হৃদয় ছোঁয়ার দিন

উপন্যাস ২২

সাজ্জাদ হায়দার

প্রকাশিত : জানুয়ারি ২০, ২০২০

সকাল দশটায় চট্টগ্রাম থেকে আগত মেইল ট্রেনটি কমলাপুর স্টেশনে থামল। থার্ড ক্লাস থেকে নেমে এলো এক আমড়াঅলা আরেক মুড়িঅলা। দুজনের গায়েই হাতাঅলা মলিন গেঞ্জি। তালি মারা লুঙি, নগ্ন পা। স্টেশনের প্লাটফর্মে কয়েকজন পাকিস্তানি সৈন্য দাঁড়িয়ে ঈগল চোখে যাত্রীদের ওঠানামা দেখছে। আমড়াঅলা মুড়িঅলার মাথায় মুড়ির বস্তা তুলে দিল। মুড়িঅলাও আমড়ার ঝাঁকা আমড়াঅলার মাথায় তুলে দিতে সাহায্য করল। মুড়িঅলা আড়চোখে পাকসৈন্যদের দিকে তাকালো। পাকসৈন্যরা ওদের দিকে মোটেও তাকাচ্ছে না। ধীর পায়ে স্টেশনের বাইরের রাস্তায় এসে চোখের ইশারায় ভাব বিনিময় করে দুজনে আলাদা আলাদা ফুটপাত ধরে পথ চলতে লাগল।

ওদিকে ইমাম ওর ঘরে কান খাড়া করে আছে। বারবার ঘড়ি দেখছে। ওর উত্তেজনা বেড়ে যাচ্ছে। সময় পার হয়ে যাচ্ছে। তবে কি সময়ের হেরফের হলো?  ভাবল, বাইরে গিয়ে হাঁটাহাঁটি করে দেখে আসবে কিনা! ঠিক এ সময় দূরাগত শব্দ ভেসে এলো, ’চাই মুড়ি, ভালো মুড়ি-ই।

নিশ্চয়ই সেই মুড়িঅলা, ইমাম নিশ্চিত হওয়ার জন্য আরেকটু অপেক্ষা করল। মিনিট খানেকের মধ্যে ইমামের বাড়ির গেটে মুড়িঅলার গলা পাওয়া গেল। মুড়িঅলা হেঁকেই যাচ্ছে। ইমাম গেটের বাইরে এলো। জিজ্ঞেস করল, কি মিয়া, ভালো মুড়ি আছে তো?

ভালো মানে, এক নম্বর মুড়ি।
কোথাকার মুড়ি?
মেথিকান্দার মুড়ি।
ঠিক আছে, বাড়ির ভেতর এসো। আমার মুড়ি দরকার।

মুড়িঅলাকে ভেতরে ঢুকিয়ে ইমাম গেট বন্ধ করে দিল। এরপর মুড়িঅলাকে নিয়ে পাশের একটা রুমে ঢুকল। বলল, ছটটু ওস্তাদ, একেবার গুরুর খেল্ দেখালি। নিয়াজির বাপও তোকে চিনতে পারবে না।
ছটটু বলল, কথা রাখ। স্টেশন থেকে এতটা পথ এসে ঘেমে গেছি। আগে মালটা বের কর।
বস্তার মুখ খুলে মুড়ি হাতিয়ে ইমাম কালো স্টেইনগান বের করে আনল। স্টেইন গানের কালো নলটা গালে ঠেকিয়ে আদর করতে লাগল। জানতে চাইল, তা জনি ওস্তাদ কই?
আমড়া বেচতে আমানের বাসায় গেছে।

আধঘণ্টা পর ছটটুকে নিয়ে ইমাম গাড়ি স্টার্ট দিল। এখন ছটটুর পোশাক-আশাক পাল্টে গেছে। এখন পাজামা-পাঞ্জাবি, মাথায় গোল টুপি। ঘোঁচা ঘোঁচা দাড়িতে ওকে ঠিক মাদ্রাসা ছাত্রের মতো লাগছে। ওদের মহামূল্য জিনিশটি এখন গাড়ির বনেটে কাপড়-চোপড়ের ঠাসা একটি ল্যাগেজের ভেতর। গাড়িটা ছুটে চলল বনানীর পথে। বনানীর নির্জন বাড়ির তিনতলার ঘরটি এখন গেরিলা ঘাঁটি। বাথরুমের স্টোরে খুব কায়দা করে দুটো হ্যান্ড গ্রেনেড আর স্টেইনগান লুকিয়ে রাখা হয়েছে। বিভিন্ন সময়ে সিরাজুল, ছটটু, আমান আর জনি আসে। প্রথমে শুরু হয় তাশখেলা। উচ্চ স্বরে গানের রেকর্ড বাজে। বাড়ির কাজের লোকেরা ইমামকে শুধু বন্ধু-বান্ধব নিয়ে গানের রেকর্ড বাজিয়ে তাশ খেলতে আর নানা রকম ফূর্তি করতে দেখে। কাজের লোকেরা চলে গেলেই ওরা ওদের পরিকল্পনা নিয়ে বসে। পিন খুলে কিভাবে গ্রেনেড ছুড়তে হবে, সিরাজুল সেই কৌশল শিখিয়ে দেয়। কে কিভাবে ঢাকা ছাড়বে, সে সব নিয়ে আলাপ হয়। দেখতে দেখতে ওদের ডেট লাইন এসে যায়।

১৪ আগস্ট পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনটি উদযাপনের জন্য গোটা পূর্ব-পাকিস্তানে করা নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। প্রথমে ওরা পরিকল্পনা করেছিল, ১৪ আগস্ট হামলা করবে। পরে ঠিক হলো, ২০ আগস্ট হামলা চালনো হবে। কারণ ১৪ আগস্টের পর পাকিস্তানিদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা শিথিল থাকবে। ঠিক হলো ১৪ আগস্ট রেকি করা হবে। ১৪ আগস্ট সকালে ইমাম লাল ভক্সাওয়গান নিয়ে রেকি করতে বের হলো। ওর গাড়িটা কাগজ আর কাপড়ের তৈরি পাকিস্তানি পতাকা দিয়ে সাজানো হয়েছে। ইমাম চাঁদ-তাঁরা আঁকা একটা টুপি মাথায় চাপিয়েছে। তারপরও কয়েকটি চেক পয়েন্টে ওকে থামতে হয়েছে। আর ইমাম উর্দুতে কথা বলেছে। ভারতীয় ’মাদার চোদ’ দালালদের চৌদ্দ গোষ্টি উদ্ধার করেছে। এসব কথা শুনে প্রতিটি চেক পয়েন্টে পাকিস্তানিরা ওকে সসম্মানে পথ ছেড়ে দিয়েছে।

ফকিরাপুলে এসে ইমামের মেজাজ চরমে উঠল। এখানে ওকে গাড়ি স্লো করতে হলো। রাস্তা বন্ধ করে আল বদররা পথসভা করছে। মতিউর রহমান নিজামী নামের এক আল বদর নেতা এখন মাইকে গলা ফাটাচ্ছে। ভদ্রলোক মুক্তিযোদ্ধা নামের ভারতীয় দালালদের প্রতিরোধে সর্বোচ্চ ত্যাগের জন্য জানবাজ বদর বাহিনীর সদস্যদের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছে। ইমাম রাগে গজড়াতে থাকলো, ইচ্ছে হচ্ছে সমাবেশ করা এই লোকগুলো উপর গাড়িটা উঠিয়ে দেয়। নিজামীর নামটা ইমামের মনে গেঁথে রইল। শালাকে কখনো বাগে পেলে হয়!

স্যারের গাড়িটা সকাল নয়টার মধ্যে ’ছিনতাই’ করে ইমাম মালিবাগের এক সরু গলিতে নিয়ে এলো। আজ ঠিক একটার সময় স্যার থানায় যেয়ে গাড়ির চুরির মামলা করবেন। সময় কম।  ইমাম গাড়ি থামানোর সাথে সাথে অপেক্ষমাণ ছটটু, জনি, আমান গাড়িতে চেপে বসল। চূড়ান্ত অভিযানে সিরাজুলকে বাদ দেয়া হয়েছে। কারণ আজকের অভিযানটা ব্যর্থ হলে যদি ওরা ধরা পড়ে কিংবা মারা যায়, তাহলে ওদের গোটা দলটা নেতৃত্বহীন হয়ে যাবে। সিরাজুল কালরাতেই ঢাকা ছেড়েছে।

একটি কড়া টান দিয়ে সিগারেটা জালানা দিয়ে ছুড়ে ফেলে ইমাম এক্সিলেটারে চাপ দিল। একটা ঝাঁকি দিয়ে গাড়িটা চলতে শুরু করল। ওরা র্নিবিঘ্নে ফার্মগেটে চলে এলো। এখানকার সিনেমা হলের উল্টে দিকে বালির বস্তার উপর মেশিনগান বসিয়ে কয়েকজন পাক হানাদার একটা চেক পোস্ট বসিয়েছে। সন্দেহ হলে ওরা সিগনাল দিয়ে গাড়ি থামিয়ে তল্লাশি করে। ইমাম গাড়ির গতি স্লো করলো। ছটটু চারদিকে তাকিয়ে গোটা পরিবেশটা দেখে নিল। মেশিনগানধারী ওদের বিপরীত দিকে তাকিয়ে আছে। মেশিনগানের নলটা উল্টা দিকে তাক করা। মেশিনগানধারীর কাছেই দাঁড়ানো অপর দুই সৈনিক নিজেদের মধ্যে খোশগল্পে মশগুল। আর এদিকের রাস্তায় দু সৈনিক রাস্তার গাড়িঘোড়ার দিকে নজর রাখছে। মুর্হূতের মধ্যে ছটটু পরিকল্পনা ঠিক করে ফেলল। পেছনে বসা জনিকে ইংগিত করল। গাড়িটা আরও স্লো হয়ে ঐ দু সৈনিকের আরও কাছাকাছি হলো। এক সৈনিক হাতের ইশারায় গাড়িটি থামতে বলছে। পর মুর্হূতে জানলা দিয়ে বেরিয়ে এলো জনির স্টেইনগান। সামান্য ঝাঁকি দিয়ে সশব্দে গুলি বেরিয়ে গেল। ইশারার জন্য উঠানো হাত নামিয়ে ফেলার সুযোগও পেল না সৈনিক। লুটিয়ে পড়ল মাটিতে। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা অন্য সৈনিক হতবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল। পর মুহূর্তে গুলির ধাক্কায় ছিটকে পড়ল দেয়ালের ওপর। রাস্তার অপর প্রান্তের গল্পরত দুই সৈনিক গুলির শব্দে এদিকে তাকিয়েই পিঠে বাধা সাব-মেশিনগান নামানোর চেষ্টা করছে। আর গাড়িটা স্কীড করে ওদের আরও কাছাকাছি উঠে এলো। এরা সাব-মেশিনগান বের করার সময় পেল না। জনির স্টেইনগানের শিকারে পরিণত হলো। গুলির ধাক্কায় ওদের দেহ দুটি আছড়ে পড়ল রাস্তার ওপর।

মেশিনগানধারী গুলির শব্দে মাথা নিচু করে নিজের দেহটা বালির বস্তার আড়ালে নিয়ে গেল। তাড়পর ঠাণ্ডা মাথায় মেশিনগানের নল ঘুরাতে লাগল। আর ইঞ্চি দশেক ঘুরাতে পারলেই গাড়িটা নিশানার মধ্যে এসে যাবে। গাড়িটা তীব্র বেগে ছুটে দাঁড়িয়ে গেল মেশিনগানধারীর পাঁচ গজের মধ্যে। দরজা খুলে লাফিয়ে নামল ছটটু। অতি দ্রুত পিন খুলে সজোরে গ্রেনেড ছুড়ে মারল। মেশিনগানের নলের নিশানায় এসেছে গাড়িটা বরাবর। সৈনিকের আঙুলও চেপে বসেছে ট্রিগারে। ঠিক তখনই শক্ত মেঝেতে আছড়ে পড়ল গ্রেনেড। আগুনের একটা নীলাভ শিখা বেরুল। প্রচণ্ড শব্দে কেঁপে উঠল ভূমি। প্লান্টারের আঘাতে ছিন্ন এক হাত উড়ে গিয়ে পড়ল রাস্তার মধ্যখানে। আর খৈয়ের মতো বিস্ফোরিত হতে লাগল মেশিনগানের শত শত বুলেট। নরক কুণ্ডের মতো ধোঁয়ায় ছেয়ে গেছে ফার্মগেটের আকাশ। ফার্মগেট মোড়কে নরক বানিয়ে ওদের গাড়িটা তেজকুনি পাড়ার সরু গলিতে ঢুকে পড়ল। একটি পথ চলে গেছে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলের দিকে। স্বাভাবিক গতিতে গাড়িটা ওদিকে চলতে লাগল। রেল ক্রসিংযের কাছে গতি কমিয়ে গাড়ি থেকে আমান নেমে পড়ল। এখান থেকে একটু হাঁটলেই ও এফডিসিতে যেতে পারবে। এই ফাঁকে ওরা গাড়ির ভূয়া নম্বর প্লেট দুটো খুলে
রাস্তার পাশের ডোবায় ছুঁড়ে ফেলল। গাড়িটা সাত রাস্তায় আসতেই ওরা স্বস্তি পেল। অন্য গাড়ির সাথে মিশে যাওয়ার সুযোগ পাওয়া গেছে। মগবাজারের নয়াটোলার গলির মুখে আবার গাড়িটা থেমে গেল। ল্যাগেজ নিয়ে গাড়ি থেকে জনি নেমেই একটি রিকশায় উঠে পড়ল। ল্যাগেজের কাপড়ের মধ্যে লুকিয়ে রাখা হয়েছে স্টেইনগান আর একটা গ্রেনেড।

এই গলিতেই জনির চাচার বাড়ি। ওদের আরেকটা শেল্টার। জনি নেমে যেতেই ওদের মানসিক চাপ কমে যায়। মগবাজার মোড়ে পাক হানাদারদের চেক পয়েন্ট থাকার ষোলআনা সম্ভাবনা। কিন্তু মগবাজার মোড়ে আজ কোনও চেক পয়েন্ট নেই। ট্যাফিক সিগন্যালে গাড়ি থামাতেই ছটটু নেমে গেল। একটু এগিয়ে রাস্তার পাড়ে পার্কিং স্পটে গাড়ি রেখে শিস্ দিতে দিতে ইমাম নেমে পড়ল। ওর মনটা খুশিতে ভরে গেছে। এ ধরনের সফল অপারেশনের মজাই আলাদা। চলবে