকে তাকালো। ছটটু ঠিক চিনতে পারল, ভদ্রলোক হঠাৎ বুড়ো হয়েছেন। পোশাক-আষাকে আগের সেই কৈলন্য নেই। ভেঙে পড়া মানুষ যেন! ফখরুদ্দিন সাহেব, পারুলের বাবা।
তোমাকে চেনা চেনা লাগছে বাবা, কোথায় যেন দেখেছি!
আমি ছটটু। আজিমুল্লাহ আমার বাবা।
তাই তো। তোমাকে এত চেনা মনে হচ্ছে। তোমার বাবা কি চমৎকার মানুষই না ছিলেন। বরিশালে আমাদের কি সুন্দর দিনই না ছিল।
আপনি কেমন আছেন চাচা?
কেমন আর থাকব বাবা! এদেশে কি এখন কেউ ভালো আছে!
ছটটু ভাবছে, পারুলের কথা জিঞ্জাস করবে কিনা। ওর মনের কথাই যেন ফখরুদ্দিন সাহেব টের পেলেন। বললেন, পারুল আমার আজিমপুরের বাসায়ই আছে। ওকে নিয়ে অনেক সমস্যায় আছি বাবা। যদি পারো একবার বাসায় এসো। আজিমপুর নিউ কলোনি তের নন্বর বিল্ডিং। এখন এলপিআরে আছি।
ফখরুদ্দিন সাহেব একটু থামলেন। কী যেন ভাবলেন। তারপর বললেন, কিন্তু বাবা, তোমার মতো বয়সি কারও এখন এই শহরে থাকা ঠিক না। গ্রামে চলে যাও বাবা, গ্রামে যাও। আর যদি আজিমপুরে যাও তবে তের নম্বরে এসো।
তিনি আর দাঁড়ালেন না। ছটটুর দেখানো পথে আজিমপুরের বাস ধরার জন্য রাস্তার ওপারে চলে গেলেন। তের নম্বর নিউ কলোনি ছটটুর মনের মধ্যে গেঁথে রইল। চলবে