হৃদয় ছোঁয়ার দিন

উপন্যাস ২৬

সাজ্জাদ হায়দার

প্রকাশিত : জানুয়ারি ২৪, ২০২০

অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে ছটটু সত্যি সত্যি একটা ফিল্ড হাসপাতাল খুঁজে পেল। বিক্রমপুর থেকে এখানে আসতে পুরো দুদিন লেগে গেল। আসলে পারুল যে ঠিকানাটা দিয়েছে সেটা ঠিক আগরতলা নয়, ত্রিপুরা-কুমিল্লা সীমান্তে। জায়গাটা নো ম্যান্সস্ ল্যান্ডের ভেতরে। পাহাড় ঘেরা একটা এলাকা। পাহাড়ের ঢালে মুলিবাঁশের বেড়া দিয়ে ফিল্ড হাসপাতাল তৈরি হয়েছে। একজন মিশনারি ডাক্তার এই হাসপাতালের উদ্যোগতা। যে মেয়েটি পারুলকে এখানকার ঠিকানা দিয়েছে সেই মেয়েটি প্রথমে অবাক তারপর উচ্ছ্বসিত হয়ে পারুলকে জড়িয়ে ধরল।

হাসপাতাল কম্পাউন্ডের পাশেই ডাক্তার আর নার্সদের আবাসিক ভবন। কয়েকটি কুঁড়েঘর। পারুলকে পেয়ে মিশনারি ডাক্তারও বেশ খুশি। শিখা নামের মেয়েটির কোয়ার্টারেই আপাতত পারুল থাকবে। ছটটুর কাজ এখন শেষ। ইচ্ছে হলে আজই চলে যেতে পারে। কিন্তু যেতে ইচ্ছে না। ফিল্ড হাসপাতালের খুটিনাটি দেখে নিতে চায়। এই হাসপাতালে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়া হয়। গুরতর আহতদের পরে ভারতের ভেতর চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়। এখন এ হাসপাতালে দুজন আহত মুক্তিযোদ্ধা রয়েছে। একজনের হাতের একটা অনামিকা আঙুল উড়ে গেছে। আরেক জনের বাহুতে গুলি আটকে আছে। দু’এক দিনের মধ্যে এদেরকে ভারতে পাঠানো হবে। কিন্তু দুজনের ধারণা, ওদের ভারতে পাঠানো দরকার নেই। এই সামান্য আঘাত নিয়ে রণাঙ্গনে যেতে পারবে। যুদ্ধ শেষ হলে সময় ও সুযোগ নিয়ে চিকিৎসা করালেই হবে।

বাহুতে গুলি লাগা মুক্তিযোদ্ধা যে সম্পূর্ণ সুস্থ, সেটা দেখাতে হাঁটাহাঁটি করে। গুলি লাগা বাহুটা নেড়ে চেড়ে নানা কসরত দেখায়। ডাক্তারের কাছে ওকে ছেড়ে দেয়ার জন্য অনুনয়-বিনয় করে। ডাক্তার সার্টিফিকেট দিলেই ওর কমান্ডার ওকে  আবার যুদ্ধে যাওয়ার সুযোগ দেবে। অন্য মুক্তিযোদ্ধা ভয়ানক জ্বরে আক্রান্ত। ওকে ঘুমের ওষুধ দিয়ে রাখা হয়েছে। ঘুম ভেঙে গেলে এই যোদ্ধাও হাসপাতালকে বিদায় জানিয়ে রণাঙ্গনে ফিরে যেতে চায়। ডাক্তার ছটটুকে জানালেন, অবিলম্বে ওর বাহু কেটে না ফেললে সাড়া দেহে পচন ছড়িয়ে পড়বে। এই হাসপাতালে অস্ত্রোপচারের সরঞ্জাম নেই বলে দুঃখ করলেন। এদের সাথে থেকে দিনটা দ্রুত কেটে গেল।

রাতে ফিল্ড হাসপাতাল আর সিস্টারস কোয়ার্টার থেকে কিছু দূরে ডাক্তারের কুঁড়েঘরে ছটটুর থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। বিছানায় শোয়ার সাথে সাথে ছটটু ঘুমিয়ে পড়ল। পরদিন খুব ভোরে ছটটুর ঘুম ভেঙেছে। একটা সিগারেট জ্বালিয়ে আকাশ-পাতাল ভাবছে। এমন সময় পদশব্দে ছটটু ফিরে তাকালো, পারুল এসে দাঁড়িয়েছে। হাতে চায়ের ফ্লাক্স। পারুল নিশ্চয়ই স্নান করে এসেছে। এ কয়েকদিনের বিধ্বস্ত পারুলের যেন নতুন জন্ম হয়েছে। আগের মতোই একটা হাসি লেগে আছে ঠোঁটে, এ যেন সেই কিশোরী পারুল।

আমি ভেবেছিলাম তুমি আরও আগে ঘুম থেকে উঠে রওনা হবে। অথচ এখনও বসে আছ? ফ্লাক্স থেকে কাপে চা ঢালতে ঢালতে অনুযোগ করে পারুল।
কোথাও যেতে হবে নাকি?
যেতে হবে মানে? তুমি আজ ফিরে যাবে না? কেমন যেন ঝাঁজিয়ে ওঠে পারুল।
তুমি কি এখনই আমাকে এখান থেকে চলে যেতে বলছ?
নয়তো কি? তুমি কি এখানে থেকে যাবে নাকি!

ছটটু পারুলের কথার ভঙ্গিতে ভয়ানক অপমানিত বোধ করল। অনেক কষ্টে রাগ দমন করে ঠাণ্ডা গলায় বলল, পারুল, তুমি আমার সাথে কয়েক দিন ধরেই খারাপ ব্যবহার করছ। কারণটা কি বলো তো?
কই, তোমার সাথে আমি আবার কখন খারাপ ব্যবহার করলাম? কিছুটা নরম গলায় পারুল বলল।
ওসব আমি বুঝি। তুমি আমাকে সারাক্ষণই এড়িয়ে যেতে চাও। ঠিকভাবে কথা বলতেও কষ্ট হয়। অথচ... ছটটু একটু থামল, এরপর বলল, সেই সময় তুমি কেমন করে কথা বলতে!
ওসব দিনের কথা মনে রেখেছ কেন! কম বয়সে মেয়েরা কত কী করে! ওসব বাদ দাও। আর এ কয়েকদিন তুমি আমার জন্য অনেক করেছ। তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি। তুমি আমায় ক্ষমা করে দাও। আর এখন তৈরি হয়ে নাও।

তুমি কিন্তু আবারও আমাকে তাড়িয়ে দিতে চাচ্ছ! ক্ষুণ্ণ কণ্ঠে ছটটু বলল। পারুল কিছু না বলে দূরের পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে থাকল। ছটটু পারুলের দিকে তাকাল। ওর শরীর দিয়ে একটা শিরশির অনুভূতি বয়ে গেল। পারুলকে প্রথম দেখার দিন এ ধরনের অনুভূতি ছিল। আজ অনেক বছর পর আবার সেই অনুভূতি ফিরে এসেছে। নরম গলায় সে বলল, পারুল, আমি জানি তুমি ভালো নেই। তুমি অনেক দূরে চলে গেছ। তারপরও... ছটটু গিয়ে পারুলের কাঁধে হাত রাখল। পারুল ঝাঁকি দিয়ে এক কদম পিছিয়ে গেল, এসব কি?

ছটটুর শিরশিরে অনুভূতিটা আবার ফিরে এসেছে। ছটটু এক কদম এগিয়ে গিয়ে পারুলকে দুহাতে জড়িয়ে ধরল। পারুল ছটফটিয়ে উঠে নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে চেষ্টা করে। ছটটু পারুলকে তীব্র ঝাঁকুনি দিল। পারুল ওর বাহু বন্ধনে স্থির হলো। ছটটু ফিসফিসিয়ে বলল, পারুল আমি এখনো তোমায় চাই। আমি তো যখন তখন মরতে পারি। আমি কারও কাছে কিছু চাইনি। এখন আমি তোমাকে চাচ্ছি। আগের মকো। এখুনি, এই মুহূর্তে।

ছটটুর ঠোঁট পারুলের ঠোঁট খুঁজে ফিরছে। পারুল সর্বশক্তি দিয়ে ছটটুকে ধাক্কা দিল। ছটটু একটু সরে গেলও পারুল ভারসাম্য হারিয়ে খাটের ওপর পড়ে গেল। ছটটু উঠে এলো ওর উপর। পারুল অস্ফুটে বলল, তুমি দেখি পাকিস্তানি সৈন্যদের মতো করছ।

পারুলের কথা শুনে ছটটু পারুলের মুখের দিকে তাকাল। পারুলের দুচোখ পানিতে ভরে গেছে। ছটটু স্থির হয়ে গেল। পাকিস্তানিরা প্রতিদিন কত মেয়েকেই রেপ করে। তুমিও অমন পশু... ছটটু পারুলকে ছেড়ে দিয়ে উঠে দাঁড়াল। পারুলের দিয়ে না তাকিয়ে সবেগে দরজা দিয়ে বাইরে চলে গেল।

পারুল অনেকক্ষণ বিছানায় নিশ্চল হয়ে পড়ে রইল। শাড়ি ঠিক করে উঠে দাঁড়িয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো। ছটটুকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। ঘণ্টাখানেক পর পারুল নিশ্চিত হলো, ছটটু সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেছে। অনুশোচনায় পারুলের মনটা ভরে গেল। পারুলের কঠিন প্রতিজ্ঞার কথা ছটটুকে খুলে বললে এ ঘটনা সৃষ্টি হতো না। পারুল ওর স্বামী শফিককে কখনো ভালবাসেনি। কিন্তু শফিক মারা যাওয়ার পর প্রতিদিনই অনুশোচনার অনলে পারুল দগ্ধ হচ্ছে। চোখ বন্ধ করলেই পারুল দেখতে পায়, শফিক দৌড়াচ্ছে, আর পেছন থেকে ছুটে আসা গুলি ওকে এফোড় ওফোর করছে। শফিকের এই অসহায় মুত্যুর একটাই প্রতিশোধ, বাংলাদেশের স্বাধীনতা।

পারুল ঠিক করেছে, দেশ স্বাধীন না হলে ও কখনো দৈহিক কিংবা মানসিক সুখের জন্য কিছুই করবে না। কিন্তু ছটটুকে দেখার পর থেকেই পারুলে ভেতরটা এলোমেলো হয়ে যায়। ছটটুর উপস্থিতি ওকে যেন বারে বারে সেই উদ্দাম নতুন যৌবনের দিনগুলোতে ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল! পারুল এজন্য বারবার ছটটুর সংস্পর্শ বাঁচাতে চেয়েছে। আর ছটটু কি মারাত্মক ভুলই না বুঝেছে! কী দুঃখই না ছটটু পেয়েছে! আবার দেখা না হলে ছটটু কখনো জানবে না, পারুল ওর জন্য কত রাত নির্ঘুম কাটিয়েছে। এই দুঃসময়ে ছটটুর সাথে আবার দেখা হওয়ার গ্যারান্টি পারুলকে কে দেবে?

শফিক বেঁচে থাকতে ছটটুর সাথে দেখা হলে পারুল নির্দ্বিধায় ছটটুর জন্য যে কোনও কিছু পারত। ছটটুর হাত ধরে রাস্তায় নামতে দ্বিতীয় বার চিন্তা করতো না। ছটটুর ডাক পেলে সমাজের পরোয়া করতো না। মনে পড়ে, করাচি থেকে ঢাকায় এসে ছটটুকে একটু দেখার জন্য ওর মন কতটা উচাটন ছিল! পারুলের দু চোখ ঢাকা শহরের অলিগলিতে ছটটুকে খুঁজে ফিরেছে। ছটটুর জন্য কত নির্ঘুম রাত কেঁদে কাটিয়েছে। ছটটু এসব কখনোই জানবে না। চলবে