হৃদয় ছোঁয়ার দিন

উপন্যাস ২৪

সাজ্জাদ হায়দার

প্রকাশিত : জানুয়ারি ২২, ২০২০

ঢাকায় পারুল কিংবা শফিকদের তেমন কোনও আত্মীয়-স্বজন নেই। বিক্রমপুরে পারুলের ফুপু থাকেন। আর কয়েকমাস পরই ফখরুদ্দিন সাহেবের এলপিআর শেষে সম্পূর্ণ রিটায়ারমেন্টে যাওয়ার কথা ছিল। এই কলোনি ছেড়ে উনি গ্রামের বাড়িতে চলে যাওয়ার কথাই ভাবছিলেন। পাশের বাড়ির এক খালাম্মা ছটটুকে ভাত বেড়ে দিতে দিতে এসব কথাই বলেছিলেন।

বুঝলে বাবা, মেয়েটার বিপদ কেবল শুরু। ভাবতে পারো, ওর জীবনটা কেমনে যাবে!
ছটটু কিছু বলল না। এসব প্রশ্নের উত্তর হয় না। খালাম্মা অনেক যত্ন করে ছটটুর জন্য বিছানা ঠিক করলেন। পারুলকে ঘুমের ওষুধ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে। খালাম্মা আজ পারুলের কাছেই থাকবেন। অনেক ধকল ও ক্লান্তি নিয়ে বিছানায় গেলেও ছটটুর ঘুম এলো না। আধা ঘুম আর আধা জাগরনের মধ্যে রাতটা কেটে গেল।

সকাল ছয়টার পর ছটটু বিছানা ছাড়ল। ছটায়ই কার্ফ্যুর মেয়াদ শেষ। রান্না ঘরে খালাম্মা নাশতা তৈরি করছেন। ছটটুর সাড়া পেয়ে চায়ের কাপ হাতে এগিয়ে এলেন। কৃতজ্ঞতায় ছটটুর মনটা ভরে গেল। মাতৃস্থানীয় কেউ অনেক দিন ওকে চায়ের কাপ বাড়িয়ে দেয়নি। চায়ের স্বাদই যেন বেড়ে গেছে! চা খেয়ে ছটটু পারুলের ঘুম ভাঙার জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। এ শহর এক মুহূর্তের জন্যও ছটটুর জন্য নিরাপদ নয়। যত দ্রুত চলে যাওয়া যায়, ততই ভালো।

পারুল যখন ছটটুকে ডেকে পাঠালো তখন ঘড়ির কাঁটা বারোটার ঘরে। একটা সাদা শাড়ি পরে পারুল বিছানায় বসে দেয়ালে হেলান দিয়ে আছে। ছটটুকে দেখে পারুলের ঠোঁটে বিমর্ষ হাসির রেখা ফুটে উঠল। এ হাসিটা ছটটুর চিরচেনা। অনেক আগে অভিমান হলে এ ধরনেরই হাসির রেখা ফুটে উঠত পারুলের ঠোঁটে। পারুলের ঠোঁটের হাসি আর দু’চোখ আগের মতোই আছে। বয়স কেড়ে নিতে পারেনি। পারুল কোনও কথা বলছে না। ছটটু কী বলবে ভেবে পাচ্ছে না। পারুলকে কি বলা উচিত ছটটু জানে না। তবে পারুলের সামনে বসে থাকতে ওর ভালোই লাগছে।

অবশেষে পারুলই মুখ খুলল, ছটটু ভাইয়া, তুমি আমাকে বিক্রমপুর রেখে আসবে?
কবে যাবে?
আগামী কাল। এ শহরে আমার আর ভালো লাগছে না।

ছটটুর অনেক কাজ। নিশ্চিতপুর ঘাঁটিতে ফেরা খুবই দরকার। ওখানে ইমাম, আমান আর জনির একত্রিত হওয়ার কথা। ছটটু সময়মতো না ফিরলে ওরা মহাচিন্তায় পড়বে। কিন্ত এদিকে পারুলকে ফেলে রেখে যাওয়া যাচ্ছে না। তারপরও একটু ভেবে ছটটু বলল, বেশ।

পরদিন সূর্যোদয়ের সাথে সাথে ওরা বাড়ি থেকে বাইরে এলো। আজ পারুলের আচার-আচরণ সম্পূর্ণ পাল্টে গেছে। শোকে বিধ্বস্ত পারুলের যেন কর্তব্যের মোড়কে নুতন করে জন্ম হয়েছে। কাল সারাদিন একই বাড়িতে থাকলেও পারুল ছটটুর সাথে একটি কথাও বলেনি। ভোররাতে উঠে পারুল নানা ধরনের কাজে লেগেছে। ঘুম ভেঙেই ছটটু দেখেছে, টেবিলে নাস্তা রেডি। প্রায় নিঃশব্দে ছটটু তৈরি হয়ে নিল। কালো বোরখায় নিজেকে সম্পূর্ণ ঢেকে পারুল বাড়ির বাইরে এলো। ছটটু খেয়াল করল, পারুল ছটটুর সাথে সব রকম দূরত্ব বজায় রেখে চলছে। আজকাল বোরখা ছাড়া এ শহরে কেউ পথ চলে না।

স্কুটারে বসার সময় পারুল স্পর্শ বাঁচাতে সচেতন ছিল। ছটটু কখনো উপযাজক হয়ে কথা বলতে পারে না। অন্যদিকে দরকার ছাড়া পারুল একটা কথাও বলেনি। ফলে কোনও কথাই জমেনি। ছটটু কি করে কিংবা কেন ওদের বাড়িতে এলো, এই অতি সাধারণ প্রশ্নটাও পারুল করেনি। ছটটুকে নিয়ে ওর যেন কোনও আগ্রহই নেই।

সদরঘাট থেকে একতলা লঞ্চে বিক্রমপুরের তালতলা যেতে হবে। তালতলা থেকে হেঁটে যেতে হবে কুসুমপুর গ্রামে। তালতলা পৌঁছাতে সাত-আট ঘণ্টা লেগে যাবে। আজ সকাল থেকেই আকাশে মেঘ জমেছে। লঞ্চের ছাদের কেবিনে অপর এক মহিলার পাশে পারুল বোরখার পর্দা সরিয়ে বসল। ওর ঠিক বিপরীতে ছটটু। এই লঞ্চের মাথায় একটি রং জ্বলা পাকিস্তানি পতাকা। দীর্ঘ দিন রোদে বৃষ্টি ভিজে এ অবস্থা হয়েছে। লঞ্চ ছাড়ার মিনিট দশেক বাকি, এ সময় লঞ্চে উঠে এলো দুই রাজাকার। হাস্যকর ভাবে ওদের রাইফেলের নল মাটির দিকে তাক করানো। স্বল্প প্রশিহ্মন প্রাপ্ত রাজাকারদের রাইফেল থেকে প্রায়ই নাকি কারণে-অকারণে এদিক-সেদিকে গুলি বেরিয়ে যায়। সে জন্যই  এই ব্যবস্থা।

রাজাকারদের দেখে যাত্রীদের চেহারায় একই সাথে বিরক্তি আর ঘৃণার অভিব্যক্তি ফুটে উঠল। তল্লাশির নামে ওরা এ ব্যাগ হাতায় তো ও ব্যাগ হাতায়। অকারণে ব্যাগ থেকে কাপড়-চোপড় মেঝেতে ফেলে দেয়। পারুলের দুটি লাগেজেও ওরা এলোমেলো করে দিল। কারও কাছে তেমন কিছু না পেয়ে কিছুটা ক্ষুণ্ণ মনেই লঞ্চ থেকে নেমে গেল দুই রাজাকার। সাথে সাথে লঞ্চ ছাড়ল। ছটটু পারুলের দিকে তাকাল। পারুল জানলা দিয়ে নদীর দিকে তাকিয়ে আছে। গত দুদিন ধরে দেখেছে পারুল সরাসরি ছটটুর মুখের দিকে তাকাতে চায় না। লঞ্চে উঠার পর পারুল ছটটুর সাথে একটা কথাও বলেনি। ছটটুও সময় কাটানোর জন্য নদী দেখতে লাগল। বর্ষা শেষের বুড়িগঙ্গানদি এখনো পূর্ন যৌবনা। টলমল পানিতে মাঝে মাঝে ডিগবাজি দিচ্ছে ডলফিন প্রজাতির শুশুক। নদীতে বক আর নাম না জানা মাছ শিকারি পাখিদের আনাগোনা।

চোখে পড়ল, পাকিস্তানি সৈন্যরা দ্রুতগামী স্পীডবোটে করে নদীতে টহল দিচ্ছে। আগেই শেষ বর্ষার কালো মেঘে বুড়িগঙ্গার আকাশ ছেয়ে গেছে। শীঘ্রই মেঘ ভেঙে বৃষ্টি শুরু হলো। বৃষ্টির ছাঁটে হারিয়ে গেল বুড়িগঙ্গার এক পাশের দালান কোঠা আর অপর পারের গাছগাছালি। পারুল এখনো একদৃষ্টে একই ভাবে নদীর দিকে তাকিয়ে আছে, বোধ হয় কাদঁছে! মেয়েটার জন্য খারাপ লাগছে। ছটটু কেবিনের বাইরে এসে সিগারেট ধরাল। চলবে