হৃদয় ছোঁয়ার দিন

উপন্যাস ২৩

সাজ্জাদ হায়দার

প্রকাশিত : জানুয়ারি ২১, ২০২০

মগবাজার মোড় থেকে নিউ মার্কেট যাওয়ার জন্য ছটটু একটা রিকশায় চাপল। বাংলা মটর রাস্তায় উঠতেই দেখল, রাস্তা উভয় পাশে প্রচুর পাকিস্তানি সৈন্য সারি সারি গাড়ি দাঁড় করিয়ে তল্লাশি করছে। কিন্তু রিকশাগুলোকে ছেড়ে দিচ্ছে। ছটটু দেখল, সাইরেন বাজিয়ে ফার্মগেটের দিকে দ্রুত গতিতে ছুটে যাচ্ছে অ্যাম্বুলেন্স আর ফায়ার বিগ্রেডের গাড়ি। শুধু বাংলামটর কেন, প্রতিটি রাস্তায়ই পাক হানাদারদের গাড়ি টহল দিচ্ছে। সব গাড়িই চেক হচ্ছে।

নিউ মার্কেটে রিকশা থেকে নামতেই ছটটু দেখল, লোকজনের মধ্যে ছোটাছুটি। জিজ্ঞাস করতেই একজন লোক বলল, ‘বেলা দুইটা থেকে কার্ফ্যু শুরু হবে। মাইকিং হচ্ছে।’ ভাড়া মিটিয়ে নিউ মার্কেটে ঢুকতেই ছটটু দেখল, মার্কেটের দোকানগুলোর শাটার নামানোর তোড়জোর চলছে। দোকানি ও ক্রেতাদের চেহারায় চাপা ভীতি। আলী বস্ত্রালয়ে গিয়ে দেখল, এরই মধ্যে দোকানটি বন্ধ করা হয়েছে। দোকানের মালিক রফিক কিংবা ওর কর্মচারী কাউকে আশপাশে দেখা গেল না। আজ রফিকের বাসায় রাত কাটানোর চিন্তা করেছিল। ইমাম, আমান, জনি সবাই আজ যে যার মতো থাকবে। কেউ কারও ঠিকানা জানাবে না।

ছটটু ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আঁৎকে উঠল, আর মাত্র পনের মিনিট পরই কার্ফু শুরু হবে। এই সময়ের মধ্যে মিরপুরে রফিকের বাড়িতে যাওয়া অসম্ভব। রাস্তায় এর মধ্যে গাড়ি চলাচল কমে গেছে। এই সময়টুকুর মধ্যে কোনও আশ্রয় খুঁজে না পেলে পাকিস্তানিদের হাতে ধরা পড়তে হবে। নিজেকে ফাঁদে পড়া জন্তুর মতো মনে হচ্ছে। কোথায় যাওয়া যায়? আশপাশে পরিচিত কে আছে? ছটটু ভাবছে আর ভাবছে। আজিমপুরে অথবা ধানমন্ডি অথবা গ্রীন রোডে? হ্যাঁ, মনে পড়েছে। আজিমপুরেই থাকেন পারুলের বাবা ফখরুদ্দিন সাহেব। তিনি বলেছিলেন, আজিমপুরের নিউ কলোনি তের নম্বর বিল্ডিং। মার্কেটের মুখে সার দিয়ে দাঁড়ানো রিকশাগুলো এখন আর নেই। তারপরও খুঁজে পেতে ছটটু একটা রিকশা পেল। রিকশাঅলা সানন্দেই ছটটুকে তুলে নিল, কারণ রিকশাটা ওই এলাকার। পারুল কিংবা ফখরুদ্দিন সাহেব যেভাবেই নিক না কেন, ছটটুকে আজ ও বাড়িতে থাকতেই হবে।

বাড়িটা খুঁজতে ছটটুকে খুব একটা কষ্ট করতে হলো না। কলোনি এলাকার প্রবেশমুখের প্রথম বিল্ডিংটাই তের নম্বর কলোনি। বিল্ডিংয়ের নিচের পূবদিকের ফ্লাটের সামনে বেশ একটা জটলা দেখতে পেল। ছটটু রিকশা থেকে নামতেই জটলা থেকে এক ব্যক্তি এগিয়ে এলো।

যাক ভাই, কার্ফুর আগেই এলেন। আমরা চিন্তায় ছিলাম। এগো তো কেউ নাই। মেয়েটা তো শুধু জ্ঞান হারায়। নিজেদের মানুষ ছাড়া কি হয়।
আমি তো ভাই ফখরুদ্দিন সাহেবে বাড়ি... ছটটুকে কথা শেষ করতে না দিয়ে লোকটি বলল, আমি তো ঠিকই ধরেছি। লোকটি বড় ভালো ছিলেন। কালরাতে এক স্ট্রোকেই শেষ, বুঝলেন।

ফ্লাটের কাছাকাছি হতেই ছটটু পবিত্র কোরান তেলোয়াতের শব্দ শুনতে পেল। ওর আশংকাই বোধ হয় ঠিক, ফখরুদ্দিন সাহেবই কালরাতে মারা গেছেন। ছটটুকে দেখে অপেক্ষমান আরও কয়েকজন এগিয়ে এলো। একজন বলল, ’আপনি ফখরুদ্দিন সাহেবের কে হন?’
’জি উনি আমার চাচা।’
’যাক ভাই, একজনকে তাও পাওয়া গেল। যান ভাই, ভেতরে যান।

ঠিক তখনই সাইরেন বেজে উঠল। র্কাফ্যু শুরু হলো। রাস্তা দিয়ে সশব্দে ছুটে যাচ্ছে সামরিক যান। একটি জীপ গাড়ি এসে থামল রাস্তার মাথায়। জীপে লাগানো লাউড স্পীকারে সান্ধ্য আইনের বিভিন্ন নির্দেশাবলি প্রচার হচ্ছে। ...অপরিচিত কোনও ব্যক্তিকে বাড়িতে আশ্রয় দেয়া যাবে না। সন্দেহজনক লোকজনকে ধরিয়ে দিতে হবে। ঘরে ঘরে তল্লাশির সময় সকলকে সহযোগিতা করতে হবে ইত্যাদি...

পারুলদের দু’কামরার ফ্লাট। ছটটুকে একজন ড্রইং রুমে নিয়ে এলো। এখানে মুর্দার খাটে ফখরুদ্দিন সাহেবের লাশ রাখা হয়েছে। লাশের পাশে কোরান তেলোয়াত করছেন একজন লোক। ভেতর ঘরে পারুলকে ঘিরে আছে কয়েকজন নারী। ছটটু অনেক মুত্যু দেখেছে। লাশের স্তূপ দেখেছে। আজই ছটটুর বোমায় উড়ে গেছে পাকসৈন্য। এসব মুত্যু ছটটুর কঠিন মনে কোনও ভাবাবেগ আনে না। এসব মুত্যু নিছক একটা সংখ্যা মাত্র। কিন্তু স্বাভাবিক মুত্যু আর সেই মুত্যুকে ঘিরে সৃষ্ট পরিবেশ সর্ম্পূন ভিন্ন জিনিস। এ ধরনের পরিবেশ মনকে খারাপ করে দেয়। ভাবাবেগকে প্রশ্রয় না দিলেও ছটটুর মনটা সত্যি খারাপ হয়ে গেল। কয়েকজন এসে ছটটুকে বাইরে নিল। না চাইলেও লাশ দাফনসহ সব দায়িত্ব এসেছে ছটটুর ওপর। একজন প্রবীণ ব্যক্তি সব বুঝিয়ে বলল। ফখরুদ্দিন সাহেব সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন বিধায় এরই মধ্যে ক্যার্ফ্যু চলাকালে লাশ দাফনের অনুমতি মিলেছে। শুধু তাই না, পাকিস্তানি বাহিনীর কিছু সৈন্য দাফনের সময় নিরাপত্তার জন্য মোতায়েন থাকবে বলে থানায় যোগাযোগের পর জানানো হয়েছে। লাশ দাফনের সময় পাকিস্তানি সৈন্যর উপস্থিতির খবরে ছটটু দমে যায়। এক্ষেত্রে সৈন্যদের পাশাপাশি গোয়েন্দা নজরদারিও থাকতে পারে। ছটটু মারাত্মক চিন্তায় পড়ল। এ যেন স্বেচ্ছায় বাঘের ঘরে ঢোকা। এখন তো আর পালানোর পথ নেই! যা হয় হবে, এখন একজন সত্যিকারের ভাতিজার ভূমিকা পালন করতে হবে। পারুলের সাথে দেখা না করলে বেমানান দেখাবে।

ছটটু বেডরুমে এলো। দুজন মহিলা সরে বসে পথ করে দিল। পারুল সাদা শাড়ি পড়ে সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে বিছানায় শুয়ে আছে। এ কী চেহারা পারুলের! বয়স আর শোকচিহ্ন আগের দেখা কিশোরী পারুলের চেনা মুখটি উধাও করে দিয়েছে।

পারুল দেখো, তোমার ভাই এসেছে। শুশ্রুষাকারী মহিলাদের একজন বললেন। পারুল কোনও সাড়া দিল না। ফ্যালফ্যাল করে সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে থাকল। এবার ছটটু বলল, পারুল আমি ছটটু। এতেও পারুলের কোনও প্রতিক্রিয়া নেই। ছটটু দাঁড়িয়েই থাকল। মিনিটখানেক পর পারুলের দেহটা কেঁপে উঠল। একটা ফোঁপানির শব্দ এলো। পারুল উপুর হয়ে শুলো। ওর দেহটা কেঁপে উঠেছে। পারুল কাঁদছে।

যাক ভাই, তুমি আসায় ও কাঁদলো। রাত থেকে চেষ্টা করেও আমরা ওকে কাঁদাতে পারিনি। না কাঁদলে যে মেয়েটা বুক ফেটে মারা যেত! শুশ্রুষাকারী মহিলা বললেন। এখনো অনেক কাজ বাকি। ছটটু আর না দাঁড়িয়ে বাইরে এলো। এ ফ্লাটের সামনে কয়েকজন লোকের জটলা ছাড়া গোটা কলোনি এলাকায় নেমে এসেছে কবরের নিস্তব্ধতা। পাকিস্তানি আর্মি কলোনি এলাকায় ঢুকে পড়েছে। চলছে ঘরে ঘরে তল্লাশি। ভারি বুটের শব্দ শোনা যাচ্ছে পাশের বিল্ডিং থেকে। এ সময় তীব্র গতিতে একটা জীপ গাড়ি ছুটে এলো। ভড়কে গেল সবাই। গাড়িটি এসে হার্ড ব্রেক করে জটলার সামনে দাঁড়ালো। সঙ্গীন উঁচু করে লাফিয়ে নামল চার সৈনিক। জীপের জানালা দিয়ে গলা বাড়িয়ে একজন ক্যাপ্টেন মর্যাদার লোক উর্দুতে হেঁকে বলল, এখানে হচ্ছেটা কি?

প্রবীণ লোকটি এগিয়ে গিয়ে ক্যাপ্টেনকে ছালাম দিয়ে র্উদু আর ইংরেজিতে সব কিছু ব্যাখা করার চেষ্টা করল। কথা শেষ হলে ক্যাপ্টেন বলল, এখানে কোনও অচেনা লোক আছে কিনা?

প্রবল বেগে মাথা নেড়ে প্রবীণ ব্যক্তি না করল। ক্যাপ্টেন জীপ থেকে নেমে এলো। সে লাশ দেখতে চায়। প্রবীণ ব্যক্তি ক্যাপ্টেনকে পথ দেখিয়ে ঘরে লাশের সামনে নিয়ে এলো। সে কাপড় সরিয়ে লাশের মুখ দেখল। লাশ দেখার পর ক্যাপ্টেনের মুখের কাঠিন্য দূর হয়ে একটা কোমল ভাব ফুটে উঠল। ক্যাপ্টেন হাত তুলে মোনাজাত শুরু করল। ক্যাপ্টেনের সাথে সাথে অন্যরাও হাত তুলল। মোনাজাত শেষে ক্যাপ্টেন নির্ভয়ে লাশ দাফন করার অভয় দিলেন। তারপর চলে গেলেন। পথে কোনও অসুবিধা হলে তার নামটি বলতে বললেন। আর্মি চলে যেতে সবাই হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো।

সন্ধ্যার মধ্যে আজিমপুর গোরস্তানে কোনও ঝামেলা ছাড়াই ফখরুদ্দিন সাহেবের দাফন হয়ে গেল। শবযাত্রীরা সবাই প্রথমে পারুলদের বাড়িতে ফিরে এলো। তারপর ছটটুর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে যার যার বাড়ি ফিরে গেল। শুধু পাশের ফ্লাট ও বিল্ডিংয়ের কয়েকজন মহিলা এখনো পারুলকে ঘিরে আছে।

২৫ মার্চ রাতে পারুল ওর স্বামী শফিককে হারিয়েছে। ওই দিন শফিক ওর এক আবাঙালি বন্ধুকে নিয়ে পুরান ঢাকা গিয়েছিল। রাতে আর্মি নামার পরও দুজনে হেঁটে হেঁটে আজিমপুরের আসতে থাকে। আসলে আর্মির ক্রাক ডাউন কত মারাত্মক হতে পারে, সেই ধারণা ওদের ছিল না। হঠাৎ করে ইংলিশ রোডে আর্মি জীপ এসে যায়। জীপ থেকে ওদের থামতে বলা হয়। শফিক নার্ভস হয়ে দৌড় দেয়। সাথে সাথে ছুটে আসে একঝাঁক বুলেট। মুহূর্তের মধ্যে শফিকের পিঠ ঝাঁজরা হয়ে যায়। আহত অবস্থায় ধরা পড়ে শফিকের অবাঙালি বন্ধু। আর্মিরা ওকে হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয়। চিকিৎসা শেষে ছেড়ে দেয়। ছয়দিন পর এ লোকটি ওদের বাড়িতে খবর দেয়। পারুলের বাবা শফিকের লাশ পেতে যারপর নাই চেষ্টা করেছিলেন। বারবার শফিক নিহত হওয়ার জায়গায় ছুটে গিয়েছেন। এলাকার লোকজনের সাথে কথা বলে তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা করেছেন। ২৫ মার্চ রাত থেকে ২৭ মার্চ সন্ধ্যা পর্যন্ত লাশটি রাস্তায়ই পড়ে ছিল। পরে ঢাকা মেডিকেলের কয়েকজন ডোম এসে লাশটি নিয়ে যায়। অনেক চেষ্টা করে ফখরুদ্দিন সাহেব ডোমদের খুঁজে পেয়েছিলেন। ওই দিন ওরা ঢাকার বিভিন্ন এলাকা থেকে অনেক লাশ ট্রাকে তুলে দেয়। এসব লাশ পরে ঢাকার বিভিন্ন নির্জন এলাকায় গর্ত করে একসাথে মাটি চাপা দেয়া হয়।

শফিককে হারিয়ে পারুলের সাথে সাথে ফখরুদ্দিন সাহেবও ভেঙে পড়েন। তার স্বাস্থ্য দ্রুত ভেঙে যায়। চলবে