হৃদয় ছোঁয়ার দিন

উপন্যাস ১৮

সাজ্জাদ হায়দার

প্রকাশিত : জানুয়ারি ১৬, ২০২০

আগস্ট মাসের শুরু থেকেই ঢাকার পরিস্থিতি পাল্টাতে শুরু করল। অকুতোভয় তরুণ গেরিলা, যাদের বয়স ষোল থেকে ত্রিশের মধ্যে, তাদের হানায় পাল্টে যেতে লাগল ঝানু ঝানু পাকিস্তানি সমর বিশারদদের হিসাব-নিকাশ। মার্চে ক্রাক ডাউনের পর পাকিস্তানি সৈন্যরা ঢাকার বাইরের বিভিন্ন জেলা ও মহাকুমাগুলোতে জালের মতো ছড়িয়ে পড়ল। ক্ষেত্রবিশেষে গ্রামেও পৌঁছে গেল পাকিস্তানি বাহিনী। এদের সাথে রইল সহযোগী রাজাকার আর আলবদর বাহিনী। গ্রামগঞ্জে তাদের অত্যাচারের মাত্রা সময়ের সাথে সাথে বেড়ে যাচ্ছে। মুক্তিযোদ্ধাদের তরফ থেকেও পাল্টা প্রতিশোধের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ঢাকাতে শুরু হয়েছে কার্যকর গেরিলা হামলা। এসব হানায় বিভিন্ন বামপন্থি ছাত্র-যুব সংগঠনের ছেলেরা অন্যদের চেয়ে বেশি সাফল্য অর্জন করছে। হতে পারে, এক্ষেত্রে এসব সংগঠনের ছেলেদের আগে অর্জিত আন্ডারগ্রাউন্ড জীবনের অভিজ্ঞতা কাজে এসেছে। এদের মধ্যে কারা কত সফলভাবে আক্রমণ চালাতে পারে, তার প্রতিযোগিতাও শুরু হয়েছে।

পাকিস্তানি সৈন্যরা ঢাকায় তাদের নিরাপদ দূর্গে এখন আর নিরাপদ নেই। রাত হলেই ঢাকা শহরের এখানে-সেখানে গুলি ছোটে। বোমা ফাটে। এসব শব্দ পাকিস্তানি সৈন্যদের বুকে কাঁপন ধরিয়ে দিলেও, অধিকাংশ বাঙালিদের কাছে এসব শব্দ ঘুমপড়ানি গানের মতোই মনে হয়। বোমা-গুলির শব্দ নাগরিকদের স্বাধীনতার স্বপ্ন জাগিয়ে তোলে। রাতের বেলা এখন পাকিস্তানি সৈন্যরা রক্ষণাত্মক অবস্থানে থাকলেও দিনের বেলা গেরিলাদের ধরার জন্য চলে নানামুখি তৎপরতা। ঢাকার বিভিন্ন অঞ্চলে হঠাৎ করেই সান্ধ্য-আইন জারি করে। ঘরে ঘরে তল্লশি চালায় পাকিস্তানি সৈন্য আর তাদের সহযোগি বাহিনী। গেরিলাদের পাত্তাও পায় না। মাছ যেমন জলের সাথে মিশে যায়, তেমনি ঢাকার নাগরিকদের মধ্যে লুকিয়ে থাকে নির্ভীক গেরিলারা। গেরিলাদের না পাওয়ায় সাধারণ নাগরিকরা পাকিস্তানি সৈন্য ও তাদের দোসর রাজাকারদের নির্যাতন আর অত্যাচারের শিকার হয়।

ছটটুদের দল এখন ঢাকায় গেরিলা আস্তানা গড়ে তুলেছে। অতি ধনবান পিতার একমাত্র পুত্র ইমাম অফুরন্ত প্রানশক্তিতে ভরপুর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফলিত পর্দাথবিদ্যার তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। চলাফেরায় দারুণ স্মার্ট ইমাম অনর্গল উর্দু আর ইংরেজি বলতে পারে। এ কারণে ক্রাক ডাউনের পর ওর বন্ধু-বান্ধবরা ঢাকা ছেড়ে চলে গেলেও ইমাম যায়নি। ইমাম ওর ভক্সওয়াগন গাড়ি নিয়ে পাকিস্তানিদের নাকের ডগা দিয়ে ঢাকার এখানে-সেখানে ঘুরে বেড়ায়। রাস্তার ধারের পাহারাদার পাকিস্তানি সৈন্যদের সামনে গিয়ে অচমকা গাড়ি ব্রেক করে। থতমত খেয়ে পাহারাদার পাকিস্তানি সৈন্যরা এগিয়ে এলে গাড়ির কাচ নামিয়ে চোস্ত্ উর্দুতে ’ওস্তাদদের’ সালাম দিয়ে সিগারেট জ্বালানোর জন্য ম্যাচের কাঠি চেয়ে বসে। তারপর ’ওস্তাদের’ দিকে সিগারেটের প্যাকেট বাড়িয়ে দেয়। তারপর এই সব ’ওস্তাদের’ সাথে খোশগল্পে মেতে ওঠে। অচিরেই ঢাকার অধিকাংশ চেকপোস্টের পাকসৈনিকদের কাছে ইমামের ভক্সওয়াগান সুপরিচিতি লাভ করে।

তেঁজগাও বিমান বন্দর সড়কেই ইমাম বেশি যাতায়াত করে। বিমান বন্দরের যাত্রী অভ্যর্থনা লাউঞ্জে গিয়ে বসে থাকে। রেস্টুরেন্টে চা খেতে খেতে বিমানের ওঠানামা দেখে। প্রথম চিন্তা ছিল, পাকিস্তানিদের সৈন্য আসা-যাওয়ার একটা হিসাব রাখা। পরে বিমানের ওঠানামা দেখতে দেখতে মাথায় একটা নুতন আইডিয়া ঢোকে। মাত্র কিছুদিন আগে প্যালেস্টাইন গেরিলা দলের তরুণী লায়লা খালেদ বিমান ছিনতাই করে সারা বিশ্ব তোলপাড় করেছে। এখন পাকিস্তানি একটা বিমান যদি ছিনতাই করা যায় তবে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে সারা পৃথিবীতে তোলপাড় পড়ে যাবে। মুশকিল হলো, বিমানের অনেক খুটিনাটি বিষয়ই ইমামের অজানা। মাথার ভেতর কোনও আইডিয়া এলে সেটা নিয়ে বসে থাকার ছেলে ইমাম নয়। ইমামের এক মামা পিআইএ’র চীফ পার্সার। তিনি করাচিতে থাকেন। আর ঢাকা-করাচি পিআইএ’র ফ্লাইটে ডিউটি করেন। ইমাম বিমান ছিনতায়ের পরিকল্পনা নিয়ে সত্যি একদিন করাচিগামী প্লেনে চেপে বসে।

করাচিতে গিয়ে সেই মামার বাসায় ওঠে। করাচিতে গিয়ে দুজন বাঙালি বন্ধুকে পেয়ে যায়। এরা দুজনই মুক্তিযুদ্ধে যেতে চায়। ইমাম ওদের মাথায় বিমান ছিনতাইয়ের আইডিয়াটা ঢোকায়। দুজনেই এতে সায় দেয়। করাচি বিমান বন্দরের নিরাপত্তা কড়াকড়ি ঢাকার চেয়ে কম। সুতারাং ওরা করাচি থেকেই বিমান ছিনতাই করার প্লান করল। ধারালো চাকু পাইলটের গলায় চেপে ধরে বিমানের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করতে হবে। বিমান সঠিক পথে যাচ্ছে কিনা সেটা জানতে হবে। এই জানার উপায়টা পার্সার মামা কাছে জানতে চাইতেই বিপত্তি ঘটল। ভাগ্নের হঠাৎ করাচি আগমন অপর দুই বন্ধুর সাথে রুমের দরজা বন্ধ করে ফিসফাস, দুই দুই যোগ করে সবই তিনি বুঝে গেলেন। ভাগ্নেকে এক রকম আটক করেই পরবর্তী ফ্লাইটে ঢাকা নিয়ে এলেন। এটা হলো জুন মাসের শেষদিকের ঘটনা। তারপর প্রায় মাসখানেক ইমাম গাড়ি নিয়ে ঢাকার রাস্তায় উদ্দেশ্যহীন ঘুড়ে বেড়ায়।

একদিন মৌচাকের সামনে হঠাৎ করেই দেখা হয়ে যায় সিরাজুলের সাথে। ইমাম একা একা চলতে অভ্যস্ত। সিরাজুলের দলের এতসব নিয়ম কানুন মেনে যোগ দেয়ার মতো ছেলে ইমাম নয়। তবে সিরাজুলকে সে সমিহ করে। সিরাজুলও ইমামকে বেশ পছন্দ করে। ইমাম সিরাজুলকে গাড়িতে তুলে নিল। পরদিন থেকে ইমামের কাজ হলো সিরাজুলকে লিফট দেয়া। সিরাজুলের কাজও অনেক সহজ হলো। আর সিরাজুলের মতো মোস্ট ওয়ান্টেড লোককে নিয়ে পাকসেনার নাকের ডগা দিয়ে ঘুরে বেড়ানো ইমামের মতো ছেলেদের কাছে থ্রিলিং বটে। একটু একটু করে সিরাজুল ইমামকে ওদের ঢাকা অপারেশনের পরিকল্পনার বিস্তারিত জানালো। ছটটু যে নিশ্চিতপুর গ্রামে মুক্তাঞ্চল গড়ে তুলেছে, এটা জেনে ইমাম মোটেই অবাক হলো না। ছটটুর কাছ থেকে ইমাম এটাই আশা করে। ঠিক হলো ঢাকা আপারেশন শেষে সবাই ছটটুর ঘাঁটিতে গা ঢাকা দেবে। তারপর কিছুদিন ওখানে থেকে আবার এসে ঢাকা অপারেশন করবে। ঢাকা অপারেশনে ছটটুও ওদের সাথে যোগ দেবে। ইমাম খুব থ্রীলড। চলবে