হৃদয় ছোঁয়ার দিন

উপন্যাস ২৫

সাজ্জাদ হায়দার

প্রকাশিত : জানুয়ারি ২৩, ২০২০

কাঠপট্টি ঘাটে আসতেই বৃষ্টি থেমে গেল। এখন ধলেশ্বরী নদীর আকাশে রোদ আর মেঘের লুকোচুরি। এখানে অনেক যাত্রী নেমে গেল। পারুলের পাশের বেঞ্চিটা খালি হয়ে গেল। ছটটু ওখানে বসতে গেলে পারুল মৃদু স্বরে বলল, আপনি আপনার জায়গায় থাকুন।

আহত মনে ছটটু আগের জায়গায় ফিরে এলো। পারুলের আচারণের কোনো মানে সে খুঁজে পেল না। উঠে আসা নতুন এক মহিলা যাত্রী পারুলের পাশে বসল। লঞ্চ ছাড়তেই কেবিনে এলো একতারা হাতে এক অন্ধ বাউল। সাথে দশ-বারো বছরের একটি মেয়ে। হাতে পিতলের খঞ্জনি। বাউল আল্লাহ রাসূলের নাম নিয়ে গান ধরল, প্রেমের মরা জলে ডোবে না...

এই গানটি ছটটু আগেও এক আধবার শুনেছে, কিন্তু আজকের মতো এরকম হৃদয় ছুঁয়ে যায়নি। পারুলও এখন বাউলের দিকে তাকিয়ে গান শুনছে। ওদের লঞ্চ যখন তালতলা ঘাটে এলো তখন বেলা তিনটা। কর্দমাক্ত ঘাট পেরিয়ে ওরা এসে দাঁড়ালো কাঁচা মাটির রাস্তায়। এখানে কয়েকটি রিকশা দাঁড়িয়ে আছে। রিকশায় অন্তত দেড়-দু’ঘণ্টার পথ। ছটটুর বেশ খিদে পেয়েছে। ঘাটের এক পাশে বাঁশের মাচার উপর খাবার হোটেল বানানো হয়েছে। সরু চালের ভাত আর কড়া পাকের পাঙ্গাস মাছ। ছটটুর খিদে আরও বেড়ে গেল যেন! পারুলকে ভাতের কথা বলতেই সে কিছুটা ক্ষুণ্ণ মনে বলল, খিদে নেই। এছাড়া খেতে বসলে বাড়ি পৌঁছাতে রাত হয়ে যাবে।

ছটটু কিছুটা লজ্জা পেল। মালপত্র নিয়ে এক রিকশাতেই হয়ে যাওয়ার কথা, তবু পারুল দুটো রিকশা নিল। আবারও ছটটুর স্পর্শ বাঁচানোর চেষ্টা! পারুলদের বাড়িটা ছাড়া বাড়ি হিসাবে পরিচিত। বিশাল একটা ফাঁকা জায়গার একপ্রান্তে ছোট একটা ছনের ঘরে পারুলের চাচা থাকেন। পারুলকে দেখে তারা দারুণ বিস্মিত। অল্প সময়ের মধ্যে প্রায় পুরো গ্রামের মানুষ এ বাড়িতে চলে এলো। পারুলের মুখে সব কিছু শুনে নানা ধরনের গুঞ্জন আর জল্পনা-কল্পনা শুরু হলো। পারুলের আত্মীয়রা হতদরিদ্র। ফলে পাশের বাড়ি থেকে নানা ধরনের খাবার আসতে লাগল। রাতে পাশের এক বাড়িতে ঘুমাতে হলো ছটটুকে। ছটটু খুব সকালে এখান থেকে কুমিল্লা যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ঘুমাতে গেল।

পরদিন সকালে ঘুম ভাঙতেই দেখল, পাশের রুমে পারুল নাস্তা সাজিয়ে ওর জন্য অপেক্ষা করছে। আজ এই প্রথম পারুল ছটটুকে দেখে হাসল। পারুলের আচরণে ছটটুর মনে যে বিরক্তি ছিল, তা মুহূর্তে উবে গেল। নাস্তার পর পারুল বলল, তুমি কি আজই যাবে?
হ্যাঁ, একটু পরেই রওনা হবো।
তোমার সাথে আমার কিছু কথা ছিল যে।
বেশ বলো।
চলো, বাইরে চলো।

একটা মেঠো পথ ধরে হাঁটতে লাগল দুজনে। পারুল বলল, আমার আর এখানে থাকা হবে না। অন্য কোথাও যেতে হবে।
কেন, এখানে কি সমস্যা?
এখানে আমার আসাটা চাচারা ভালোভাবে নেইনি।
কেন, কালকেই ওরা তোমার বাবার মুত্যুর খবরে কাঁদল?
সবই লোক দেখনো। আমি ঘুমিয়ে পড়েছি মনে করে ওরা নিজেদের মধ্যে অনেক কথা বলেছে। সত্যি বলতে কি, এদের আমি ঠিকমতো চিনিই না। এরা আমার বাবার আপন ভাইও না। এদের ধারণা, আমি বেশি দিন এখানে থাকলে এসব সম্পত্তি চেয়ে বসবো। এছাড়া তোমার সাথে আমার সর্ম্পক নিয়েও নানা কথা বলেছে। এখানে থাকা নিরাপদ নয়।
তাহলে তুমি কি করতে চাও? ঢাকায় ফিরে যাবে?
ঢাকায় আমি আর যাচ্ছি না। ঢাকায় একটি মেয়ের সাথে আমার পরিচয় হয়েছিল। মেয়েটির সাথে আমি একদিন মিছিলে গিয়েছি। মেয়েটি ছাত্র ইউনিয়নের মেম্বার। আমার স্বামীর মুত্যুর পর একদিন আমার বাসায় এসেছিল। মেয়েটি আমাকে আগরতলা নিয়ে যেতে চেয়েছিল। মেয়েটি আমাকে বলেছিল, আমার স্বামীকে পাকিস্তানিরা মেরেছে। এখন আমার প্রতিশোধ নেয়া উচিত। আর এ শহরে কোনও মেয়েই নিরাপদ নয়। অন্যদিকে প্রত্যেক দিন কত মুক্তিযোদ্ধা বিনা চিকিৎসায় মারা যাচ্ছে। এদের সেবা করার কেউ নেই। আমি মেয়েটির কথায় রাজি হলেও বাবার জন্য যেতে পারিনি। কালরাতে অনেক ভেবে আমি ঠিক করেছি, ওখানেই যাব।

কিন্তু আগরতলা তো অনেক বড় জায়গা। ওখানে মেয়েটিকে চিনবে কিভাবে?
মেয়েটি আমার ডায়েরীতে সংকেতে ঠিকানা লিখে গিয়েছে। তুমি তো আমার জন্য অনেক করলে। আমার জন্য আরেকটু কষ্ট করতে পারবে না?
তা না হয় করলাম, কিন্তু এদেরকে কি বলবে?
এদেরকে বলবো পাশের গ্রামে তোমার এক আত্মীয় থাকে, ওখানে একদিনের জন্য যাব। আর এরা কিছু মনে করলেও কিছু যায় আসে না। এখন দেখো, তুমি আরেকটা দিন আমার জন্য থাকতে পারবে কিনা!

পারুলকে পথের মাঝে ফেলে দেয়ার প্রশ্নই আসে না। চলবে