হৃদয় ছোঁয়ার দিন

উপন্যাস ১৬

সাজ্জাদ হায়দার

প্রকাশিত : জানুয়ারি ১৪, ২০২০

গ্রামের পুরনো ভবনের একটি রুমে বাবু আর ওর বোন মিষ্টি মায়ের সাথে থাকে। বাবা ঢাকায় থেকে মাঝে মাঝে এখানে এসে থাকেন। এ বাড়ির অন্য সবাই ঢাকা থেকে এসেছে। স্কুলের ছাত্রাবাসটি গ্রামের লোকেরা ওদের মতো যারা ঢাকা থেকে এসেছে তাদের জন্য ছেড়ে দিয়েছে। বাবু দেখেছে, গ্রামের লোকেরা সত্যি ভালো! ওদের সাথে কী চমৎকার ব্যবহারই না করে! কোনও কিছুর দরকার হলে বলা মাত্র কাজটি করে দেয়। বাবা গ্রামে এলে দারুণ মজায় ওদের সময় কাটে। বাবা ওকে নিয়ে দিঘলী বাজারে যান। পদ্মা নদীর পাড়েই দিঘলী বাজার। বাজার ঘেঁষে লঞ্চ আর নৌকা ঘাট। বাবা বাজারে এলে ওদের এক আত্মীয় পান্নাদার দোকানে বসে গল্প-সল্প করেন। আর বাবু একাকী সারা বাজার ঘুড়ে বেড়ায়। লঞ্চ ঘাট এলাকাই বাবুর সবচেয়ে বেশি ভালো লাগে। পদ্মা নদীটা সমুদ্রের মতো। এপাড় থেকে ওপাড় দেখা যায় না। নদীতে শত শত পাল তোলা নৌকা। নদীর উপরে ভেসে থাকা মেঘকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে পালের নৌকা চলতে থাকে। মাঝে মাঝে নদীর আকাশে ভেসে বেড়ায় নাম না জানা পাখির ঝাঁক। নৌকা ঘাটে কত ধরনের নৌকা ভেড়ে। একেক নৌকার একেক চেহারা।

লাবু অনেক নৌকার নাম জানে। বাবু কয়েকটি নৌকার নাম জেনেছে— জেলে নৌকা, গস্তি নৌকা, পানশি নৌকা, কেরাই নৌকা, কোষা নৌকা— আরও কত কী! নৌকাগুলো কত ধরনের জিনিসপত্র নিয়ে আসে। বাবুর সবচেয়ে ভালো লাগে, মাছ বোঝাই জেলে নৌকা দেখতে। কত ধরনের মাছই জেলেরা ধরে আনে! একদিন বাবু নৌকার সাথে বাঁধা বিশাল এক মাছ দেখেছে। হাঙ্গর কিনা কে জানে! লাবু অনেক কথা বলে। একদিন বলেছে, পদ্মা নদীতে নাকি বিশাল বিশাল চিংড়ি মাছ আছে। ওসব মাছ ইচ্ছে হলে দাঁড়া দিয়ে বড় বড় লঞ্চ পানির নিচে টেনে নিয়ে যায়। মাকে অবশ্য এ কথা জিজ্ঞাস করতেই মা হেসে খুন। গ্রামের মানুষ কত কথাই বলে! লাবুর কথা বাবুরও বিশ্বাস হয়নি। তবে জেলে নৌকার সাথে বাঁধা ভয়ংকরদর্শন মাছটি দেখে মনে হচ্ছে, পদ্মা নদীতে দৈত্যর মতো মাছ থাকা সম্ভব!

এছাড়া আছে দিঘলী বাজারের দই আর মিষ্টি। বাবার সাথে বাজারে এলে বাবা ওকে বড় একটা মিষ্টির দোকানে বসিয়ে দেন। তারপর ওকে যত ইচ্ছে দই-মিষ্টি খেতে বলেন। বাড়ি ফেরার সময় ওরা অনেক সদাইপাতির সাথে মিষ্টির হাঁড়ি নিয়ে বাড়ির পথ ধরে। ওদের পুরনো বাড়িটার কাছেই আরেকটা ভবন। অতি পুরানো এই ভবনটাকে সবাই নাটমন্দির বলে। জমিদাররা এই ভবনে এসে গান শুনতেন। বাবা সন্ধ্যাবেলায় এখানে বসে রেডিওর ভল্যুম বাড়িয়ে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র শোনেন। আশপাশের প্রায় সব লোকই এখানে চলে আসে। নিঃশব্দে সবাই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র শোনে। ’চরমপত্র’র কথা নিয়ে হাসাহাসি করে। ’বিচ্ছু মাইর আর প্যাদানিতে খানসেনাদের ছেড়াবেড়া অবস্থা, শুধু ফুটুস আর ফুটুস। এভাবে চললে স্বাধীনতা তো শীঘ্রই এসে যাবে!’ এই সব বলাবলি করে।

বাবা একদিন মাকে বললেন, এই বিচ্ছুদের দলে ছটটু চাচা আছেন। বাবু এ কথা শুনে ফেললেও কাউকে বলেনি। এসব কথা বড়দের কাছে বলা বারণ। তবে লাবুর কাছে বলা যেতে পারে। লাবু তো বড়দের মতো নয় যে, বাবুকে বিপদে ফেলবে! কাশবন খুবই মজার। দূর থেকে কেমন সাদা কার্পেটের মতো দেখায় আর কাছে গেলেই ফাঁকা ফাঁকা। কাশগাছ গায়ে লাগলে গা জ্বালা করে। বাবু একটা প্রজাপতির পেছন পেছন এ বনে এসেছে। বাবুর হাতে প্রজাপতি ধরার জাল। একটা কাঁঠি গোল করে তাতে মাকড়শার আঁশ জড়ানো হয়েছে। কোনোমতে প্রজাপতির গায়ে জালের আঁশ ছোঁয়াতে পারলেই হলো, প্রজাপতি কুপোকাত। এ ফাঁদ ওকে বানিয়ে দিয়েছে লাবু। লাবুর মাথায় অনেক বুদ্ধি। লাবু নাকি শিয়ালও ধরতে পারে! সকাল থেকেই বাবু প্রজাপতির পেছনে পেছনে ছুটলেও এ পর্যন্ত একটা প্রজাপতিও ধরতে পারেনি। প্রজাপতিগুলো অনেক চালাক। ফাঁদ দেখলেই উড়ে যায়। অথচ লাবু এ ধরনের ফাঁদ দিয়ে ঝটপট প্রজাপতি ধরে। লাবুর পাখি ধরার ফাঁদও আছে।

বাবু  আগে কখনো গ্রাম দেখেনি। গ্রামে কত কিছুই না আছে। নদী, নৌকা, শস্যক্ষেত, আর পাখি। গ্রামে আসার পর বাবুর পড়াশুনা করতে হয় না। পড়বে কি, বাবুর স্কুল যে ঢাকায়। আর এখন ঢাকায় তো যুদ্ধ চলছে। মুক্তিযুদ্ধ। বাবা বলেছেন, দেশ স্বাধীন হলে ওরা আবার ঢাকায় ফিরে যাবে। বাবুর স্কুলও খুলে যাবে। সকাল বেলাটা বাবু অনেকক্ষণ একা থাকতে চায়। সকালবেলা লাবুর অনেক কাজ থাকে। গরুগুলোকে গোয়ালঘর থেকে বাইরে এনে খাবার দিতে হয়। তারপর মাঠে বেঁধে রাখতে হয়। এছাড়া প্রতি বিকেলবেলা লাবু পুকুরে ’চাঁই’ পেতে রাখে। সকালবেলা এই ’চাঁই’ উঠাতে হয়। ’চাঁই’ এর ভেতর অনেক মাছ উঠে আসে। সকালবেলা অনেক কাজ শেষ করে তবেই লাবু আসে। লাবুর মতো স্কুলে না যেয়ে যদি এসব কাজ নিয়ে থাকা যেত, তবে খুবই ভালো হতো!

বাবু দেখল, কাশফুলের মাথায় আরেকটা বড় প্রজাপতি। পাখায় কত ধরনের রং। বাবু ঠিক করল এই প্রজাপতিটা ধরবে। কিন্তু প্রজাপতিটা খুব চালাক। বাবুর ফাঁদ দেখলেই উড়ে যাচ্ছে। প্রজাপতির পেছনে ছুটতে ছুটতে বাবু ঘেমে গেল। এমন সময় বাবু দেখল, কাশবন দুলছে। কিছু একটা কাশবনের ভেতরে ঢুকেছে। শিয়াল নয়তো? লাবু অবশ্য বলেছে, এই গ্রামে বাঘডাসও আছে। বাঘডাস হলো ছোট সাইজের বাঘ। বাবুর মতো ছোট ছেলেদের খেয়ে ফেলতে পারে। বাবু একটু ভয় পেয়ে কাশবনের নড়াচড়া দেখতে লাগল। বাবু দৌড়ে সরে যাওয়ার চিন্তা করল। হঠাৎ করে কাশবন ফুড়ে লাবু বেরিয়ে এলো।
ভয় পাইছ দোস্ত? লাবু দাঁত বের করে হাসতে লাগল। লাবুকে পেয়ে বাবু খুবই খুশি হলো।

শোনও বাবু, আইজ একটা মজা আছে। নারায়ণ বাড়ির মঠ ভাঙা হইবো।
কেন? বাবু বলল। বাবু ওই মঠটা দেখেছে। মঠের চূড়া যেন আকাশ ছুঁয়েছে। ওই মঠে নানা ধরনের শত শত পাখির বাসা। মঠ ভাঙলে ওই পাখিগুলো কোথায় যাবে? সে আবারও জিজ্ঞেস করল, মঠ কেন ভাঙবে রে লাবু?
তুমি জানো না বুঝি? এই গ্রামে যদি পাকিস্তানি সৈন্য আসে আর মঠ দেহে, তয় বেবাক মানুষ মাইরা ফেলবো। যেমন তোমাগো শহরে মানুষ মারছে। অহন লও নারায়ণ বাড়ি যাই।

লাবু বাবুর সাথে হাঁটতে থাকে। বলে, ও বাবু, তোমারে এহন আমগো বাসায় যাইতে অইবো। মায় পিঠা বানাইছে। পিঠা খাইয়া নারায়ণ বাড়ি যামু।
বাবু লাবুর সাথে ওদের বাড়ি যায়।

নারায়ণ বাড়ি গ্রামের একপ্রান্তে। একসময় নারায়ণ নামের এক জমিদার এখানে থাকতেন। এই বাড়িতে এখন তেমন কেউ থাকে না। এই বাড়ি এখন এখানকার স্কুলের সম্পত্তি। এক পাশে একটি ভগ্নপ্রায় দোতলা বাড়ি। একটা শান বাঁধানো বিশাল দীঘি। আর দীঘির পাড়ে সুউচ্চ মঠ। মঠের এখানে সেখানে বটগাছের চারা গজিয়েছে। লাবু  বলেছে, আগে এখানে নাকি হিন্দুরা পূজা করত। কিন্তু অনেক বছর ধরে পূজা হয় না। কাল নাকি স্কুল ঘরে মিটিং হয়েছে। সবাই ঠিক করেছে, এই মঠটা ভেঙে ফেলবে। কোনও গ্রামে হিন্দুদের কোনও চিহ্ন পেলে নাকি পাকিস্তানিরা সবাইকে মেরে ফেলে। আর মুন্সিগঞ্জে নাকি পাকিস্তানিরা চলে এসেছে। যে কোনও দিন দিঘলী বাজারে চলে আসবে। আর দিঘলী এলেই এ গ্রামে চলে আসবে। চলবে