
হৃদয় ছোঁয়ার দিন
উপন্যাস ২০
সাজ্জাদ হায়দারপ্রকাশিত : জানুয়ারি ১৮, ২০২০
আমানের এখন আর কিছুই ভালো লাগে না। এফডিসি এখন প্রায় ফাঁকা। জহির রায়হান, আলমগীর কবির, ববিতা, সুচন্দা, বেবি ইসলামসহ অনেকেই ঢাকায় নেই। ধারণা করা হয়, অনেকেই সীমান্তের ওপারে চলে গেছেন। এফডিসিতে নতন কোনও কাজ হচ্ছে না। যাদের সিংহভাগ বিনিয়োগ হয়েছে তারা বাকি কাজগুলো শেষ করার জন্য এফডিসিতে আসেন। আমান প্রথমে ভেবেছিল ঢাকা ছেড়ে চলে যাবে। দেশের ভেতরে কোনও মুক্তাঞ্চলে ক্যামেরা নিয়ে কাজ করবে। কিন্তু সিরাজুল ওকে ঢাকায়ই থাকতে বলেছে। ঢাকায় পার্টির শেল্টার গড়তে হবে। আমানকে এজন্য কাজ করতে হবে। সুতরাং অনিচ্ছা সত্ত্বেও আমানকে ঢাকা থেকে যেতে হয়েছে। এফডিসিতে এখন আর রাতদিন কাজ হয় না। সন্ধ্যার আগেই কাজ শেষ করতে হয়। তারপর জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাড়ির পথ ধরতে হয়। সন্ধ্যাবেলা আমানের কাছে খুবই বিরস লাগে। সন্ধ্যার সাথে সাথে নগরীর দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায়। ফলে নগরীটা ভুতুড়ে নগরীতে পরিণত হয়। শহরে এখন আর আড্ডাও নেই।
ক্রাক ডাউনের পর একদিনই আমান মফিজ খালুর বাসায় গিয়েছিল। মফিজ খালুর সাথেই দেখা হয়েছিল। তিনি আমানকে এড়িয়ে যেতে চেয়েছেন। আমান কিছু বলার আগেই বলে ফেলেন, তুমি অন্য দিন এসো। তোমার খালা, পারভিন কেউ বাড়ি নেই। মফিজ খালুর কণ্ঠস্বরই বলে দিচ্ছে, তিনি মিথ্যা কথা বলছেন। একথা শোনার পর আমান আর দাঁড়ায়নি। ক্রাক ডাউনের পর মফিজ খালু রাতারাতি পাল্টে গেছেন। মুক্তিযোদ্ধারা দেশের বিভিন্ন এলাকার রাস্তাঘাট ব্রীজ-কালভার্ট উড়িয়ে দেয়ায় সেগুলো মেরামতের জন্য কনসট্রাকশনের প্রচুর কাজ হচ্ছে। সুতরাং অবাঙালিদের সাথে মফিজ খালুর মতো কিছু বাঙালি চুটিয়ে কাজ বাগাচ্ছে। অবাঙালি ব্যবসায়ী আর পদস্থ সামরিক কর্মকর্তাদের সাথে এখন তার দহরম মহরম সর্ম্পক।
ক্রাক ডাউনের পর একদিনও পারভিনের সাথে দেথা হয়নি। পারভিনের খোঁজে ওদের বাড়ি যেতে রোজই ইচ্ছে হয়। কিন্তু নানা সংকোচের জন্য যাওয়া হয় না। একদিন দেখা হয়েই আমান বুঝেছে, খালু ওকে এড়িয়ে যেতে চান। হতে পারে পাকিস্তানিদের সাথে কাজ করায় তিনি খুব অপরাধ বোধে ভোগেন! এছাড়া হয়তো তিনি চান না পারভিনের সাথে আমান সর্ম্পক রাখুক!
অবশেষে মনের সাথে বোঝাপড়া করে আমান এক বিকেলে পারভিনদের বাড়ি গেল। মফিজখালু থাকলেও ক্ষতি নেই। যেমন করে হোক আজ পারভিনের সাথে দেখা করতেই হবে। কলিং বেল চাপতেই কাজের ছেলেটা দরজা খুলে ওকে ড্রইং রুমে নিয়ে বসালো। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পর খালা এলেন। আগেও আমান খেয়াল করেছে, কেউ এ বাড়িতে এলে খালা বেশ সময় নিয়ে সাঝগোজ করে তবে নিচে নামেন। আজও যথারীতি বিভিন্ন ধরনের গহনা পরে তিনি আমানের সামনে এলেন। আমান খালার সাথে পারভিনকে আশা করেছিল। পারভিনকে দেখতে না পেয়ে আমান মনে মনে হতাশ হলো। খালার যা অভ্যাস তিনি নিজেই ননস্টপ কথা শুরু করলেন।
এই দেখ, গণ্ডগোলের (মুক্তিযুদ্ধকে খালা গণ্ডগোল বলেন) কারণে কোথাও যাওয়ার উপায় নেই। কত কিছু কেনার ছিল! বলতে পারিস গণ্ডগোল কবে শেষ হবে! বাড়িতে থাকতে থাকতে হাঁপিয়ে গেলাম। পারভিনটাও বাসায় নেই।
পারভিন কোথায় গেছে খালা?
সে কী, তুই জানিস না? পারভিন বিলাতে। এখন লন্ডনে আছে। তোর খালু গত মাসে ওকে নিয়ে করাচি গিয়েছিল। ওখান থেকে পারভিন তোর খালুর ফুপাতো ভাইয়ের সাথে লন্ডন গেছে। পাসর্পোট না কীসব ঝমেলা শেষ হলে আমি আর তোর খালুও লন্ডন যাব। আমরা গেলে বিলাতেই পারভিনের বিয়ে হবে। সিলেটি এক পাত্র পাওয়া গেছে। পারভিনকে নিয়ে কত চিন্তাই না ছিল! তুই কিন্তু রাতে খেয়ে যাবি। আমি বাবুর্চিকে বলে দিচ্ছি। আমি তো আর এখন রান্নাঘরে যাওয়ার সময় পাই না।
খালা অনর্গল বকতেই থাকলেন। কথার ঝড় থামতেই আমান উঠে দাঁড়াল। খালা বললেন, সেকি, তুই উঠলি যে বড়! এই গণ্ডগলের রাতে তুই কোথায় যাবি? রাতে থেকে যা। গেস্টরুম খুলে দেই।
অনেক কষ্টে খালার হাত থেকে নিস্তার পেয়ে আমান বাড়ির বাইরে এলো। ওর মনটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। এ শহর ছেড়ে দূরে কোথাও চলে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে। কিন্তু কোথায় যাবে? খুব কম সময়ের মধ্যে পারভিন ওর কতই না কাছে এসেছিল! বোকার মতো ওকে নিয়ে কত স্বপ্নই না আমান দেখেছে! ওর ভেঙে পড়ার সময়ই অবলম্বনের মতো পারভিন সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। বড় কিছু করার স্বপ্ন নিয়ে বারবার আমান উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করেছে। পারভিনকে নিয়ে স্বপ্নটা বোধ হয় ভেঙেই গেল! যুদ্ধ শুরু না হলে হয়তো আমান কোনও না কোনও চলচ্চিত্র তৈরির দায়িত্ব পেত। নিজেকে গ্রহণযোগ্য করার একটা সুযোগ পাওয়া যেত। এই পরিবারের সাথে এখন আমানের অনেক ব্যবধান। পারভিনের সাথে বিচ্ছেদ স্বাভাবিক। এররপরও এই পৃথিবীতে কত অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটে। পারভিন আমানের মনে কত স্বপ্নই না জাগিয়েছে। আমানও সব বাধাকে তুচ্ছ জ্ঞান করে স্বপ্নের জাল বুনেছে। এই যুদ্ধে অনেকে অনেক কিছু হারিয়েছে। আমান পারভিনকে হারালো। বড় তাড়াতাড়ি সব শেষ হয়ে গেল!
ক্রাক ডাউনের পর পারভিনের সাথে আমানের আর যোগাযোগ হয়নি। হয়তো পারভিন আমানের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে। ক্রাক ডাউনের পর কোনও মেয়ের পক্ষেই এ শহরে একা চলাচল সম্ভব নয়। আমানের কোনও ঠিকানাই পারভিনকে দেয়া হয়নি। আমানের দেখা পাওয়ার জন্য পারভিন হয়তো এফডিসিতেও যোগাযোগ করেছে। মাঝখানে বেশকিছু দিন আমান এফডিসিতে যায়নি। পারভিন নয়, এই মন্দ সময়ই এই বিচ্ছেদের কারণ। আমান নিজেকে প্রবোধ দিল। তার কাছে সব কিছু ফাঁকা ফাঁকা লাগছে।
পারভিনকে নিয়ে ভাবতে ভাবতে আমান মেসবাড়ির ঢোকার মুখে এসে দাঁড়াল। চার বছর ধরে আমান এ বাড়িতে আছে। এ বাড়িটা ওদের দলের একটা শেল্টারও বটে। আমানের মেসবাড়িটা বেশ মজার। চারদিকে বস্তি। মাঝখানে সরু ঘুর পথ। সুতারাং বাইরে থেকে মেসবাড়ির অস্তিত্ব বোঝার উপায় নেই। আমান ওর রুমে হেরিকেনের আলো জ্বলতে দেখে বেশ অবাক হলো। দরজার একটা পাটও খোলা। আমান ঘরে ঢুকেই হেরিকেনের ম্লান আলো দেখতে পেল, একজন লোক চৌকিতে শুয়ে গুনগুন করে রবীন্দ্র-সংগীতের সুর ভাজছে। গলাটা চেনা চেনা মনে হচ্ছে। আমানের সাড়া পেয়ে অচেনা লোকটি গান বন্ধ করে উঠে বসল। ছটটু না হয়ে যায় না! ছটটু এক লাফে বিছানা থেকে উঠে আমানকে জড়িয়ে ধরল।
আমান, তোকে কত দিন পরেই না দেখলাম। শালা আমরা মরছি যুদ্ধ করে আর তুমি প্রেম করে বেড়াচ্ছ! আমি সব খবরই রাখি। হা হা...
আমান বলল, ছাড় তো। হাড়গোড় ভেঙে ফেলবি দেখছি।
আগে শালা রাতে খাবার ব্যবস্থা কর। খিদেয় পেট চো চো করছে। ছটটু আমানকে ছেড়ে দেয়।
ছটটু জেলে যাবার পর এই প্রথম আমানের সাথে দেখা। রাতে খাবার পর ওদের তুমুল গল্প জমে উঠল। আমান সানন্দে ছটটুর সাথে গেরিলা স্কোয়াডে যোগ দিতে রাজি হলো। চলবে